এক নিভৃতবাসের সূচনাপর্ব!

জুন মাসের প্রথম দিনের প্রভাতে পাহাড় ঘেরা ছোট্ট বিমানবন্দরে সামান্য কয়েকজন সহযাত্রীর সঙ্গে গুটিগুটি অবতরণের পর বোঝাই যায়নি শুরু হতে চলেছে নির্বাসিতের জীবন। রোদ ঝলমলে আকাশের নিচে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শহরটিকে মন্দ লাগেনি। রাষ্ট্রপুঞ্জের গাড়িতে ঝড়ের গতিতে ব্যাগ-বাক্স সমেত আরোহীকে তুলে নিয়ে যাত্রা হল শুরু।
আর এক সে কোয়ারেন্টাইন!

ভিরান্দিয়ারা থেকে কিছুদূর গিয়ে গাড়ি বাঁ দিকের রাস্তা ধরল। সামনে পুলিশের চেকপোস্ট। সেখানে নিজের পরিচয়পত্রের কপি জমা দিতে হবে শুনে কিছুটা অস্বস্তি হল। এর আগে যেখানেই চাকরি করেছি, পুলিশের খাতায় নাম ওঠেনি কখনও। গাড়ি ফের রওনা দিল। বেশ কয়েকটা গ্রাম পেরিয়ে এক ধূ-ধূ মাঠে পৌঁছলাম। শুনলাম সেটার অপর প্রান্তে রিসর্ট। পাশে একটা বিএসএফ ক্যাম্প। পরে জেনেছিলাম সেটাই শেষ ক্যাম্প, কারণ আমাদের রিসর্টের সামনে থেকেই শুরু হচ্ছে দিগন্তবিস্তৃত সাদা প্রান্তর– যাকে লোকে সল্ট ডেসার্ট বা রান বলে জানে।
দূরকে করেছ নিকট বন্ধু

গত দু’সপ্তাহ ধরে আমরা এক অদ্ভুত সময়ের মধ্যে বাস করছি। এক এক দিন ঘুম ভেঙে মনে হচ্ছে যেন সায়েন্স ফিক্শন-এর মধ্যে বেঁচে আছি। স্পর্শ থেকে দূরে, একে অপরের স্পর্শ বাঁচিয়ে বেঁচে থাকা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব বন্ধ; এখন পড়াশোনা, গবেষণা, মিটিং সবকিছুর মাধ্যম ভার্চুয়াল। অর্থাৎ কম্পিউটার বা ফোন। শিক্ষার্থীদের দেখাশোনা হচ্ছে zoom, blue jeans, webex, ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে। হাত বাড়িয়ে প্রিয় বন্ধুকে ছোঁয়ার উপায় নেই। বড় জোর একটা দু’টো উড়ন্ত চুম্বন স্ক্রিন তাক করে পাঠানো যেতে পারে।
এই সময়, এই চিড়িয়াখানা

করোনা ভাইরাসের আড়ালে অন্য যে ভাইরাসটা লুকিয়ে বসে আছে, সে তো বহুদিন ধরে মানুষকে আক্রান্ত করে রেখেছে! সে শরীরে মারে না। মনকে ঝাঁঝরা করে ফেলে, ধীরে। খুব ধীরে। অসুস্থ মানুষ চায় একটা ছোট্ট, নিজস্ব পৃথিবী তৈরি করতে, যেখানে থাকবে শুধু তার পরিবার, তার ধর্ম, তার জাতি। প্রতিবেশীকে সেই পৃথিবী থেকে বহিস্কার করতে সে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না, যদি সে প্রতিবেশী অন্যধর্মী হয়। এই মানুষ স্বার্থপর।
অসামাজিকতাই একমাত্র রক্ষাকবচ

আপনি বাঁচলে বাপের নাম— এখন আর নয়। এখন সবাই বাঁচলে নিজের বাঁচার একটা সম্ভবনা আছে। সুতরাং বাধ্য হয়ে সবার কথা ভাবতে হবে। কেবল নিজের হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা পাকা করলেই হবে না। অন্যের জন্য হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক ডজন স্যানিটাইজ়ার কিনে ঘরে মজুত রাখলে বাঁচা যাবে না। অন্যের জন্য দোকানে স্যানিটাইজার ছাড়তে হবে। আবেগে ভেসে গিয়ে থালা বাজিয়ে মিছিল করলে হবে না। মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জানলায় বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাজাতে। যে ভাবে অন্যান্য দেশ নিজের মতো করে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছে। রাস্তায় বেরিয়ে নয়। ঘরে থেকে।
করোনার কুশপুতুলি

আচ্ছা এতে রাখঢাকের কী আছে মশাই? রোগ হলে হবে, হয়েছে। স্বীকার করুন। সবার বাড়িতে আমাদের বুড়োমানুষেরা আছেন, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসে ভোগা প্রচুর মানুষ রয়েছেন। আমাদের লিফট ইত্যাদি পরিষ্কার করা হচ্ছে সর্বক্ষণ। কিন্তু সেই ছেলেগুলি গায়ের জোরে আবার ঢুকে পড়বে না তো? সারাক্ষণ স্যানিটাইজেশন চলছে। পেপারওয়ালা, পুজোর ফুল, দোকান থেকে কয়েন ফেরত নেওয়া, স্যুইপার, মালি, ড্রাইভার সব বন্ধ করে আমরা হোম কোয়ারান্টাইনে রয়েছি। কিন্তু অবোধ এই বালকেরা? এরা এত অবাধ্য? প্লিজ কথা শুনুন সবাই। রোগ লুকোবেন না। রোগ ছড়াবেন না।