বাংলাদেশে জাফলং প্রকৃতিকন্যা  নামে পরিচিত। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে বহে চলা পিয়াইন নদীর তীরে  স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ নিদর্শন। মন না চাইলেও জাফলং থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তেই হবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নদীর ধারের পাথরভাঙা যন্ত্রগুলো চালু হয়ে গেলেই আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে পাথরের গুঁড়ো। বিষিয়ে যাবে পরিবেশ। একই সঙ্গে ভারত থেকে আসতে শুরু করবে কয়লা, চুনাপাথর ইত্যাদির ট্রাক। এইসব খনিজ পদার্থের কতটা বৈধ আর কতটুকু অবৈধ তা বিবেচনা করার জন্য দুই দেশের সরকারি আধিকারিকরা দায়িত্ব পালন করুন আমরা বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জৈন্তাপুরের দিকে এগিয়ে যাই। পরিবেশ দূষণের দাপটে দমবন্ধ হয়ে গেলে দেখবটা কী! রাস্তার হাল বেশ খারাপ। সারাদিন পাথর, কয়লা, চুনাপাথর ইত্যাদি বোঝাই ট্রাক চলছে। তার উপরে প্রায় প্রতিটি ট্রাকেই বহন ক্ষমতার  থেকে অনেক বেশি ওজনের পণ্য থাকে। মজবুত রাস্তাও এত বেশি ট্রাক এবং ওজনের দাপটে সুস্থ থাকতে পারে না বলে স্বাভাবিক যান চলাচল বিঘ্নিত হতে বাধ্য। তবে রাস্তার  পাশে ছড়িয়ে থাকা চা বাগানের দিকে নজর দিলে মন ভালো হয়ে যায়। জৈন্তাপুরে এখন আর রাজারানির রাজত্ব নেই। নেই রাজবাড়ি। জয়ন্তিয়া রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ ১৬৮০-তে এখানে রাজবাড়ি   নির্মাণ করিয়েছিলেন। সম্ভবত এই মুলুকে এটিই ছিল প্রথম ইটের তৈরি বাড়ি। আসলে তিনিই প্রথম জয়ন্তিয়া রাজা যিনি জয়ন্তিয়াপুরে রাজধানীর পত্তন করেন। রাজবাড়ি  ছাড়া তৈরি হয়েছিল অনেক বাসস্থান, মঠ-দেউল, পান্থনিবাস ইত্যাদি। রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছিল চারটি কামান। নিঃসন্দেহে সেই সময়ের নিরিখে যথেষ্ট আধুনিক ছিল এইসব উদ্যোগ। তবে সময়ের ধারাবাহিকতায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এখন শহরের তোরণদ্বার বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে শ্যাওলা আর আগাছায় ঢাকা এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে পড়ে আছে জয়ন্তিয়া রাজবাড়ির   ধ্বংসাবশেষ। বিধ্বস্ত রাজবাড়ি, জয়ন্তীশ্বরী বা জৈন্তাশ্বরী মন্দির এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেগালিথ এখনও হারিয়ে যায়নি। জয়ন্তীশ্বরী মন্দিরটির প্রধান কাঠামোটিও অত্যন্ত করুণভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। তবে চন্ডীর থাল নামে পরিচিত মন্দির প্রাঙ্গণের গোলাকার পাথরটি কিন্তু এখনও প্রায় অবিকৃত। শোনা যায় এই পাথরের উপরই সেই আমলে বলি দেওয়া হত। আরও শোনা যায় যে নিয়মিত পশুবলি হলেও বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে এখানেই হত নরবলি। লোকশ্রুতি, কারাগারে আটক থাকা বন্দিদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষকে জয়ন্তীশ্বরীর বার্ষিক উৎসবের সময় বলির জন্য বেছে নেওয়া হত। বলির পরে মুন্ডহীন শব মন্দিরের পাশে অবস্থিত কুয়োর মধ্যে ফেলে দেওয়া হত। এই কুয়োটির গঠনশৈলী পূর্ব ভারতের প্রচলিত কুয়োর মতো নয়। দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাটের বাউলির মতো ছিল এই কুয়ো। ভূগর্ভের জল অনেক গভীরে থাকায়  বাউলিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে জল তুলে আনতে হয়। সেই রীতিতে এই ব্যতিক্রমী কুয়োটি কেন বানানো হয়েছিল তার হদিশ পাওয়া যায় না। ১৮৩৫-এ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জয়ন্তিয়া রাজ্য দখল করে নেওয়ার পর নরবলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কুয়োটির প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে এটি একটি আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়। লোকশ্রুতি হলেও নরবলির বিষয়টি একেবারেই সারবত্তাহীন বলা যায় না। নারতিয়াং-এ অবস্থিত প্রাচীন দুর্গামন্দিরে এখনও প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় বলির আগে ছাগলের মাথায় মানুষের মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয়। মন্দির চত্বরের চারপাশের দেওয়ালটি সংরক্ষণের চেষ্টা হলেও আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে আদিরূপ হারিয়ে গেছে। ঘোড়া, সিংহ এবং ডানাযুক্ত অর্ধ-পরীর মতো বিভিন্ন পোড়ামাটির ভাস্কর্যর ভাঙ্গাচোরা অবস্থা দেখে নকশার মূল চেহারা আন্দাজ করা যায়।

Jaintapur Rajbari http://offroadbangladesh.com/places/jainta-rajbari/
জৈন্তাপুর রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ

ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দেখা যায় কিছু পাথরের তৈরি  স্মৃতিসৌধ। ছোটবড় বিভিন্ন আকারের মেগালিথ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জৈন্তাপুরে সব মিলিয়ে ৫৭টি মেগালিথের খবর পাওয়া গেছে। ১১টি এখনও অক্ষত। জাফলং থেকে যে রাস্তাটা সিলেট গেছে সেটা ধরে এগিয়ে গেলে জয়ন্তীশ্বরী মন্দিরের পাশে শহীদ মিনারের সামনে দেখতে পাবেন ১৯টি  মেগালিথ। গড় উচ্চতা ২.৪ মিটার। সবচেয়ে বড়োটির দৈর্ঘ্য ৩.৫ মিটার আর চওড়ায় ২.৬২ মিটার। বাদবাকি মেগালিথ অসংখ্য খন্ড খন্ড টুকরোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। 

জৈন্তাপুর মেগালিথের সঠিক সংস্থাপন তারিখ নিরূপণ করা সম্ভবপর নয়। এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খননকার্য পরিচালনা করা হয়নি। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রমাণ করেছেন এখানকার মেগালিথগুলি নারতিয়াং-এর মেগালিথের সমগোত্রীয়। ১৭৬৫-তে বাংলার দেওয়ানি হাতে পাওয়ার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্বেষণ শুরু করে। কৃষিজ, বনজ ছাড়াও খনিজ সম্পদের উপর নজর ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে চুন সরবরাহ করত জয়ন্তিয়া রাজ্য। পাকা বাড়ি থেকে শুরু করে সড়ক, সেতু  ইত্যাদি যাবতীয় নির্মাণকাজের জন্য চুন অপরিহার্য। তখন তো আর সিমেন্ট ছিল না, কাজেই চুনই ভরসা। পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে আবার প্রয়োজনে সামনাসামনি লড়াই করে বর্মার বা এখনকার মায়ানমারের ফৌজের দখলে থাকা আহোম রাজ্য পুনরুদ্ধারের পর ১৮২৬-এর ২৪-শে ফেব্রুয়ারি ইয়ানদবু নামের এক গ্রামে বসে ব্রিটিশ এবং বর্মার মধ্যে এক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যুদ্ধ থামে। বর্মার ফৌজের ধারাবাহিক হানাদারি, অত্যাচার-লুটতরাজ বন্ধ হয়। তবে একইসঙ্গে ৫৯৮ বছর ধরে চলতে থাকা আহোম রাজের পতন ঘটে। কালবৈশাখী ঝড় যেমন বজ্রবিদ্যুৎ সহ ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস নিয়ে আসে ঠিক তেমনিভাবেই আহোম রাজের পতনের মধ্যেই জয়ন্তিয়া দখলের ইঙ্গিত পাওয়া গেছিল। অবশেষে ১৮৩৫-এর ১৫-ই মার্চ জয়ন্তিয়া রাজ্যের পার্বত্যাঞ্চল দখল করে নিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। জয়ন্তিয়ার রাজ্যের ত্রয়োবিংশ রাজা রাজেন্দ্র সিংহ-কে  সমতলের সম্পত্তির দেখভাল করার জন্য জয়ন্তিয়াপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মাসে ৫০০ টাকা। আর পার্বত্যাঞ্চলের প্রশাসনের জন্য নিযুক্ত হলেন পনেরো জন দোলই আর জনা চারেক সর্দার। নিজের এলাকায় দোলইরা ছিলেন সর্বময় অধিপতি। শুধুমাত্র নৃশংসতম অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা দোলইদের ছিল না। প্রশাসনের দায়দায়িত্ব-ঝক্কি সামলানো সহজ নয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তেমন লোকবল ছিল না যারা প্রশাসন পরিচালনায় সক্ষম। তারা শুধু নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে আগ্রহী। সবমিলিয়ে জয়ন্তিয়া রাজ্যের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্তাচলে চলে গেল।

পরের পর্ব – জোয়াই (পর্ব ৫)

Amitabha Ray Author

প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *