১
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে নামলেই লটারির দোকানটা। অবিনাশ লটারি। ছোট্ট ঘুপচি। সেই দোকানেও এক কোটি টাকার ফার্স্ট প্রাইজ লেগে গেল! বড় বড় করে দোকানের সামনে পোস্টার মারা। অবাক হলাম। গত তিন বছরে নয় নয় করেও বেশ লটারি জিতেছে ক্রেতারা। সবই এই ভাঙাচোরা দোকানের দাক্ষিণ্যে। অথচ পাকা ছাদও জোটেনি দোকানটার। এখনও অ্যাসবেস্টসের চাল।
গোপা আজকাল প্রায়ই লটারির টিকিটের জন্য তাগাদা দিচ্ছে। আমিই গা করিনি। আমার কাছে লটারির টিকিট কেনা মানে ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো।’ আমার মতো চুনোপুঁটিদের বিন্দু বিন্দু টাকা নিয়েই তো ফার্স্ট প্রাইজের মহাসিন্ধু। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, কী এমন দাম টিকিটের। একশোটা টাকা বার করতে পারব না? কিন্তু মাসান্তে সেই একশো যোগাড় করাই মুশকিল।
আমি আবার ধারদেনায় অক্ষম। অফিসে কারও কাছে হাত পাততে লজ্জা হয়। গোপার লক্ষ্মীর ভাঁড়ে হাত ঢোকাই লুকিয়ে। এমনকী তাতাইও বুঝে গেছে। ওর টিফিনের পয়সা থেকে দশ বিশ টাকা দেয় মায়ের নজর এড়িয়ে। ছেলেটার উপর মায়া হয়। নাহ, লটারি কিনে পয়সা নষ্ট করা অর্থহীন। কত টিকিট কিনেছি আইবুড়োকালে। আমার যা কপাল। লাগবে না। তার থেকে যা চলছে চলুক। সাধে কী বলেছে সুখের থেকে স্বস্তি বড়?
আমি আসলে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। আগে ছিলাম গ্রুপ ডি। প্রোমোশন হয়েছে অনেকদিন পর। প্রায় বারো বছর, মানে একযুগ ধরে ঘষটেছি। সরকারি অফিসে সবকিছুই বড্ড ঢিলেঢালা। হচ্ছে হবে করতে করতেই সময় পেরিয়ে গেল। এদ্দিন গোপা কোনওরকমে চালিয়ে এসেছে। তাতাই বড় হচ্ছে। ক্লাস এইট হল। প্রাইভেট টিউশন না দিলে ছেলেটা দাঁড়াতে পারবে না। স্কুলে তো তেমন লেখাপড়া হয় না। গোপার বড়দা সাহায্য না করলে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোও অসম্ভব ছিল। প্রচণ্ড খরচ স্কুলের। এই অফিসে ক্লার্কের চাকরিতে কোনও উপরির বন্দোবস্ত নেই। গোপা প্রায়ই ঘ্যানঘ্যান করে লটারির টিকিট কিনতে। ওর যেসব আত্মীয়পরিজন লটারিতে টাকা জিতেছে, তাদের ফিরিস্তি দেয়। বিরক্তি ধরলেও হজম করতে হয়। একলপ্তে পঞ্চাশ হাজারের বেশি আজ পর্যন্ত ঘরে আনতেই পারলাম না। প্রোমোশনের বকেয়া মাইনেটা নেহাত সরকার বাহাদুর জমিয়ে রেখে এককিস্তিতে দিয়েছিল, তাই।
ঘরে ঢুকতেই ধুনোর গন্ধ পেলাম। গোপা আবার পুজোআচ্চা খুব ভালবাসে। ভক্তিভরে সন্ধ্যা দেয়। শাঁখ বাজায়, উলু দেয়। কিন্তু আমার আজকাল ধোঁয়ায় কষ্ট হয়। ক’দিন ধরেই একটা খুকখুকে কাশি হচ্ছে। ঠান্ডাগরম লেগেছে বলেই মনে হয়। দফতরে এয়ারকন্ডিশন মেশিনটা বসিয়েছে আমার টেবিলের সোজাসুজি। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জমে যাচ্ছি। এদিকে ট্রেনে বাদুড়ঝোলা হয়ে যেতে আসতে হাওয়া খাচ্ছি। শরীরের আর কী দোষ!
গামছা পরে বালতিটা হাতে নিতেই গোপা তুলসিতলা থেকে চেঁচিয়ে বলল, “গামলায় জল ধরা আছে। পাতকুয়োর জলে চান কোরও না। এমনিই কাশছ।”
কুয়োর জল গায়ে ঢালার সময় গত দু’দিন আমি শিউরে উঠেছি। বরফের মতো ঠান্ডা। মেদমজ্জা ফুটো করে একেবারে শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। আসলে পৈতৃক ভিটের কুয়ো বলেই ভেবেছিলাম যেহেতু অভ্যেস আছে, তেমন কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু গতকাল থেকেই শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। স্নান একেবারে বাদ দিলেও হবে না। ডেলি প্যাসেঞ্জারির চটচটে ঘাম ক্লান্তি আঠার মতো জুড়ে থাকে। তোলা জলই ভাল।
মুড়িমাখার বদলে আজ একটা অন্য জিনিস নিয়ে এসেছে গোপা। চমকে উঠলাম। আজ মাসের শেষ দিন। ত্রিশ তারিখ। প্লেটে সাজানো রসগোল্লা, নরমপাকের সন্দেশ। ভাঁড়ে রাবড়ি। কী ব্যাপার? এসবের আয়োজন করল কে?
তাতাই বড় হচ্ছে। ক্লাস এইট হল। প্রাইভেট টিউশন না দিলে ছেলেটা দাঁড়াতে পারবে না। স্কুলে তো তেমন লেখাপড়া হয় না। গোপার বড়দা সাহায্য না করলে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানোও অসম্ভব ছিল। প্রচণ্ড খরচ স্কুলের। এই অফিসে ক্লার্কের চাকরিতে কোনও উপরির বন্দোবস্ত নেই।
– আগে ঠাকুরের বাতাসাটা মুখে দাও। গোপার চোখে জলভরা মেঘ। থমথমে মুখ।
– মিষ্টি?
– সুবল দিয়ে গেল। এক কেজি রাবড়িও আছে।
– টাকা দিল কে?
– ওর টাকায়।
– মানে? হতভম্ব আমি রাবড়ির ভাঁড়টাকে লক্ষ্য করলাম। কলকাতার অভিজাত দোকানের নাম লেখা।
– বলেও গেল, বউদি লোক দেখে নাও। আর এসব কাজ করব না। পোষাচ্ছে না।
এবার ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। বিরক্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে গোপা।
– গৌরচন্দ্রিকা ছাড় তো। যত্তসব মেয়েলি প্যানপ্যানানি। আসল কথাটা বলবে?
গোপা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। চোখ বড় বড়। নাকের পাটা ফুলছে।
– বলি আসল কথাটা কোনওদিন শুনেছ? ঘরের লোকের কথা তো কানেই নাও না।
পাশের ঘর থেকে তাতাই ছুটে এল। “কবে থেকে চিল্লিয়ে যাচ্ছি ওগো, একটা লটারির টিকিট কেনো। নাও, এখন সহ্য করতে পারবে তো ? পায়ের জুতো মাথায় উঠল।”গোপার চুল অবিন্যস্ত। আজ চুলে চিরুনি ছোঁয়ায়নি। হাতখোঁপা খুলে পড়েছে।
– হেঁয়ালি রেখে খুলে বলবে, নাকি বেরিয়ে যাব? আমার রাগ চড়ছে। তাতাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুবলকাকা অবিনাশ লটারির ফার্স্ট প্রাইজ জিতেছে। এক কোটি।”
সুবলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিত্যদিনের লড়াইয়ে ভাঙা চোয়াল, তোবড়ানো গাল। আমার থেকে বছর দশেকের ছোট কে বলবে। উল্টে বুড়ো দেখায় ওকে। সুবল লাইনপাড়ের বস্তিতে থাকে। সারা পাড়ার ফাইফরমাশ খাটে। বাবা ওকে দিয়ে কুয়োতলা, উঠোন সাফ করাত, নারকেলের ডাল ঝাড়াত বলে আমাদের বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। আমিও টুকটাক কাজকর্ম করাই। বদলে একথালা ভাত খেয়ে যায় আর পুরনো দু’একটা শার্টপ্যান্ট নিয়ে যায়। একমাত্র পুজোর সময় ওকে কড়কড়ে নোটে বখশিশ দিই কারণ বোনাস পাই বলে।
মাথাটা হঠাৎ জ্বলে উঠল। শালা, আমি খেটে খেটে মুখে রক্ত তুলব আর তুই আয়েশ করবি বসে বসে! বিধাতার চক্রান্ত ছাড়া এ আর কিছুই নয়। মনে হল টান মেরে ঠাকুরের আসনটা ফেলে দিই। গোপার চোখ ছলছলে। ও আবেগ চাপতে পারে না। আমি প্লেটটা সরিয়ে দিলাম টুসকি দিয়ে। গোপাকে বললাম, “এই ব্যাপার! এমন ভাব করছ যেন আমার ভাগের টাকাটা সুবল জিতে নিয়েছে।”
তাতাই নির্লিপ্তসুরে বলল, “সেটাই তো মাকে বোঝাতে পারছি না। দু’শোটা টাকা দিয়ো তো বাবা। জ্যাকপট যে কেউ জিততে পারে। এনিবডি। তবে ফার্স্টে অবিনাশেই ট্রাই করব। ভেরি লাকি শপ।”
আমার মাথায় শুধু অবিনাশ নামটা ঘুরতে লাগল চরকির মতো।
২
দুটো কাশির সিরাপ কিনেছিলাম পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে। এরকম কাশি আমার আগেও হয়েছে। আবার সেরেও গেছে আপনাআপনি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই অন্তত হাজার দুয়েক টাকার ধাক্বা। ভিজিট, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধপত্র মিলিয়ে। ভেবেছিলাম এবারও সেরে যাবে। কিন্তু কাশির সঙ্গে বুকে একটা ব্যথা শুরু হল। তারপর মাঝরাতে কাশতে কাশতে বালিশে রক্ত উঠে গেল। ঘাবড়ে গেলাম। পাশে গোপা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওকে না জাগানোই স্থির করলাম। থাক, নিশ্চিন্তে ঘুমাক। এমনিই সারাদিন সংসারের জোয়াল টানে।
গতকাল মাইনে পেয়ে অবিনাশ লটারি থেকে ‘বঙ্গরত্ন বাম্পার’ এককোটির টিকিট কিনেছি। কেউ জানে না। ইচ্ছে করেই বলিনি। তাতাইকেও দু’শো টাকা দিয়েছি। ওকে বলেছি অবিনাশ থেকে ‘মহালক্ষ্মী সুপারডুপার’ কাটতে। আজ লম্বা লাইন পড়েছিল অবিনাশে। চপের দোকান ছাড়িয়ে রিকশাস্ট্যান্ড অবধি। মালিকটা হিমশিম খাচ্ছিল বিক্রিবাটা সামলাতে। যেদিন ভিড় কম থাকবে, মালিকটার সঙ্গে খোশগল্পে ভাব জমাব।
ষ্টেশন লাগোয়া একটা পলিক্লিনিকে কম টাকায় কিছু ডাক্তার পাওয়া যায়। সদ্য এমডি পাশ করা এমনই এক ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলাম। তরুণ হলেও এলাকায় নামডাক আছে। তিনি স্টেথো দিয়ে দেখেটেখে বললেন, “কফ, রক্ত পরীক্ষা আর বুকের এক্স রে করে তিনদিন পর আসুন। স্ক্যান পরে লাগতে পারে। যদি খারাপ কিছু দেখি তখন।”
পাশের ঘর থেকে তাতাই ছুটে এল। “কবে থেকে চিল্লিয়ে যাচ্ছি ওগো, একটা লটারির টিকিট কেনো। নাও, এখন সহ্য করতে পারবে তো ? পায়ের জুতো মাথায় উঠল।”গোপার চুল অবিন্যস্ত। আজ চুলে চিরুনি ছোঁয়ায়নি। হাতখোঁপা খুলে পড়েছে।
আমি ইতস্তত করে বললাম, “অনেকদিন ভোগাচ্ছে কাশিটা। কোনও ওষুধ দিলেন না?”
ডাক্তারবাবু বললেন, “এখন ওষুধ খাওয়ার জন্য হেদিয়ে পড়ছেন কিন্তু যদি টিবি ধরা পড়ে তবে এক বছর টানা ওষুধ খেতে হবে।”
আমার চোখ কপালে উঠল। “এক বছর?”
– হ্যাঁ, আর সেরকম বজ্জাত টিবি হলে আরও বেশি। রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা। ভাল কথা, আপনি রুমাল ব্যবহার করবেন। যেখানে সেখানে কাশবেন না। বাড়িতে খাওয়ার থালা বাসন আলাদা করবেন।
বাসনকোসন আলাদা করব ! আমি কি অস্পৃশ্য? বাড়িতে সুবলের থালাবাটি গ্লাস আলাদা করা আছে জানি। আমি কি ওর সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসব? হঠাৎ মনে পড়ল, সুবল তো কোটিপতি। এখন আর আমার বাড়ির ছায়া মাড়াবে না। তাহলে কি ওর থালাতেই খেতে হবে আমায়!
অসংলগ্ন ভাবনার ভিড়ে মাথাটা টলে গেছিল। পলিক্লিনিকের দারোয়ান আমাকে স্ট্যান্ডের রিকশায় তুলে দিল। আজ হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই। কিন্তু গোপাকে এখনই কিছু বলা উচিত হবে না। দুশ্চিন্তা করবে। তার থেকে আগে কফ পরীক্ষা আর বুকের ছবি করি। কাল অফিসে হাফ সি এল নেব। সকালে শিয়ালদা নেমে আগে ঢুকব সরকারি হাসপাতালে। ওখানে দেখিয়ে নেব আর পরীক্ষাগুলোও করিয়ে নেব। ভাবনাচিন্তা করে দেখলাম পলিক্লিনিকের ডাক্তারবাবুর সঙ্গে নিশ্চয়ই এক্স রে সেন্টারের যোগসাজস আছে। নয়তো একটা ওষুধও লিখলেন না অথচ ভিজিট নিলেন! সরকারি হাসপাতালে অকারণ ভয় দেখাবে না।
বাড়িতে ঢুকতেই তাল ফুলুরির গন্ধ পেলাম। গোপা তালের বড়া ভাজছে। আমাকে দেখে বলল, “আজ এত দেরি হল? শিগগির হাত পা ধুয়ে এস। গরম গরম খাবে।” তাতাই স্কুলের টার্ম পরীক্ষায় অঙ্কে আর ফিজিক্সে পুরো নম্বর পেয়েছে। খাতা নিয়ে এল। গার্জেনকে সই করাতে হবে। গর্বে বুক ফুলে উঠল। খুব ইচ্ছে করছিল ওর চুলটা ঘেঁটে দিই, জড়িয়ে ধরি। সংযত করলাম নিজেকে। নাহ, উচিত হবে না। যদি ছোঁয়াচে হয় রোগটা…
গোপাকে বললাম, অফিসে একজন হাত দেখে বলেছেন, এক মাস কলাপাতায় ভাত খেতে আর ব্রহ্মচর্য পালন করতে। আমার নাকি ফাঁড়া চলছে। সামনের অমাবস্যার পরে কেটে যাবে। গোপা উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “আমিও ভাবছিলাম তোমার নামে একটা বারের পুজো দেব।”
আমি বললাম, “তুমি আগে তাতাইকে বইপত্তর নিয়ে এঘরে শিফট করতে বল। আমি আজ থেকে তাতাইয়ের ঘরে থাকব।”
জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে ‘দুগগা দুগগা’ জপতে জপতে গোপা পাশের ঘরে গেল। বালিশের খোল আর চাদর বয়ে নিয়ে গেল তাতাই। গোপা আমার বিছানা করে মশারি টাঙিয়ে রাখবে। আড়চোখে দেখলাম ওকে। কিচ্ছু টের পায়নি। এভাবেই কদিন কাটুক। এর মধ্যে একটা হেস্তনেস্ত হবে। পকেট থেকে লটারির টিকিটটা বার করে সন্তর্পণে আলমারির লকারে রাখলাম। কয়েকটা দরকারি কাগজ আছে লকারে। বাড়ির দলিল, বাবার ডেথ সার্টিফিকেট, আমার নামে একটা বিমা। টিকিটটা এখানেই সুরক্ষিত।
৩
চোখে ঝাঁক ঝাঁক সর্ষেফুল দেখলাম। হঠাৎ আত্মীয় পাব কোথায়? এদিকে এমন সুযোগ হাতছাড়া করাও অনুচিত। যেখানে দু’তিন মাস বাদে তারিখ পাওয়া যায় সেখানে আজকেই স্ক্যান হবে। বাইরে অনেক খরচ। ডাক্তারবাবু বললেন, হাজার তিন চারেক লাগবে। এখানে সম্পূর্ণ ফ্রি। গোপাকে বলার প্রশ্নই ওঠে না।
ডিপার্টমেন্টের কারওকে ডাকব না। কুচুটে লোকজন। কথাটা চাউর করবে কিন্তু সুরাহা হবে না। বরং পাড়ার ঝন্টু কিংবা প্রদীপকে ডাকলে হত। কিন্তু ওরা ট্রেন ধরে আসতে আসতে আউটডোর বন্ধ হয়ে যাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর আত্মীয়দের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই অগত্যা শ্বশুরবাড়ির দিকে কাউকে বলা যায় কিনা গভীরভাবে ভাবছিলাম।
সরকারি হাসপাতালের পাঁচিলে যারা পা ঝুলিয়ে বসে থাকে তাদেরকে আমার বাঘা বাঘা জ্যোতিষীর থেকেও বড় মনে হয়। এঁরা মুখ দেখলেই মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। আমাকে দেখেই একজন লাফিয়ে নামল পাঁচিল থেকে।
তাতাই স্কুলের টার্ম পরীক্ষায় অঙ্কে আর ফিজিক্সে পুরো নম্বর পেয়েছে। খাতা নিয়ে এল। গার্জেনকে সই করাতে হবে। গর্বে বুক ফুলে উঠল। খুব ইচ্ছে করছিল ওর চুলটা ঘেঁটে দিই, জড়িয়ে ধরি। সংযত করলাম নিজেকে। নাহ, উচিত হবে না।
– ভাই কী ব্যাপার? কোনও আর্জেন্ট সমস্যা? রক্ত লাগবে? পেশেন্ট ভর্তি করতে পারছেন না? ট্রলি দরকার?”
কেউ গায়ে পড়ে যেচে কথা বললে ভারি বিরক্ত লাগে। ডেলি প্যাসেঞ্জারি করি বলে এদেরকে এড়িয়ে চলি। বেশিরভাগ পকেটমার। কিন্তু এখন শিরে সংক্রান্তি। অতএব, বলেই ফেললাম, “আমি তো একা।” আমার গলার কাঁপুনি লোকটার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এড়ায়নি। আমি ভাবছিলাম ছুঁচ ফুটিয়ে পরীক্ষার সময় অজ্ঞান হয়ে গেলে কী হবে! পকেটে তিনশো টাকা আছে। ট্রেনের মান্থলি। আইডেন্টিটি কার্ড। সব হাপিশ হবে। বাড়ি ফিরবই বা কীভাবে! লোকটা পান খাওয়া দাঁত বার করে হেসে বলল,
– কোথায় একা? ম্যায় হুঁ না! আপনার বড়দা শাহরুখ খান। সারা হাসপাতাল আমাকে বড়দা বলে চেনে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনার কাজ হয়ে যাবে।
হয়েও গেল। কড়কড়ে দুশো টাকা দিয়ে বড়দা কিনলাম। বড়দা সই করল আবার বসেও রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না ছুঁচ ফুটিয়ে পরীক্ষা হয়। যন্ত্রণা হচ্ছিল কিছুক্ষণ পর। বড়দা কিন্তু পালাল না। আমাকে নিজের পয়সায় কোল্ড ড্রিংক খাওয়াল, ব্যথার ট্যাবলেট জোগাড় করে আনল। প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেও দিল। ফোন নম্বর দিয়ে বলল পরে দরকার হলে যেন যোগাযোগ করি। আজ দেরি হওয়ার জন্য অন্য ট্রেনে উঠেছি। সব অচেনা মুখ। ভাদ্র মাসের গুমোট গরম। কাঁচরাপাড়া পেরনোর পর ভিড়টা একটু পাতলা হতেই দেখলাম সুবল বসে আছে।
আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম। এতক্ষণ সুবলের কথা যে মনে পড়েনি, তা নয়। কিন্তু সন্দেহ ছিল যে লটারি জিতে ওর মাথা ঘুরে গেছে। সুতরাং ডাকলে আগের মতো ছুটে আসবে কিনা সন্দেহ। সুবল আমার মুখ দেখেই বুঝল গন্ডগোল। ও প্রথমেই ওর সিটে আমাকে বসাল। তারপর বকাবকি করতে লাগল, যে ওকে ডাকিনি কেন। সারাদিন ধকল গেছে। ঘেমে নেয়ে তৃষ্ণার্ত। ট্রেন থেকে এক বোতল জল কিনলাম। সুবল কিছুতেই দাম দিতে দিল না। আমার ভালো লাগছিল আবার গায়ে জ্বালাও হচ্ছিল। পই পই করে ওকে বলে রাখলাম যে আমার অসুখের কথাটা যেন কারওর কাছে না বলে। বিশেষত গোপাকে নিয়ে আমার ভয়। হাউহাউ করে কাঁদবে। অসুস্থ হয়েও পড়তে পারে।
আমার শরীরের হাল দেখে সুবল রিকশা নিতে চাইছিল। কিন্তু আমিই নিষেধ করলাম। আজ প্রচুর বেহিসাবি খরচ হয়েছে । সুবলের থেকে তো রিকশাভাড়া নেওয়া যায় না। তার থেকে ধীরেসুস্থে হেঁটে যাই। সুবলকে বললাম, “চল বাড়ি অবধি দিয়ে আসবি।” ও বলল, “আরে সেকথা বলতে হবে তোমায়?”
আশ্বস্ত হলাম। অবাঞ্ছিত কেউ সঙ্গে থাকুক আমিও চাইনি। সুবল এক কোটি টাকা পেয়ে কী পরিকল্পনা করছে, সে কৌতূহল কুরে কুরে খাচ্ছে সেই প্রথম দিন থেকেই। আজ ফুরসত মিলে গেল নিরিবিলিতে শোনার। কিন্তু সুবলের সঙ্গে হাঁটা ঝকমারি। কিছুক্ষণ পরে পরেই ওর পরিচিত মুখেরা ঘিরে ধরতে লাগল।
– সুবল, তোমার তো বিরাট খবর। ধার নেব কিন্তু।
– খাওয়াচ্ছিস কবে ছোঁড়া?
– সুবলদা, মাইরি ফাটিয়ে দিয়েছ। এবার পুজোতে পঞ্চাশহাজার টাকা চাঁদা দেবে।
সুবল রীতিমতো সেলিব্রিটি হয়ে উঠেছে উপলব্ধি করলাম। আমাকে কেউ পাত্তাই দিল না। এতক্ষণ বুকের ব্যথাটা টের পাইনি। আবার চিনচিন করে শুরু হয়েছে। সুবলের সঙ্গে নিভৃতে কথাই হল না। ছোট লোহার গেটটা খোলার সময় সুবল শুধু বলল, “ভাবছি আসলের পুরোটাই ফিক্সড করে রাখব বউয়ের নামে। সুদ যা আসবে তা দিয়ে একটা ফাস্টফুডের দোকান খুলব স্টেশনে।”
– চলবে? আমার বুকের ব্যথাটা বাড়ছে। সুবল আওয়াজ করে হাসল। “দৌড়বে গো দাদা। তাতাইকে জিজ্ঞেস কোরও। ওদের বয়সী ছেলেপুলেই তো খায়।”
বারান্দায় বসে গোপা মোচা ছাড়াচ্ছে। পরনে একটা সাধারণ জংলা ছাপা শাড়ি। ওকে একটা ভাল শাড়িও দিতে পারিনি। একবার মুখফুটে চেয়েছিল সিল্ক কাতান। সুবলের বউ টুম্পার চেহারাটা হঠাৎ ভেসে উঠল চোখের সামনে। কাতানসিল্ক জড়ানো। আমি চোখ বুজে ফেললাম।
আরও পড়ুন: শ্যামলী আচার্যের ছোটগল্প: লাল ঘুড়ি
৪
নাহ লাগল না। পয়া তারিখেই লটারির টিকিট কাটল তাতাই, অবিনাশের দোকান থেকে। কিন্তু নম্বর মিলল না। তাতাইয়ের ‘মহালক্ষ্মী’, আমার ‘বঙ্গরত্ন’ সব ফেল। একদিন ফাঁকায় দোকানের মালিকটাকে বাগে পেয়ে প্রচুর ভাট বকলাম। উদ্দেশ্য আর কিছুই না। টিপস নেওয়া। প্রাইজ জেতার সুলুক সন্ধান। তাও সবশুদ্ধ মোট চারশো টাকা গচ্চা গেল।
এই বাজারে চারশো কম নয়। তিনজন মানুষের তিনদিনের বাজারখরচ। মাছমাংস না হোক, নিরামিষ তো হত! সুবলের ফাস্ট ফুড সেন্টারের পাশ দিয়ে যেতে রাগে গা রিরি করে জ্বলে উঠল। ব্যাপক বিক্রি! নীচে ডাঁই হয়ে থাকা থার্মোকলের এঁটো প্লেট গুনতি করলেই বোঝা যায় কত খরিদ্দার সুবলের।
তাতাই চুপিচুপি জানাল সেদিন গোপাও নাকি অবিনাশ থেকে টিকিট কিনেছে। শ্যাম্পুর শিশি কেনার জন্য একশো টাকা চেয়েছিল গোপা। তবে কি… কলঘরে গিয়ে দেখলাম আমার আশঙ্কা অমূলক নয়। ধুঁধুলের ছোবড়ার পাশে রিঠেসিদ্ধ। দুটো এক টাকার স্যাশে শ্যাম্পু। ঘরে গিয়েও শ্যাম্পুর বোতল চোখে পড়ল না। আমার চোখ জ্বালা করছে। বুঝলাম গোটা পরিবার লটারির পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছি। কিন্তু এ তো অনিশ্চিত। তাহলে?
হপ্তাখানেক বাদে রিপোর্ট নিতে গেলাম হাসপাতালে। এই ক’দিনে শরীর আরও দুর্বল হয়েছে। রিপোর্টে কী লেখা আছে স্পষ্ট বুঝলাম না। কিন্তু ‘কার্সিনোমা অফ লাংস’ শব্দটার মানে যে ক্যানসার সেটা আমার অজানা নয়। গোটা পৃথিবী এক লহমায় পানসে হয়ে গেল। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় মনে হচ্ছিল আমি না থাকলেও কিচ্ছু এসে যায় না জগতের। আমি এক অপ্রয়োজনীয় বস্তু। আজ সজীব। কাল জড়।
ঘরে ফিরে তাতাইয়ের হাসিতে হুঁশ ফিরল। স্কুলক্রিকেটে ক্যাপ্টেন হয়েছে। জার্সি দিয়েছে স্কুল। ব্যাট কিনতে কলকাতায় যেতে চাইল। গোপাও ছেলের সঙ্গে যেতে চাইছে। সত্যিই তো, একঘেয়ে জীবনে বদল চাইবে, এতে অন্যায় কী! আমি চোখ বুজলে গোপার আছে কে? একমাত্র দাদাই যেটুকু স্নেহ করে। কিন্তু বউদি খান্ডারনি। গোপা বিশেষ লেখাপড়াও জানে না। মাধ্যমিক ফেল। কোথাও চাকরির আশা নেই। তাতাইকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
দিল্লিবাসী শালাকে খবরটা দেওয়া উচিত হবে কি হবে না এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পরদিন হাসপাতালে গেলাম। আউটডোরে ঢুকেই চমকে গেছি। এ কী! ইনি তো সেই ডাক্তারবাবু যাকে আমি পলিক্লিনিকে দেখিয়েছিলাম প্রথমে। ডাক্তার অনিন্দ্য সরকার! আমাকে চিনতে পারেননি। মুখের ভাব দেখেই বুঝলাম। রিপোর্ট দেখে বললেন, সরকারি স্তরে এই মুহূর্তে এ রোগের ঠিকঠাক ওষুধ পাওয়া দুর্লভ। সাপ্লাই নেই। কেমোথেরাপি লাগবে এখনই। ছটা কেমো দিতে হবে খেপে খেপে। সমস্যা হল সব মান্ধাতার আমলের ওষুধ। তেমন কাজের নয়। তাতেও লাইন আছে। আমার থেকেও খারাপ রোগীদের অগ্রাধিকার। মরিয়া হয়ে বললাম,
– হালফিলের ভাল ওষুধ পড়লেও কি বাঁচার সম্ভাবনা নেই ডাক্তারবাবু?
– পাচ্ছেন কোথায়? বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। প্রচুর খরচ।
– ঠিক আছে। সেটার রেফারেন্সই দিন।
ডাক্তার সরকার চশমার ফাঁক দিয়ে অদ্ভুতভাবে দেখলেন। বললেন,
– দেখুন, আপনাকে নিরাশ করছি না। বাঁচার ইচ্ছে মানুষের বেসিক চাহিদা। আসলে কী জানেন, সর্বস্বান্ত হবেন এমনও সম্ভাবনা আছে। ঘটিবাটি বিক্রি করেও হয়তো সুস্থ হতে পারলেন না কিন্তু জলের মতো খরচ। ঠিক আছে, কয়েকটা ঠিকানা দিচ্ছি। চেষ্টা করে দেখুন।
সেই চিরকুট নিয়ে পরের তিনদিন আমি একাই শহরের সব বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতাল চষে ফেললাম। কিন্তু যে উদ্যম নিয়ে শুরু করেছিলাম, অচিরেই মিইয়ে গেল। আমার ছটা কেমো এবং তার আনুষঙ্গিক খরচ যা বলল, তাতে ভিটেমাটি বাঁধা দিতে হবে। যদি মরে যাই তবে গোপা আর তাতাই যাবে কোথায়! মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যাবে।
অগত্যা শালাকে ফোন করে সবকিছু খুলে বললাম। সে বেচারি শোনামাত্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। ভাবলাম হয়তো বোনের ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তা করছে। কিন্তু বড়শালা যে চাকরি ছেড়ে দিল্লির লোহালক্বড়ের ব্যবসায় সমস্ত পুঁজি লগ্নি করেছে, সে খবর আমার কাছে ছিল না। বলল টাকাপয়সা ঢেলে হাত পুরো ফাঁকা। বড়জোর পঞ্চাশ হাজার পাঠাতে পারবে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। এখন উপায়?
আরও পড়ুন: বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়র ছোটগল্প: সহযোদ্ধা
হাল ছেড়ে দিয়ে পরদিন থেকে আবার অফিসে যেতে শুরু করলাম। কী আর করা যাবে। আমরা তো নিয়তির সন্তান। ভাগ্যের মার যখন খেয়েছি, সহ্য করতেই হবে। চোখের সামনে তিলতিল করে স্ত্রী পুত্রকে কপর্দকশূন্য হতে দেখার থেকে মরাও ভাল। বড়শালাকে অনুরোধ করেছিলাম যেন গোপাকে না জানানো হয়, সেও ফোনে আর্জি জানাল আমি যেন বিনা চিকিৎসায় নিজেকে শেষ না করি। গতকাল ফোন করে শালাবাবু আরও বলল আমার জন্য এক লাখ টাকা জোগাড় হয়ে যাবে।
৫
এক লাখের আশ্বাসে আমার মনোজগতে কিছুই হেরফের হল না। আজকাল আমার বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। অফিস যাই। কোনওরকমে কাজকর্ম করি। ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরি। রাতে কেশে কেশে দলা দলা রক্ত তুলি। যা দীর্ঘ লাইন! সরকারি কেমো পাওয়ার আগেই হয়ত আয়ু ফুরোবে আমার। প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে হাজার বিশেক তুলেছিলাম চিকিৎসার জন্য। পরিবার নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে গেলাম দুম করে। বলা যায় না আর কদিন আছি।
গড়িয়াহাটের শাড়ি প্যালেসে ঢুকেই গোপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনেক শাড়ির ভিড়ে একটা লাল কাতানসিল্ক চোখ টানল আমার। সবুজ আঁচল। আয়নার সামনে গোপার গায়ে যখন শাড়িটা ফেলে দেখাচ্ছিল সেলসম্যান, ওকে রানির মত লাগছিল। খুশিতে গোপার মুখ দিয়ে কথা বেরল না। আর আমার খুব কান্না পেয়ে গেল। পুরুষমানুষের কাঁদতে নেই। তাই লুকিয়ে রুমালে চোখ মুছলাম।
তাতাইকে ক্রিকেট ব্যাট ছাড়াও ডিউজ বল কিনে দিলাম। আর একটা স্মার্টফোন। অনেকদিন আগে চেয়েছিল ছেলেটা। বায়না করা ওর স্বভাবে নেই। তাই ভুলেও গেছিল। অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে আমার গালে চকাস করে হামি খেয়ে ফেলল ছেলে। ধর্মতলায় একটা বড় রেস্তরাঁয় ওদের নিয়ে খেতে গেলাম। আমার খিদেবোধ বহুদিন অবলুপ্ত। কিন্তু ছেলে আর বউ যখন আমার প্লেটে বিরিয়ানি তুলে দিচ্ছিল, না করতে পারলাম না। তাতাই চেটেপুটে খেল। রেজালার মাংস চুষে হাড়গোড় ছিবড়ে করে ফেলল। গোপাও খুব তৃপ্ত। বিশেষত মিষ্টি পান খেয়ে।
ফেরার সময় শিয়ালদার ভিড়ে তিনজন তিনদিকে ছিটকে আলাদা হয়ে গেলাম। এমনিতেই প্ল্যাটফর্মে অন্যদিনের থেকে বেশি ভিড়। শ্রাবণমাসে বাবার মাথায় জল ঢালার ফিকিরে প্রচুর সাধুসন্ন্যাসী। গোপা আর তাতাই নিত্যযাত্রী নয়। ভিড় কাটানোর উপায় জানা নেই। ওদের টিকিটও আমার পকেটে। রেলপুলিশের হাতে পড়লে হাজতে। আপ রানাঘাট আর গেদে লোকালের কামরায় খুঁজে পেলাম না। ডাউন ট্রেনের লাইন ফাঁকা।
পাগলের মতো খুঁজে চললাম ওদের। কিছুক্ষণ বাদে তাতাইকে পেয়ে গেলাম। ও রেলের অফিসে গিয়ে বলেছিল তাই মাইকে ওর নাম ঘোষণা করেছিল। কিন্তু গোপাকে কোথাও পেলাম না। উদভ্রান্তের মতো দৌড়োদৌড়ি করে চললাম। ছেলের মুখ শুকিয়ে আমসি। হঠাৎ একজন পরিচিত নিত্যযাত্রী জানালেন, শিয়ালদা সাউথে এক মহিলা বিনা টিকিটে চেকারের হাতে ধরা পড়ে কান্নাকাটি করছে। দৌড় দৌড়। আবার ছুটলাম। জীবনটাই শুধু দৌড়ে বেড়ানো আর খোঁজাখুঁজি।
গোপাকে উদ্ধার করলাম। বারুইপুর লোকালে ভুল করে উঠে গেছিল। আমাকে দেখে মনে হল যেন হারানিধি পেয়েছে।
– একটা ফোন করতে পারলে না?” গোপা জিভ কেটে বলল,
– পার্স রাখিনি তো কাছে। বুথে টাকা ছাড়া ফোন করতে দেয় না।
গড়িয়াহাটের শাড়ি প্যালেসে ঢুকেই গোপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনেক শাড়ির ভিড়ে একটা লাল কাতানসিল্ক চোখ টানল আমার। সবুজ আঁচল। আয়নার সামনে গোপার গায়ে যখন শাড়িটা ফেলে দেখাচ্ছিল সেলসম্যান, ওকে রানির মত লাগছিল। খুশিতে গোপার মুখ দিয়ে কথা বেরল না।
কামরায় তিনজন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসলাম। আজকের মতো দিন আগে আসেনি। অপূর্ব। বাড়ি ফিরেও ঘোর কাটছিল না ওদের। গোপা বারবার শাড়িটা খুলে দেখছিল আর তাতাই ফোন থেকে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল বন্ধুদের সঙ্গে। স্টেশনে নেমে সিম ভরে দিয়েছি ওর ফোনে।
গভীর রাতে গোপাকে ডাকলাম বারান্দায়। আজ পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় কুয়োতলা, চাতাল ভেসে যাচ্ছে। আমার বুকের ভিতরেও সমুদ্র। আবেগের ঢেউ টলমল।
– গোপা, আজকের মতো যদি আবার হয়। ধর আমাদের আর দেখাই হল না। পার্মানেন্ট হারিয়ে গেলাম।
বোধহয় কিছু আন্দাজ করেছিল গোপা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
– জানতাম, কিছু একটা লুকোচ্ছ তুমি। বিছানা আলাদা করলে, পাত আলাদা করলে। সব তোমার অজুহাত।
– আমার বিরাট রোগ হয়েছে গোপা। আশা নেই। আমার গলা বুজে আসছে। প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার সংবাদ দেওয়া ভয়ঙ্কর। যমের কাজটা আমিই করছি দূতী হয়ে। চিল চিৎকার করে কেঁদে উঠল গোপা।
– তোমার এত বড় অসুখের কথা গোপন করেছ? ওষুধপথ্যি না করে উল্টে হাজার হাজার টাকা খরচ করছ আমাদের পিছনে? চল, কালই তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। গোপার গলা ভেঙে গেছে।
– চুপ কর, তাতাই জেগে যাবে।
– জাগুক। তাতাইয়ের জানা দরকার বাবার কী হয়েছে। তুমি কেমন মানুষ যে নিজের হাতে আমাদের জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছ!
আমি ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। কাশির দমকটা আজ কম। বোধহয় আজকের জন্য অসুখটাকে পজ় বাটন দিয়ে থামিয়ে রেখেছে যমরাজ। শুনতে শুনতে গোপার চোখ জ্বলে উঠল। ঘরে গিয়ে একজোড়া বাউটি নিয়ে এল।
– এটা কালই বেচবে। আর আমি নিজে যাব সুবলের কাছে।
– লোক হাসিও না গোপা। সুবলের দায় পড়েছে আমার চিকিৎসার টাকা দিতে।
– আমি তো ধার চাইব। নদী থেকে এক মগ জল দিতে পারবে না সুবল? কোটি টাকা বাপ রে! তোমার কেমোটা হোক।
– গোপা, দুনিয়ায় সবকিছুই লটারি। সুবলের সেই রেলা নেই।
গোপার চোখে বিস্ময়।
– টুম্পা ছেড়ে গেছে ওকে। কানাঘুষোয় শুনলাম বাইকওয়ালা যে মাছের ব্যবসায়ী ঘুরঘুর করত, তার সঙ্গেই পালিয়েছে। বাচ্চাদুটোকেও ফেলে গেছে। সুবল নাকি ওকে টাকাপয়সা কিছুই দিত না। সুবলের রোল চাউমিনের দোকানও উঠে গেছে। ওকে দেখতেই পাই না।
গোপা নির্বাক।
আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের বড়গল্প: যত দূরেই যাই পর্ব ১, পর্ব ২
গোপা তুলসিতলায় উপুড় হয়ে পড়ল। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে লাগল, “এতবড় বিপদে তুমি পাশে দাঁড়াও ঠাকুর। অন্তত যেন মানুষটার চিকিচ্ছে করতে পারি।”
পরদিন সন্ধেবেলায় একটা ফোন এল।
– মিস্টার দীপক দাস বলছেন?
– হ্যাঁ, বলুন।
– আমি ডাক্তার অনিন্দ্য সরকার বলছি।
– ডাক্তারবাবু আপনি?
– শুনুন, আপনি অ্যাপ্লাই করেছিলেন কেমোথেরাপির জন্য?
অন্ধকারে একফালি আলোর রশ্মি ঝলকে উঠল। আমি কোনওরকমে ঢোঁক গিলে সাড়া দিলাম। – মিস্টার দাস, আপনি কালই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। একটা বিরাট বড় এনজিও ক্যানসারের ওষুধ দিচ্ছে অত্যন্ত কম দামে। কিন্তু সেই সুযোগ পেতে গেলে আপনাকে ওদের প্রোজেক্টে সই করতে হবে। ওরা আপনার সব রিপোর্ট নেবে, ফটো তুলবে। গবেষণার কাজে লাগাবে। ইটস আ কন্ট্রাক্ট। আপনার মতো যারা কেমোথেরাপির খরচ তুলতে পারছেন না, তাদের জন্য এটা একটা চান্স।
আমি ওকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। কাশির দমকটা আজ কম। বোধহয় আজকের জন্য অসুখটাকে পজ় বাটন দিয়ে থামিয়ে রেখেছে যমরাজ। শুনতে শুনতে গোপার চোখ জ্বলে উঠল। ঘরে গিয়ে একজোড়া বাউটি নিয়ে এল। এটা কালই বেচবে। আর আমি নিজে যাব সুবলের কাছে।
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। এই ডাক্তারকে কমিশন খাওয়া দালাল ভাবছিলাম! অথচ আমি সরকারি হাসপাতালে ওঁকে চেনাটুকু পর্যন্ত দিইনি। এমনকী রিপোর্ট নিয়ে দেখাও পর্যন্ত করিনি পলিক্লিনিকে। ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচব তো?
– দেখুন, বাঁচামরা পুরোটাই ফিফটি ফিফটি। ওভাবে তো বলা যায় না। রোজ কত সুস্থ লোক মারা যাচ্ছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে। আমরা বড়জোর চেষ্টা করতে পারি। তবে এই এনজিও-দের দেওয়া ওষুধটা কিন্তু আপনি যে কেমো নেবেন ভেবেছিলেন তার থেকেও পাওয়ারফুল। এর লাইফ এক্সপেক্টেন্সি অনেক বেশি।
– আমার মোবাইল নম্বর পেলেন কোথায় স্যার? আমি তো নাম ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলাম অঙ্কোলজি ডিপার্টমেন্টে।
– লটারির টিকিট কিনেছিলেন বোধহয় সেদিন। খামটা ফেলে গেছিলেন সেদিন সরকারি হাসপাতালে, আউটডোরে। আমার টেবিলে। টিকিটের পিছনে আপনার নাম, ফোন নম্বর লেখা ছিল।
আমার বুকের মধ্যে প্রবল ঢেউ উঠেছে। ঝড়ের পূর্বাভাস!
– শুনুন দীপকবাবু, আমার কাছে সিরিয়াস পেশেন্টদের লিস্ট আসে। যাঁদের কেমোথেরাপি খুব প্রয়োজন। লটারির টিকিটে লেখা আপনার নাম, মোবাইল নম্বর কেমো অ্যাপ্লিকেন্টদের একজনের সঙ্গে মিলে গেল। তাই আমিই আপনাকে এনজিও-র দেওয়া প্রথম সুযোগটা দিতে চাইছি। সিরিয়াল অনুযায়ী যদিও আপনার নম্বর সাতশো কুড়ি।
কী বলব বুঝতে পারছি না। হাজার ওয়াটের বাল্ব যেন জ্বলে উঠেছে অন্ধকার ঘরে!
– আমি?
– হ্যাঁ, দীপক দাস। পায়রাডাঙা। অবিনাশ লটারি।
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
খুব, খুব ভাল লাগলো। অনেক দিন পর এক শ্বাসে পড়লাম একটা গল্প। বাহুল্য বর্জিত টান টান আপনার লেখা চিরকালই ভাল লাগে আমার।
কী অসাধারণ লেখা !
জীবনের একটা লটারি পাওয়ার গল্প!
আসলে জীবনে বেঁচে থেকে কখনও কখনও টাকা পয়সা সোনা দানা..এসব মেটেরিয়ালিস্টিক জিনিসও তুচ্ছ হয়ে যায়..যখন প্রায় হেরে যাওয়া পুরো জীবনটাই আবার বেঁচে থাকার একটা চান্স পায়….
এমন মূল্যবান লটারি কজন সৌভাগ্যশালী পায়!
অসাধারণ পাঞ্চলাইন, অসাধারণ ট্যুইস্ট!!
বড় ভাল! আর মর্মস্পর্শী।
এক নি:শ্বাসে শেষ করলাম। টানটান নির্মেদ লেখনি ।
খুব ভালো লাগলো | অভিনব প্লট | লটারি নিয়ে অনেক গল্প পড়েছি তবে এটি চমকপ্রদ লাগলো |
গল্পটা খুব ভাল লাগল…শেষে যে আশার আলো দেখালেন তার জন্য অনেক ধন্যবাদ ♥
Khubbhalo laglo, sheshta besh motivating.