তখন শিবঠাকুর, গৌরীকে বলল, তোমায় হালকা চাঁদের মত সাদাপানা গয়নায় সাজাব।
তারপর কী হল গোরাদাদা?

শোলার ওপর নরুন দিয়ে নকশা তুলছে গোরা। কাজ করতে করতে আড়চোখে কুমোরকাকার আট বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে বলল,
শিব বিশ্বকর্মাকে বলে জলে শোলা ফুল ফোটাল। সাদা সাদা, পলকা। আর আমরা মালাকাররা তানাদের আদেশে ঠাকুরের গয়না বানিয়ে চলেচি।

ঘাটালের রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো এ বছর ত্রিশে পড়ল। আজ মহালয়া। প্রতিমা গড়া প্রায় শেষ। তেঁতুলবিচির আঠার সঙ্গে রং গুলে সরু তুলি দিয়ে মায়ের আকর্ণবিস্তৃত চোখদুটো আঁকা বাকি কেবল। প্রতিপদে চক্ষুদান করা এবাড়ির রীতি। তারপর গর্জন তেল পড়বে, রুপোর অস্ত্রে সেজে উঠবেন মা, পরবেন ডাকের সাজ। শিউলি ফুলের মতো সাদা শোলার ওপর রাংতা সেঁটে গড়ে তোলা মুকুট, চাঁদমালা, বালা, কানপাশায় মা সেজে ওঠেন সপরিবার। মালাকার গোরাচাঁদ একমনে শোলা কেটে নকশা করে মুকুট তৈরি করে চলেছে। কাজের ফাঁকেই চলছে কথা।

তা হ্যাঁরে, তোর বাপ এবার এলনি?
কুমোর কাকা কাজের ফাঁকে নস্যি নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল।
না গো, তার বুকে বেদনা। তার ওপর হাত কাঁপে।
তা তোর কাজ তোর বাপের চেয়েও ভালো। তোর বাপের সঙ্গে কদ্দিনের আলাপ। তোকে ছ’দিনের রেখে তোর মা মোলো। ওইটুনি ছেলে নিয়ে কী কষ্ট! বাপেরে দেখিস সোনা। বড় দুঃখী।

গোরা উদাস হয়ে তাকিয়ে রইল। শরতের ছানাকাটা মেঘ জায়গায় জায়গায় জমে গিয়ে এখন সূর্যটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। রোদের আঁচ বেশ নরম। ওদিকে বাবাকে একা রান্না করে খেতে হচ্ছে হাত পুড়িয়ে। সকালে ত্রিফলা ভেজানো জলটা খাচ্ছে কিনা, কে জানে! রাতে ভিজিয়ে রাখতেই হয়তো ভুলে যাচ্ছে! যা ভুলো।

মস্ত শানবাঁধানো ঠাকুরদালানের সামনের চাতালে সবাই কাজে ব্যস্ত। ইঁদারার গভীরে ঝপ্ করে বালতি ফেলে হাতে হাতে জল তুলে ঠাকুরের পেতলের বাসন মাজছে বাগদি বৌয়েরা। গঙ্গাজলে শুদ্ধি করে বেদিতে তোলা হবে। ব্যস্ত উঠোনে কাজ আর ডেকে হেঁকে কথা একইসঙ্গে চলছে। হঠাৎ কলরব কমে এল। জমিদার মশাইয়ের একমাত্র মেয়ে মাখনবালা আদরের বেড়াল সোহাগীকে কোলে নিয়ে চাতালে এসে দাঁড়িয়েছে।
কই গো, বাগদি বৌ, বাসন সব তোলা হল?
এই তো দিদিরানি।
হাত চালাও দিকি।
মাখনবালার বয়স বছর চোদ্দো। প্রতিষ্ঠা করা ইঁদারার বাঁধানো চাকে হেলান দিয়ে সে কাজ তদারক করতে লাগল। মস্ত ঝুড়িতে মাজা ঝকঝকে বাসনগুলো ঠুংঠাং শব্দ করে একে অন্যের গায়ে জড়ো হচ্ছে।
এই ওদিকে ঘুরে আয়
সোহাগীকে মাটিতে ছেড়ে মাখনবালা সোজা হয়ে দাঁড়াল। গত পরশু তার ঋতুস্রাব শেষ হয়েছে। রিঠে দিয়ে ঘষা ভিজে চুলগুলো হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে সে পায়ে পায়ে গোরার সামনে। খানিক কাজ দেখে তারপর সে ঠাকুরের বেদির দিকে এগিয়ে গেল চোখ আঁকা দেখতে। গোরা তাকিয়ে দেখল। শ্যামলা রঙে বেশ বাড়ন্ত গড়ন। পিঠ অবধি চুল ঠাকুরের পাটের চুলের মতো কোঁকড়ানো।
এইটুকুন মেয়ে, কত্তালি দেখ দিনি…
বৃদ্ধা বাগদি বৌ পাশের বিন্তির মাকে হাতে টিপে চাপা গলায় বলল।
কত্তামা আঁতুড়ে মরা ছেলে বিইয়ে সেই যে বিচনা নিয়েচেন, কত্তাবাবুও সেই থেকে কেমন উড়ু উড়ু। তাই এই মেয়ে এত দাপুটে হয়ে উঠেচে। কতায় বলে না, আতুরির মেয়ে চাতুরি? এ হল তাই।
চোখে চোখে হাসি খেলে গেল দাসীদের মধ্যে।
একটা বেলি নকশা নরুনের খোঁচায় নষ্ট। আর একটা শোলার টুকরো কাটতে কাটতে গোরা ভাবতে লাগল, তার চেয়ে বয়সে ছোট একটা মেয়ে ট্যাকার গরমে মনিষ্যিকে মনিষ্যি ভাবে না, হ্যাঁ! বাপমায়ের বয়সীদের সঙ্গে অবধি হুকুমের সুরে কথা বলে? মনটা তিক্ত হয়ে উঠল তার।

– গোরাদাদা কী করছ? ভিতরে আসব?
দরজায় মণি। জানলা দিয়ে বিকেলের লালচে আকাশের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ওবেলার দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। মণিরা এ বাড়ির আশ্রিতই একরকম। বিধবা মায়ের সঙ্গে কাকাদের গঞ্জনা দিয়ে ভাত মেখে খেত দু’বেলা। স্ত্রী অসুস্থ হবার পর এখানেও গিন্নিবান্নি কেউ নেই বলে জমিদারবাবু দূরসম্পর্কের বোন আর ভাগ্নিকে এনে রেখেছেন।
তুমি কী এমন এসোজন বসোজন, যে বললে তবে আসবে? এসো দিনি।
গোরা স্নেহের হাসি হেসে বলল।

এ বাড়িতে রাতে ময়দা হয়। গোরা মাটি দিয়ে উনুন গড়ে একার মতো ভাত করে নেয়। রুটি ওর সয় না পেটে। মাটির সরায় আমন ধানের মোটা চালের ওপর জল ঢেলে কচলে কচলে ধুয়ে ঘোলা জলটা খিড়কি দিয়ে পেছনের দিঘির ধারে ফেলে এল। চাল ধোয়া জল দিঘির ধারের কাঁচা মাটিতে শুষে নিল কিছুটা, বাকিটা সরু রেখায় ঘাসের জঙ্গলে গড়িয়ে গেল। ঘরে এসে চালটা হাঁড়িতে দিয়ে উনুনের ঝিঁকের ওপর বসিয়ে দিল গোরা। মণি একদৃষ্টে দেখছে, লালচে আগুনের আভাস গোরাদাদার টকটকে ফর্সা আদুল বুকের ওপর এসে পড়েছে। নাক-চোখ যেন মাটি দিয়ে নিখুঁত করে গড়া। কী সুন্দর দেখতে! তার অমন রঙ হলে মাটিতে পা-ই পরত না। 

ইদিক পানে কেন আজ? গোরা হাঁড়িতে হাতা দিতে দিতে বলল।
কটা শোলার ফুল দেবে গো?
কেন?
বারে, আমার মেয়ের সঙ্গে মাখনদিদির ছেলে পুতুলের বে না?
মাখনদিদি? তোমরা সকলে তাকে অত তোয়াজ কর কেন?
হুম। মা-ও তাই বলে। বড্ড গিন্নিপনা আর গুমোর তার। মা-ও নিন্দে করে।
যাক গে, যাও, ওই ঝোলায় আছে কটা ফুল, নাও গে।

মণি এগিয়ে গিয়ে দেখল দুটো কাপড়ের ঝোলা হুক থেকে ঝুলে আছে। সামনেরটায় হাত গলাতেই একটা ঠান্ডা কিছুতে হাত লাগল। সরু মতন মুখটা। বেশ শক্ত। ভারী। খচমচ আওয়াজ পেয়ে গোরা তাকিয়েই চমকে উঠল।
এই এই, ওতে নয়। ভাতে ঠেকানো হাতা নিয়েই এঁটোকাটা ভুলে গোরা এগিয়ে এল।
কী গো ওটা? হাত সরিয়ে থতমত খেয়ে মণি বলে উঠল।
তোমার অত কথায় কাজ কী, যাও বলচি এখন এখান থেকে!
চোখে চোখ রেখে হিংস্রভাবে বলে উঠল গোরা। মণি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।



যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
      উমা আমার কত কেঁদেছে…

আকাশের ঝকঝকে নীল রং দিঘির জলে হাওয়ায় তিরতির কাঁপছে। বাউলের আগমনী গান ওপার থেকে হাওয়ায় পুজোর গন্ধ বয়ে নিয়ে ভেসে আসছে। আজ তৃতীয়া, ঠাকুরের সাজ পরানো হবে। গোরা সরস্বতীর মূর্তির ওপরে জাফরি নকশার বুকপাটা বসিয়ে চোখ সরু করে দেখছে। আর একটুখানি ছাঁটতে হবে গলার দিকটা।

শুনলুম নাকি মণির পুতুলের জন্য শোলার ফুল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে?
কয়েকটা বেশি ছিল। দিয়েচি। আলগোছে বলল গোরা।
! বেশ। নষ্ট করা হচ্চে এভাবে। যুদ্ধের বাজারে সব কিচুর কত দাম জানো!
এসব বাড়িতে বড়দের মুখে শোনা কথা। এরকম উদ্ধত কথার ভঙ্গিতে গোরার মাথা তেতে উঠল। গোরার একটাই দোষ। ওর মাথা বড্ড গরম। গাঁয়ের সতীশদা এমনি বলে,
এই হল তোর ভেতরের আঁচ। খুব পবিত্র এটা। একে নিভতে দেব না আমি।
সতীশদার কথা গুলো যেন পুরুষমানুষের মতো নয়। মেয়েমানুষদের মতো মায়া মায়া। কতদিন ওদের সকলের জন্য খাবার বানিয়ে ও গাঁয়ের হিজলতলার পোড়ো শিবমন্দিরে রেখে এসেছে। সতীশদা খেয়ে বলেছে,
মা নেই, নিজে রেঁধে খাস তো। তোর রান্নার হাত মেয়েদের চেয়ে সরেস।
মা থাকলে… কী হত কে জানে! নিশ্চয়ই পাঠশালায় পড়ত ও। মা উযযুগ করে পড়াশোনা করাত। 

সতীশদা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলে কীরকম মায়ের মতো লাগত। ওর হাতগুলো মেয়েদের মতো নরম। ওই হাত দেখলে কে বলবে… যাকগে। ওকে যে কাজটা করতে বলেছে সেটা করতে পারলেই হল। এই যে মেয়েটা যুদ্ধের কথা বলল, দুনিয়ার কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে সেসব কিচ্ছু জানে না। কিন্তু গোরা জানে। মিত্রপক্ষ কী, হিটলার কে, সব। আরও অনেক কিছু জানে।
– কী হল? কাজ থামিয়ে কোন জগতে ডুব দিলে হ্যাঁ?
মাখনের নাকে সোনার নথ ঝকঝক করে উঠল। গোরা সচেতন হয়ে উঠে জবাব না দিয়ে কাজ করে যেতে লাগল। ছেলেটার বড্ড ডাঁট। মাখন ওর উপেক্ষায় মনে মনে জ্বলে গেল। আশপাশে দাসদাসী। সকলের সামনে মান যাচ্ছে মাখনের। উত্তর না পেয়ে সরে গেলে আরওই মানহানি হবে।

সদর দরজা দিয়ে হাতে ঠেলা গাড়ি ঢুকছে। তাতে রঙিন কাচের নতুন ঝাড়বাতি। কাচের গেলাসের সেট। সুন্দর সুন্দর পোরসিলিনের মূর্তি। সাহেবসুবো আসবে। তাদের আপ্যায়নের জন্য। মেমসাহেব নাকি আসবে মাখনের বয়সী একটা মেয়ে নিয়ে। মাখন ভেবে রেখেছে, ও যাবেই না আগে কতা বলতে, সে যতই সায়েব হোক। মাখনের এক দূরসম্পর্কের কাকা গাড়ির সঙ্গে এসে হাঁক দিয়ে বলল,
কই রে মাখন, মাবাবাকে ডাক দিকি।
মাখন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাড়াতাড়ি যাবার উদ্যোগ নিয়ে সে কথা ছুড়ে দিল,
পরে কতা হবে। ছিশটির কাজ পড়ে আছে বাপু।
গোরার ফর্সা মুখটায় সারা শরীরের রক্ত ছুটে এল। এই একরত্তি মেয়ের এত দেমাক কিসের! বাবা জমিদার বলে? সায়েবদের পা চাটা। সতীশদা ঠিক বলে, সায়েবদের বুটের গুঁতোয় এরা কেন্নো হয়ে যায় পুরো। ঘেন্না হয় দেখলে।

– ঢাকিরা এসে গেচে। আয় লা।
মাখনের ঘর লাগোয়া ঢাকা বারান্দায় পুরো অন্তঃপুর হাজির। সদর দিয়ে সার বেঁধে ঢাকিরা ঢুকছে। কাঁধের ঢাকে কাশফুল বাঁধা। এ বাড়ির পুজোয় ঢাক একটা বড় আকর্ষণ। প্রত্যেক বছর একশো আট ঢাক আসে। চাটগাঁ, ময়মনসিং এসব দিকে ওদের ঘর। দালানে জল বাতাসা খেয়ে ওরা এখন জিরোবে খানিক। মাখনও পায়ে পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আজ ভোরের দিকে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে ও। দিঘির জলের ফোঁটার মতো টলটলে, অথচ স্পষ্ট ছায়ার মতো স্বপ্ন। ও নদীর ধারে দাঁড়িয়ে। কত সাদা সাদা শোলা ফুল সে নদীতে! একটা সুন্দর সাদা হাত সেই শোলা তুলে নিচ্ছে। তারপর তা দিয়ে গয়না বানিয়ে ফেলছে মুহূর্তের মধ্যে। সেগুলো একটা একটা করে পরিয়ে দিচ্ছে। 

ঘরে এসে মাখন সাজ-আলমারির কাচের সামনে দাঁড়াল। রাঙাঠাম্মা কাল চুল বেঁধে দিয়েছিল কলা বিনুনি করে। এত আলগা বাঁধে, খুলে গেছে একদিকেরটা। মা কত ভালো করে বেঁধে দিত লাল সাদা ফিতে দিয়ে। ভিজে কাপড়ে মুখ মুছিয়ে চন্দনের টিপ দিত কপালে। মা আজ কতদিন হয়ে গেছে বিছানায়। সায়েব ডাক্তার আসে টমটম গাড়িতে। কী ওষুধ দেয়। মা ঘুমিয়েই থাকে সারাদিন। মাখন দোরের কাছে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে দেখে মাকে। কেউ দেখলে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বলে,
নীচে যাও মাখন। মা তো বিশ্রাম করছে।
মায়ের কথা মনে পড়ে বুকের মধ্যেটা কান্নায় আঁট হয়ে যায়। মণি নেকির কী ভাগ্যি! কী সুন্দর মা আছে। পিসিমা কত ভালোবাসে ওকে! নিজের মেয়ে বলে বড় মাছটা ওর পাতেই দেয় নুকিয়ে, মাখন নিজে দেখেছে। মাখনের মা-ও সুস্থ থাকলে অমন করত। এই পুজোর দিনে কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিত। 

জানলার বাইরে ফ্যাকাসে নীল আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। জানলার গরাদে গাল ঠেকিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখল, গোরা কলসি করে জল আনছে। এই ছেলেটারও মা নেই। ওর নিশ্চয়ই এমনতর কষ্ট হয়! না, মাখন আর গোরার সঙ্গে বকাঝকা করে কথা বলবে না। কটা দিনই বা! ঠাকুর জলে পড়লে পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে তো চলেই যাবে।

ভোরের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। ফর্সা হাত গয়না পরিয়ে দিচ্ছে। মাখন মনে মনে গোরার মুখটা একবার ভাবল। ফর্সা, কাটা কাটা মুখ। একবার দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইশ! তা বলে তাকিয়ে থাকবে না মাখন! আরো গুমোর দেখাবে। কিন্তু এখন একা ঘরে গোরাকে নিয়ে ভাবতে বেশ লাগছে। ভাগ্যিস ভাবনাগুলো কেউ দেখতে পায় না, জানতে পারে না! মাখন নিজের মনে হাসল। ছেলেটা চলেই যাবে কদিন পর। আচ্ছা তার আগে ওকে একটা কাজ করতে বললে হয় না! 



কাজ তো শেষ। কাল ষষ্ঠী। একটা কাজ করে দেবে?
দরজায় দাঁড়িয়ে কোনও সম্বোধন না করে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল মাখন। গোরা মাটিতে বসেছিল। জানলার দিকে চোখ। মাখনের প্রশ্নে ফিরে তাকাল। মাখন অবাক হয়ে দেখল গোরার চোখদুটো লাল, বেশ ছলছল করছে। মাখনের বুকের ভেতরে মুচড়ে উঠল। কাঁদছে? কেন? ওরও কি মায়ের জন্য মন কেমন করে মাখনের মতো! নিশ্চয়ই তাই। জানলার বাইরের পাঁচিলের ওপরে গাঢ় সবুজ আগাছাগুলো এদিক ওদিক নড়ছে হাওয়ায়। মাখন এবার চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে এল। ঘরে শোলার এলোমেলো কাটা অংশ পড়ে আছে।
আমার জন্য ঠাকুরের সাজের মতো শোলার গয়নাগাটি বানিয়ে দেবে?
মাখনকে এত অনুনয়ের সুরে কথা বলতে কেউ শোনেনি। গোরা অবাক হয়ে তাকাল। বাবার জন্য বড্ড মন কেমন করছে আজ। কবে দেখা হবে কে জানে! যদি আদৌ দেখা না হয়! মাখনের নরম গলার স্বরে জোর করে ঠেলে পেছনে পাঠানো কান্নার স্রোতটা আবার ঢেউয়ের মতো গলার কাছে এসে জমাট হল। কিন্তু না, এই দেমাকি মেয়ের সামনে শক্ত হতে হবে। ভাল করে কথা বলছে, সেটাও হয়তো বড়লোকি খেয়াল। গোরা কড়া গলায় বলে উঠল,
এখনও অল্প কাজ বাকি। সময় হলে চেষ্টা করে দেখবখন। এখন এসো। আমি একটু জিরোব।
সময় হলে? বেশ…
মাখন গলায় পুরনো তেজ ফুটিয়ে বলল। তারপর গুমগুম করে উঠোন ভেঙে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। হাঁফ লাগছে। কপাল গড়িয়ে গাল বেয়ে ঘাম নামছে। তার সঙ্গে আরও দুটো নোনতা উষ্ণ জলের ধারা দু’গাল বেয়ে খরস্রোতা নদীর মতো বইতে লাগল। ভাগ্যিস এখানে এখন কেউ নেই। মাখন বুকে জমে থাকা বাষ্প উজাড় করে দিল।

ঠিক শুনচ?
হ্যাঁ কত্তা। আমাদের পাইক মদনপুরে নেমন্তন্ন করতে গিয়ে খপর এনেচে। শুনেই ছুটতে ছুটতে আসছি।
নায়েবের কথা শুনে জমিদার ত্রিদিব রায়চৌধুরী গুম হয়ে আকাশপাতাল ভাবতে লাগলেন।
বিপ্লবী সতীশ চাটুজ্যে ধরা পড়েছে সঙ্গীসাথী সমেত। স্বদেশী ডাকাতদের লুকিয়ে রাখার জন্য আমাদের মালাকার হরিকেও পুলিশ তুলে নিয়ে গেচে। কিন্তু পিস্তলটা পাওয়া যায়নিকো।
হুঁ, তুমি কী বলছ, এ ছোঁড়া?
হ্যাঁ কত্তা। আমার তাই মন বলছে। অষ্টমী ভোগের দিন ফিটন সায়েব আসবে বউ মেয়ে নিয়ে। কে বলতে পারে…
কী সব্বোনাশ! শেষে আমার বাড়িতে! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! সায়েব আমাদের মা-বাপ। কী হবে? – আমিও বুঝতে পারছি না। ধরুন, তাদের খপর দিলাম। তারা এসে দেকল কিচু নেই। গেরামের নোকের সামনে নাক কাটা যাবে।
সন্ধ্যেবেলার জলখাবারের থালা হাতে মণি ঘরে ঢুকতে গিয়ে কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল। পিস্তল! ওরে বাবা। গোরাদাদার বাপকে পুলিশ ধরেছে! স্বদেশী ডাকাত! হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। ও আচ্ছা! এটা এখুনি বলতে হবে মামাবাবুকে। ঘরে ঢুকে থালাটা গোল টেবিলের ওপর রেখে মণি ভয়ে ভয়ে বলল,
একটা কতা বলব মামাবাবু?
উফফ, তুই আবার কী বলবি? এখন যা দিকি। আর মোহনকে বলগে, এ ঘরে একন যেন কেউ না আসে। জমিদার বাবু অসহিষ্ণু।
বলছিলুম কি, পিস্তল কি ঠান্ডা মতন হয়?
কী জ্বালা! যা ভাগ।
শুনুন না মামাবাবু, গোরাদাদার থলিতে একটা ঠান্ডা নলের মতন কী ছিল। আমি হাত দিয়েছিলুম বলে কী বকুনি।
জমিদার আর নায়েব দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
যা ভাবছিলুম
কী হবে? পুজোআচ্চার বাড়ি!
এই মেয়ে, এবার এ ঘর থেকে যা। মা শীতলার দিব্যি এসব কাউকে বলবি না। মা-কেও না। যা পালা।

মণি বেরিয়ে যাবার পর নায়েবের মুখে হাসি ফুটল,
মা অভয়ার দয়া। আজ রাত্তিরটা পাখিকে পাহারা দিয়ে রাখতে হবে।  কাল বোধনের আগেই শুভকাজ। আপনি তো তাদের উবগারই করলেন। রায়সাহেব হবেন আপনি। মিলিয়ে নেবেনখন। জমিদার মশাইয়ের বাঁকাচোরা কপাল সোজা হল। কথাটা তো ঠিক। ভালোয় ভালোয় স্বদেশী ডাকাতকে নিজের উদ্যোগে ধরিয়ে দিলেই… আহা! কপাল খুলল বলে!
কাকপক্ষী যেন টের না পায়!
কথায় বলে, দেওয়ালেরও নাকি কান আছে। তিনজন ছাড়া সব কথা হয়তো দেওয়ালই শুনল। কখন যেন ফাটল ধরেছে, এবার সেটা বুঝল দেওয়াল নিজেই। নইলে আঁধারে শুধু নাকের নোলক চকচক করবে কেন! দুটো ভয়ার্ত চোখও চকচক করল। বুকের মধ্যে ধুকধুকিটা বেড়ে গেল কয়েক পর্দা। ত্রস্ত পা নূপুরের শব্দ চেপে অন্ধকার বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে চলে গেল।



ঝিঁঝি ডাকা রাত। রাতের তারার কয়েকটা টুকরো যেন জোনাকি হয়ে ডানা পেয়ে উড়ে খোলা জানলা বেয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে। কয়েকপাক খেয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। গোরা আনমনে সেদিকে তাকিয়েছিল। তারপর ঘরের প্রদীপে তেল ঢেলে আগুন উস্কে দিয়ে সে আবার কাজে বসল। মনে মনে মাখনের চেহারাটা কল্পনা করল গোরা। লম্বাপানা, আঁট চেহারা। মুখখানা তরতরে। ঠোঁট যেন বেঁকেই আছে। কিন্তু চোখদুটো আশ্চর্য শান্ত। গরুর চোখের মতো টানা টানা। নাহ, কাল যখন গর্জন তেল মাখা মা দুগ্গাকে মুকুট পরাচ্ছিল, তখন মায়ের চোখ দুটো কাছ থেকে যেমন টানা, ওই মেয়েটারও তাই। 

একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছুরি দিয়ে শোলা কেটে মাখনের জন্য গয়না বানাতে বসল আবার। বড়লোকের মেয়ের খেয়াল। শোলার গয়না ঠাকুরকে মানায়। মানুষ ওরকম পরে! না, পরলে তাকে মানাবে! কে বোঝাতে যাবে! খুব অস্পষ্ট একটা পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। গোরা কান খাড়া করল। রাত প্রায় দু প্রহর। কে আসছে! বন্ধ দরজায় খুব আস্তে খুট খুট আওয়াজ হল।

কে?
জবাব নেই। আরও দুবার ডাক পড়ল দরজায়। শোলা কাটার ছুরি বাগিয়ে ধরে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে একটানে আগল খুলে ফেলল গোরা। কালো চাদর মোড়া একটা মূর্তি ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দাঁড়াল। গোরা ছুরি বাগিয়ে ধরে সামনে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
একী! তুমি! এত রাতে?
চাদর সরে গেছে। হাত দিয়ে আরও সরিয়ে মাখন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ আমি।’ তারপর এগিয়ে এসে মেঝেতে বসে শোলার গয়নাগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল।
আমার সব কথা শোনো দেখছি। এ বাড়ির সবাই অবশ্য শোনে।
গলায় দেমাক। গোরা চুপ করে রইল।
এখন আমি তোমায় হুকুম করচি, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও।
চোখে চোখ রেখে মাখন বলে উঠল।
মানে?
অত মানে আমি জানি না, যা বলচি করো।
সতর্ক চাপা আদেশের সুরে মাখন বলে উঠল।
যদি না যাই?
তোমার কাছে কী আচে, সবাই জেনে গেছে। তোমার বাপকেও ধরেছে পুলিশ। তোমার আদরের মণি, ও-ই বলে দিয়েছে। কাল সকালে পুলিশ এসে কুকুরের মতো গুলি করে মারলে ভাল হয়, না?
মাখনের শেষের কথাগুলো ভিজে উঠল। গোরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। এটা কী হয়ে গেল! কী করে!
তুমি যাও, দু’টি পায়ে পড়ি। আর কত কষ্ট দেবে আমায় জেদ করে?
একরাশ সজল আকুতি অঞ্জলির ফুলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গোরার সামনে। গোরা কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ দুটো সাবধানে বুকের কাছে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হল।
এই চাদরটা নাও। আর দিঘির দিকের পাঁচিল টপকে যাও। আজ সব দরজায় দারোয়ান জেগে।
বলে কালো চাদরটা ছুঁড়ে দিল গোরার দিকে।

সামনে অন্ধকার পথটা চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। গোরা যেতে গিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর মুখ ফিরিয়ে মাখনের চোখে চোখ রেখে বলল,
তোমার জন্য শোলার গয়নাগুলো বানিয়েছিলাম। একবার হলেও পোরো। খুব মানাবে তোমায়, দেখো!

হৈমন্তী ভট্টাচার্য পেশায় শিক্ষিকা। নিবাস দমদম। মূলত নিবিড় পাঠক। রঙের বাহারে প্রকৃতির ছবি আঁকা এবং কলমে ভাবনাকে রূপ দেওয়া তাঁর প্যাশন। শারদীয়া সহজিয়া, বিষাণ শারদীয়া, ঋত্বিক, অভিব্যক্তি, কাশফুলের বার্তা, পাঁচ মাথার মোড়, শনিবারের আসর, দক্ষিণের জানালা ই-ম্যাগ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *