দিব্যি পড়তাম এক নামী ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে, হঠাৎ বাবা কোথা থেকে শুনে এসে একটা বৃত্তি পরীক্ষার ফর্ম নিয়ে এসে আমায় দিয়ে বললেন পরীক্ষা দিতে হবে। আমায় নাকি হস্টেলে দেওয়া হবে- তা নাহলে আমি উচ্ছন্নে যাব। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। আর এমন ভাগ্য, পাশও করে গেলাম। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা প্রিয় লিলুয়া ছেড়ে মা-বাবার সঙ্গে হাজির হলাম নরেন্দ্রপুরে, ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে, ক্লাস এইটে ভর্তি হতে। প্রথম হোস্টেল শিবানন্দ ভবন। মিশনে সব হোস্টেল শ্রীরামকৃষ্ণের দীক্ষিত সন্ন্যাসী শিষ্যদের নামে নামে।
প্রথম দিনই বিভ্রাট। রুমমেটরা জানাল ধুতি পরে প্রেয়ার হলে যেতে হবে। অন্নপ্রাশনের পর জীবনে কোনওদিন ধুতি পরেছি বলে মনে পড়ে না। ঢোঁক গিলে সিনিয়র রুমমেটকে বললাম “দাদা, একটু পরিয়ে দেবে?” একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এগিয়ে এসে ধুতিটা পরিয়ে দিয়ে বলল “এরপর থেকে নিজেকে পরতে হবে। শিখে নিবি।” ধুতির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই পরের দিন সকালে পিটি করে আসার পর সিনিয়র দাদা হাতে একটা ঝাঁটা ধরিয়ে দিয়ে বলল “নে, ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দে!” আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কস্মিনকালেও ঝাঁটা হাতে নিইনি বাড়িতে। আর তার চেয়েও বড় কথা, আমার কাছে অত্যন্ত রহস্যজনক ব্যাপার ছিল এইটা বোঝা যে, ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় কেন এগিয়ে যেতে হয় আর ঘর মোছার সময় কেন পিছিয়ে আসতে হয়। যাইহোক, উত্তর মিলল না। কিন্তু ঘর ঝাড়ুর অভিজ্ঞতাও হল। ক্রমশ জানতে পারলাম সবাইকেই এই কাজ করতে হয় রোটেশন পদ্ধতিতে।
এরপর শুরু হল এক অন্য জীবন, যার সঙ্গে আমার পরিচিতিই ছিল না। সারাদিন ধরে ঘণ্টা-বাদন আর তার সঙ্গে সঙ্গে কর্মসাধন। দিন শুরু হত মর্নিং বেল দিয়ে- তারপর মর্নিং টি, পিটি, সকালের প্রেয়ার, তারপর স্টাডিহলে সব্বার সঙ্গে বসে পড়াশুনো। এরপর প্রাতঃরাশ, ইস্কুলে যাওয়া, টিফিন টাইমে হোস্টেলে ফেরত এসে মধ্যাহ্নভোজ। খেয়েদেয়ে আবার ইস্কুলে ফেরত যাওয়া, সবের জন্যেই প্রাত্যহিক রুটিনমাফিক সময় বাঁধা ছিল। এমনকি বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়াও বাধ্যতামূলক ছিল। আমাদের গেম্স টিচার জিতুদা/শরৎদা রীতিমত হাজিরার রেজিস্টার নিয়ে খেলার মাঠে উপস্থিত থাকতেন। সন্ধ্যেবেলা আবার প্রেয়ারহলে গিয়ে প্রার্থনা। সেখান থেকে আবার স্টাডি হলে বসে বাধ্যতামূলক পড়াশুনা। শুধু রাতের খাওয়ার পর ঘরে বসে পড়াশুনা করার অনুমতি ছিল, তাও রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। তারপর ‘লাইট্স অফ’ বেল- আলো নিবিয়ে দিতেই হবে।
রুমমেটরা জানাল ধুতি পরে প্রেয়ার হলে যেতে হবে। অন্নপ্রাশনের পর জীবনে কোনওদিন ধুতি পরেছি বলে মনে পড়ে না। ঢোঁক গিলে সিনিয়র রুমমেটকে বললাম “দাদা, একটু পরিয়ে দেবে?” একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এগিয়ে এসে ধুতিটা পরিয়ে দিয়ে বলল “এরপর থেকে নিজেকে পরতে হবে। শিখে নিবি।” ধুতির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই পরের দিন সকালে পিটি করে আসার পর সিনিয়র দাদা হাতে একটা ঝাঁটা ধরিয়ে দিয়ে বলল “নে, ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দে!”
একবার পরীক্ষার আগে বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে পড়াশুনা করার জন্যে ভীষণ বকুনি খেয়েছিলাম। কি করব- নরেন্দ্রপুরে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনেই যে আমাদের হেডমাস্টারমশাই হরিদা বলে দিয়েছিলেন- “পড়াশুনাটা মন দিয়ে করবে। মনে রাখবে এখানে সবাই ফার্স্ট বয়!” ছুটির দিনেও ছুটকারা ছিল না- রবিবার যে দেরি করে ঘুম থেকে উঠব, তার উপায় নেই। সকালবেলা সাড়ে আটটা বাজতেই ভারি ইউনিফর্ম পরে, মোটা জুতো পরে এনসিসি করতে দৌড়তে হবে। একটা অবশ্য বাড়তি আকর্ষণ ছিল রবিবারের ড্রিলে- শিঙাড়া আর জিলিপি জুটত টিফিনে!
তবে এই সারাদিনের বাঁধা রুটিনে ফাঁক-ফোকর কি আমোদ এক্কেবারেই কি ছিল না? অবশ্যই ছিল। খাবার-দাবার চিরকালই একটা স্পর্শকাতর জায়গা। মিশনে মাছ মাংস ডিম সব কিছু যদিও দেওয়া হত, আমাদের বিস্তর অভিযোগ ছিল রান্নার মান নিয়ে। প্রতিবাদের বিভিন্ন ভাষা হয়। আমরা এক অনন্য উপায়ে প্রতিবাদ জানাতাম। আমাদের গোপন মিটিংয়ে ঠিক করে নিতাম কবে আমরা “কাঁড়ি দিবস” উদযাপন করবো। সেইদিন যাই মেন্যু থাকুক, আমরা এত খেতাম যে রান্নাঘরে খাবার কম পড়ে যেত। বিশ্ববিজয়, রাণা, রামকৃষ্ণ সৈনিক, বিকাশের মতো দক্ষ প্লেয়ারদের কল্যাণে রাত্তিরবেলা মেন কিচেনে আবার হাঁড়ি চাপাতে হত। প্রশাসনকে বিড়ম্বনায় ফেলেই নৈতিক জয়ের আনন্দ উপভোগ আর কী।
হোস্টেলের নিয়ম ছিল, রাইজিং বেল বাজলেই ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে আর সেটা হোস্টেল ওয়ার্ডেন অমলদা তীক্ষ্ণ চোখে নিচ থেকে খেয়াল রাখতেন। শীতকালে সকাল সাড়ে পাঁচটায় সেই বেলের চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার কিছু ছিল না, কারণ শুধু ঘুম থেকে ওঠা তো নয়, তারপর পিটি করতে বেরোতে হত ওই শীতের মধ্যে। একবার প্ল্যান করে সুইচের সঙ্গে দড়ি বেঁধে দেওয়া হল, যাতে বেল বাজলেই বিছানায় শুয়ে টান দিলেই লাইট জ্বলে ওঠে আর আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি। বিপত্তিটা হল, যে বন্ধুর ওপর দড়ি টান দেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতেই সুইচের দড়িতে টান পড়ল আর রাত আড়াইটেতে ফটফটিয়ে বাতি জ্বলে উঠল। এদিকে আমরা তো ঘুমে অচেতন। মাঝরাতে টহল দিতে বেরিয়ে অমলদার নজরে পড়ল সবার ঘরে আলো জ্বলছে। তিনি ঘরে এসে দেখেশুনে বুঝলেন ব্যাপারখানা। এরপর আমাদের ঘরের সব্বাইকে ডেকে এমন উত্তম-মধ্যম দিলেন যে “দিমাক কি বাত্তি” জ্বলে গেল এক্কেবারে চিরকালের মতো!
খাবার-দাবার চিরকালই একটা স্পর্শকাতর জায়গা। মিশনে মাছ মাংস ডিম সব কিছু যদিও দেওয়া হত, আমাদের বিস্তর অভিযোগ ছিল রান্নার মান নিয়ে। প্রতিবাদের বিভিন্ন ভাষা হয়। আমরা এক অনন্য উপায়ে প্রতিবাদ জানাতাম। আমাদের গোপন মিটিংয়ে ঠিক করে নিতাম কবে আমরা “কাঁড়ি দিবস” উদযাপন করবো। সেইদিন যাই মেন্যু থাকুক, আমরা এত খেতাম যে রান্নাঘরে খাবার কম পড়ে যেত।
আশ্রমের সুউচ্চ পাঁচিলের মধ্যে কিছু ফাঁক-ফোকর ছিল যেগুলো ছিল আমাদের পালাবার জায়গা ছিল। সুযোগ বুঝে পাঁচিল টপকে সোনারপুর গড়িয়া অঞ্চলের সিনেমা হলে ঢুঁ মারা একটা নিয়মিত ব্যাপার ছিল। যারা আরও দুঃসাহসী, তারা তো ধর্মতলা পর্যন্ত চলে যেত সিনেমা দেখতে। ফিরতে রাত হত বলে পকেটে টুথব্রাশ আর পেস্ট নিয়েই সিনেমা দেখতে যেতাম। পরনে এক্কেবারে সাধারণ জামাকাপড়। ফেরার সময় পাঁচিল টপকে ঢুকে দাঁত মাজতে মাজতে ফিরতাম, যাতে কোনও মহারাজের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে বলতে পারি নাইট-ওয়াকে গিয়েছিলাম। একবার বেশি রাত হয়ে গেল ফিরতে। যখন হোস্টেলে পৌঁছলাম তখন মেন গেটও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জীবন বাজি রেখে পাইপ বেয়ে উঠে দোতলার কার্নিশ দিয়ে হেঁটে ঘরে পৌঁছেছিলাম সেইদিন। কিন্তু কথায় বলে, সব দিন কাহারও সমান নাহি যায়! একদিন ধরাও পড়লাম। কিন্তু সামনে মাধ্যমিক ছিল বলে হরিদার বদান্যতায় সেদিন বেঁচে গিয়েছিলাম।
হোস্টেলে থাকাকালীন আমাদের বিস্তর অভিযোগ ছিল। কিন্তু পরে জীবনযুদ্ধে নেমে বুঝতে পারি এই অনুশাসন কতটা উপকার করেছিল আমাদের। কোনও কাজই যে ছোট নয়, ঘর পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার, মালির কাজ- সব হোস্টেল জীবনেই শিখেছি। তাই পরবর্তীকালে যখন কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে, নরেন্দ্রপুরের সেই কঠোর অনুশাসন আর নিয়মানুবর্তিতাকে বারবার সেলাম জানিয়েছি- আর ভেবেছি ভাগ্যিস বাবা আমায় হোস্টেলে পাঠিয়েছিলেন!
সরকারি (রেল) আবাসনে বেড়ে ওঠা। ইংলিশ কনভেন্ট আর রামকৃষ্ণ মিশনের সংমিশ্রণ। পেশায় ডাক্তার। যদিও মাউথ অরগ্যান আর ইউকেলেলে হাতেও সমান স্বচ্ছন্দ। মঞ্চে বাজাতে খুব ভালোবাসেন। লং ড্রাইভ, আড্ডা, পার্টি, হৈ হুল্লোড়.... সবই চলে। বর্তমানে দক্ষিণ পূর্ব রেল হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি টেরিটোরিয়াল আর্মিতেও উনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে আছেন।
লেখালেখি টা ওনার latest passion।
ডাক্তার কুন্ডু র লেখা খুবই ভালো লেগেছে।মানুষ টিকে চিনি।তাই আরও বেশি উপভোগ করতে পারলাম। কঠোর অনুশাসন ওনাকে জীবন যুদ্ধে একজন পোড় খাওয়া সৈনিক হিসাবে গড়ে তূলেছে।
ধন্যবাদ
পুরানো কথা মনে পড়ে গেল।
হোস্টেল জীবনের অভিজ্ঞতা দারুণ সাবলীল আর দক্ষ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছো।তোমার সাফল্যের মুকুটে আর এক রঙিন পালক সংযোজিত হল।
আমি আপ্লুত
চমৎকার লেখা সোমনাথ। সুখপাঠ্য ও প্রাণবন্ত