গ্রিসে গিয়েছিলাম দু’হাজার সাতে। বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। বিষয় ছিল ‘জাস্টিস’। আমি পড়েছিলাম ‘মণিপুরের মা’। বলতে হয়েছিল কেন লিখলাম কবিতাটি। মায়েরা কতটা লড়াই করেছিলেন বিচার চেয়ে? বিচার পেয়েছিলেন? 

এথেন্সে নেমেই আমি সেই রাগি জেদি মেয়েটার খোঁজ করছিলাম। এখানেই তো দেখা হওয়ার কথা। দুটো গভীর নিদ্রাহীন চোখ। কতদিন সেখানে কেউ চুম্বন করেনি। কালো মেঘের মতো চুল, কতদিন সেখানে চিরুনি পড়েনি। সোনা পুড়ে তামার মতো হয়ে ওঠে যখন কেউ, তখন মানুষকে একটু অন্যরকম দেখায়। সেই তামারঙ মেয়েটির জন্য আমি দাঁড়িয়ে আছি বাসস্টপে। আমি দাঁড়িয়ে আছি মেট্রো রেলে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ভূমধ্যসাগরে। মেয়েটিকে আমি কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। এখানেই থাকার কথা। এখানেই তার বাড়ি। এখানেই তার বাবা একদিন মায়ের চুলের কাঁটা খুলে নিয়ে নিজেকে অন্ধ করেছিলেন।  এখানেই সে রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে কথা বলেছিল। কেন তার দুই ভাইয়ের মৃতদেহ রাজ্যের বাইরে পড়ে থাকবে? কেন সম্মান পাবে না মৃতদেহ? যেখানে মৃতদেহ সম্মান পায় না, সেখানে মানুষ কী করে সম্মান পাবে? প্রাচীন গ্রিস জাস্টিস নিয়ে এই প্রশ্নটা সেদিনই তুলেছিল। আজও উত্তর দিতে পারিনি আমরা।

বাইজানটাইন সভ্যতার পথরেখা চলে গেছে প্যারোস দ্বীপের ভেতর দিয়ে। সেখানে একটা সুন্দর বাড়ি দেওয়া হল আমাদের। ইন্টারনেট আছে। টেলিভিশন আছে। এটা একটা দ্বীপ, কিন্তু মেয়র আছে। খুব হ্যান্ডসাম। মেয়রকে দেখতে ক্রেয়নের মতো। নিষ্ঠুর ক্রেয়ন কি দেখতে ভাল ছিল না? পৃথিবীর  ইতিহাসে বেশিরভাগ নিষ্ঠুর পুরুষ দেখতে ভাল। তাদের সেক্স অ্যাপিল হলিউডের নায়কদের থেকে বেশি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি আর নাইজিরিয়ান কবি হাঁটতে শুরু করলাম ভূমধ্যসাগর ধরে। একটা ছোট্ট গ্রামে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে একটা আঙুরক্ষেতের সামনে একটা নাটক হচ্ছে। একটাই লোক অভিনয় করছে। তার ভাষা গ্রিক। নাইজিরিয়ান কবি অনেকক্ষণ শোনার পরে বললেন , ‘ইটস গ্রিক টু মি।’ ছোটবেলায় শোনা এই ইংরেজি প্রবাদটিকে যেন চাক্ষুষ করলাম। আমরা চলে যাচ্ছিলাম, আমাদের চমকে দিয়ে সেই একজন অভিনেতা আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল, পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল– 

“ইটস নট গ্রিক
হোয়েন আ মাদার ক্রায়েজ
ইটস নট গ্রিক 
হোয়েন আ ফাদার ডায়েজ।”

রাতে ডিনার টেবিলে আরও তিনজন কবি। একজন আর্জেন্টিনার, একজন বার্মার, একজন রাশিয়ার। অলিভ পাতায় সাজানো ফ্রুট স্লালাড মুখে দিতে দিতে নাইজেরিয়ার কবিকে বললাম,
– এরা এত সহজ করে কবিতা লিখতে পারছেন একটা দ্বীপে বসে। এটা ভাবা যায় না। আমাদের সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো।
– কে সুভাষ? নাইজিরিয়ান কবি জানতে চাইলেন। আমি বললাম,
– চল্লিশের দশকে তিনি মুখের ভাষায় কবিতা লিখে চমকে দিয়েছিলেন। তারপর কবিতা আবার কঠিন হয়েছে। আবার সহজ হয়েছে। এই দুটো জিনিস ঘটতেই থাকে কবিতায়। যেমন বের্টোল্ট ব্রেখটের সহজ, সরাসরি, জ্যা-মুক্ত কবিতা লেখার পরও জার্মান কবিতা কঠিন হয়েছে। দুরূহ হয়েছে। আবার সহজ হয়েছে। আমাদের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর পরে উৎপলকুমার বসু হয়েছে, মণিভূষণ হয়েছে। দেবদাস আচার্য হয়েছে। অরুণেশ ঘোষ হয়েছে। আবার একই সময়ে দাঁড়িয়ে, একই সময়খণ্ডে বসবাস করে, দু’জন কবি হয়ে উঠতে পারেন দুরকম– একজন মাটির মতো সরল, আর একজন লুপ্ত ভাষায় লেখা শিলালিপির মতো দুর্বোধ্য। যেমন নির্মল হালদার এবং সদ্যপ্রয়াত গৌতম বসু।
আমি নাইজেরিয়ান কবিকে অনুবাদ করে শোনালাম দু’জনের দু’টি কবিতা।

আমাদের ডিনার টেবিলে এসে যোগ দিলেন প্যারোস দ্বীপের এক কবি। ব্লু জিনস, সাদা টি শার্ট পরা সেই কবি হাতে একটা প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছেন। তিনি নিজেই বাজান। বাজাতে বাজাতে থামলেন। দু’লাইন কবিতা বললেন। আমি তাঁর যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে। কেমন চেনা চেনা লাগছে। সাউথ ইন্ডিয়ান বীণার মতো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
– এভাবেই কি তোমরা কবিতা পড়ো?
আধুনিক জিনস পরা গ্রিক যুবক কবি কিছু বুঝতে পারল না। সে ‘লিজা লিজা’ বলে ডাকতে লাগল। লিজা এসে দাঁড়াল। মেয়েটি তার বান্ধবী। সে চোস্ত ইংরেজিতে বলল,
– সবাই এ ভাবে কবিতা পড়ে না ঠিকই, বাট দিস ইজ হাউ হি রিডস।
যন্ত্রটির নাম “লায়ার।” মানে বীণা। যে লায়ার (lyre) শব্দটা থেকে লিরিক কথাটা এসেছে। লায়ার বাজিয়ে যে কবিতা প্রাচীন গ্রিসে পড়া হত, তাকেই বলা হত লিরিক। তার কবিতাপাঠের পর আমি লিজাকে বললাম,
– তুমি কি তোমার বন্ধুর কবিতা অনুবাদ করে শোনাবে?
গোটা ডিনার টেবিল থেকে একই দাবি উঠল। লিজা তার স্মার্টফোন থেকে অনুবাদ বের করে আনল। তখন দু’হাজার সাত। জায়গাটা গ্রিক দ্বীপপুঞ্জ। এই লিজা মেয়েটি জেল খেটেছে জানা গেল। দ্বীপের মেয়র তার শত্রু। মেয়রের বিরুদ্ধে তার লড়াই। আমি যাকে প্রথম থেকে খুঁজছি, সেই আন্তিগোনে আমার সামনে বসে আছে। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। তার সুরেলা তেজি কন্ঠে লিজা পড়ে চলেছে– 

“উইন্টার ইজ নট মাই এনিমি 
বাট স্প্রিং ইজ।
ইট অ্যারাউজেজ মি অ্যান্ড আই ব্লুম
আই ব্লুম টু ডাই ইন স্প্রিঙ।”

আমার মনে হল পাহাড়ের মাথায় বসে ইম্ফলের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে ইবমচা সিংয়ের কবিতা শুনছি। আমার মণিপুর আর গ্রিস এক হয়ে মিশে যায় কবিতায়। ‘আই ব্লুম টু ডাই ইন স্প্রিং।’
‘বসন্তে মারা যাব বলে আমি ফুল হয়ে আসি।’
মণিপুরের কবিতা কানে বাজতে থাকে, ‘আর্মিমেন শুট বার্ডস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স ইন স্প্রিং।’

কবিতা যেখানেই লেখা হোক, পাহাড়ে অথবা মরুভূমিতে, জঙ্গলে অথবা মেগাসিটিতে, কবিতার ভেতরে যে কবিতা লুকিয়ে থাকে ঝিনুকের মধ্যে, সেটা মানুষের চোখের জল। সেটা সব জায়গায় দেখতে একরকম। এখানেই কবিতা জিতে যায়।

জন্ম নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে‚ ১৯৫৮ | ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক | পড়িয়েছেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। 'দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে' এনে দিয়েছে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার‚ ২০১৩ সালে| বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি। লিখেছেন পঁয়ত্রিশটি কাব্যগ্রন্থ যার মধ্যে রয়েছে একা নরকগামী (১৯৮৮), জেরুজালেম থেকে মেদিনীপুর (২০০১), মণিপুরের মা (২০০৫) ইত্যাদি। 'ভাষানগর' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সুবিদিত।

4 Responses

  1. সুবোধদা পদ্যকার না গদ্যকার বলা মুশকিল। উনি যখন গদ্য লেখেন, তখন যেন খোলামাঠে সেনাপতি হাঁটছেন, যখন পদ্যে থাকেন, তখন যেন একদল বালিহাঁস উঠে আসে মানুষের পিঠে । এই লেখাটি অনবদ্য।

  2. ভালো কবি ভালো গদ‍্য লিখতে পারেন, এটাই আমারা জানি। এখানে তার ব‍্যত‍্যয় ঘটেনি। ভালো লাগা এই কবি ও কবিতার কথা। মুগ্ধ হলাম, সুবোধ দা!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *