ডুয়ার্স অঞ্চলে যখন চা-বাগানের পত্তন শুরু হল, তখন প্লান্টারদের সামনে মূলত দু’টি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। প্রথমত: এখানকার অত্যন্ত নিবিড় অরণ্য কেটে সাফ করা এবং দ্বিতীয়ত: এ কাজের জন্য বিপুল সংখ্যক শ্রমিক জোগাড় করা। পাহাড়ে যখন চা চাষ শুরু হল, তখন সেখানে নেপালি এবং পাহাড়িয়া শ্রমিকের অভাব হয়নি। কিন্তু সমতলে শুধু নেপালি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ হল না। সেখানে শ্রমিক কম পড়ল। সে সময়ে আবার ডুয়ার্সে ছিল কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়ার রাজত্ব। অরণ্যও বিপন্মুক্ত ছিল না, সেখানে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের বিচরণ। ডুয়ার্সের স্থানীয় উপজাতির মানুষেরা চা-বাগান শ্রমিকের কাজে সেভাবে যোগ দেননি। এর কী কারণ? অনেকেই মনে করেন স্থানীয় রাভা, মেচ, রাজবংশীদের প্লান্টাররা শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করতে চায়নি কারণ ‘স্থানীয় জনজীবন থেকে চা-শিল্পের এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন রাখা শোষণকে কায়েম রাখার স্বার্থে প্রয়োজন।’
বাইরে থেকে শ্রমিক এনে স্থানীয়দের একঘরে করে রাখাই ছিল প্লান্টারদের উদ্দেশ্য। কেউ কেউ লিখেছেন, সে সময়ে হাওড়া থেকে রামপুরহাট সাহেবগঞ্জ হয়ে উত্তরবঙ্গে রেললাইন পাতার কাজ করছিল সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি আদিবাসী শ্রমিকেরা। রেললাইনের উঁচু ভিত তৈরি করতে মাটি কাটা, পাথর ভাঙা, স্লিপারের জন্য গাছ কাটা ইত্যাদি কাজে তাঁরা এত কঠিন পরিশ্রম করেছিলেন ও দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, যে লাইন পাতার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। ব্রিটিশ প্লান্টাররা এটাও লক্ষ করেছিল, যে এঁরা শুধু পরিশ্রমী নন, এঁরা ‘মিথ্যে বলে না, ভিক্ষা করে না, স্বাধীনচেতা হলেও বিনয়ী ও নম্র।’ ফলে এঁদের দিয়ে কাজ করাতে সুবিধে।
অনেকে আবার মনে করেন, স্থানীয় জনজাতির রাভা, মেচ, গারো এদের মিলিত জনসংখ্যা চা-বাগানে শ্রমিকের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল ছিল। তাছাড়া, স্থানীয় জনজাতিদেরও শ্রমিকের কাজে আগ্রহ ছিল না। তাঁরা কৃষিকাজ ও শিকারকেই জীবিকা হিসেবে পছন্দ করতেন। তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের সমাজ ও জীবনধারা অটুট থাক। আবার অনেকে মনে করেন, ডুয়ার্সের উপজাতির মানুষ চা-চাষের কাজ পছন্দ করেননি, কারণ এ কাজে মজুরি ছিল খুবই কম এবং খাটুনি ছিল মারাত্মক। উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম পর্বে চা শ্রমিকদের মাসমাইনে ছিল তিন টাকা। অসমের বাগানগুলিতেও ছিল একই মজুরি।
এদিকে অসমে ও ডুয়ার্সে কৃষি শ্রমিকেরা মাসে সাত টাকার মতো রোজগার করত। জলপাইগুড়িতে কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল তিন আনা থেকে চার আনা, অর্থাৎ মাসে সেই সাত টাকা। আর সে আমলে জলপাইগুড়িতে সর্বক্ষণের কৃষি শ্রমিক প্রায় ছিলই না। যাদের ছোট জোত ছিল, তারাই নিজের জমিতে কাজ শেষ করে পরে অন্য জোতদারের জমিতে শ্রম দিত। সুতরাং জমির কাজ ছেড়ে কে চা-বাগানের শ্রমিকের কাজে যোগ দেবে? তাছাড়া কাজের শর্তও তো আকর্ষণীয় ছিল না। চা-শ্রমিকের কাজ তো শুধু চা-পাতা তোলা নয়, চা-গাছ ছাঁটাই, কোদাল চালিয়ে জমিকে চাষের উপযোগী করা, এসবও ছিল। আর ছিল ডুয়ার্সের দুর্ভেদ্য অরণ্য সাফ করার মতো খাটুনির কাজ। সাপ, বাঘ, হাতির উপদ্রবের কথা বাদই দিলাম।
আরও পড়ুন: যূথিকা আচার্যের কলমে: নরখাদকের দেশে
প্লান্টার সাহেবদের তাই শ্রমিকের খোঁজে তাকাতে হল বিহার-ছোটনাগপুরের উপজাতিদের দিকে। সাহেবরা শ্রমিক সংগ্রহের জন্য নির্ভর করলেন আড়কাঠিদের (যাকে বলে দালাল) উপর। আড়কাঠিদের শ্রমিক সংগ্রহের প্রধান উপায় ছিল প্রতারণা। বাজারের দিনে, বিশেষত শুঁড়িখানায়, তারা এই সরল সাদাসিধে আদিবাসীদের চা-বাগানের এক কল্পরাজ্যের গল্প শোনাত। বলত, চা-বাগানে কাজ করলে অন্নবস্ত্রের অভাব থাকবে না, বাসস্থানেরও অসুবিধে নেই, কাজ কম, মজুরি বেশি, এমন আরও নানা মিথ্যে কথা! ফলে ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা দলে দলে চলে এসেছিল আসাম এবং ডুয়ার্সের চা-বাগানে।
বহু বহু বছর ধরে রামগড়, পালামৌ, ছোটনাগপুর ইত্যাদি পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা এলাকার আদিবাসীরা স্বয়ংশাসিত ব্যবস্থাতে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করে আসছিলেন। যে পরিবার প্রথম জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করত, সেই পরিবারের প্রধানকে গ্রামের মোড়ল বা প্রধান হিসেবে মেনে নেওয়া হত। এরকম ২৫/৩০টা গ্রাম মিলে তৈরি হত একটা পরগনাইত। এরকম বারোটি পরগনাইতের সমষ্টিকে বলা হত দেশমণ্ডল। এই দেশমণ্ডলের কাজ ছিল অধিবাসীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা, সমাজের নিয়মনীতি রক্ষা করা ইত্যাদি। পরে অবশ্য হিন্দু ভাবধারার প্রভাবে এ অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক ধারণা গড়ে ওঠে। বংশপরম্পরায় শাসিত এসব অঞ্চলের স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থার ক্ষয় শুরু হয় সপ্তদশ শতক থেকে।

এ সময়েই ছোটনাগপুরের আদিবাসী রাজা হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাবধারা গ্রহণ করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা বাড়াতে সচেষ্ট হন। রাজা নিজেকে আর মুন্ডা সম্প্রদায়ভুক্ত বলে পরিচয় দিতেন না, বলতেন তাঁর বংশের উৎপত্তি নাগ দেবতা থেকে। এই পরিবার আশপাশের হিন্দু রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সুত্রে আবদ্ধ হতে শুরু করল। ফলে নিজ আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে এইভাবে রাজপরিবারের একটা দূরত্ব তৈরি হল। এই সূত্র ধরেই বাইরের মানুষেরা, যাদের আদিবাসীরা বলতো ‘দিকু’ বা ‘দিগু’, তাদের প্রবেশ ঘটল এবং তারা আদিবাসীদের জমি হাতিয়ে নিতে শুরু করল। দিকুরা শুধু যে অদিবাসীদের জমি আত্মসাৎ করল তাই নয়, এরা রাজার অধীনে বড় বড় শাসনকার্যের সঙ্গে যুক্ত পদগুলিও দখল করে নিল। শুধু হিন্দু নয়, মুসলমান, শিখ প্রভৃতি ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষও ব্যবসাসূত্রে এ অঞ্চলে এসে আদিবাসীদের জমিহারা করেছিল।
১৭৬৫ সালে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ছোটনাগপুর অঞ্চল লিজ় নেয়। ইংরেজদের আগমনের ফলে আদিবাসীদের অবস্থা হল আরও করুণ। মুন্ডা, ওরাওঁ প্রভৃতি আদিবাসীরা ছিল অত্যন্ত সরল। পুঁথিগত শিক্ষা বলেও তাঁদের কিছু ছিল না। সুতরাং জমিজমা সংক্রান্ত জটিল দলিল-দস্তাবেজ তাঁরা বুঝতেন না। ফলে যা হবার তাই হল। ধীরে ধীরে এঁরা রূপান্তরিত হলেন কৃষি শ্রমিকে। সম্পূর্ণ স্বয়ংশাসিত আদিবাসী সমাজ ভেঙে গেল। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের পাশ করা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঐ সময়ে এ অঞ্চলে প্রয়োগ করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ১৮২৩ সালের পর থেকে এ অঞ্চলেও জমিদারি প্রথার পত্তন শুরু হল। এবং তারই সূত্র ধরে বসল নানাবিধ কর। এমনকী মহুয়া গাছের উপরও কর বসানো হয়েছিল। অথচ এই গাছগুলি ছিল আদিবাসীদের কাছে প্রকৃতির দানের মতো। এরপরেই আদিবাসীরা একের পর এক বিদ্রোহে সামিল হয়, কিন্তু সে অন্য ইতিহাস।
দিকুদের অত্যাচার ও ইংরেজদের কুশাসনের সঙ্গে আদিবাসীদের সর্বনাশের আর একটা কারণ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ১৮৭৩-৭৪, ১৮৯৩-৯৪, ১৮৯৭-৯৮ সালে এ অঞ্চল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। এ কারণে দলে দলে মানুষ শ্রমের সন্ধানে নিজভূম ত্যাগ করতে শুরু করে। জমিহারা দুর্ভিক্ষপীড়িত এইসব আদিবাসিদের চা-শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য নজর পড়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। এঁরা যে শুধু দরিদ্র ছিলেন তা-ই নয়, ছিলেন অনুগত এবং অমানুষিক জীবনযাপনেও প্রস্তুত। সুতরাং ১৮৯১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা থেকে দলে দলে মানুষ, বিশেষত ওঁরাও ও মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষ ডুয়ার্সে চলে আসে।
অসমের চা-বাগানের পত্তন হয় ১৮৩৯ সালে আর ডুয়ার্সে ১৮৭৪ সালে। স্বাভাবিকভাবেই অসমে নিয়োগের ক্ষেত্রে এইসব পরিযায়ী শ্রমিকেরা অনেক বেশি বঞ্চিত হয়েছিলেন, অনেক বেশি দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন। আড়কাঠিদের দেখানো মিথ্যা স্বপ্নে ভুলে তাঁরা দীর্ঘ কষ্টকর যাত্রাশেষে চা-বাগানে পৌঁছে দেখতেন, সেখানে ন্যূনতম বসবাসের জায়গা অথবা স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থা নেই। মালিকদের চরম অত্যাচারের বিরুদ্ধেও তাঁদের করার কিছু ছিল না। চুক্তিপত্রে তাঁদের সই করিয়ে নেওয়া হত এবং বহু বছরের জন্য তাঁরা একরকম ক্রীতদাসে রূপান্তরিত হতেন। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে যে ১ মে ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ সালের মে মাসের মধ্যে আগত ৮৪,৯১৫ জন কুলির মধ্যে ৩১, ৮৭৬ জনই মারা গিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে ‘অভিবাসী আইন’ পাশ হবার পর থেকে অবস্থার কিছু সদর্থক পরিবর্তন হয়।
আরও পড়ুন: অমিতাভ রায়ের কলমে: জোয়াই
অসমে আড়কাঠিরা যথেষ্ট বদনাম কুড়িয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই ডুয়ার্সে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছিল সর্দারদের মাধ্যমে। চা-বাগানে নিয়োজিত সর্দারেরা কোনও এক নির্দিষ্ট সময়ে দেশে গিয়ে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে আসত ডুয়ার্সে। এখানে অবশ্য অসমের মতো তাঁদের চুক্তিপত্রে বেঁধে ফেলা যায়নি, ফলে শ্রমিকদের অন্য বাগানে পালিয়ে যাবার সম্ভবনা ছিল। তাঁদের অন্যান্য সরকারি সংস্থায় চাকরি নিয়ে চলে যাবার ক্ষেত্রেও আইনগত অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আদতে কেউই চা-বাগান ছেড়ে যেতে পারেননি কেননা চা-বাগানে তাঁদের কঠিন নজরদারীতে প্রায় বন্দি করে রাখা হত। ডুয়ার্সে যাঁরা প্রথম শ্রমিক হয়ে এসেছিলেন, তাঁরা অসমের শ্রমিকদের মতো নিপীড়নের মুখে না পড়লেও তাঁদের অবস্থাও অসমের তুলনায় খুব একটা যে ভাল ছিল, এ কথা বলা যাবে না। এখানেও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও উপযুক্ত বসবাসের ব্যবস্থার উপর কর্তৃপক্ষ আদৌ নজর দেননি। শ্রমিকরা নিজেরাই সর্দারদের দেওয়া কাঠ, বাঁশ দিয়ে নিজেদের বসবাসের ব্যবস্থা করে নিয়ে ছিল। ডুয়ার্সে কালাজ্বর ও ম্যালেরিয়ায় অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৯১১ সালে ‘ডুয়ার্স এনকোয়ারি’ কমিটির প্রতিবেদন এই ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দিয়েছিল।
এদিকে ছোটনাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা থেকে যে সমস্ত শ্রমিকরা ডুয়ার্সে এলেন, এ অঞ্চলে তাঁদের নাম দেওয়া হোল মদেশীয়া। এঁরা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাভাষীর বিভিন্ন কৌমের মানুষ, নৃতাত্ত্বিক বিচারে মূলত প্রোটো-অস্ট্রোলয়েড বা আদি দক্ষিণ নর-গোষ্ঠীর মানুষ। এই মদেশীয়া শ্রমিকদের মধ্যে যাঁরা নিজস্ব সাম্প্রদায়িক চরিত্র বিসর্জন দেননি, তাঁরা ট্রাইব বা জনজাতি হিসেবে চিহ্নিত হন। আর যাঁরা নিজস্ব জাতিসত্তা ও রীতিরেওয়াজ, সংস্কার বিসর্জন দিয়ে হিন্দু সমাজে মিশে যান, তাঁরা জাতি বা কাস্ট হিসেবে পরিচিত হন। তাঁদের মাতৃভাষার নাম সাদরি। এইসব আদিবাসীরা যখন স্বদেশ ছেড়ে এসেছিলেন, অনুমান করা হয় তখনই তাঁরা তাঁদের সঙ্গে সাদরি ভাষাটিকে ‘লিঙ্ক ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা যোগাযোগ রক্ষার ভাষা হিসেবে সঙ্গে করে এনেছিলেন। আদিবাসীরা সকলে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সদস্য হলেও প্রত্যেকের আলাদা আলাদা মাতৃভাষা ছিল। কিন্তু এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ভাষা বুঝত না। এ কারণে সকলের কাছেই বোধগম্য একটি ভাষার প্রয়োজন ছিল। সাদরি ভাষা ডুয়ার্সে এই প্রয়োজন মিটিয়েছিল।
আমরা যতদিন এই মদেশীয়া শ্রমিকদের দেখেছি, ১৯৮০-৮২ সাল পর্যন্ত, তখনও এঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা, সংস্কার এবং নিজস্ব স্বভাব লক্ষ করেছি। এঁরা টোটেম চিহ্নধারন করতেন। নানারকম অলৌকিকে বিশ্বাস করতেন। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী মদেশীয়ারা পূর্বপুরুষের পুজো করতেন। এঁদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রচার হওয়ায় অনেকেই খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁরা অন্যদের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন এবং এঁদের পোশাক পরিচ্ছদও ছিল অনেক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এঁরা নিয়মিত চার্চে যেতেন। সামাজিক উৎসবে অংশগ্রহন করতেন। খ্রিস্টানদের বাদ দিলে বাকিরা নিজেদের হিন্দু সমাজভুক্ত ভাবতেন এবং হিন্দুদের মতো জাতপাত মানতেন। তবে এঁরা বৈদিকমতে মূর্তিপুজো ও মন্ত্রোচ্চারণ করতেন না। আগেই লিখেছি এঁরা পূর্বপুরুষের পুজো করতেন। তাছাড়াও পাথর, মাটি, গাছ, ভূত-প্রেত-অপদেবতা — এঁদেরও পুজো করতেন।

বর্তমানে বিশ্বায়ন, শিক্ষার প্রসার, প্রযুক্তির হানা মদেশীয়াদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে চিরকালই এঁরা নতুন কিছুকে চট করে অস্বীকার করেন না। তবে তাঁর পরেও ভূতপ্রেত, ডাকিনীবিদ্যা, গুণীনতন্ত্র, ঝাড়ফুঁক এসবের প্রভাব থেকে তাঁরা এখনও মুক্ত নন। মদেশীয়া সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ শ্রমবন্টন রয়েছে। নারীদের জন্য বিশেষ কিছু অধিকারও রয়েছে। কিন্তু যৌন ব্যাভিচারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই কঠিন শাস্তির মুখে পড়তে হয়। পুজো কিংবা ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে পুরুষরাই প্রধান ভূমিকা নেয়। পঞ্চায়েত ও স্বসাশন আদিবাসী সমাজের ভিত্তি। হাড়িয়া পান ও সমবেত নৃত্যগীত ব্যতিরেকে আদিবাসীদের অনুষ্ঠান অসম্ভব। এঁরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করলেও, স্বাস্থ্যসচেতনতা প্রায় নেই। তবে অপরাধপ্রবণতা এঁদের মধ্যে কম। খুন জখম বা চুরি ডাকাতি বড় একটা দেখা যায় না। পেশাগতভাবে ভিক্ষুকও এ সমাজে নেই।
চা-বাগানে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গিয়েছে সামাজিক সম্পর্কও। চা-বাগানে এসে নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীভিত্তিক বাসস্থান তারা পায়নি। চা শ্রমিকদের অন্য কোনও জীবিকার ব্যবস্থাও নেই। একটা নির্দিষ্ট স্থানে (বলা হয় কুলি লাইন) ভাষা-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে এক সঙ্গে বসবাস করেন। একইরকম প্রাসাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থায়। এখন অবশ্য অনেক মদেশীয়া শ্রমিক প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। অনেকেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে চা-বাগানে বাবুর কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন, যা এক সময়ে ছিল বাঙালিদের একচেটিয়া। তাছাড়াও মদেশীয়া পরিবারের অনেক মানুষ আজ, রেল, বন বা সরকারের বিভিন্ন দফতরে চাকরি পাচ্ছেন। তবু পরিবারের একজন হয়তো রয়ে গেছেন সেই চা-বাগানেই।
*তথ্যঋণ:
১.সান্যাল মানিক/ চা-শিল্প ও শ্রমিক আন্দোলন /পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
২.তিরকি মনোহর / জলপাইগুড়ির আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতি/ পশ্চিমবঙ্গ: জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা/তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ/পশ্চিমবঙ্গ সরকার/১৪০৮।
৩.চক্রবর্তী সমীর / উত্তরবঙ্গের আদিবাসী চা-শ্রমিকের সমাজ ও সংস্কৃতি/মনীষা/অক্টোবর ১৯৯২।
৪..Bhowmik Sharit / Class formation in Plantation System/People’s Publishing House/1981.
৫. দাশগুপ্ত অপূর্ব / ডুয়ার্সের চা বাগান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি/সমাজ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি পরিচয় / দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা,ফেব্রুয়ারি,২০১৫।
৬.বিষ্ণু সুধীর কুমার/সাদরি: আদিবাসী চা শ্রমিকদের ভাষা/অর্পিতা প্রকাশনী,১ কে রাধানাথ মল্লিক লেন, কলকাতা-১২/১৫ই এপ্রিল,২০১১।
অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।