জার্মানির কোলন-বন এয়ারপোর্ট। অ্যারাইভাল লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। একপ্রান্ত থেকে ট্রলির ওপর একটা ছোট্ট সুটকেস আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ঠেলে নিয়ে আসছেন দিব্যকান্তি এক সন্ন্যাসী। গেরুয়া বসন, দীর্ঘ উন্নত শরীর, মুখে স্মিত হাসি। স্বামী লোকেশ্বরানন্দ। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, তখন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচারের প্রধান, তবে আমাদের নরেন্দ্রপুরের সবার কাছে শুধুই বড় মহারাজ।

আমি তখন ডয়চে ভেলে জার্মান রেডিওতে কাজ করি। কোলনে অফিস। বড় মহারাজের বার্লিনে একটা বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ ছিল। সেখান থেকে কোলন আসছেন তাঁর পুরনো ছাত্রের কাছে, মাত্র একবেলার জন্য। কোলন থেকে ড্যুসেলডর্ফে বক্তৃতা, তারপর রোম। সারা পৃথিবীর রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুগামীদের কাছে যিনি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের প্রতিনিধি, সেই পোপ জন পল, ভ্যাটিকানে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনের এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করে বিশেষ অনুরোধ-সহ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এত সুন্দর গল্পের মতো করে রামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা বলতেন স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, তাঁর কাছ থেকে কিছু শোনার সুযোগ ছাড়া যায় না। আগেই আবদার জানিয়ে রেখেছিলাম, ডয়চে ভেলেতে বাংলায় ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেব আমি, আর ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নেবেন এলিজাবেথ হডি, ইংরেজি বিভাগের এডিটর। মিনিট দশেকের স্লট। হডির খুব চিন্তা ছিল, “স্বামীজি মোটামুটি ইংরেজি বলতে পারবেন তো?” আমি শুধু বলেছিলাম, “হ্যাঁ।”

Swami-Lokeswarananda-Maharaj 1
দিব্যকান্তি এক যোগীপুরুষ, মুখে সর্বদা হাসি

ইংরিজির কথায় আমার নরেন্দ্রপুরের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। স্কুলে প্রথমদিকে ইংরিজিতে বেশ কাঁচা ছিলাম। ভাষাটাকে বড় কঠিন মনে হত, ভয় পেতাম। পরীক্ষার নম্বর কমতে কমতে ফেলটুস মার্কা। ইংরিজি টিচারদের কাছে ব্যাপারটা হয়ে গেল প্রেস্টিজ ইস্যু। ক্রমে সেই খবর পৌঁছলো বড় মহারাজের কাছে, যিনি নিজে ইংরেজিতে এমএ, ফার্স্ট ক্লাস। একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। মঙ্কস কোয়ার্টারে ওঁর ঘরজুড়ে শুধু বই আর বই। তখনও ইজিচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিলেন। প্রণাম করতে স্মিত হেসে বললেন,
“ইংরিজি পড়তে ভালো লাগে না, দীপংকর?”
“কঠিন লাগে, বড্ড ভয় করে।”
“এক কাজ করো। কয়েকটাদিন ইংরেজি ক্লাসের পাঠ্যবইগুলো তুলে রাখো। লাইব্রেরিতে গিয়ে আগাথা ক্রিস্টি আর কোনান ডয়েল পড়। দেখবে, ভয় কেটে যাবে। ইংরেজি সাহিত্য সোনার খনি। ভালো না লেগে পারে না।”

তাই করলাম। খুঁজে খুঁজে মহারাজ যে সব বইয়ের কথা বলেছেন পড়তে শুরু করলাম। এবং আশ্চর্য, আস্তে আস্তে ভয় কাটতে লাগল! ইংরিজিতে দিগগজ পণ্ডিত না হলেও গোমুখ্যু হয়ে থাকিনি। কারণ, এই সন্ন্যাসী ইংরেজিতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বাণী পড়তে না বলে আমাকে বলেছিলেন ইংরেজি গোয়েন্দা কাহিনি পড়তে। ইনিই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে ঠিক করে ছুরিকাঁটা দিয়ে খেতে হয়। সর্বত্যাগী একজন সন্ন্যাসী, কিন্তু পৃথিবীর বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য না করে ছাত্রদের সেগুলো গ্রহণ করতে শিখিয়েছিলেন।

ডয়চে ভেলে স্টুডিওতে বাংলা সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর বড় মহারাজকে ইংলিশ সার্ভিসে নিয়ে গেলাম। এলিজাবেথকে আমি আগেই সংক্ষেপে ওঁর পরিচিতি দিয়ে রেখেছিলাম। তবু ওঁকে দেখে প্রথম দর্শনেই সবাই মুগ্ধ। ওঁরা ধরেই নিয়েছিলেন ভারতীয় সাধু হবেন স্বল্পবাস, শশ্রুগুম্ফ শোভিত, জটাজূটধারী। এরপর আরও চমক! দশ মিনিটের জায়গায় প্রায় একঘণ্টা পরে মহারাজকে নিয়ে স্টুডিও থেকে বেরলো এলিজাবেথ। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
“তুমি তো সাংঘাতিক লোক! আমাকে শুধুমাত্র বলেছিলে উনি ইংরেজি বলতে পারেন!”
আমি হাসি চেপে সরল মুখে জিজ্ঞেস করলাম, ”কেন, পারেননি বুঝি?”
এলিজাবেথ রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল-
“আরে তোমার ওই আন্ডার স্টেটমেন্টের জন্য ওঁকে ইন্টারভিউতে আমি প্রশ্নগুলো যেভাবে করব ভেবে রেখেছিলাম, সব রিফ্রেজ করতে হল!”

Swami-Lokeswarananda-Maharaj speech
ভাষণরত বড় মহারাজ

ইংরেজি ইন্টারভিউটা দাঁড়িয়েছিল ৪০ মিনিটে। তার থেকে এক মিনিটও নাকি বাদ দেওয়া যায় না। তাই ওটা পরপর চারদিন দশ মিনিট করে সম্প্রচার করেছিল ওরা। পরে এলিজাবেথ আমাকে বলেছিল,
“জানো, তুমি সেদিন স্বামীজিকে নিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকতেই মনে হল ভরদুপুরে আবার যেন সূর্যোদয়। গেরুয়া পোশাকে এমন জ্যোতির্ময় পুরুষ আমি আর দেখিনি।”
পরে, আমি তখনও বিদেশে, এলিজাবেথ একবার কোলন থেকে কলকাতায় এসেছিল শুধুমাত্র মহারাজকে দর্শন করে যাওয়ার জন্য।

এর বছরতিনেক পর আমি আনন্দবাজার থেকে আর একবার ছুটি নিয়ে ভয়েস অফ আমেরিকায় কাজ করতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাই। নরেন্দ্রপুরের প্রাক্তন ছাত্রদের অনুরোধে বড় মহারাজ সেখানেও বারদুয়েক গিয়েছেন। আমাদের বাড়িতে দ্বিতীয়বার রাত্রিবাস করেছিলেন। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরে বেরিয়েছি, ওঁকে নিয়ে আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি যাব, যেখানে ওঁর ৮০ বছরের জন্মদিন পালিত হবে। গাড়ি স্টার্ট করে জিজ্ঞেস করলাম,
“মহারাজ, ওয়াশিংটন শহরটা তো আপনার তেমন করে দেখাই হয়নি! কয়েকটা জায়গায় একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাই?”

Swami-Lokeswarananda-Maharaj-b
তখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান

উনি সোৎসাহে রাজি। রাস্তার দু’পাশে সবকিছু দেখতে দেখতে চলেছেন। আমি কোনটা কী বলে দিচ্ছি। হঠাৎ দেখি সামনের গাড়িটি চালাচ্ছে একটি মেয়ে, তার নাম্বার প্লেটে লেখা আছে ‘ASK ME’। ওখানে আসলে নম্বরপ্লেটে নম্বর-অক্ষরের বদলে কেউ চাইলে কোনও শব্দও দিতে পারত। সেটা মহারাজের নজরে পড়েছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এর মানে কী?”  একটু দোনামোনা করে বলেই ফেললাম, মেয়েটি খুব সম্ভব সিঙ্গল। গাড়ির নাম্বার প্লেটটাই তার বন্ধু খোঁজার বিজ্ঞাপন। মানে, ‘একবার বলে দেখ, তোমাকে ভালো লাগলে বন্ধুত্বে রাজি হয়ে যেতেও পারি!’ এরকম আরও নাম্বার প্লেটে লেখা দেখেছি.. MAY BE… তারও ওই মানে।”

মহারাজকে এত খোলাখুলি কথাটা বলে ফেলে তখন আমার লজ্জাই লাগছে। উনি কিন্তু ব্যাপারটা নিলেন একেবারে অন্যভাবে। বললেন, “দেখো দেখি কীরকম স্বাধীন চিন্তাধারা! সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এটা সম্ভব!” এতটাই মুক্তমনা ছিলেন আমাদের বড় মহারাজ। আমার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার, গাইড, যাঁকে আমি নিঃসঙ্কোচে বলতে পেরেছিলাম, “আমি পুজোআচ্চা করি না। আমার বাড়িতে কোনও ঠাকুর দেবতার ছবি নেই, রাখতেও চাই না।”

Swami-Lokeswarananda-Maharaj meditating
ধ্যানমগ্ন মহারাজ

মহারাজ বলেছিলেন, “তুমি না চাইলে দরকার নেই। হিন্দু দর্শন বলে, ধর্ম হল যা সমাজকে ধারণ করে রাখে। তুমি যদি সেই ধর্মে বিশ্বাস করো, আর কোনও ধর্মীয় আচার আচরণ তোমার না করলেও চলবে। মানুষের ক্ষতি করবে না, উপকার করার চেষ্টা করবে, সমাজের ভাল করার চেষ্টা করবে। তা হলেই ধর্ম পালন করা হবে।”

 

ছবি সৌজন্য: লেখক

Dipankar Chakraborty

দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।

2 Responses

  1. লেখাটি প’ড়ে খুব ভাল লাগল। আগেও প’ড়েছি। সুন্দর লেখা বারবার প’ড়লেও মনে হয়, প্রথমবার প’ড়ছি। অভিনন্দন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *