সেদিন সারা শহর জুড়ে শ্রাবণ আর শ্রাবণ। একেবারে জল থৈথৈ কাণ্ড। পথে-ঘাটে সর্বত্রই জল আর জল। আকাশের দিকে তাকালেও তার কোনও বিরাম নেই। জানি না কালীদাসের মেঘদূতে এমন বিরামহীনতা ছিল কিনা।
সেদিন কলকাতার এক বনেদি বাড়ির বৈঠকখানায় বসেছে বর্ষার গানের মজলিশ। উপস্থিত সকলেই বাইরের শ্রাবণধারায় কমবেশি ভিজে এসেছেন। এদিকে বৈঠকখানার মঞ্চে উপবিষ্ট তবলচি সেখানে তবলায় বোল তুলছেন। পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন সৌম্যকান্ত ধীরেন বসু। শুরু করলেন নজরুলের এই গানটি গেয়ে,
‘শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে’!
সেই অল্পবয়সে বাইরের বর্ষার জল যেন চোখের জলের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল এই গানের মীড়ে। আজও সেদিনের শ্রাবণসন্ধ্যার স্মৃতিতে বর্ষার জন্য আকুল হয়ে ওঠা মনের জন্য অবাক লাগে। সেদিন শ্রাবণ সন্ধ্যায় ধীরেন বসুর কন্ঠে শোনা নজরুলগীতিটি পরবর্তীকালে বহু জায়গায় বহুবার শুনেছি এবং একই রকম অনুভুতি হয়েছে। তারপর বহু বর্ষা এসেছে জীবনে, কখনও ঝড় হয়ে, কখনও তাণ্ডব হয়ে আবার কখনও আশ্চর্য এক পেলবতার পরশ নিয়ে। সব বর্ষার স্মৃতিই অন্তরে থেকে গিয়েছে নানারূপে নানাবর্ণে। ভাবি, বর্ষায় মাঝেমাঝে মন এমন আকুল হয়ে ওঠে কেন, কিন্তু তল পাইনা।
আমাদের বাংলায়, হ্যাঁ, দুই বাংলায় বর্ষার যে রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি, তাকে বহু যুগ ধরেই কবি গীতিকাররা তাদের ছন্দের, সুরের, তালের আবহে বারবার বন্দনা করেছেন। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সর্বাগ্রে থাকলেও তাঁর বর্ষার গান এবং কবিতা নিয়ে আজ কোনও কথা বলব না। তবুও বর্ষার কথা যখন বলি, তাঁর একটি কথা না বললে মনে হয় বর্ষার এই শ্রাবণধারা কোথাও যেন অপূর্ণ থেকে যাবে। রবীন্দ্রনাথ একবার খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষার হয় জিৎ!’এই আপ্তবাক্যটিকে যদি আমরা স্বীকার করে নিই, তবে আমাদের সঙ্গীতের যে সম্পদ বাংলা গানে পাই, তা সে আধুনিক হোক কিংবা সিনেমায়, একেবারে টইটুম্বুর হয়ে আছে বলেই আমার বিশ্বাস।
আসলে আমাদের বাংলার বুকে, প্রকৃতি বিশেষত বর্ষাকালে, অর্থাৎ আষাঢ় শ্রাবণে বড়ো স্নিগ্ধ হয়ে হাজির হয়। ফলে গরমের দাবদাহে অতিষ্ঠ চিত্ত বিহ্বল হয়ে পড়ে। মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর তখনই বাঙালি আত্মসমর্পণ করে গান ও কবিতায়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বর্ষার দিনে পথে ঘাটে না নেমে, ওই জানালার পাশে করতলে মাথা রেখে বাইরের অঝোরধারাকে দেখতেই বাঙালি ভালোবাসে। উপভোগ করে রিমঝিম বর্ষার অনুরণন। ফলে মনের উপর বর্ষার প্রভাব সুগভীর হয়ে ওঠে। প্রকৃতি এবং মানুষের মন যেন বর্ষায় এসে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে যায়। এই দুই সম্পর্কের এ যেন এক অপার রহস্য। একেবারে অন্য অনন্য এক রোম্যান্টিসিজম। এ কথা তো ঠিকই যে প্রকৃতির তাপমাত্রা, প্রকৃতির বাতাস, প্রকৃতির আলো, প্রকৃতির আঁধার, বৃষ্টি, শিশির, কুয়াশা এসবই মানবমনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় রচিত হয় গান, কবিতা, ছবি।
বর্ষায় রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও আমরা বহু গান পেয়েছি। সেদিনই শুনছিলাম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে পরিবেশিত, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ গানটি। কবেকার গান, আজও শুনলে উতলা হয়ে পড়ি। এমনই একটি বর্ষার গান শুনতে শুনতে ভিজে যাই মরমে যা কিনা কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা গেয়েছিলেন আশির দশকে। গানটি ‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না’। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির দিনে এই গানের আর্তি একেবারে অবিস্মরণীয়। এই গানটি সেই সময়ে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে দুই বাংলার বাঙালির মুখে মুখে ফিরত। মনে পড়ে ঠিক তার পরের দশকে ওপার বাংলার আরেক শিল্পী সেলিম চৌধুরীর গাওয়া বৃষ্টির একটি মিষ্টি গানের কথা ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। এত সুন্দর করে গানটি সুরে-তালে-ছন্দে বাঁধা হয়েছিল, যে মানুষ তাকে আপন করে নিয়েছিল। এছাড়াও বাংলাদেশের নিয়াজ মহম্মদ চৌধুরীর কন্ঠে ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ গানটি আবালবৃদ্ধবনিতার মন কেড়েছিল।
এপার বাংলাতেও বর্ষার গানের তালিকাটি সুবৃহৎ। তবে সব গানই যে জনপ্রিয় হয়েছিল বা হয়ে ওঠে তা তো নয়। গান জনপ্রিয় হবার প্রাথমিক শর্তগুলোর মধ্যে সুর-তাল-ছন্দের পাশাপাশি কথাটাও খুব আন্তরিক এবং সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া জরুরি। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে আমাদের কান পাততে হয় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’ গানটিতে। যেমন সুর, তেমন তার কথা, আর সঙ্গে গায়কী। এছাড়া হৈমন্তী শুক্লার কন্ঠে ‘ওগো বৃষ্টি আমার’ গানটিও যেন বর্ষার একটি নিখুঁত ছবি এঁকে দেয় মনের মণিকোঠায়। গানটির সঙ্গে সঙ্গে ভিজে যাওয়া যায়। এমন করেই ভেসে যাওয়া যায় সুবীর নন্দীর ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’ গানটির তালে ছন্দে।
আবার যদি ওপার বাংলার বর্ষার সঙ্গে নীলুফার ইয়াসমিনের ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’ গানটিতে অবগাহন করি তাহলেও চমক লাগে। অবাক হই ফিরোজা বেগমের গলায় ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’ শুনতে শুনতে। কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া যায়। এমনই আরও দুটি গানের কথা মনে পড়ছে। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘আকাশ এত মেঘলা’ও ‘এলো বরষা যে সহসা মন’। এই গানগুলির মধ্যে একটা চিরনতুনের সুর আর বাণীর পরশ পায় শ্রোতা। তাই আজও এ গানের আর্তিতে বর্ষা ছুঁয়ে যায়।
একুশ শতকের বর্ষার গান বললে মনে পড়ে অঞ্জন দত্তের ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ও ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’র কথা। লোকমুখে ফিরত গান দুটি। আজও শোনা যায় কোনও যুবক যুবতীর কন্ঠে। একই রকমভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে শ্রীকান্ত আচার্যের ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ গানটি বা নচিকেতার ‘শ্রাবণ ঘনায়’ গানগুলি। পাশাপাশি মৌসুমি ভৌমিকের ‘বৃষ্টি পড়ে রে’ ও ‘ভাবি কখন বৃষ্টি নামবে’ গানগুলোও আমাদের আকৃষ্ট করে তার সমস্ত বাঁধ ভেঙে। এই যে বর্ষার চিরবিরহের গান এবং বাঙালি, তার সঙ্গে খিচুড়ি এবং ইলিশমাছ ভাজা, প্রকৃতি উপভোগের এই স্বাদটাই বাঙালির মননে ঘন বর্ষায় এক গর্বিত স্পর্ধা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।