লালু আর ভুলুর মতো বন্ধু হয় না। আমার পাড়ার দুই কুকুর। রোজ খাওয়াই। আগে আদর করতাম। এখন আর করি না। তাতে তাদের খুব দুঃখ। আমি নীচে নামলেই, কাছে চলে আসে। বলি, চাটিস না কিন্তু। সামান্য দূরে থেকে কান নাড়ায়। লেজ নাড়ায়। আমি দু’বাটি ভাত আর তরকারি বা মাছ দিয়ে দিই দু’জনের সামনে। পরম তৃপ্তিতে খায় আর লেজ নাড়ায়। লালু আর ভুলু। নামটা আমার দেওয়া। খাওয়া শেষ হলে বাটিগুলো তুলে নিই। ওরা ঘাড়ে লাফিয়ে চাটতে চায়। বারণ করি। থেমে যায়।

যখন বাজার দোকানের দিকে হাঁটি, কিছুটা পথ সঙ্গে সঙ্গে যায়। তারপর দাঁড়িয়ে থাকে, আমার হেঁটে যাওয়ার রাস্তার দিকে চেয়ে। আবার যখন আসি, তখন দৌড়ে দৌড়ে আসে। সঙ্গ দেয়। আমাদের বাড়ির নীচেই থাকে সারাদিন। বিকেলে ওদের বরাদ্দ চারটি করে বিস্কুট। সকালেও তাই। লালু আর ভুলু। ওদের দৌড় আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য কয়েক পা সামনে ও পিছনে। ওদের ঈশ্বর হয়তো আমি। ওদের জন্ম মৃত্যু বিবাহ এখানেই। এটাই ওদের পৃথিবী। আর আমি, ওদের অন্নদাতা! কী গর্ব আমার, সত্যিই!

তো ওরা এমনিতে খুব ভাল, কিন্তু জানেই না ওদের সীমানার বাইরে জগৎটা কেমন। আমাদের বাড়ির কাছে একটা বড় ডাস্টবিন আছে। আশপাশের সমস্ত ফ্ল্যাটের আবর্জনা যায় সেখানেই। লালু ভুলুকে যতই খেতে দাও না কেন, ওরা ওই ডাস্টবিনে যাবেই। যেন ওই ডাস্টবিনটাই ওদের এই কুকুরজন্মের বিধি ও উদ্দেশ্য। এ নিয়ে হিংসা, মারামারি, অন্য পাড়ার কুকুরদের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া। হয়তো খাবার কিছুই নেই, কিন্তু অন্য কুকুরদের আসতে দেওয়া যাবে না। এই ধরুন খেতে দিয়েছি। হঠাৎ একজন লাগাল দৌড়। দেখাদেখি, আর একজন। আমি চেঁচাচ্ছি পিছনে, ‘এই চলে আয়’। তারা তো হুশ। শুনতে পাচ্ছি শুধু তীব্র চিৎকার। তারপর দেখলাম চিৎকার কমল। একজন দৌড়তে দৌড়তে এল। পিছনে আর একজন। দিলাম কষিয়ে দুই চড়। মুখ বুজে মার খেল। আহ্লাদের লেজ নাড়াল। আবার মারলাম। মার খেল। তার পর খাবার খেতে লাগল।

 

আরও পড়ুন: সায়ন্তন ঠাকুরের গল্প: হিরা মালিনী – প্রথম পর্ব

 

আমি যে মারলাম, আমার প্রতি ওদের রাগ নেই। কিন্তু স্বজাতিরা অধিকার করতে এলেই রাগ। এই ওপর থেকে যখন বিস্কুট ছুড়ে ছুড়ে দিই, ওরা খায়। লেজ নাড়ায়, জুলজুল করে চেয়ে থাকে, পরমুহূর্তেই নিজের কথা মনে হয়। এমন আমরাও তো চেয়ে আছি। লেজ নেই, তাই নাড়াচ্ছি না। উপরের দিকে চেয়ে আছি। বসের দিকে চেয়ে আছি। শাসকের দিকে, অগ্রজের দিকে, দাদার দিকে, নেতার দিকে। কেন? না ওই পায়ের তলায় ঠাঁই দেবেন বলে, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দেবেন বলে, এলাকার কিছু কিছু ডাস্টবিনের প্রধান করবেন বলে। কী আর করবে লালু ভুলু! এলাকাটা বড় করাও যায় না। ডাস্টবিনের সংখ্যা যদি একটু বাড়ানো যায় তাহলেও হয়।

কিন্তু তা কি আর ওদের পক্ষে করা সম্ভব? আর ডাস্টবিন বাড়ালে যে কম্পিটিশন বাড়বে না, তাই বা কে বলেছে! সেখানেও যদি লালু ভুলু প্রধান হতে চায়? খিদে বলে কথা! লালু ভুলু চায় এলাকায় শুধু লালুভুলুই থাকবে। আর আমি রোজ ওদের দিকে দু’বেলা বিস্কুট ছুঁড়ে দেব! ওদের ছেলেপুলেদেরও কি আর ঢুকতে দেয় না? এত হিংসে কেন? সে কি আমারই আদরে?

লালু ভুলুর জন্য সত্যিই মাঝেমাঝে খুব কষ্ট হয়। কত প্রতিভা ছিল ওদের! স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার রাস্তা ছিল। কিন্তু সেই যে ওরা বুঝে গেল আমি ওদের না খেতে দিলে ওরা ভাল খাবার পাবে না, সেইদিন থেকে হল সমস্যা। ওরা জানে ওদের লেজ নাড়ানোটা হল গিয়ে ডিফেন্স মেকানিজম। আমি ওদের প্রভু বলে আমার বাতকর্ম-ও ওদের কাছে সুগন্ধী। কারণ আমি না আদর করলে ওদের তো শিরে সংক্রান্তি। আমার বাড়িতে মাছটা, মাংসটা হলে, হাড় যদি ওদের না দিয়ে ওই কালো কুকুরটাকে দিই? যদি আমি অন্য কুকুরদের পোষ্য করে নিই, তাহলে? যা কিছু আদর পেয়েছিল সব তো মাঠে মারা যাবে। সুতরাং চোখ বুজে ভক্তি করো। প্রভু বলে কতা! সবকিছুই তো আমার ইচ্ছের উপরে।

 

আরও পড়ুন: সায়ন্তন ঠাকুরের গল্প: হিরা মালিনী – দ্বিতীয় পর্ব

 

তো আমি যদি হাতে লাঠি নিয়ে নামি, তাকেও ওরা চাটে। আমার এক বন্ধুর কুকুর তো মালিক পেচ্ছাপ করে আসার পর বাথরুমে ঢুকে প্যান পর্যন্ত চাটে। আমার প্রথম প্রথম সন্দেহ হত, রাগ হত, ঘৃণাও হত। এখন আর এসব হয় না। কারণ বুঝেছি কুকুররা সবচেয়ে আগে বুঝে যায় তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে কী কী করতে হবে! স্ট্রাগল ফর এগজিসটেন্স। করতেই হবে। না করলেই বিপদ। তখন পাড়ায় থাকলেও ওদের কেউই দেখবে না, আদর করবে না, খাবার দেবে না, ডাকবে না। চুপচাপ পড়ে থাকবে পাড়ার এক অন্ধকার কোণে। হয়তো পাড়া থেকে বেরিয়ে যেতেও বাধ্য হবে একদিন!

লালু ভুলু এসব ঝুঁকি কেন নেবে? জানে তো, তারা হল নেড়ি। বড়জোর বেপাড়ার কুকুরকে তাড়াতে পারে। আর কিছু না। তাই সবার উপরে মালিক সত্য, তাহার উপরে নাই। মালিকের হাঁচি কাশি টিকটিকি বাতকর্ম, মোদী মার্ক্স নেহেরু কাশ্মীর কবিতা পেট্রল হাগু হিসি ধর্ম গদ্য ভোট চশমা দাড়ি উকুন সব বড় ভালো। আর তারা লালু ভুলু।

আমার বড় ভয় করে মাঝেমাঝে। যখন দেখি আমার আদর ক্রমশ আরও হিংস্র করে তুলছে ওদের। লালু আজকাল ভয় দেখায়। ভুলু, লোভ। কাদের দেখায়? এই আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের গলিটায় একটা নতুন কুকুরকে। এমন স্বাধীকারপ্রমত্ত কুকুরের প্রতি তাদের যাবতীয় হুমকি। যেন বা এ পাড়ার তারাই দাদা। প্রথমে ভাবতাম, এ সবকিছুই নিখাদ কুকুরত্ব। তারপর দেখলাম, নাহ, তাদের এই হম্বিতম্বির কনফিডেন্স অন্য কারণে। অবশ্য শুধু যে লালু আর ভুলুকে দোষ দেওয়া যাবে, তা নয়। ওই যে খাদ্যপ্রার্থী কুকুরটি, তার দোষ কম নয়। সে কেন লোভী হবে? ভুলু যতই তাকে কমফর্ট জোনের লোভ দেখাক না কেন, তাকে তো মনে রাখতে হবে এলাকাটা আসলে আমার আর লালু আমার প্রতিনিধি। সেখানে লালুর মনেও গভীর আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। জানে, সে ল্যাব নয়, গ্রেট ডেন নয়, নেকড়ে তো নয়ই। স্বাভাবিক এক নেড়ি। কিন্তু আমি তাকে ক্ষমতা দিয়েছি।

সেই যে ওরা বুঝে গেল আমি ওদের না খেতে দিলে ওরা ভাল খাবার পাবে না, সেইদিন থেকে হল সমস্যা। ওরা জানে ওদের লেজ নাড়ানোটা হল গিয়ে ডিফেন্স মেকানিজম। আমি ওদের প্রভু বলে আমার বাতকর্ম-ও ওদের কাছে সুগন্ধী। কারণ আমি না আদর করলে ওদের তো শিরে সংক্রান্তি।

সেদিন কী হল জানেন, আমার মামার বাড়ির ল্যাব এল বেড়াতে। সেও আমাকে খুব ভালবাসে। তাকে দেখেই কী চিৎকার। যেন গেল তাদের সাম্রাজ্য। পরে যখন দেখল– না, ব্যাপারটা সামান্য কয়েক ঘণ্টার, তখন অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ফিরে এল। আর যখন সেই বিদেশি ফিরে গেল, তখন শুরু হল তাদের আদরের ঠেলা। আর সে কী আদর! যত বলি পাবি পাবি, তোরাই পাবি সেরা হাড়গুলো। কিন্তু বললেও শোনে না। সকলের সামনে চাটে, হাত তুলে জিভ লম্বা করে, গলা থেকে কৃতজ্ঞতার ঘড়ঘড় শব্দ করে। সে যে পাবলিকলি এসব করছে, তাতে লজ্জাও নেই। অগত্যা নিয়ে আসতে হয় এক প্যাকেট ব্রিটানিয়া মেরি বিস্কুট। আমি ওদের প্রভু বলে কতা! প্রভুকে তো ভালবাসতেই হবে, যদি সে গোপনে গোপনে মারতে চায়, তাই না?

দূর থেকে দেখি উঁকি মারছে ওই ও গলির সাদাটা। মনে পড়ে যায়, সেদিন অন্ধকারে ওর পেটে পা পড়ে গিয়েছিল বলে কী খেঁকিয়েই না এল! নাহ যতই যোগ্য কুকুর হোক, একে আমাদের পাড়ায় জায়গা দেওয়া যাবে না। বলে দিই লালুকে। লালু কান খাড়া করে শোনে। তারপর পিঠের লোম দাঁড়িয়ে যায়। চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে গর্জন শুরু করে। বোঝাই। এভাবে না। এভাবে না। গোপনে ভয় দেখাও। কিন্ত ওই কুকুরটাকে দেখলে বুঝি, এ একবার যদি লালুকে আক্রমণ করে, লালুর শেষদিন সেদিন-ই। যোগ্য হলেও আর কতজন নিজের জায়গা খুঁজে পায়! মনে যার চাকরসত্তা নেই, সে কি ভাল কুকুর হতে পারে?

ঘরে ফিরি। হাত ধুই। বই নিই। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করে। আমি কি মাফিয়া নাকি? আর লালুভুলু কি আমার ক্যাডার?  কেন যে করছি এসব! শুধু তো কবিতা লিখতে এসেছিলাম। লিখতে পেরেছি কি? পাড়ায় আমার খুব নাম। আর ওদের খুব ডাক। কিন্তু তা তো কেবল পাড়ার মধ্যেই। যেদিন আমি এই পাড়া ছেড়ে চলে যাব, সেদিন তো ওদের কোনো আইডেন্টিটিই থাকবে না। তখন ওদের কী হবে? কারা ওদের মনে রাখবে?  কারা খেতে দেবে?

 

আরও পড়ুন: সায়ন্তন ঠাকুরের গল্প: হিরা মালিনী – শেষ পর্ব

 

কিন্তু এখন সে সব দিন আর নেই! লালু আর ভুলু এখন আমার চেয়ে ভাল প্রভু পেয়ে গেছে। এখন লালু ভুলু খেঁকিয়ে উঠলে আর ভৌ ভৌ বেরোয় না। বেরোয় জয় শ্রী…! না, ভূতের মুখে রামনামের মতো আমার কলমেও সে সব আসবে না। কিন্তু আমার ওদের নিয়ে খুব ভয়। ওরা যে প্রভুর প্রতি কোনও প্রশ্ন করে না। শুধু অনুগত থাকে। শুধু একটু খেতে দিলেই হল। পেট ভরে খাওয়ালে এরা যে কোনও বিদেশি কুকুরকে হার মানিয়ে দিতে পারে। আর যদি ওদের পুজো করে কেউ ধর্মরাজ বানিয়ে দেয়, তাহলে তো কথাই নেই। তখন তো ওদের আর এইটুকু এলাকা নয়, দেখা যাবে সব এলাকা থেকে তোলা যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কি আদৌ ওদের পাড়াটা বাড়বে? না কি একটু বেশি বড় পাড়ায় আরও ছোট একটা জগতের মধ্যে শয়তান বুনো খুনে কুকুর হয়ে যাবে এরা?

যাক গে, আমি তো আর ওদের মালিক নই। এখন লালু ভুলু ভোটে দাঁড়িয়েছে। এখন ওরাই আমার মালিক।

Hindol Bhattacharjee হিন্দোল

হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা লেখার শুরু নয়ের দশকে। কবি ও লেখক হিসেবে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দুইই পেয়েছেন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে। মোংপো লামার গল্প, সব গল্প কাল্পনিক, রুদ্রবীণা বাজো, বিপন্ন বিস্ময়গুলি, এসো ছুঁয়ে থাকি এই লেখকের কিছু পূর্বপ্রকাশিত বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *