বাংলা অভিধান অনুযায়ী (তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ) কাসমর্দ > ( প্রাকৃত) কাসুংদ > (বাংলা) কাসুন্দি বা চলতি কথায় “কাসন” কিম্বা “কাসোনদি।” এভাবেই বিবর্তন হয়েছে আমাদের সবার জিভে জল আনা এই ঝাঁঝালো আচারের। বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতির অন্যতম ধারক এই কাসুন্দি। শুধু কাসুন্দি বলতে সর্ষেবাটা দেওয়া টক আচারকে বোঝায়। কিন্তু আমকাসুন্দি হল নামে এবং স্বাদে একঘর আচার।
গ্রামবাংলায় পান্তাভাত, কয়েতবেল, পেয়ারা, আমড়া, চালতা ও কাঁচা আম বা মুড়ি মেখে কাসুন্দি খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও আমাদের বাড়িতে দেখেছি ভাতের পাতে রেলিশ বা চাটনি হিসেবেই এই আমকাসুন্দি পরিবেশিত হতে। বাড়িতে অন্য কোনও চাটনির জোগাড় না থাকলে বয়ামবন্দি আমকাসুন্দি বের করে তেলের মধ্যে সর্ষে ফোড়ন দিয়ে আমকাসুন্দির চাটনি খেতে অমৃতসম। সে যুগে অভিজাত এবং বনেদি বাঙালি বাড়ির রীতি হিসেবেই পরিচিত ছিল এই আমকাসুন্দি বানানো। গ্রীষ্মের শুরুতে নতুন ঝাঁঝালো রাইসরষে, কাঁচা আম এবং পাকা তেঁতুল ওঠামাত্রই এই সম্বচ্ছরীয় আচারের জোগাড় হতে দেখেছি।
আমার ঠাকুমার জন্ম খুলনা জেলার সাতক্ষীরায়। সেই ঐতিহ্য মেনেই আমার মায়ের হাতের আমকাসুন্দির স্বাদ নেবার সৌভাগ্য হয় আমার। অনেকের হাতে ঠিকমতো বানানো না হলে পুরনো কাসুন্দি বিস্বাদ হয়ে খাবার অযোগ্য হয়ে পড়ে। সেই কারণেই বুঝি পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটাঘাঁটি প্রবাদের সার্থকতা খুঁজে পাই।
আমাদের বাড়ির অন্যতম স্ত্রী আচার হল আমকাসুন্দির হাত। ঠাম্মাকে দেখেছি বৈশাখের অক্ষয়তৃতীয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে যেতে। ওইদিন ফুল, দূর্বা, বেলপাতা, সিঁদুর, সরষের তেল প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে সূর্য এবং মা গঙ্গাকে আবাহন করে ‘সরিষা ধোয়ার’ প্রথা অনেক কালের। কালো সরষে জলে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে শিলনোড়ায় শুকনো বাটা হবে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে। এবার ওই সময় সদ্য ওঠা কাঁচা আম ছাড়িয়ে থেঁতো করে নুন হলুদ মাখিয়ে রোদে দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে।
আম শুকিয়ে আমসি হবে না। অথচ রোদে সামান্য নরম হয়ে যাবে, যাতে পরে তার মধ্যে সব তেল মশলা ঢুকে যায়। তারপর কাচের শিশিতে ভরে নেওয়া হবে সেই জারানো আম, সরষে গুঁড়ো, তেঁতুলের ক্বাথ, চিনি আর সর্ষের তেল। দিনকয়েক রোদে ফেলে রাখলেই তৈরি হবে সমবচ্ছরি অভিনব আমের আচার। চলতি কথায় যার নাম পূর্ববাংলায় আম কাসুন্দি আর পশ্চিমবাংলায় আমের কাসন।
ঠাম্মার পরে এত নিষ্ঠার সঙ্গে এসব মা’কে পালন করতে দেখেছি। এখন এসব প্রথা লুপ্তপ্রায়। যেসব বাড়িতে কাসুন্দির নিয়ম নেই তারা করতে পারবে না। ফলে কাছাকাছির মধ্যে আত্মীয়বন্ধুদের জন্যেও মা’কে আলাদা আলাদা শিশি ভরে বানাতে হত। অতীব সুস্বাদু এই আমকাসুন্দির রহস্য বুঝেছি পরে। সরষে গুঁড়ো আর আমের গন্ধে মাখামাখি সেই রসায়ন আরও লাইমলাইটে আসে কাঁচা সরষের তেলের মধ্যে পড়লে। তবে ঘটিবাড়ির আম কাসুন্দিতে চিনি থাকবেই। সেই সঙ্গে থাকবে তেঁতুলের টক। অতএব আমের গন্ধ, টক, মিষ্টি আর সরষের ঝাঁঝ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এই বাঙালি আচারটি হারিয়ে যেতে দেব না বলেই এই লেখা।

রাণী চন্দের “আমার মায়ের বাপের বাড়ি” (বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, ১৯৭৭) বইটিতে শনিপুজো, হরির লুঠ, নারায়ণ পুজো ও নানাবিধ বারব্রতর সঙ্গে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে সরষে ধোয়া, ঢেঁকিতে কোটা এবং শুদ্ধাচারে কাসুন্দি তৈরির আনন্দ রন্ধনের প্রসঙ্গ এসে পড়েছে। রবিঠাকুরের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসেও, কমলা ঘণ্ট রাঁধছে। এমন সময় সেখানে হাজির চক্রবর্তী-খুড়া, যে বৃদ্ধের মতে, পশ্চিমের প্রচণ্ড গরমে যারা না থেকেছে তারা ঠিক অম্বলটা রাঁধতে পারে না৷ তেঁতুল নেই তো কী, আমকাসুন্দি দিয়ে কেমন করে একটা চটজলদি অম্বল রাঁধা যায়, তা তিনি অনায়াসেই দেখিয়ে দিতে পারেন।
বাংলাসাহিত্যে “পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে নেই” অথবা “আড়াই কড়ার কাসুন্দি, হাজার কাকের গোল” নিয়ে প্রচলিত বাগধারা থাকলেও আমরা কেউই পুরনো আমকাসুন্দি চাখতে পেলে কিন্তু ছাড়ি না। ঠাকুমা বলতেন ঠিকমত বানাতে পারলে পুরনো হলে আরও স্বাদ বাড়ে এর। এইজন্যই বুঝি সেকালে কাসুন্দিকে নাকি বলা হত “চাটনির রানি”। রেণুকা দেবী চৌধুরানির “পথের আচার” বই থেকে প্রাচীন বাংলার কাসুন্দির ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
কথায় বলে, অরুচির অম্বল, শীতের কম্বল। শীতের লেপ বালাপোষ রোদ খাইয়ে তুলে রাখলেই বাঙালির রসনা তেতো আর টকের দিকে ঝুঁকে যায়। সূর্যের তাপ যতই বাড়তে থাকে তখনই সব ভালমন্দ দূরে সরিয়ে রেখে অম্বলে মেতে ওঠে আম বাঙালি। কারণ অম্লস্বাদ হাওয়াবদলজনিত অরুচি দূর করে, শরীর ঠান্ডা করে। এটিই ট্রপিকাল বাংলার সাবেকি স্বাস্থ্যরীতি৷ এ কারণেই বুঝি মঙ্গলকাব্যে হরেক কিসিমের অম্লরসের ছড়াছড়ি৷ শাক্ত কাব্যের ধারার মতো বৈষ্ণব রান্নাতেও আমের টক বা কাসুন্দির উল্লেখ রয়েছে৷ শ্রীচৈতন্যের পার্ষদ কবি কর্ণপুর তাঁর ‘কৃষ্ণাহ্নিক-কৌমুদী’ বইতে রাধাকৃষ্ণের প্রিয় যে ভোজ্যগুলির তালিকা পেশ করেছেন, তার মধ্যেও আছে ঘিয়ে ভাজা আমচুরের সঙ্গে সরষের গুঁড়ো মিশিয়ে টকের কথা৷
পানিহাটির রাঘব পণ্ডিতের ভগিনী দময়ন্তী পুরীতে শ্রীচৈতন্যদেবের কাছে রাঘব পণ্ডিতের মাধ্যমে নিত্যি পাঠাতেন বহুবিধ খাদ্যদ্রব্য ভরা “ভরাঘবের ঝালি” যার মুখ্য আকর্ষণ ছিল নানাবিধ মিষ্টান্নর সঙ্গে হরেকরকমের কাসুন্দি। ঝালকাসুন্দি, আদাকাসুন্দির সঙ্গে থাকত চৈতন্যের প্রিয় আমকাসুন্দি। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের পাকপ্রণালীতে আমকাসুন্দির রেসিপি “ঝালকাসুন্দি” নামে রয়েছে। সে যুগে ঢেঁকিতে সর্ষে কোটা হত। তবে সর্ষে ছাড়া অন্য কোনও ঝালমশলা বা লংকা আলাদা করে এই আচারে দেওয়া হত না। পূর্ববাংলার কাসুন্দিতে চিনির উপস্থিতি নেই।
সে যুগে কাচের বয়াম ভরে থরে থরে যে সব আচার বন্দি হত, তার মধ্যে আমকাসুন্দির আভিজাত্য ছিল আলাদা। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে সব আচারের থেকে পৃথক এই আমের কাসন ছিল সেকালের বিধবাদের স্বাদকোরকের অগতির গতি। গরমে ভাতের পাতে নিরামিষ আহারের সঙ্গী ছিল এই আমকাসুন্দি। গরমকালে শনিবার ইশকুলের ছুটি হত দুপুর দুটোয়। ঠা ঠা রোদে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম দল বেঁধে। বাড়ি ফিরে এক একদিন ঠাম্মার শেষপাতের এই আমকাসুন্দি সহযোগে “হাত অম্বল” বরাদ্দ থাকত আমার জন্যেও।

ঠান্ডা ভাতের মধ্যে গর্ত করে কাঁঠালি কলা চটকে দিয়ে তার মধ্যে চিনি আর পাশে এক টুকরো কাগজি লেবু রাখা থাকলেই বুঝতাম সেদিন ভাতের মধ্যে হাত অম্বল পড়বেই। এসবের জোগাড় করে মা একটি হাতায় এক পলা তেলের মধ্যে সর্ষে ফোড়ন আর দুটো গন্ধরাজ লেবুপাতা ফেলে দিয়ে চড়বড় করে উঠলেই আমকাসুন্দি দিত। হাতার মধ্যেই টেপাগোঁজায় সেই মিশ্রণ টগবগ করে ফুটে উঠলেই সোজা ভাতের মধ্যে ঢেলে দিত হাত অম্বল। সঙ্গে কাঁচালঙ্কা, ইচ্ছে হলে আরও তেঁতুল। জমে যেত গরম দুপুরের শেষ পাত। ঠাম্মা বলেছিল একদিন। আগেকার বাল্য বিধবাদের মাছমাংস কেন যে খেতে দিত না বুঝি না। সেই শোক ভুলতেই নাকি ওঁরা বানিয়ে ফেলেছিলেন এই হাত অম্বল!
আমাদের গরমের ছুটি ভরে উঠত রোদে রাখা কাঁচা আমের চটজলদি রোদ আচারে কিম্বা আমকাসুন্দির গন্ধে। কাচের প্লেটে আম কুরিয়ে চিনি আর কাঁচালংকা কুচি দিয়ে মেখে ছাদের কড়া রোদে চুপিচুপি রেখে আসত মা। দুপুরে সেই অনবদ্য রোদে জারানো আমের আচার হাতে পেতাম তিন চার ঘণ্টা ঠা ঠা রোদে রাখার পর। তারপরে তারিয়ে তারিয়ে টাকনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের ছুটির হোমওয়ার্কের হাত চলত তাড়াতাড়ি। প্রজ্ঞাসুন্দরী এই টাকনা কে চাকনা বলেছেন। আমকাসুন্দির ক্ষেত্রেও এই টাকনা বা চাকনা প্রযোজ্য।
* ছবি সৌজন্য: Pikturenama, Youtube, heraldindia
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।