গোলকিপার (শেষ পর্ব)

“টাকার জোরে, ক্ষমতার নেশায় তার চতুর্দিকের সব কিছু নিজের ইচ্ছে মতো চালাতে চায়, এরকম একটা উন্মাদ, একটা পাগলের জন্যে তোমাকে ভুগতে হয়েছে গোলকিপার। তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও হয়েছে। ঠাম্মাকে হারিয়েছি আমি এই পাগলামির জন্যে। তখন তো জানতামই না। কিন্তু সেই পাগলটাকে কি আজ এক মুহূর্তের জন্যেও দেখতে পেলে? অবশ্য দেখবেই বা কী করে! তুমি তো আজ একবারও তাকাওইনি তার দিকে!”
গোলকিপার (পর্ব ২৩)

সুজাত একটু ভেবে বললেন, “আজ শিম-পোস্তটা কোরও। বলছিলে না, কুর্চি ভালোবাসে? তার সঙ্গে মটর ডাল আর ঢেঁড়স ভাজা। তারক একটু পরে গলদা চিংড়ি দিয়ে যাবে। চিংড়ি কিন্তু সবাই নাও খেতে পারে। আর একটা মাছ লাগবে। বসন্ত দেখ, বাজারে যদি পাবদা পাও আজ। তাহলে পাবদার তেল-ঝাল। পাবদা না-পেলে একটা ফোন করে জানিও ট্যাংরা, ভেটকি কোনটা পাওয়া যাচ্ছে। মৌরলা পেলেও নিয়ে নিও, তাহলে ঢেঁড়সের বদলে মৌরলা ভাজা। বারো জন খাচ্ছি আমরা, সেই বুঝে মাছ নেবে। পাবে তো?”
গোলকিপার (পর্ব ২২)

এতক্ষণ মুখ খোলেননি সুমিত্রা। এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে মেয়েটা তোর ভালোর কথা ভেবেই এত কিছু করছে, আমি তো দেখছি সেই একেবারে প্রথম দিন থেকে, তার সঙ্গে কোনও কথা না বলে তাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না ছোটু। সে যদি তার বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে থাকে…” মা’কে কথা শেষ করতেও দিল না অরিত্র, ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠল, “তুমি কিছু জানো না মা। কুর্চি আমার বন্ধু বলে এই লোকটা, কুর্চির বাবা, আমাকে শেষ করে দিতে চায়। দেবুদাই দুদিন আগে বলছিল, ভাড়াটে খুনি লাগাবে আমার পেছনে। এখন ওরই সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে? পাগল নাকি!”
গোলকিপার (পর্ব ১৯)

বেলভেডিয়ার নার্সিং হোমে পৌঁছতে পৌঁছতে অবশ্য ভিজিটিং আওয়ার শেষ। তবে ডাক্তার করকে হাসপাতালেই পেয়ে যাওয়ায় অরিত্রর কাছে যেতে কুর্চির অসুবিধে হল না। সকালের ফিজিওথেরাপি সেশন শেষ করে স্নান-টান সেরে ঘরের কোণের সোফায় বসে শরদিন্দু পড়ছিল অরিত্র। কুর্চিকে দেখে খুশি খুশি গলায় বলল, “কদ্দিন পরে এলে। আমাকে তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে!” শুনে এত জোরে হেসে উঠল কুর্চি যে নিজেই লজ্জা পেল। অরিত্রর মুখোমুখি সোফাটায় বসতে বসতে বলল, “সরি। দিন নেই রাত নেই, আমি পাঁইপাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছি, আর আমাকে নিয়েই চিন্তা হাসপাতালে বন্দি গোলকিপারের! শুনি, কিসের এত চিন্তা তোমার?”
গোলকিপার (পর্ব ১৮)

একসঙ্গে জনা কুড়ি লোকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ আরাম করে বসার ব্যবস্থা যে ঘরে, সেখানে একা বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন সুজাত। পড়ছিলেন, না সামনে কাগজ মেলে বসেছিলেন, বলা মুশকিল। সামনে রাখা পেয়ালায় চা জুড়িয়ে জল। একবারও ইচ্ছে হয়নি তাতে চুমুক দেওয়ার। রাতে অনেক ধৈর্য ধরেও ঘুম না-আসায় ওষুধ খেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সকালেও মন দিতে পারছেন না কোনও কিছুতে। যে মনঃসংযোগের জন্যে তাঁর এত সুনাম, আজ কিছুতেই তার হদিশ পাচ্ছেন না। অনেক ধাঁধার কোনও সমাধানই খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি–– কুর্চি কী জেনেছে, কতটা জেনেছে, কীভাবে জেনেছে!
গোলকিপার (পর্ব ১৭)

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হাজির ডাক্তার কর। এসেই অরিত্রর চিকিৎসার ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, “অনেকটাই তো সেরে উঠেছ এখন। প্রেসার খুব নেমে গিয়েছিল, এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। এবার হাঁটা-চলা শুরু করা যাক, নাকি ফুটবলারশ্রী? আজই তোমার আইসিইউ-মুক্তি। আমি সব বলে দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে ছ’তলার কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনারা থাকুন, ওর সঙ্গেই ছ’তলায় যান। ওর ভালো লাগবে। কাল থেকে ওর ফিজিওথেরাপি শুরু হবে। তার কয়েক দিন পরে কাউন্সেলিং। ফরোয়ার্ডদের পা থেকে বাজপাখির মতো বল তুলে নেওয়ার অভ্যেসটা ফিরে আসা চাই তো?”
গোলকিপার (পর্ব ১৬)

গেটের একপাশে নিম আর অন্যপাশে কাঞ্চন। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত খালি জায়গাটা এখন এই ফাল্গুনের মাঝামাঝি খয়েরি রঙের খসা নিমপাতা আর স্কারলেট রঙের ঝরা কাঞ্চন ফুলে মিলেমিশে লাবণ্যময়ী প্রাচীনার মতো মায়াময়। গেটের দুই পাল্লা জুড়ে একটা তালাসুদ্ধু শিকল এমনভাবে জড়ানো যে মনে হতে পারে গেটে তালা ঝুলছে। কিন্তু অভিজ্ঞ চোখ সহজেই বুঝে নেয়, শিকল নামালেই গেট খুলে যাবে। ভেতরে ঢুকে কুর্চি দেখল, সদর দরজা বাইরে থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ, অথচ তাতে তালা লাগানো নেই!
গোলকিপার (পর্ব ১৫)

মাঝের তিনটে দিন সুমিত্রাকে সত্যিই নিয়ম করে অরিত্রর খবর দিয়ে গেছে দেবদীপ। সুমিত্রা জানেন অরিত্রর অবস্থা স্থিতিশীল, চিকিৎসায় ভালোই সাড়া দিচ্ছে সে। তবু সারাটা রাস্তা এলেন দুরুদুরু বুকে। নার্সিং হোমে পৌছে লবির সামনে দেবদীপ অপেক্ষা করছে দেখে আরও যেন বেড়ে গেল তাঁর বুকের কাঁপুনি। লিফট থেকে নেমে আইসিইউ-এর দিকে যেতে যেতে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বছর চারেক আগে হাসপাতালে তাঁর স্বামীর শেষ কয়েকটা দিনের দৃশ্য। ভয় হচ্ছিল, চনমনে ছেলেটা যন্ত্রের ঘেরাটোপে কী জানি কী কষ্টের মধ্যেই না আছে! যত এসব কথা ভাবছেন, ততই যেন পা অসাড় হয়ে আসছিল তাঁর। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ।