সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর নয়, একুশ দিন পর আজ, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনই আমার শিক্ষক দিবস। আজ তিনি দ্বিশতবর্ষীয়ান। আজকের দিনে আমি বাংলার সরকারের কাছে দাবি করছি, এই দিনটি অন্তত বাঙালির শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। অবিলম্বে।
ভারতের ইউনিয়ন গভর্নমেন্টেরও আসলে এটাই করা উচিত। যদিও, এই সরকারে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে, নিজেদের আদর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে, পুরুষপ্রধান ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপ্রতীপ বিদ্যাসাগরের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে উদযাপন করা, আদৌ সম্ভব কিনা, খানিক ঢঙ করে বললেও বলতেই হয়, চাপ আছে, বস্। তৎকালীন তথাকথিত হিন্দুসমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, একের পর বিপ্লব ঘটানো, নারীশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ দিয়ে শুরু করে সবচেয়ে বড় থাপ্পড় নিঃসন্দেহে বিধবাবিবাহ আইন পাশ করানোয় প্রধান বা প্রায় একক ভূমিকা নেওয়া, সমাজের মানুষের এবং বিশেষ করে নারীর যাবতীয় যন্ত্রণায় কাতর ও তা অতিক্রমে সক্রিয় অগ্রগামী এর’ম একটা ট্যারা লোকের চেয়ে, মেয়েদের ভূমিকা আসলে বিবাহ এবং মাতৃত্বেই, এমন বিশ্বাসে ঋদ্ধ এক জন দর্শনশাস্ত্রী-ই যে, কংগ্রেসের মতোই এখনকার সরকারি দল ও তাদের দার্শনিক পিতৃকুল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কাছেও অধিক মান্য হবেন আপাতত, অন্তত যদ্দিন না চোখের মাথা খেয়ে সরাসরি ওনাদের ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকরকে সেই স্থানে বসানো যাচ্ছে, শুনুন, আজকের হিন্দুত্ববাদীদের পূর্বসূরি হিসেবে যে-যে কালে যাঁদের-যাঁদের ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাঁরা সক্কলেই বিদ্যাসাগরকে তাঁর জীবদ্দশাতেই ঠিক কী কী গালাগাল করেছেন, এমনকি পেছনে গুন্ডা লাগিয়ে ঠ্যাঙানোর চেষ্টা অবধি, তাতে আজকের বাজারে বেঁচে থাকলে তিনি যে দিনের আলোয় এই মহানগরীর প্রকাশ্য রাজপথে লিঞ্চড হয়ে যেতেন, লোকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করবার বদলে উল্টে বরং সক্রিয় সঙ্গত করত সোল্লাসে, এইটুকু বুঝে নেওয়ার জন্যে বিরাট বোদ্ধা হওয়ার দরকার পড়ে না, হাতে না-পেয়ে সে রাগ বড়জোর জাস্ট ওই মূর্তি-টুর্তি ভাঙবার ওপর দিয়েই বেরচ্ছে, ওই আর কী!
দেখুন, এমনিতে, রাধাকৃষ্ণন সম্পর্কে বিশ্রী সমস্ত বিতর্ক আছে। হ্যাঁ, নরম করেই বললুম। রাষ্ট্রপতিত্ব অবধি উঠেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে বেশি স্পষ্ট করে বললে, কানে লাগতে পারে অনেকের। ইংরিজিতে তো অনেক কথাই কম খারাপ শোনায়, তাই বলি রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে plagiarism-এর অভিযোগ আছে, আজ না, এমনকি তিনি যখন উপরাষ্ট্রপতি ও পরে রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ওঁর কয়েক জন ছাত্র অত্যুৎসাহে নাকি ওঁর জন্মদিন পালন করতে চান, এবং, তাতে স্বয়ং রাধাকৃষ্ণন নিজেই নাকি তাঁদের বলেন, ওই ভাবে শুধু ওঁর জন্মদিন হিসেবে পালন না-করে একেবারে শিক্ষক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করলেই ব্যপারটা “my proud privilege” হবে, তো, সেই ১৯৬২ দিয়েই, তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম বচ্ছর থেকেই শিক্ষক দিবস পালন শুরু হচ্ছে, এ বার, এটা একটু কেমন-কেমন কিনা, ক্ষমতার পরোক্ষ ব্যবহারে জাতীয় জীবনে নিজের অমরত্ব প্রতিষ্ঠার লোভ সংবরণ করতে না-পারা কিনা, সে সব অস্বস্তিকর প্রশ্নে ন’য় না-গেলুম, বরং বলি, এই সমস্ত কিছুর বহু বহু যুগ আগেই তাঁর বিরুদ্ধে ওই বিশেষ অভিযোগটি উঠেছে। এবং, সে অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরই ছাত্র বিশিষ্ট গবেষক-অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ, সেই ১৯২৯ সালে। খুচরো অভিযোগ না, বেমক্কা বদনাম করবার ষড়যন্ত্র নয়, নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ সহযোগে তোলা স্পষ্ট অভিযোগ, যা এমনকি আদালত অবধিও গড়ায়, তখনকার কালে কুড়ি হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের দাবী সমেত, শেষ পর্যন্ত আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি বা বোঝাপড়া হয়। যদিও যথারীতি এখানেও নানাবিধ প্রভাব-খাটানোর খতিয়ান নাকি আছে, কিন্তু ঠিক কী ভাবে এবং কী কী শর্তে ব্যাপারটা মেটে, তার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা নাকি ছিল। পুরো বিষয়টি ঘিরে তৎকালীন বহু খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী ব্যক্তি, পত্রপত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানেরও স্পষ্ট বক্তব্য লিপিবদ্ধ আছে যদুনাথের পক্ষে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় দিয়ে শুরু করে পরবর্তী কালে খুশবন্ত সিংহ, এমনকি কলকাতা হাইকোর্টের এক সময়কার প্রধান বিচারপতি ও পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ফণীভূষণ চক্রবর্তীর ১৯৭৬-এ যদুনাথকে লেখা দীর্ঘ চিঠি পর্যন্ত। ভাবুন, তাহলে কত দীর্ঘ সময়কালজুড়ে কত বিরাট আকারে গুরুত্ব দিয়ে পুরো বিষয়টি চলেছে। শিক্ষাজগতের গুরুভার বিষয় বলেই সম্ভবত, সাধারণ মানুষের কৌতূহলে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি।
আর, এই সব কেচ্ছা যদি না-ও ধরি, Plagiarism-এর বিষয়টি এড়িয়ে যদি মেনেও নিই তাঁর প্রগাঢ় পান্ডিত্যের কথা, ভারতীয় দর্শনে তাঁর অবদানের কথা, তা হলেও প্রশ্ন হচ্ছে, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন-ই কেন? ওমনি করে ভাবলে তো আরও গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক অনেক ভারী সমস্ত নাম আসে, যাঁরা নিজ নিজ বিষয়ে অনেক বেশি যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন ওই সময়কালেই, জগদীশচন্দ্র থেকে রমেশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ। তা ছাড়া, দেশের শিক্ষক দিবস পালন করব যাঁর নামে, খালি পান্ডিত্যই কি সে ক্ষেত্রে বিবেচ্য হওয়ার কথা? শিক্ষার প্রসারে তাঁর কী এমন ভূমিকা? কী এমন মাথাঘোরানো অবদান তাঁর ভারতের শিক্ষাবিস্তারে? সাবিত্রীবাঈ ফুলে-র চেয়ে, বেগম রোকেয়া-র, এমনকি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি কি? সত্যিই কি ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর এত বড় অবদান? বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কথা ন’য় ছেড়েই দিলুম।
নাকি, কুটিল রাজনীতির ছ্যাঁচড়া কোনও প্যাঁচ? ইতিহাসের অতি তরল একটি বাঁকে, শীর্ষ নেতার অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে তৎকালীন বিশ্বের অতি শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রে দূত হয়ে যাওয়ার সুযোগ, সেখানে বসে ভারতের সবচাইতে বড় নায়কের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন, এবং, সেই সম্পর্কিত অতি অতি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় ঘটনাক্রমে শর্তসাপেক্ষ নীরবতা তথা পক্ষপাতিত্বই কি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় আসনে তাঁর আরোহণের প্রাথমিক ও মোক্ষম ভিত্তি? যেখানে পৌঁছে তিনি এমনকি নিজের জন্মদিনে একটি জাতীয় দিবসের প্রায় প্রস্তাবনা অবধি করে ফেলতে পারেন? শুনুন, একটি বিশেষ ধারার রাজনীতির আধিপত্য আর তার পা-চাটাদের নানা ভাবে পুরস্কৃত করবার চল, স্বীকৃতি দেওয়ার, জাতীয় মননে স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠার যাবতীয় উদ্যোগ অতি বেহায়া ভঙ্গিমায় দীর্ঘকাল ধরে হয়ে এসছে এ দেশের এক সময়কার ক্ষমতাসীনদের হাত ধরে। আবার, দিনকাল বদলাবার পরে এখন, তাদের পরিবর্তে আরেকটি রংবাজি আর তার গুরুঠাকুরদের মাথা তুলবার প্রক্রিয়াও যে অতি অশ্লীল ভাবে শুরু হয়ে গ্যাছে, সেটাও স্পষ্ট। এবং, এই কৌশলে এঁরা দিব্যি ব্রাত্য করে দিতে পেরেছেন গোটা উপমহাদেশের আর সমস্ত ইতিহাস-বর্তমান-ভবিষ্যতকে, ঠিক যেমন ভাবে বাকি সব মনীষী আর তাঁদের অবদানকে মানুষের মন থেকে মুছে দিতে চেয়েছেন বা অন্তত গুরুত্ব কমিয়ে , ওই আর কী, ওঁরাও ছিলেন, ওঁদেরও খানিক ভূমিকা-টুমিকা ছিল মার্কা একটা ভাব প্রতিষ্ঠা করবার একটা দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া চলছে নিরন্তর, উপমহাদেশে সামাজিক ন্যায় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রামে বিশেষ করে বাংলার ও বাঙালির বিপুল অবদানকে ক্রমাগত লঘু করে দিয়ে, সম্পূর্ণ হাওয়া করে দেওয়ার পরিকল্পনা ওই দু’পক্ষেরই সমান। রামমোহন থেকে সুভাষচন্দ্র, কেউই তাঁদের প্রাপ্য সম্মানের কণামাত্রও পাননি ভারতীয় ইউনিয়নের কাছে। ব্রিটিশ, কিছুতেই পেরে না-উঠে তার সবচেয়ে বড় শত্রু এই বাংলাকে না-খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছে, গেলো-বচ্ছর ইয়েমেনে তৈরি করা দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে ব্রিটেনের রাণী তো সে কথা বলেও ফেললেন গাল-ভরে, ওই ফর্মুলায় নাকি কত অস্ত্র বেঁচে যায়! তাতেও হয়নি, এমনকি সাতচল্লিশে আবার নতুন করে বাংলাকে ভাগ করেও ক্ষমতা-হস্তান্তরের দুই পক্ষের আশ মেটেনি, এই উপমহাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির, রাজনীতির এবং অবশ্যই অর্থনীতির একদা ভরকেন্দ্রটাকে ভুলিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছেন এঁরা। দীর্ঘকালীন ষড়যন্ত্রের এই সারসত্যটুকুন বাঙালিরা আর কবে বুঝবো, জানি না।
ঈশ্বরচন্দ্রের অবদান কী, সে বিষয়ে বক্তৃতা করবার ধৃষ্টতা আমার নেই। নীরদ সি-র “আত্মবিস্মৃত বাঙালি” ওঁর সম্পর্কে বলতে গেলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওই ‘বর্ণপরিচয়’-টুকুই তুলে আনে, ঠিক আছে, ন’য় ওইটুকখানি মনে রেখেই বাংলার সরকার আজ বাঙালির শিক্ষক দিবস পালন করুন। ওতেই হবে।
যদিও, আমার মতে, অতীশ দীপঙ্করের পর, এত বড় শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত উপমহাদেশে আর বোধহয় কেউ আসেননি কখনও। এবং, ওই মাপের পান্ডিত্য অর্জন করেও, এক জীবনে স্বেচ্ছায় নিজের কর্ষণক্ষেত্রের পরিধি অনন্ত করে দিয়ে, তার সমস্ত কোণের সব ক’টা কণায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে, বাঙালির সহস্রবচ্ছরব্যাপী জাতিজীবনেও এত বড় সমাজবিপ্লবী আর কেউ কোনও দিন এসছেন বলে আমার জানা নেই। আমি, কাকে আর শিক্ষক হিসেবে, ওঁর ওপরে রাখতে পারি, বলুন!
জন্ম কলকাতায়। কর্মও মোটের ওপর এখানেই। কারণ, সম্ভবত এ শহরের প্রতি মাত্রারিক্ত মায়া। যৌবনে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত পড়াশুনোর প্রতি দায়বদ্ধতা ক্রমক্ষীয়মান, উল্টে সিলেবাস-বহির্ভূত নানা বিষয়ে আগ্রহ, বিশেষ করে রাজনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সিনেমা। কর্মজীবনে শুরুর দিকে, বিভিন্ন বিনোদনমূলক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে বেশ কিছু জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিচালক। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সিনেমার দুনিয়ায় সম্মানিত কয়েকটি ফিল্মের সম্পাদক। এরই মধ্যে, প্রথম সারির কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি। বর্তমানে স্বাধীন ভাবে তথ্যচিত্র ও প্রচারমূলক ছবি নির্মাণ, বিভিন্ন অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত। আর, ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শদাতা একটি সংস্থার অংশীদার। প্রথম প্রকাশিত গদ্য ২০০৬, ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদিত ‘রোববার’ পত্রিকায় (সংবাদ প্রতিদিন)। পরে, আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময় ও অন্যত্র। প্রবন্ধ বা ফিচারধর্মী লেখার পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি ছোটগল্পও।