রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন বছর চৌত্রিশ। সে বছর ‘সাধনা’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্তিক সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ লিখলেন। নাম দিলেন, ‘মেয়েলি ছড়া’। সেই আমলে এমন নামের আড়ালে শিশুপাঠ্য গ্রন্থকারদের উদ্দেশে একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
‘শিশুদের কল্যাণ যাঁহারা কামনা করেন তাঁহারা যেন কেবলমাত্র প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ভাগক্রমে বিশুদ্ধ সাধুভাষায় জ্ঞানশিক্ষা ও নীতিশিক্ষা প্রচার না করিয়া চিত্রবিচিত্র কাল্পনিক কথা ও রূপকথা সংগ্রহ ও সৃজনপূর্ব্বক শিশুদের হৃদয় সরস এবং তাহাদের শিক্ষার পথ সুন্দর এবং তাহাদের জীবনারম্ভকাল নবীন ঊষারাগে রঞ্জিত ও ছায়ান্বিত করিয়া তোলেন।’
শিশুদের এমন তরলখাদ্য দেবার কথা বলেছেন যাতে ‘আনন্দে স্বেচ্ছাসহকারে’ নিজের মনের সঙ্গে সে অনায়াসে তা মিশিয়ে নিয়ে ‘প্রফুল্ল পরিপুষ্ট এবং বলশালী’ করে তুলতে পারে নিজেকে। ইতিহাস বলছে এই কালেই শিশু-সাহিত্যিক যোগীন্দ্রনাথ সরকার এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর চেষ্টায় সে অভাবপূরণের কর্ম শুরু হয়। কবি নিজেও লিখেছিলেন যুক্তাক্ষর-বর্জিত কিছু ছড়া, যেমন ‘নদী’।
প্রশ্ন হতে পারে, হঠাৎ করে এমন একটি প্রসঙ্গ কেন লিখছি। দীর্ঘদিন ধরে শিশু-কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত থাকায় উপলব্ধি করেছি, বাংলাদেশের শিশুরা ইদানীং ভালো ছড়া, গল্প থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের শিশুদের জন্য অভিভাবকরা সেই উনিশ বা বিশ শতকের ছড়া বা গল্পের উপর নির্ভর করেই সন্তানদের তরলখাদ্য পরিবেশন করে চলেছেন, যদিও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন চিরকালের সেরা জনপ্রিয় ছড়া বা পদ্যগুলোরও খাবি খাওয়ার মতো অবস্থা। হাতে গোনা দু-একটি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়া এই দায় যেন বইপাড়ার আর কারও নেই। এ বড় দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।

ছোটদের জন্য বইপাড়ার এমন দীনতার কালে হঠাৎ হাতে এসে পড়েছে ‘স্যাস’ থেকে প্রকাশিত সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘পুরোনো ছড়া নতুন ছবি’ নামে একটি রঙিন বই। বইটি হাতে পেয়ে ছেলেমানুষের মতো উল্টেপাল্টে দেখলাম একাধিকবার। পৃষ্ঠা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ ছেলেবেলার স্মৃতি ভেসে উঠল। শহরতলির যে পাড়ায় আমার ছেলেবেলা কেটেছে, সেখানে চিলেকোঠার ছাদে গেলে আশেপাশে গাছ-গাছালি আর সবুজ মাঠ দেখা যেত। মাঝে পুকুর একটা ছিল বটে, তবে নদী বলে ঠাহর হত না। কিন্তু মায়ের মুখে শ্রাবণের তুমুল বর্ষণের দিনে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর/ নদে এল বান’ এই ছড়াটি শুনলেই পুকুরের মধ্যে বৃষ্টির জলের শব্দ আর কিলবিল করে বিলি কাটা দেখে কেমন রোমাঞ্চকর মনে হত। এই দৃশ্যকে সাক্ষী রেখে শ্রাবণের ধারার মতো মা অনর্গল বলে যেতেন ‘শিবঠাকুরের বিয়ে হল/ তিন কন্যাদান // এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন/ এক কন্যা খান // এক কন্যা গোসা করে/ বাপের বাড়ি যান।’ শুনতে শুনতেই মনের কোণে একটা ভিন্ন ছবি ফুটে উঠত।
সুধীরঞ্জনের ‘পুরোনো ছড়া নতুন ছবি’ বইটিতে এই ছড়াটি এই বুড়োবেলায় পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেভুলানো ছড়া: ১’ প্রবন্ধে এই ছড়াটি সম্পর্কেই তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাটি মনে পড়ে গেল। মজা করে লিখেছিলেন,
‘এ বয়সে এই ছড়াটি শুনিবামাত্র বোধ করি প্রথমেই মনে হয়, শিবঠাকুর যে তিনটি কন্যাকে বিবাহ করিয়াছেন তন্মধ্যে মধ্যমা কন্যাটিই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমতী।’
অথচ ছেলেবেলায় এমনতর চরিত্রবিশ্লেষণের ক্ষমতা বা বুদ্ধি থাকে না। তাই এই ছড়ার প্রতিটি ছত্র শিশুমনে একটা কল্পলোকের স্বপ্ন বুনতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যা কিনা ‘চরিত্রবিশ্লেষণ অপেক্ষা চিত্রবিরচনের দিকেই তখন মনের গতি’ বইতে থাকে। শিশুমনে সেই চিত্রগড়ার কাজ করে এমন ছন্দবন্ধন। যেমন, ‘বাঁশ বনের কাছে / ভুঁড়ো শিয়ালি নাচে // তার গোঁফ জোড়াটি পাকা / মাথায় কনক চাঁপা।’ এমন ছন্দের ছড়ায় শিশুমন কল্পনা করার রসদ পায়। এই ছড়ার সঙ্গে যে ছবি এঁকেছেন সুধীরঞ্জন, তা শিশুমনকে সহজেই জয় করে নেবে বলে আমার ধারণা। কারণ ছড়ার সঙ্গে মানানসই ছবি শিশুমনের উপর রেখাপাত করে। সুধীরঞ্জনের রঙতুলি এব্যাপারে আগাগোড়াই সচেতন এবং সজাগ থেকেছে।

সুধীরঞ্জনের শিল্পকলার ভিত্তি তৈরি হয়েছে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। দিনকর কৌশিকের তত্ত্বাবধানে শিল্পচর্চা যে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে, তা এই বইয়ের পুরনো ছড়ার সঙ্গে নতুন নতুন ছবির রেখাচিত্রেই ধরা পড়ে। ধরা যাক ‘ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি/ আমার বাড়ি এসো // সেজ নেই মাদুর নেই/ পুঁটুর চোখে বোসো // বাটা ভরা পান দেব/ গাল ভরে খেয়ো // খিড়কি দুয়ার খুলে দেব/ ফুড়ুৎ করে যেয়ো।’ — এই ছড়ায় তিনি মাটির দাওয়ায় পুঁটু আর পুঁটুর মাকে এমন স্বাভাবিকভাবে বসিয়ে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিকে এনেছেন খোলা জানালার ওপার থেকে, যে শিশুমনের উপর এক অনাবিল কল্পরাজ্য তৈরি হতে বাধ্য। শিল্পীর অপরূপ সৃষ্টির সঙ্গে পাঠকের মন একাত্ম হয়ে যায়।
কবির ভাষায় ‘এই ছবিগুলি একটি রেখা একটি কথার ছবি।’ উপমা দিয়েছেন তিনি ‘দেশলাই যেমন এক আঁচড়ে দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠে, বালকের চিত্তে তেমনি একটি কথার টানে একটি সমগ্র চিত্র পলকের মধ্যে জাগাইয়া তুলিতে হয়।’ শুধুমাত্র কোনো অংশ তুলে তার ছবি আঁকায় সমগ্রতা থাকে না। সুধীরঞ্জন পুরনো ছড়া নিয়ে চর্চাকালে এই আপ্তবাক্যটিকে মনে রেখেই প্রতিটি ছড়ার মধ্যেকার নির্যাসটুকু নিয়ে সমগ্র ছড়াটিকেই নতুন করে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এখানেই ‘নতুন ছবি’র নামকরণের সার্থকতা। এক কথনে এই কাজের প্রসঙ্গে সুধীরঞ্জন স্পষ্ট করে বলেছেন, ছেলেবেলায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র রাক্ষসী রানি এবং খোক্কসের ছা’য়েরা এখনো অন্ধকারে তাঁর মনের মধ্যে হানা দেয়। রূপকথার গল্পের এরকম সচিত্রকরণ আর কোনোদিনই হবে না বলেই তাঁর ধারণা।
সুধীরঞ্জন বলেছেন,
‘আইকম বাইকম’ বা ‘পানকৌড়ি’র প্রচলিত ছড়ার সঙ্গে কমলকুমার মজুমদারের আঁকা ছবিগুলি ছড়ার দৃশ্যগুলিকে হুবহু তুলে শিশুদের খুশি করার অসম্ভব চেষ্টায় মেতে ওঠেননি – বরং ছড়া থেকে ছবি হয়ে ওঠার চিত্রগত সম্ভাবনাকে দ্রুত রেখার সাহায্যে এঁকে পৌঁছে দিয়েছেন শিল্পের এক আন্তর্জাতিক স্তরে যেখানে শিবঠাকুরের বিয়ে আর মাতিস, পিকাসোর ড্রইং পাশাপাশি ঠাঁই পাবে।’
এক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরী অগ্রজশিল্পীদের কথা সশ্রদ্ধে জানিয়েওছেন,
‘নন্দলাল বসুর ‘সহজ পাঠ’-এর ছবির সাদাকালো বিভাজনে ঘরোয়া আটপৌরে জীবন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আলংকারিক বিন্যাসে শিল্পের এক অন্য স্তরে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরেই বলি, যে ছড়ায় বর্ণিত এই সব অসম্ভব কল্পনা এবং কখনো কখনো পরস্পর যোগসূত্রহীন ঘটনাকে একটি ছবিতে দৃশ্যগতভাবে রঙে রেখায় সম্ভব করে তোলা বেশ কঠিন কাজ। অথচ ক্ষীরনদীর কুলে খোকার মাছ ধরতে গিয়ে নাকাল হওয়ার দৃশ্য ছবিতে না ফুটিয়ে তুলতে পারলে শিল্পীর মনেও শান্তি নেই। আর সেই ছবি দেখে শিশুরা আনন্দ পাচ্ছে কিনা সেটাই সর্বোচ্চ পরীক্ষা। ‘পুরোনো ছড়া নতুন ছবি’ সেই অসম্ভব প্রচেষ্টার একটি ধাপ।’

এই বইয়ের পাতায় পাতায় পুরনো ছড়াগুলি নতুন ছবিতে মুড়ে নতুন করে শিশু সাহিত্যের আঙিনাকে ভরে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা কিনা সাধুবাদের যোগ্য। রূপকথার গল্প বা ছড়া শিশুমনে পরিচিত জগৎ নিয়ে গড়ে ওঠে না। সে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে এক ভিন্ন জগৎ গড়ে। কল্পরাজ্যের সেই ছবি শিশুকে টেনে নিয়ে যায় অন্যভুবনে। এখানেই ছড়াকার, গল্প-বলিয়ে বা চিত্রশিল্পীর নৈপুণ্য প্রকাশ পায়।
মুখবন্ধে সুধীরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’র প্রসঙ্গ টেনে সসংকোচে বলেছেন — ‘যেমন মিষ্ট ছন্দ শুনিলেই তাহাকে গানে বাঁধিয়া গাহিতে ইচ্ছা করে তেমনি এই সকল ভাষার চিত্র দেখিলেই ইহাদিগকে রেখার চিত্রে অনুবাদ করিয়া আঁকিয়া ফেলিতে ইচ্ছে করে।’ এই ইচ্ছের উপর ভর করেই তিনি কোনোরকম পরিকল্পনা ছাড়াই মনের আনন্দে তুলিকলম নিয়ে শুরু করেছিলেন রেখার চিত্রে অনুবাদ করার প্রয়াস। কবুল করেছেন, ‘একদিকে ছড়া থেকে যে ছবি মানসচক্ষে ভেসে ওঠে তাকেই ভর ক’রে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রঙ তুলিতে রূপ দিয়েছি।’
হ্যাঁ, সঙ্গে তাঁর হাতের নিপুণ আলপনার পরশ রয়েছে কমবশি সব ছবিরই আনাচে কানাচে। আর তাই এই বইয়ের ছড়া ও ছবির হাত ধরেই শিশু এক অজানা অচেনা অদেখা ভুবনে প্রবেশ করে। তার মনে অনাবিল আনন্দের আবেশ তৈরি হয়। সেখানেই শিল্পীর সার্থকতা। এই বইয়ে শিল্পী সুধীরঞ্জন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তা পালন করে একুশ শতকের বাংলার শিশুমনে নতুন আলোকপাত করার সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই শুভ কাজে সবরকমের সহযোগিতা করেছে স্যাস প্রকাশনা সংস্থা।
গ্রন্থ – পুরোনো ছড়া নতুন ছবি
লেখক – সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক: স্যাস পাবলিশার্স
প্রথম প্রকাশ: ২০২১
বিনিময়: ৫৫০ টাকা
সব ছবি সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত।
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
চমৎকার