আমরা একটি শহরতলিতে থাকি, অনেকটাই গ্রামের মতো! মানুষজনও গ্রামের মতো সহজ সরল!রাতে রাস্তার আলো খুব দূরে দূরে টিম টিম করে জ্বলে! প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন জায়গাটা মোটেই পছন্দ হয়নি, রাতের বেলা বাইরের অন্ধকারে কেমন গা ছমছমে ভাব! এখানে আবার শিয়াল, কায়োটি, হরিণের প্রাদুর্ভাবও বেশি! এই হরিণরা কিন্তু ‘আমার সোনার হরিণ চাই’-এর মতো হরিণ নয়! এরা রীতিমত গাড়ি চালকদের আতংক! কখন যে দলবেঁধে তিরগতিতে রাস্তা পার হবে তা কারও জানা নেই! প্রায়ই গাড়ির সামনে পড়ে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে! তবে চিন্তার কিছু নেই তারা গাড়ি দুমড়ে দিয়ে বহাল তবিয়তে দৌড়ে পালিয়ে যায়! এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ, একবার আমাদের নতুন গাড়িতে সবাইকে নিয়ে আমরা চাইনিজ খেতে যাচ্ছি। আমি ড্রাইভারের পাশে বসে আছি। বাড়ির মাইলখানেকের মধ্যেই সারা গাড়িটা ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল! কোনও গাড়ি আশেপাশে নেই! ধাক্কাটা আমার দিকেই মানে প্যাসেঞ্জারের দরজার দিকেই। অন্য যাত্রীদের মন্তব্য এক বড় হরিণ দৌড়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়িতে ধাক্কা মেরে চলে গেছে। দরজা খোলা যাচ্ছে না, দুমড়ে মুচড়ে অস্থির! নতুন গাড়ির শোকে স্বভাবতই সবাই নেমে আহা উঁহু করতে লাগল। আমি তো গাড়িতে আটকে, দরজা খোলা যাচ্ছে না, তাই নামতেও পারছি না। গাড়িতে বসেই কান্নাকাটি…! বক্তব্য, তোমরা এক্ষুনি ওই হরিণটা খুঁজে বার কর, কতটা লেগেছে দেখ, বেঁচে আছে তো? তারা আমাকে সান্ত্বনা দিতে, একটু বিরক্ত হয়েই চারদিক দেখে এসে বলল, কোথাও তার ট্রেস পেলাম না। তোমার সোনার হরিণ ধাক্কা মেরেই পালিয়ে গেছে!

Deer on road
সোনার হরিণ ধাক্কা মেরেই পালিয়ে গেছে!

আমাদের গ্রামে মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাকও শুনতে পাওয়া যায়! আর কায়োটির উপদ্রবও কিছু কম নয়! ছোট কুকুর বা বাচ্চাদের শিয়াল বা কায়োটির থেকে সামলে রাখতে বলা হয়! এ হেন জায়গাকে আমি আর কী বলব গ্রাম ছাড়া? আর যা আছে তা খুব সুন্দর সুন্দর রংবেরঙের পাখি! ব্লু জে, কার্ডিনাল, স্প্যারো (চড়াই), রবিন, ডাভ, গোল্ডফিঞ্চ, উডপেকার (কাঠঠোকরা) এমন কত রকমের পাখি! দেখতে বড় সুন্দর লাগে, চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে সারাক্ষণ তাদের কলকাকলি শুনতেও বড় ভালো লাগে। এক জোৎস্নাভরা রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে মনে হল কারা যেন কথা বলছে! আসলে পাখিদের মজলিশ বসেছে ! এদিক থেকে একে ডাকে তো অপরদিকে থেকে আর এক পাখির সাড়া! রবিকবির সেই গানের মতো, ‘এ পারে মুখর হল কেকা ওই, ও পারে নীরব কেন কুহু হায়’। এ এক বিশেষ পাওয়া! আর এক রকমের বুনো পাখি দেখা যায়, অনেকটা বড়সড় মুরগির মতো, কিন্তু দেখতে ভালো নয়! তারা ওড়ে না, কিন্তু নির্ভয়ে সারা পাড়া চষে বেড়ায় সন্তানসন্ততি নিয়ে! তাদের দেখে আমার মনে হয় দাদু-ঠাকুমা, ছেলে-বৌ-নাতিপুতি নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে! অবশ্য তারা সারাদিনই পুরো সংসার নিয়ে স্বাধীনভাবে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়! এদের চেহারার মতো গলার স্বরও কর্কশ! এখানে থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের এক বিশেষ পদ এই পাখির মাংস, কিন্তু অবাক লাগে এই বুনো পাখি কেউ মারে না! আর যা এখানের সুন্দর তা হল প্রাকৃতিক দৃশ্য! “গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে”, প্রকৃত অর্থেই এ কথা সত্যি! দুপাশে ঘন সবুজ গাছপালা তার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সরু সিঁথির মতো রাস্তা চলে গেছে! বড় নিঃঝুম, বড় সুন্দর!আমার এক বন্ধু টেক্সাস থেকে এসে বলেছিল, তোমরা তো ভেকেশন ল্যান্ডে বাস কর! আসল কথা যাতায়াতের তাড়ায় চারদিক দেখি কই?আমার কবি ঠাকুরের কথা, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না!’ 

IMG 1 rural
গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভুলায় রে

গ্রামে যেমন চাষ হয়, খেত খামার থাকে আমাদের এখানেও তার প্রভাব খুব বেশি! এরা ফার্ম বলে! টাটকা আনাজপাতি, ফলমূল, বিচুলি সব পাওয়া যায়! মাঝে মাঝে ফার্মাররা সব ফসল গাড়িতে সাজিয়ে সপ্তাহের এক একদিন এক একটা আধা শহরের এক বিশেষ জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকজন এসে কিনে নিয়ে যায়! দাম একটু বেশি কিন্তু একেবারে টাটকা সবজি! আমাদের বাড়ির কাছে এরকম একটা ফার্ম আছে! নাম Codman farm, যাতায়াতের পথে পড়ে! ঘন গাছগাছালির মধ্যে হঠাৎ বিশাল এক পলাশপুরের মাঠ (ভুবনডাঙার মাঠ), মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা! ঘনকালো চুলের মাঝের সরু সিঁথির মতো মনে হয়!এই ফার্মটা একটু অন্যরকমের! রাস্তার একধারে ঘন সবুজের কার্পেট, তাতে বিভিন্ন শাকসবজির বাহার! সবার আগে চোখে পড়ে অগুনতি সৈন্যের মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র ভুট্টাগাছ! তারপর ঘন সবুজ পামকিন (আমাদের কুমড়ো) গাছ মাঠে লতিয়ে আছে, এরপর ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালং সব ভাব-ভালবাসা করে নিজের নিজের জায়গায় সংসার করছে! এই সিঁথিকাটা রাস্তার একদিকে যেমন আনাজপাতির ঘর সংসার আর অপরদিকে জীবজন্তুর এক অস্থায়ী আস্তানা! সেখানে গরু, ছাগল, লোমশ ভেড়া এমু পাখি এসবের বসবাস! তারের জালের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে ভিন্ন জন্তুদের আস্তানা! অবাক লাগে যখন দেখি ভেড়া আর ছাগলের মধ্যে একটা করে এমু পাখি! পরে জেনেছি এখানে কায়োটি বা শেয়ালের উপদ্রব খুব বেশি তাই এই এমু পাখি watch dog এর মতো এই নিরীহ জীবদের পাহারাদারের কাজ করে!

তারের জালের বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকে ভিন্ন জন্তুদের আস্তানা!

এই পথ দিয়ে আমার নিত্য যাতায়াত! রোজই এই যাতায়াতের পথে দেখি এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! কেউ কাজ করছে, কেউ বা ছবি তুলছে! এই ফর্মটার কাছে আসলেই মনে হয় হঠাৎ কোন তেপান্তরের মাঠে এসে পৌঁছেছি! প্রশস্ত নীল আকাশ নেমে এসে পলাশপুরের সবুজ মাঠকে ছুঁয়ে দিয়েছে! এবছর আগস্ট মাসের শেষের দিকে যখন আকাশে মেঘের ভেলায় শরতের ছোঁয়া, গাছের পাতার রঙের ছোঁয়া, তখন একদিন কাজে যাবার পথে দেখি সারা মাঠে শরতের পেঁজা তুলোর মতো কী যেন বিছিয়ে আছে! অবাক হলাম! কী এখানে? নাহঃ তুলো নয়, ছোট ছোট দুধসাদা পাখি! কোনওদিন দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখা হয়নি! যাবার পথে সময়ে পৌঁছনোর তাড়া, ফেরার পথে পেছনে গাড়ি থাকে তাই নেমে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখা হয়নি! তবে যাতায়াতের পথে দেখি সেই ছোট্ট পাখিগুলো বেশ তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে! ডানার ঝাপ্টানি শোনা যায়! আর একটা জিনিস লক্ষ করেছি পাখিগুলোর মধ্যে একটা কুকুর বসে থাকে! গত সপ্তাহে একদিন কাজ থেকে ফিরছি দেখি এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ট্রাইপড লাগিয়ে ছবি তুলছে! সেই দেখে আমারও শখ হল। রাস্তার গা ঘেঁষে গাড়ি পার্ক করে আমিও নেমে পড়লাম ছবি তুলতে! কাছে গিয়ে দেখলাম, অজস্র পাখি, যেন পাখির ঝরনাধারা! গাড়ি থেকে শোনা যায় না, কিন্তু এরা বেশ সরব, সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে যাচ্ছে! যিনি ছবি তুলছিলেন তিনি পাখি সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন! আমাকে বললেন যে এগুলো টার্কি! আমার জানা ছিল না যে টার্কি এত সুন্দর দেখতে হয় ! উনি আরও বললেন যে যাদের নীল চোখ আর টকটকে লাল বিক তারা ছেলে পাখি! মেয়েদের তত দেখতে ভালো হয় না! এই সুন্দর নীল চোখ দেখেই মেয়েপাখিরা আকৃষ্ট হয়! আমি দূরে কুকুরটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম কুকুরটাই এই পাখিগুলোর Watch dog! অবাক লাগল! শিয়ালের থেকে বাঁচাতে কুকুর পাহারা দিচ্ছে? কুকুরও তো মাংস খায় কিন্তু কী সংযম! সে এক প্রান্তে চুপ করে বসে আছে, এমন নির্লোভ জন্তু কেন, মানুষ পাওয়াও কঠিন!

নাহঃ তুলো নয়, ছোট ছোট দুধ সাদা পাখি! কোনওদিন দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখা হয়নি! যাবার পথে সময়ে পৌঁছনোর তাড়া ফেরার পথে পেছনে গাড়ি থাকে তাই নেমে কাছে গিয়ে ভালো করে দেখা হয়নি! তবে যাতায়াতের পথে দেখি সেই ছোট্ট পাখিগুলো বেশ তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে! ডানার ঝাপ্টানি শোনা যায়!

ভদ্রলোকের দেখাদেখি আমিও বেশ কিছু ছবি তুললাম! ফটোগ্রাফার ভদ্রলোক আমাকে বললেন তুমি একটু বেড়ার ধার দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে হেঁটে যাও, দেখ কী হয়! অবাক কাণ্ড! আমি যেদিকে হাঁটছি তারাও দল বেঁধে বকবক করতে করতে সেইদিকে হাঁটছে! এ এক মজার খেলা তো! আশ্চর্য হলাম আমি বেড়ার এদিকে আর ওরা ওদিকে, কিন্তু ঠিক আমার পাশে পাশে একদিক থেকে আর একদিকে বরাবর চলছে! আমার ব্যাপারস্যাপার দেখে ভদ্রলোক হেসে বললেন, ওরা ভাবছে তুমি খাবার দেবে তাই তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে! আমি একটু অবাকই হলাম। এদের খাবার দেওয়া যায় না কি? কে জানে কোনও নিয়ম নির্দেশ আছে কি না, কারুকে তো খেতে দিতে দেখিনি! উনি বললেন নিয়ম নেই বটে, তবে অনিয়মের কথাও কোথাও লেখা নেই। তুমি ব্রেড এনে খাওয়াতেই পারো! খাওয়ানো তো আর পালাচ্ছে না, সে যে কোনও একদিন এনে খাওয়ানো যাবে! সেদিন আরও কয়েকটা ছবি তুলে Steve (ফটোগ্রাফারের নাম)-এর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করে বাড়ি ফিরে এলাম।

Watch Dog
কুকুরও তো মাংস খায় কিন্তু কি সংযম!

বাড়ি ফিরে মনটা খারাপ লাগছিল! ওরা এত আশা করে আমার পেছন পেছন ঘুরছিল আর আমি কিছু দিতে পারলাম না! আবার বেরিয়ে একটা বড় পাউরুটি কিনে আনলাম! পরেরদিন কাজে যাবার আগে ছোট ছোট করে কেটে নিলাম যাতে ওরা সবাই খেতে পারে। এক ব্যাগে হয়তো কম পড়বে তাই বাড়ির পাঁউরুটিটাও নিয়ে টুকরো করে বড় ব্যাগে ভরে নিলাম! সেদিন সকাল থেকেই মনটা খুব উৎফুল্ল! আজ পাখিগুলোকে ঘুরে ঘুরে খেতে দেব! যাবার পথে যথারীতি তাড়া, খাবারের ঝুলি গাড়িতে রেখেই দৌড়ালাম! যাবার পথে দেখলাম তারা রোজকার মতো মজলিশ করছে!
সারাদিন কাজের মধ্যেও বেশ উত্তেজনা, কে জানে ফার্মের কোনও লোক ওখানে থাকবে কি না, তাহলে হয়তো খেতে দিতে পারব না! ভেবে রেখেছি একবার এ প্রান্ত থেকে দেব তখন সব এদিকে এসে জড় হবে, আবার অন্য দিকে যাব ওরাও আমার সঙ্গে সঙ্গে ঝটপটিয়ে চলবে, সেখান থেকে খাবার দেব! এই সব নানা জল্পনা কল্পনা করতে করতে তড়িঘড়ি কাজের থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম! ফার্মের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে কোনওমতে খাবারের ঝুলি নিয়ে ছুট!কিন্তু এ কী? পাখিরা কই! এক ধার থেকে এক ধারে ছুটে গেলাম, একটা পাখিও নেই! সারা মাঠ ভর্তি ছেঁড়া পাপড়ির মতো কিছু সাদা পালক ছড়িয়ে আছে! শুধু দূরে কুকুরটা একা বসে আছে! আর চোখে পড়ল একটা পোস্টার!Posterমনে পরে গেল সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতার কটা লাইন .. ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে- ‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল, একেবারে সোজা চলে এল
ধব্‌ধবে সাদা দামি কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ;অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে  ছবি সৌজন্য: লেখিকা, flickr

আশির দশকে হাওড়ার বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবারের ঘোরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করতে মার্কিনদেশে চলে এসেছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তনী স্বপ্না রায়। সঙ্গী স্বামী রাহুল রায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত স্বপ্না তিন দশক আগে আমেরিকার বস্টন শহরে তৈরি করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল স্বরলিপি। আজ তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একশর বেশি। তার মধ্যে ভারতীয়, অভারতীয় উভয়েই আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *