তন্দুরি চিকেনের নামে আমাদের নোলায় লাগে সুড়সুড়ি। কিন্তু তার মূলে কী, তাই জেনে নেওয়ার চেষ্টায় এই লেখা। অবিশ্যি রেস্তোরাঁর লাল টকটকে তিখা পেস্ট দিয়ে ম্যারিনেট করা তন্দুরি চিকেন মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

‘তন্দুর’ শব্দটি এসেছে ফারসি ‘তনুর’ বা আরবি ‘তন্নুর’ থেকে ৷ এই তন্নুর ঠিক কীরকম তা ইংরেজি পাঠকের কাছে ভেঙে বুঝিয়ে বলছেন বাগদাদ ও মসুল বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপিকা নওয়ল নসরাল্লাহ্– “Domed clay oven for baking flat breads and cookies. It is also used for roasting different kinds of meat and braising and simmering pots and potpies.”

বাড়িতে বা রেস্তোরাঁয় নাকি তন্নুর রাখার সব থেকে ভালো জায়গা হল রান্নাঘরের পূর্বদিকে, তা হলে তা হাওয়া যে দিক থেকে বয় তার উল্টোদিকে থাকবে৷ অবশ্যই কারণটি বিজ্ঞানসম্মত। কোনও বাস্তুতান্ত্রিক কারণ খুঁজবেন না প্লিজ। সেরা তন্নুরের ভিতরটা হবে বড়োসড়ো, আর তার গা-টা হবে মাঝারি পুরু৷ তন্নুরের তলার ছিদ্রটার (আয়ন অল-তন্নুর) মুখ থাকবে পশ্চিম দিকে, যাতে যখন সে ছিদ্র খোলা থাকবে তাতে এসে ঢোকে পশ্চিমী  হাওয়া ৷ আর কী কী সরঞ্জাম লাগবে এতে রান্নার জন্য? তাও বলা আছে– একটা আঁকসি (সিন্নার), রুটি যদি তন্নুরের নীচে পড়ে যায় সেটা তোলার জন্য৷ লোহার ডান্ডা (মিহরাক), তন্নুরের আগুন খোঁচানোর জন্য একটা মোটা কাপড়, যা গরম এবং আর্দ্রতা সইতে পারে, তন্নুরের ভিতরটা মোছার জন্য৷ আর তন্নুরের ঢাকা!

Tandoor
তন্দুরি বানাবার উনুন তন্দুর বা তন্নুর

‘পাকরাজেশ্বর’ গ্রন্থে পাওয়া যায় সাত রকমের পাকপ্রণালীর কথা। ভর্জন, তলন, স্বেদন, পচন, ক্বথন, তন্দুর ও পুটপাক। এর মধ্যে দ্বারবদ্ধ গরম যন্ত্রে হয় তন্দুর। একসময় “কন্দুপক্ক” শব্দটি নিয়ে তোলঘোল হয়েছিল। অনেক তর্কের পরে বেদান্ততীর্থ গিরিশচন্দ্র সিদ্ধান্তে এলেন, যে পাত্রে ভাজা হয় তা ‘ভ্রাষট্র’ আর যাতে সেঁকা হয় তা ‘কন্দু’। পরবর্তীকালে পণ্ডিতদের অনুমান এই কন্দুই বর্তমানের তন্দুর। ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ নাটকেও কন্দুর উল্লেখ আছে।

কাঁচা মুরগির মাংস ছাল ছাড়িয়ে নুন, টক দই ও তন্দুরি মশলায় ম্যারিনেট করে গোলমরিচ, লাল লঙ্কার গুঁড়ো, কাশ্মীরি লংকার গুঁড়ো এবং হলুদ বা তিখা পেস্ট দেওয়া হয়। ম্যারিনেশন বেশি হলে মাংস বেশি নরম হবে। এবার ম্যারিনেট করা মাংস ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তন্দুরের গনগনে আঁচে। তারপরের গল্প সবার জানা। যতক্ষণ না পোড়া পোড়া হবে ততক্ষণ রাখতে হবে। মাংসের ভেতর অবধি সেদ্ধ হবে। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ডেকান কলেজের অধ্যাপক বসন্ত শিন্দের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সিন্ধু সভ্যতায় তন্দুরি চিকেনের মতো একটি খাবার ছিল। সিন্ধু অঞ্চলে পাঞ্জাব প্রদেশে ব্যবহৃত তন্দুরের অনুরূপ উনুনের সন্ধান পাওয়া যায়। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর ধ্বংসাবশেষ থেকেও তন্দুরের হদিস পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।  মাটি খুঁড়ে মুরগির পোড়া হাড়ের অবশেষও পাওয়া গেছে। সুশ্রুত সংহিতায় রয়েছে রাই (সর্ষে) গুঁড়ো ও সুগন্ধি মশলা কষে মাখিয়ে উনুনে মাংস রান্নার উল্লেখ।

Tandoori Murg
উনুনে পোড়ানো ম্যারিনেটেড মুরগিই হল তন্দুরি চিকেন

তন্দুর উনুনে আদতে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা হয়। তন্দুরটি কাঠ-কয়লা দিয়ে জ্বালানো হয়, ফলে মাংসে স্মোকি ফ্লেভার আসে। এছাড়া চিকেনের টুকরো বা গোটা মুরগি ধাতব রড দিয়ে ঝুলিয়ে বা জ্বলন্ত কাঠকয়লার ওপরে রাখা হয়। সম্পূর্ণ গ্রিলড চিকেন দিয়ে তন্দুরি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রেসিপি রয়েছে। এর মধ্যে কিছু তন্দুর উনুনে, আর কিছু কাঠকয়লার ওপরে রান্না করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে “ছিড়গা” (ঝলসানো গোটা মুরগি ), “তন্দুরি মোরগ” (কাঠবাদাম মিশিয়ে ঝলসানো গোটা মুরগি ), “মোরগ কাবাব শিখি” (ধাতব রডে ঝুলিয়ে ও পুর ভরা রান্না করা মুরগি), “কুকার তন্দুরি” (ধাতব রডে ঝুলিয়ে রান্না করা সেদ্ধ মুরগি), “তন্দুরি মোরগ মাসাল্লাদার” এবং “মুরগি ভোগর” (ভোগর ধাঁচে রান্না করা মুরগি)।

অতীতের কথা বাদ দিয়েই বলি, পাঞ্জাবে এই তন্দুরি চিকেন রমরমিয়ে ব্যবসা করতে করতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসমুদ্রহিমাচলে এখন তার ব্যাপ্তি। তবে আরবি ফারসি সব তথ্য মেনেই বলা যায়, ভারতে এই তন্দুরি চিকেনের জনপ্রিয়তার মূলে যিনি, তিনি হলেন কুন্দনলাল গুজরাল। জনপ্রিয় ‘মোতিমহল’ রেস্তোরাঁর গ্লোবাল চেইনের মালিক, এমন দাবি কুন্দনলালের নাতি মণীশ গুজরালের।  

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে অবিভক্ত পাঞ্জাবের চাকওয়াল শহরে, সম্ভবত ১৯০২ সালে বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম কুন্দনলালের। ব্যবসায় মন্দা দেখা দিতে বাধ্য হয়েই পেশোয়ারের গোরাবাজারে মোখা সিং লাম্বা বলে একজনের এক তন্দুর রেস্তরাঁয় কাজ নিতে হয়। সেখানেই তাঁর প্রথম আলাপ তন্দুরের সঙ্গে। ঐতিহাসিক কাল থেকেই তন্দুর মূলত ব্যবহার হত রুটি বানানোর কাজে। মুঘল আমলে তন্দুরে মাংস পোড়ানোর রীতি থাকলেও সেই মাংস প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় পোড়ানোর ফলে শক্ত হত খুবই। কারণ ম্যারিনেশনের আদবকায়দা মুঘলদের জানা ছিল না।

Tandoori-Chicken-in-Oven
এখন অবশ্য নানারকম ইলেকট্রিক চুল্লিতেই তন্দুরি বানানো চলে

পেশোয়ারের সেই রেস্তরাঁয় মাটি খুঁড়ে একটা তন্দুর বানানো হয়েছিল। আর সেখানেই মুরগি বিভিন্নভাবে ম্যারিনেট করে তন্দুরে ভরে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন কুন্দনলাল। মোখা সিংয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় কুন্দনলাল রেস্তরাঁর দায়িত্ব নেন। রেস্তোরাঁর নতুন নাম হয় মোতিমহল। আর এই সময়েই দই এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে চিকেনকে ম্যারিনেট করার ব্যাপারটা পুরোপুরিভাবে রপ্ত করে ফেলেন কুন্দনলাল। তৈরি হয় এক ঐতিহাসিক রেসিপি। তন্দুরি চিকেন। পৃথিবীর প্রথম তন্দুরি চিকেনের আস্বাদ পায় পেশোয়ারবাসী। দোকানের ব্যবসা আর ব্যপ্তি দুইই বাড়ল।

কিন্তু এরপর দেশভাগের ক্ষত তাড়া করল তাঁকে। হিন্দু হিসেবে পাকিস্তানে থাকা নিরাপদ হবে না ভেবে ১৯৪৭ সালের ভয়াবহ দাঙ্গায় সবকিছু ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমালেন কুন্দনলাল। স্ত্রী আর বারো বছরের সন্তানকে নিয়ে। কিছুই আনতে পারেননি। এনেছিলেন শুধু তন্দুরি চিকেন বানানোর অনন্য স্কিল। আশ্রয় মিলল এক ত্রাণ শিবিরে। আবার শুরু হল লড়াই। ইচ্ছে ছিল রেস্তরাঁ বানাবেন। আরও অনেক পাঞ্জাবি হিন্দু সেসময় দিল্লিতে। অনেকে কুন্দনলালের চেনাও। এরকমই আর এক কুন্দনলাল, জাগগী আর ঠাকুরদাস এই তিনজন মিলে দিল্লির দরিয়াগঞ্জ এলাকায় ধাবা খুললেন। সেই পেশোয়ারের ছেড়ে আসা স্মৃতি নিয়ে। এখানেই ভারতবর্ষের প্রথম তন্দুরি চিকেন বিক্রি করা শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে এত বিক্রি হয়, যে পাশের একটা জমি কিনে মোতিমহল চারশো লোক বসার মতো রেস্তরাঁ তৈরি করে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে নাম।

পন্ডিত নেহরু প্রথমবার মোতিমহলের খাবার খেয়েই তাকে এত ভালবেসে ফেলেন যে সমস্ত বিদেশি ডেলিগেটদের নিয়ে যেতেন সেখানে। প্রায় সমস্ত মিটিংয়ে খাবার যেত মোতিমহল থেকে। নেহেরু থেকে ইন্দিরা গান্ধী, রিচার্ড নিকসন থেকে জেএফ কেনেডি সেখানে মুরগির ঠ্যাং চিবিয়েছেন সাগ্রহে। অচিরেই ভারত, মার্কিনদেশ আর ইউরোপে কম করে ১২০টি শাখা খোলা হল মোতিমহলের আর সে কৃতিত্ব কুন্দনলালের নাতি মণীশ গুজরালের।

Tandoori Roti
তবে তন্নুরের মূল কাজ ছিল রুটি পাকানোতেই

তবে এই তথ্যের সঙ্গে সহমত হননি খাদ্য গবেষক, কাবাব কিসসা গ্রন্থের রচয়িতা নীলাঞ্জন হাজরা। তাঁর মতে, মোতিমহল রেস্তোরাঁটির আদতে কোনও শাখা নেই। এ রেস্তোরাঁ খোদ কুন্দনলালের কাছ থেকে বিনোদ চাড্ডা কিনে নেন ১৯৯১ সালে। অবিশ্যি মণীশ গুজরাল নিজস্ব অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করে একটি বই লিখে প্রকাশ করেও ফেলেন যার নাম “অন দ্য কাবাব ট্রেইল: আ মোতিমহল কুকবুক” (পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া)। সেখানে তিনি জানান, তন্দুরি চিকেন এবং তন্দুরি ক্যুইজিন তাঁর দাদু কুন্দনলালের আবিষ্কার। আর নীলাঞ্জনবাবুর আপত্তি সেখানেই।

অবিশ্যি ভারতে এই তন্দুরিকে নিয়ে আসা এবং জনপ্রিয়তা আর প্রচার বাড়ানোর মূলে মোতিমহলকে অস্বীকার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। যদিও তন্দুরি যে তারও বহু বহু আগের রন্ধনপদ্ধতি তা জানিয়েছেন নীলাঞ্জনবাবু। তাঁর মতে, কুন্দনলালের জন্মের ১০০০ বছর আগে আবু মহম্মদ অল মুজ্জফর ইবন নাসির ইবন সইয়ার অল- ওয়াররাক নামে এক কলমচি সে যুগের বাগদাদি বড়লোকেদের খানাপিনা নিয়ে “কিতাব অল-তবিখ” নামে এক সংকলন লেখেন। সেই বইতে তন্নুর বা Tannur শব্দের উল্লেখ আছে ১৪টি জায়গায়। আর আগেই বলেছি অধ্যাপিকা নওয়ল নসরাল্লাহ্-এর ইংরেজি অনুবাদও মিথ্যে হবার নয়। অতএব আশাকরি তন্দুরির অন্দরে প্রবেশ করে এতক্ষণে পাঠকের চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল। 

 

*তথ্যসূত্র: 
কাবাব কিসসা (ধানসিড়ি) / নীলাঞ্জন হাজরা
শুভশ্রী, খাবারের স্বাদকাহন/ বইমেলা সংখ্যা ২০২০
*ছবি সৌজন্য: delish.com, wikipedia, spice bangla, Times Food
*ভিডিও সৌজন্য: Spice Eats, Youtube

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *