২৮ ফেব্রুয়ারি‚ ১৮৯৭। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। তার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু শোভাবাজার রাজবাড়ি। আজ সে বাড়ির ঠাকুরদালানে উপচে পড়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষের ভিড়। সংবর্ধনা দেওয়া হবে বিশ্ববরেণ্য সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকে। তার কয়েকদিন আগেই শিকাগো ধর্মমহাসভায় বক্তৃতা (১৮৯৩ খ্রি) দিয়ে বিশ্বজয় করে জন্মভূমিতে ফিরেছেন তিনি। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল কলকাতার আর এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের ঠাকুরদালানে তাঁকে সংবর্ধিত করা হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে এসেছিল সেই পরিবার। তখন কার্যত রাতারাতি সব ব্যবস্থা করেছিলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির তৎকালীন কর্তা রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব। তাঁর উদ্যোগে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল স্বামীজিকে।

১৮৯৩ সলে শিকাগো শহরে বিশ্ব ধর্ম মহাসভা শুরু হয়েছিল ১১ সেপ্টেম্বর। প্রথমদিনই বক্তৃতায় বিশ্বজয় করেছিলেন স্বামীজি। ১৭দিন ধরে চলেছিল এই সভা। ভারত থেকে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়াও অংশ নিয়েছিলেন নববিধান সমাজের হয়ে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, বৌদ্ধধর্মের এইচ ধর্মপাল‚ ব্রাহ্মধর্মের বি বি নাগরকর‚ জৈন ধর্মের গাম্ভি, থিওসফিক্যাল সোসাইটির জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। মহাসভার অভূতপূর্ব সাফল্যের কথা লেখা হয়েছিল দ্য মিরর‚ বঙ্গবাসী‚ লাইট অফ দ্য ইস্ট-সহ তৎকালীন নামী পত্রপত্রিকায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়‚ যে বাংলার ভূমিপুত্র স্বামীজি‚ সেখানে উদযাপন হয়নি। হয়েছিল সুদূর মাদ্রাজে। উদ্যোগ নিয়েছিলেন রামনাদের রাজা ভাস্কর বর্মা। আয়োজিত হয়েছিল আনন্দ সভা। উদযাপন হয়েছিল ক্ষেত্রীতেও। মহারাজা অজিত সিং-এর আহ্ববানে। প্রশংসা ও অভিনন্দনবার্তায় ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বীর সন্ন্যাসীর কৃতিত্বকে।

কলকাতার শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটে একবছর পরে। ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার টাউনহলে সভা হয়। সভাপতিত্ব করেন রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বরা। সেখানেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হবে বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দকে। ১৮৯৬-এর ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড থেকে মাদ্রাজ পৌঁছলেন স্বামীজি। তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হল। এ বার ‘মিরর’ পত্রিকায় ডাক দিলেন আর এক নরেন। নরেন্দ্রনাথ সেন। বললেন, বাংলার মাটিতে সংবর্ধিত হোন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। নইলে এই লজ্জা থেকে বাঙালি মুক্তি পাবে না। এই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হল। তৈরি হল অভ্যর্থনা সমিতি। স্থির হল নাগরিক সংবর্ধনা সভার সভাপতি হবেন দ্বারভাঙার তৎকালীন মহারাজ।

Young Vivekananda
বিবেকানন্দের নাগরিক সংবর্ধনাসভা হল শোভাবাজার রাজবাড়িতে

১৮৯৭-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাজ থেকে বজবজ এলেন স্বামীজি। ২০ তারিখ ট্রেনে করে পৌঁছলেন কলকাতায়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি‚ ১৮৯৭ বা ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ১৮ ফাল্গুন‚ রবিবার। এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা রাধাকান্ত দেবের তরফের ঠাকুরদালানে সংবর্ধিত হবেন স্বামী বিবেকানন্দ। আগের দিন এই অনুষ্ঠান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দ্বারভাঙার তৎকালীন মহারাজ। আদতে তাঁকে ভুল বোঝায় একটি গোষ্ঠী। বলা হয়‚ কায়স্থ হয়ে কী করে সন্ন্যাসী হবেন স্বামী বিবেকানন্দ? তাছাড়া তিনি কালাপানি পেরিয়েছেন। তাই হিন্দু সমাজে তিনি ব্রাত্য। এই গোষ্ঠীর সক্রিয়তায় শেষ মুহূর্তে পিছু হটেন মহারাজ। জানিয়ে দেন তিনি ওই সংবর্ধনা সভায় সভাপতি হবেন না। তখন নাগরিক সংবর্ধনার সভাপতিত্ব করলেন মহারাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব। সহ সভাপতিত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন মহারাজা নরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব।

নির্দিষ্ট দিনে রাজবাড়িতে উপচে পড়ল ভিড়। এমন সভা কলকাতা আগে দেখেনি। বিভিন্ন এস্টেটের রায়বাহাদুর‚ রাজা মহারাজা তো ছিলেনই। উপস্থিত ছিলেন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বরা। সবথেকে বড় কথা‚ এই সভা ধর্মের বেড়াজাল ভেঙেছিল। একদিকে উপস্থিত ছিলেন ঠাকুরবাড়ির গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর‚ বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যদিকে ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী সুরেশ চন্দ্র সমাজপতি। হাজির ছিলেন ইউরোপীয় সমাজও। স্বামীজি ঊষালগ্নেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি নিছক ‘হিন্দু সন্ন্যাসী’ বা হিন্দু ধর্মের প্রচারকের থেকে আরও অনেক বড়, যার পরিমাপ অকল্পনীয় ও অসম্ভব। সভায় জয়ধ্বনি দিয়ে‚ মালা পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় জ্যোতিষ্ক বিবেকানন্দকে। মানপত্র পাঠ করে তাঁর হাতে তুলে দেন সভাপতি বিনয়কৃষ্ণ দেব।

সংবর্ধিত বিবেকানন্দ ইংরেজিতে দিয়েছিলেন জবাবী বক্তৃতা। প্রথমেই বলেছিলেন জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় আন্দোলনের গুরুত্ব। বলেছিলেন‚ মানুষ মায়া ত্যাগ করে মুক্তির সন্ধানে সংসার ত্যাগ করে। কিন্তু তার পরেও ভোলে না জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী। তারপর বলেন‚ তিনি সন্ন্যাসী হিসেবে নন, বাংলার‚ কলকাতার রাজপথের ধুলো মেখে বড় হওয়া সেই বালক বিলে রূপেই নাগরিকদের কাছে আসতে চান। বাংলার যুব সম্প্রদায়কে ডাক দেন তাঁর থেকে আরও বড় হয়ে‚ আরও বেশি কিছু করে দেখাতে। তিনি মনে করতেন‚ ধনসম্পদে বাংলা পিছিয়ে থাকলেও দেশের অন্য প্রান্তের তুলনায় বুদ্ধি এবং কর্মোৎসাহ বাংলাতেই বেশি। শেষে উল্লেখ করেন তাঁর জীবনদেবতা‚ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কথা। বলেন‚ ঠাকুর তাঁর আচার্য। তাঁর ইষ্ট। তাঁর যা কিছু ভাল‚ সব ঠাকুরের। আর যা কিছু বাজে ও মন্দ‚ তা সব তাঁর নিজের।

 

*তথ্যসূত্র: ডা. অমরনাথ করণ ও তীর্থংকর দেব
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, bongquotes

banglalive logo

মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *