এমন কিছু মানুষ থাকেন, জীবনে তাঁদের সঙ্গে কোনওদিন পরিচয় হয়নি, কিন্তু দেখা হয়েছে বারবার, আলাপ হয়েছে গভীরভাবে। ছোট থেকে বড় হওয়ার চলার পথে তাঁরা জড়িয়ে থেকেছেন, আগলে রেখেছেন, জীবনস্মৃতির শীতলপাটিতে নকশা বুনেছেন অজান্তেই। অবরে সবরে সেই শীতলপাটি বিছিয়ে মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিতে নিতে আকাশের মাঝে প্রিয়জনদের মুখ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যাওয়া সেইসব অনামী দিনে ফিরে যাওয়া সহজ হয়ে ওঠে তাঁদেরই জন্য। তারপর তাঁরা একদিন তারা হয়ে যান, আর টুপটুপ করে খসে পড়ে আমাদের চলতি জীবনের গল্পের ছোট ছোট পরিচ্ছেদগুলো। মনখারাপ আর মনকেমনের জন্য কিছুটা অবকাশ৷ আজ আরও বেশি করে মনে হচ্ছে এসব কথা, কারণ সকালে চোখ খোলার আগেই আটহাজার মাইল দূরে খবর পৌঁছে গেল নিমেষেই, এমন এক মানুষ চলে গেলেন৷  যাওয়ার সময় তো হয়েছিল, ওভারটাইমেই আরও কিছুদিন থেকে গেছেন হয়তো। তবুও তাঁর সঙ্গে চলে গেল আমার এবং আমাদের মতো যারা সত্তর-আশির দশকে বড় হয়েছি, ছোটবেলার কিছু অমূল্য টুকরো, আর আমাদের সাদাকালো বোকা বাক্সের অ্যাডিকশন। 

যৌথ পরিবার আর নেই, পুরনো তোষক বিছানা বালিশের আরাম ছেড়ে আমরা ছারপোকারা ছড়িয়ে গেছি, হারিয়ে গেছি। কিন্তু মাধুকরী মন, পুরনো লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে জমানো ‘মুঠো তন্ডুল’ অসময়ে মনে করিয়ে দেয় সেই ভরা বসতের ভালোবাসার দিনগুলোর কথা।

কুহেলি, আমার মা, আমাদের মায়েরা 

আমাদের বৈঠকখানা রোডের ফ্ল্যাটবাড়িতে লোক ছিল অনেক, জায়গা ছিল কম। কিন্তু অভাব ছিল না পরিসরের ৷ ‘এটা আমার, ওটা তোমার’ এরকম কোনও কথা যে হতে পারে, জানা ছিল না কারও ৷ রাতের দিকে মা, তিতি, তাতু, কাকু, বাড়ি ফিরলে জমাটি আড্ডা বসত। বড় গ্রামোফোন ছিল সিআইটি রোডের বাড়ি আর ব্যারাকপুরের বাড়িতে ৷ এখানে ছিল এইচএমভি-র ছোট রেকর্ড প্লেয়ার ৷ ইপি না এলপি মনে নেই, বাজছে “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি ” আর আমার সবে দাড়াঁতে শেখা বোন টলমল পায়, চাইনিজ কাট চুলে, হাত ঘুরিয়ে, ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে ৷ এই গানটা শেষ হলেই অন্য গান– ‘তুমি রবে নীরবে’। বড়রা গল্প করেই চলেছেন। আমাদের তখন সরব দাবি– আবার ‘মেঘের কোলে’, চাই৷ অরিগামির প্রথম পাঠ ঠাম্মার কাছে পুরনো কাগজ দিয়ে “কেয়া পাতার নৌকো” গড়া৷ একটু বড় হয়ে জেনেছি সেটা সিনেমার গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত৷ সিনেমার নাম ‘কুহেলি’৷ সাদাকালো ছবির গানটা ইউটিউবে চালালে, পিয়ানোর মহিলাটি এক্কেবারে আমার মা। সেরকম বুফঁ করা চুলের খোঁপা, ক্যাটস আই চশমা চোখে, স্টাইল স্টেটমেন্টে আমার সেদিনের মা। আমাদের অনেকের মা।

Kuheli by Tarun Majumdar
কুহেলি ছবির পোস্টার
মুভিং ইমেজেস, বিভেদ গেল ঘুচে 

ইন্ডিয়া পর পর দুটো টেস্ট হেরেছে (এসব কথা অক্ষরে অক্ষরে মনে নেই, ঝালিয়ে নেওয়া।) তৃতীয় টেস্ট না জিতলে পুরো সিরিজটাই মাটি; তাই ইডেনের ম্যাচ ঘিরে সাংঘাতিক উত্তেজনা। পতৌদির টিমকে জিততেই হবে। ক্লাইড লয়েডের টিমে তখন ভিভ রিচার্ডস, ঝাঁকড়া চুলের কালীচরণ, আরও কত কে ৷ ঘোষণা করা হল পরীক্ষামূলকভাবে কলকাতায় টিভি চালু হবে৷ হইহই কাণ্ড| হুজুগে বাড়ির সবার তখন বাটা কোম্পানির ‘পুজোয় চাই নতুন জুতো’-র মতন, ‘বাড়িতে চাই নতুন টিভি’-র আব্দার৷ দিল্লিতে প্রথম দেখেছিলাম, এখন আমাদের বাড়িতেও আসবে৷ দল বেঁধে নিউ মার্কেটের কাছে এলিট সিনেমার গায়ে, কাবেরী-কর্ণাটক এম্পোরিয়ামের পাশের এক দোকান থেকে ‘ওয়েস্টন টিভি’ নিয়ে আসা হল৷ বাড়ির ছাদে বসল অ্যালুমিনিয়মের অ্যান্টেনা৷ কাকেরাও অবাক, আমরা তার চেয়েও বেশি। বড় বড় সিনেমার পর্দা ছাড়াও ঘরের ভেতরের মুভিং ইমেজেস-এর সঙ্গে হল হাতেখড়ি। ব্যাপকভাবে ইন্ডিয়া জিতে গেল। দূর সম্প্রসারণে কলকাতার হল প্রোমোশন৷ সিনেমাও পা বাড়িয়ে নিশ্চিন্তে নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ল আমাদের বসবার ঘরে৷  ৯ আগস্ট ১৯৭৫ সাল থেকে শনি-রবিবার হলেই বেশ উৎসব উৎসব ব্যাপার। শুধুমাত্র ছোটদের সিনেমা বলে তখন আর ভাগাভাগি নেই। শনিবার হলেই সন্ধ্যেবেলা ছোটবড় সবাই বাক্সটার সামনে জড়ো। নিজের বাড়ি, পরের বাড়ি, পাশের বাড়ি, পাড়ার বাড়ি সবার অবারিত দ্বার৷ ‘রামমোহন’ সিনেমা দিয়ে শুরু। তারপর পাতা উল্টে বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাদাকালো নড়েচড়ে বেড়ানো বইগুলো মেলে ধরল অন্য জগৎ৷ আর পাশাপাশি ছিল রেডিওতে অনুরোধের আসর।

“হরিদাসের বুলবুল ভাজা টাটকা তাজা খেতে মজা”, গানটা আমরা ভাইবোনেরা যে কতরকমভাবে নেচে হেসে গেয়ে উঠেছি, কতরকম বিভিন্ন কারণে… কারণগুলো অকারণ হয়ে হারিয়ে গেছে ৷ চৌকো খবরের কাগজ কেটে পাকিয়ে, কোণাচে ঠোঙাতে মুড়ি-ছোলাভাজা মাখা খাওয়া হয়েছে। পুঁচকে ভাইটা বিকেলে ঘটা করে বুলবুলভাজা বানিয়ে নিজেই স্বঘোষিত হরিদাস! খুচরো পয়সা নিয়ে পকেট ভরিয়ে ফেলত দিব্যি ৷ ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ মুক্তি পাবার বহু বহু বছর বাদেও গানটা কখনও পুরনো হয়নি৷ 

আর তখনও সিনেমার পরিচালক কে, তাই নিয়ে অত মাথাব্যথাও ছিল না। স্কুলের উঁচু ক্লাসে ওঠার পর কুইজ় নিয়ে মাতামাতির সময় আস্তে আস্তে সেসব মানুষদের নামের সঙ্গে পরিচিত হতে শিখলাম৷ একদিন ‘চিত্রমালা’ চলার সময় আমাদের সে কী হাসি৷ মিষ্টি মহুয়া গয়নাগাটি পরে গান গাইছেন, ‘সখি ভাবনা কাহারে বলে, সখি যাতনা কাহারে বলে, সখী ভালোবাসা কারে কয়”… এদিকে আমাদের হাসির রোল। কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল কে কটা ছেলের নাম বের করতে পারে। “আমার চোখে তো সকলই শোভন/ সকলই নবীন, সকলই বিমল/ সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন..,”  সেই থেকে রবিঠাকুর আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। আরে! শুধুই সিরিয়াস না, বেশ ভালোবাসাবাসির গানও তৈরি করেছেন তো!

দল বেঁধে নিউ মার্কেটের কাছে এলিট সিনেমার গায়ে, কাবেরী-কর্ণাটক এম্পোরিয়ামের পাশের এক দোকান থেকে ‘ওয়েস্টন টিভি’ নিয়ে আসা হল৷ বাড়ির ছাদে বসল অ্যালুমিনিয়মের অ্যান্টেনা৷ কাকেরাও অবাক, আমরা তার চেয়েও বেশি। বড় বড় সিনেমার পর্দা ছাড়াও ঘরের ভেতরের মুভিং ইমেজেস-এর সঙ্গে হল হাতেখড়ি। ব্যাপকভাবে ইন্ডিয়া জিতে গেল। দূর সম্প্রসারণে কলকাতার হল প্রোমোশন৷ সিনেমাও পা বাড়িয়ে নিশ্চিন্তে নির্দ্বিধায় ঢুকে পড়ল আমাদের বসবার ঘরে৷  

শনিবারের সিনেমা ‘কাচের স্বর্গ’, সত্যিকারের গল্পতেই লেখা থাকে সব চরিত্র কাল্পনিক। আর এ গল্পের শুরুতেই লেখা কোনও কাল্পনিক নয়, সত্য চরিত্রের ভিত্তিতেই নির্মাণ৷ সত্যিকারের ডাক্তারের সেই পরিচয়। মানুষ বাঁচানোর ব্রত নিয়েছেন যাঁরা, হিপোক্রেটাসের শপথ নিয়ে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত শেষ চেষ্টা করে যাবেন অসুস্থকে সুস্থতার পথে নিয়ে যাওয়ার। ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে’ গানটা আমাদেরও প্রাথর্নাসঙ্গীত হয়ে উঠল সেই থেকে ৷ পিসি, ঠাকুমা, মা, ভাইবোন সবাই গেয়ে উঠতাম আমরা লোডশেডিংয়ের বারান্দায়৷ 

ছোটদের বই, বড়দের বই

মায়ের অফিসে শনিবার হাফ ডে থাকত৷ মানি, আমার বড়মাসি, আর মা ছিলেন বেস্ট ফ্রেন্ড ফরএভার। শনিবার অফিসের পর বৃন্দাবন মল্লিক লেনের দিদির বাড়ি উপস্থিত হতেন মা, তারপর বিকেলে যাওয়া হত শ্যামবাজার বা কলেজ স্ট্রিট ৷ টুকটাক বাজারহাট সেরে বাড়ি ফেরা। সিনেমা দেখা হত মাঝে মাঝে। কিন্তু সব ‘বই’ তো ছোটদের না, তাই আমাকে বোঝানো হত ডাক্তার দেখাতে যেতে হবে। আমি থাকতাম পাশের বাড়ির মধুমামির কাছে ৷ ‘হোটেল স্নোফক্স’-এর নামটা ফিশফিশ শব্দেও কেমন করে যেন কানে পৌঁছে গেছিল। কিছুতেই ছাড়ব না সেদিন, কারণ ভেবেছিলাম বেশ দারুণ জায়গায় ভালো মোগলাই পরোটা খেতে যাচ্ছেন দুজনে। অনেক পরে জেনেছি, হোটেলের বার-এ নাচগান করেন যাঁরা, তাঁদের নিয়ে গল্প ৷ সময়টা সেরকমই ছিল। সেইসব মেয়েরা, যাঁরা চাকরি না পেয়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে নাচগান পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, হোটেলের অতিথিদের মনোরঞ্জন করার জন্য তাদের বারবনিতার পরিচয় দিয়েছিল সমাজ। বারবার তরুণ মজুমদারের ছবিতে সেই ষাট সত্তর দশকের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজের ছবি উঠে এসেছে। ‘এখানে পিঞ্জর’-এর মতন ছবিতে দেখেছি অভাবের দায় অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা কীভাবে বিপথগামী হয়। ‘হোটেল স্নো ফক্স’-এ চাকরি হারিয়ে মেয়েটিকে ক্যাবারে ড্যান্সারের কাজ শুরু করতে হয়, ‘ঠগিনী’-তে নতুন বউ সেজে বর ঠকাতে হয়। সমাজ পারেনি তাঁদের আশ্রয় দিতে।

Tarun Majumdar Filmmaker
বই থেকে ছবি-তে উত্তরণ অনায়াসে হত তরুণবাবুর সিনেমায়
সাহিত্যসাথে যোগে যেথায় বিহার

আমাদের বাড়িতে বইপড়ার চল ছিল খুব। উপন্যাস সমগ্র থেকে আনন্দলোক, খেলার আসর, ‘লাইফ’ থেকে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’, কমপিটিশন সাকসেস, কাগজের ঠোঙার ভাঁজ খুলে সেই সব আধখাবলা অক্ষর পড়ে ফেলাটাও যেন জিনগত অভ্যাস। তাই সাদাকালো অক্ষরের লেখাগুলো যখন জীবন্ত হয়ে উঠত, উৎসাহ বেড়ে যেত দেড়গুণ। আমার কাকু, সকলের অভিভাবক, বাড়ির সবাইকে সেইসব ‘বই’ দেখাতে নিয়ে যেতেন এখনকার ধুলো হয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলিতে। পূরবী, ছবিঘর, অরুণা, রাধা, প্রাচী, পূর্ণ, উত্তরা, উজ্জ্বলা ছিল আমাদের উৎসবের আঁতুড়ঘর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিমল কর, বনফুল, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল রায়, সুবোধ ঘোষ এরকম অজস্র বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিকের লেখাকে পরিচালক হয়ে রুপোলি পর্দায় হাজির করেছেন, বারবার… আমাদের প্রিয় ঘরোয়া তরুণ মজুমদার।

অ্যামনেশিয়া

শনিবার দুপুরে মা অফিস থেকে ফিরলে, খাওয়াদাওয়া সেরে মায়ের পাশে শুয়ে গল্প শোনা, বড্ড আরাম। আমার মা খুব সুন্দর করে আস্তে আস্তে গল্প বলতেন। বিখ্যাত দেশ বিদেশের সাহিত্যিকদের লেখা গল্প যেমন বলতেন সহজ করে, ছোট করে,  আবার অনেক পুরনো-নতুন সিনেমার গল্পও শোনাতেন ৷ কখনও খুকখুক করে হাসতাম, আবার কখনও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতাম ৷ কত কিছু শিখতাম, না শেখার ছলে। একবার দুই যমজ বোনের গল্প শুরু করলেন। ট্রেন দুর্ঘটনায় এক বোনের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে শুনতে কেঁদেছিলাম। মা ভরসা দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যায় ৷ একে বলে অ্যামনেশিয়া– টেম্পোরারি মেমোরি লস ৷ হাতেখড়ি হয়েছিল Etymology-র সঙ্গে, শব্দের উৎস সন্ধানের পথ চেনার উপায়। জেনেছিলাম ‘amnesia’ কথার উৎস গ্রিক ভাষায়, যার মানে বারবার ভুলে যাওয়া। সোজা ইংরেজিতে forgetfulness। নানা ভাষার পরিধি এইভাবে মিলে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ৷ সিনেমার নাম, ‘স্মৃতিটুকু থাক’। অনেক পরে, আমাদের সেই বোকাবাক্সে, কোনও এক শনিবার সন্ধ্যায় সেই সিনেমা দেখে আরও অবাক হয়েছিলাম, দুই বোনের চরিত্রেই সুচিত্রা সেন ৷ উফ্ ক্যামেরার কী কারিকুরি! 

Tarun Majumdar film
উজ্জ্বলাতে শেষ তরুণ মজুমদারের ছবি দেখা ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’
পাড়ার ছোট্ট দোকানগুলো

‘ফুলেশ্বরী’ ছবিটা খুব মনে আছে গানের জন্য। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ পেরিয়ে আরও কিছুটা গেলে, শিয়ালদা স্টেশনের এপারে ছবিঘর সিনেমা হল। তখনকার স্মৃতি মনে থাকার কথা নয় একেবারেই, তবুও কীভাবে যে মনে আছে জানি না। বা হয়তো মনে নেই, পরে টিভিতে দেখার স্মৃতিটাই মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। ছবিঘরের ঠিক পাশেই দুটো দোকান ছিল, রুবি সাইকেল স্টোর আর সেন্ট্রাল সাইকেল স্টোর, আর সেসব দোকানে সাইকেলের পাশাপাশি রেকর্ডও বিক্রি হত ৷ কাকুর সঙ্গে স্কুটারে চেপে গেলেই দুই দোকান থেকেই হাঁকডাক ৷ বসিয়ে চা বিস্ফুট ও খাওয়াতেন আর দু’দোকান থেকেই সবরকমের রেকর্ড কেনা হত। কী সুন্দর সম্পর্ক ছিল ক্রেতা, বিক্রেতা এমনকী প্রতিযোগী বিক্রেতাদের মধ্যেও!  ‘ফুলেশ্বরী’র গানের রেকর্ড থেকে একটা গানের একটা কলি থেকে গেছে সেই সেদিন থেকেই। 

“যেও না, দাঁড়াও বন্ধু, আরো বলো দু’কথা
হংসপাখায় পাক লাগে কি সরস্বতীর আসন যেথা”

আজীবন ঈশ্বর না মানলেও, মানুষের শিক্ষাদীক্ষা ঠিক থাকলে সত্যি করেই কোনও কুকথা কোনওদিন ছুঁতে পারে না।  এখনও এ কথাকে সমান সত্য বলে মানি। ভাগ্যিস হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তরুণ মজুদার, মান্না দে, পুলক বন্দোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মুকুল দত্ত, সুধীন দাশগুপ্তের মতো আরও এমন সব মানুষেরা ছিলেন একসঙ্গে, আমাদের সময়।

পুরনো পাড়া, পুরনো হল

বড় হয়েছি শহরের বেশ খানিকটা জুড়ে৷ এদিকে আমহার্স্ট স্ট্রিট-বাদুড়বাগান, ওদিকে বৈঠকখানা, হ্যারিসন রোড, বৌবাজার, কলেজ স্ট্রিট, ওয়েলিংটন, নিউ মার্কেট অবধি যাওয়া-আসা যত্রতত্র, অন্যদিকে সিআইটি রোড, পার্কসাকাস, পার্ক স্ট্রিট, গড়িয়াহাট, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর অবধি। লালবাজারও ছিল বেশ পরিচিত। শ্যামবাজার, বাগবাজার, ডানলপ গড়িয়ে গাড়িপথে বা ট্রেনপথে চাকদহ রানাঘাটেও ছিল অবাধ যাতায়াত৷ আর নানারকম সিনেমা হলে বাড়ির সবাই মিলে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছিল আমাদের উৎসবের দিন। ঠাকুমা, পিসি, কাকিমা, জেঠিমা বাবা, কাকু, মাসি, মামা এমনকী বাড়ির অন্য পরিজনেরা, যাঁরা আমাদের দেখাশোনা করতেন, রান্নাবান্না, স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন, তাঁরাও বাদ যেতেন না।

পূরবী আর ব্যারাকপুরের অতীন্দ্র– সম্ভবত, এই দুই হল মিলিয়ে ‘দাদার কীর্তি’ দেখেছি বোধ হয় আটবার। গোটা সিনেমাটাই পুরো মুখস্থ হয়ে গেছিল। ভাইবোনরা মিলে চিত্রাঙ্গদার প্রোডাকশন নামিয়ে ফেলেছিলাম বাড়ির সরস্বতী পুজোয়৷ আর আমাদের ন্যাকা সং, ইউনিভার্সাল উত্তর হয়ে উঠেছিল ‘বয়েই গেছে, তোমার ডাকে সাড়া দিতে’…। মহুয়া, তাপস, অয়ন, দেবশ্রী আমাদের সব হিরো হিরোইন হয়ে উঠলেন। সঙ্গে অনুপকুমার, রবি ঘোষরা। জীবনটা রঙিন হয়ে উঠতে থাকল। প্রেম প্রেম ভাব জাগতে থাকল মনে। প্রাচীতে বহুদিন চলেছে ‘অমরগীতি’, স্কুল থেকে ফেরার পথে বাস থেকে ঠিক নজরে পড়ত, জুড়িগাড়ির ছবিটা ব্যানার জুড়ে। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের টপ্পা, ততদিনে রেকর্ডের বদলে টেপ রেকর্ডারে ক্যাসেট বাজছে। আমরা বড় হচ্ছি আর দিনগুলো বদলে যাচ্ছে।

ভালোবাসা ভালোবাসা

যখন ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ মুক্তি পেল তখন শিওর শট, একবারে কিছুই ভরসা নেই, ডবল ভেরিফাইড করে নেওয়া দরকার, আমাদের রবি ঠাকুর অবধি তাই বলে গেছেন। ব্যাস, এরপরই ঝুপ করে বড় হয়ে গেলাম, উজ্জ্বলাতে সেই শেষ তরুণ মজুমদারের ছবি দেখা। সত্তর, আশির দশক পেরিয়ে, নব্বইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম আর ছোটবেলার দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। হারিয়ে গিয়েও অনেক কিছু হারায় না, মনের ক্যামেরায় চাইলেই সুন্দর সুন্দর অ্যালবামে সাজিয়ে রাখা যায় আর ইচ্ছেমতন বের করে স্মৃতিদের সঙ্গে আঁকিবুকি কাটা যায়। তরুণবাবু, আপনি ছিলেন বলেই অ্যালবামগুলো আজও এত মনোরম। আর এভাবেই আপনিও থেকে যাবেন স্মৃতির অ্যালবামের পিছনপাতায়, গানেগল্পে ভালোবাসা ভালোবাসায়।

 

*ছবি সৌজন্য: Dhakatribune, Imdb, Wikipedia

Mousumi-Dutta-Ray Author

মৌসুমীর জন্ম কলকাতায় হলেও গত তিন দশক ধরে নিউ ইয়র্কই তাঁর বাসস্থান এবং কর্মস্থান। এক্কেবারে বিশুদ্ধ ক্যালইয়র্কার। শুঁটকি মাছ থেকে চন্ডীপাঠ, Grateful Deads থেকে সুপ্রীতি ঘোষ আর এই diasporic dichotomy-র জাগলিংয়ে হাত পাকাতে পাকাতেই দিন কাবার। ভালোবাসেন বই পড়তে, ছবি আঁকতে, রান্না করতে, আড্ডা মারতে আর ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন সক্কলকে নিয়ে জমিয়ে বাঁচতে!

10 Responses

  1. দারুন! দারুন ! বড় নস্টজ্যালজিক লেখা। ঝড়ঝড়ে ভাষায় মন ভালো করা আর খারাপ করার স্মৃতি। আমরা যারা ষাটের দশকে জন্মেছি তাদের কাছে অমুল্য।
    আরও চাই ।
    অরূপ দাশগুপ্ত

  2. অসাধারণ লেখা দিদিভাই। তোমার লেখা টাইম মেশিনে চাপিয়ে ঘুরিয়ে আনলো যেন পূর্বজন্ম থেকে। আরো লেখো। অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *