‘অতি অল্প হইল’- মানে কুরুক্ষেত্র না বাধা পর্যন্ত। কী? না, রান্নার ‘স্বাদ’ বা ‘তার’ তো দূরস্থান, খাওয়া কেন গেলাও তো যাচ্ছে না। এমনকি খিদের মুখে পেটের জ্বালা যে মিটবে তা-ও নয়। ফলে যতক্ষণ না রাঁধুনির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে টপটপ এবং অন্তত একবেলা খাওয়া বন্ধ  এবং অভিমানের উপোস – ততক্ষণ থামা নেই। কেউ গগনভেদী চিৎকার, কেউ গা জ্বলুনি ফোড়ন, কেউবা ও ঠিক আছে-গোছের কাঁধ নাচিয়ে মাথা নিচু, কেউ বা মুখে কুলুপ কিন্তু ব্যঙ্গের হাসি। দিদিশাশুড়ি, পিসঠাকুমা ,শাশুড়ি, জেঠশাশুড়ি, খুড়শাশুড়ি এমনকি ধনার মা, ধোপা বউ, আলতা বউ কুনকুনি, সকলের মুখেই সেই এক রা। “আগো ছি ছি ! কী কান্ড!” এরা সকলেই তো এক পাঠশালা পার হয়ে, হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতে আজ কেউ সুয়ো কেউ বা দুয়োরানি বনেছে। বাড়ির পুরুষমানুষদের রসনাতৃপ্তি কি এত সোজা! লাঠি, দা, হাতা, খুন্তি, ছাঞ্চা, সাঁড়াশির রিনরিন বা টুংটাং। মুগ্ধকরণ। আত্তিকরণ।

আমার এখনকার রাঁধুনি মঙ্গলা তো চচ্চড়ির সবজি শাকপাতা সমেত ঝপাঝপ প্রেশার কুকারে। সিটি ফোঁশ খুলতেই গনগনে আঁচের তেলে এক খাবলা যা হোক কিছু ফোড়ন ছিটিয়ে হড়াস করে লপসি ঢেলে খুন্তি খোঁচা। মুহূর্তে জল শুকিয়ে থকথকে। গা মাখা রসায় ডাঁটা, কাঁঠাল বিচি, বড়ি সব জব্দ এবং মসৃণ। রান্নার কম বেশি, ঝাঁঝা তাত বা মরা আঁচ কিংবা কষতে কষতে তেল ছাড়া – সে সব আর কিছুই বলি না। যে দিন ঠিকঠাক পোস্ত, ধোঁকা, হিং-ফেলা আলু ছোকা বা নারকেল কুমড়ি হয় – শুধু সে দিনই বলি, ‘ভালো হয়েছে রে!’ সে সব দিনের ‘কুরুক্ষেত্র’ থেকে আজকের এই সমঝোতাও বা কম কী! তাই আজকাল স্বপ্নে আর ঈশ্বর আসেন না; আসে না রাশিয়া বা চিন বা কিউবা বা ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ। অনাবিল আরামে শুধু ভেসে ওঠে ঘরোয়া রান্নার ছবি। তাক-বাক এবং গন্ধ সমেত।

আটপৌরে পিঁড়িপাতা রান্নাঘর। পর পর মাটির উনুন। লোহার কড়া আর অ্যালুমিনিয়ামের ডবল এক্সএল সাইজের হাঁড়িতে ভাত। দশ থেকে পনেরো জনের একবেলার পাত তো প্রতিদিনের জো। ভাতের এঁটোর আগে থরে থরে দুধ জ্বাল। লম্বা ডাঁটির গোল হাতা ডুবছে আর উঠছে। পেটরোগাদের জন্যে একফুটে এক বাটি নামল। পেটে সয়দের জন্যে মাঝারি ঘন। আরও এক বাটি সরলো। ছোট বাটিতে আর একটু তুলে কারও জন্যে জলছানা। ঘন দুধের সর তুলে পাথর বাটিতে জমা। সাতদিন পর বেটে ঘি। শেষ দুধটুকু মরা আঁচে ফুটিয়ে ক্ষীর। কর্তা গোঁফ চুমরে রাতে খাবেন। পাতলা জ্বাল, মোটা জ্বাল এবং ক্ষীর – এই পথটুকু পার করতে পদে পদে বাঘ, ভালুক আর লাল পিঁপড়ে। ধোঁয়া গন্ধ, তলা ধরা, উথলে ওঠা, ছানা কেটে যাওয়া, কী না হতে পারে! পাণ্ডব-কৌরব যুযুধান, মধ্যে অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন। তাই দ্রৌপদীর এত লাঞ্ছনা সহ্যও কিছু নয়। আসল কথা হল যে, তিনি ছিলেন রন্ধন পটিয়সী।

জলখাবারের লুচি পরোটাও আর একথাক কাঁটা ছড়ানো উঠোন। চালা, ঠাসা, ময়াম – নিক্তি ও সময় মেপে। তারপর তো সমান মাপের লেচি কেটে বেলন-ভাজন। আটা বা ময়দা ঠাসতে ঠাসতে যখন একটা মসৃণ তাল হয়ে গামলা ছেড়ে অনায়াসে উঠে আসবে এবং যখন সেই গামলা দেখে মনে হবে যে সদ্য মাজা, ঝকঝকে — তবে মাখা সমান সমান। না হলেই বেলতে গুঁড়ি, ভাজতে তেল, খেতে ছাল। আড়াই টানে গোল লুচি বেলতে না পারলেই চাকি বেলন বাজেয়াপ্ত। সাসপেন্ড। বাটনার শিল ধুয়ে ডিমোশন। লুচির গোল এবং পরোটার ত্রিকোন –  এসবে যদি আর্কিমিডিসের নিখুঁত জ্যামিতি এবং পিকাসোর নিটোল আত্মবিশ্বাস না থাকে তো শোরগোল-কেলেঙ্কারির একশেষ। আবার ভাজার সময় পরোটা হতে হবে নরম ও মুচমুচে আর লুচি হবে ফুলে টুসটুসে একটু লালচে সাদা। গায়ে ফোস্কা হলেই জলখাবারের নিকুচি। 

এখন ভাবলে অবাকই লাগে, যে কী অমানুষিক পারদর্শিতায় একই কড়ার ডাল ভাগে ভাগে আধসেদ্ধ, ফোটা ফোটা, নরম, না-থকথকে, সম্বার ছাড়া ডালের জল, সম্বার দেওয়া ওপর-হাতার ছাঁকা ডাল এবং নিচের হাতার খাস-ডাল করা হত। সামান্য কম বেশি হলেই মন্তব্য -‘ট্যালটেলে’ বা ‘জোয়ারের জল সব আজ ডালে ঢুকেছে।’ হিংয়ের কমবেশি হলেই ‘উচ্ছে ছাড়াই তেতোর ডাল!’ একই রকম আহা-বাহা-তাহা সেই ভাত রান্নাতেও। কেউ পাতে দিতেই টংটং ঝরঝরে, কারওর নরম ঝরঝর, কারওর বা ফ্যান ফ্যান গলা ভাত, কারও আবার ফ্যান ঝরানো দলা। পছন্দমতো না হলেই এক রা – ‘ভাতের হোটেল যেতে হবে গো!’ চাল বাছা থেকে শুরু করে ফুটে ওঠা এবং দফায় দফায় নজরদারি সেরে ভাত কাঁচিয়ে হাঁড়ি মাজতে নামিয়ে দেওয়া অবধি সে এক বিশাল গেরো। রান্নার গুণ বিচারে চালু কথা ছিল ‘চেয়ে চেয়ে আছে।’ সে ভাত, ডাল, ঝোল, অম্বল বা তরকারি যা-ইই হোক না কেন। মনঃপুত না হলেই ঢেঁকুরের আরাম হাপিস। শান্তি গিয়ে ঠেকবে অশান্তির অক্ষিধে আর মন খালিখালি ভাব।

***

ইদানীং দেখছি যে কম বা বেশিরই নিকুচি। ঘরে যে হাঁড়ি চড়ছে এই ঢের। ঘর থেকে বাড়তি লোকজনও সব উবে হুশ। মেয়েরা ঘরের সঙ্গে আরও বড় কিছুও সামলাচ্ছে সক্ষমতার বিশ্বাসে। পড়ে পড়ে ঝামটানি খেয়ে গুমরে গুমরে পেটে কিল – এসব দিন ট্যাংকিতে। আর এখন তো ঘরের বাইরে মস্ত এক হেঁশেল, যেখানে সব ধরনের রান্নাই অর্ডার মাফিক পাওয়া যাবে। তাই ইচ্ছের সুখে আর অবসর ও সময় পেয়ে যে রান্না, সে তো মহার্ঘ্য! মানিয়ে গুনিয়ে কিছুটা বাড়ির আর কিছুটা বাইরের, অর্ডার মাফিক। আর আছে ঢালাও তৈজসপত্রের সঙ্গে আধুনিক সুব্যবস্থা। মাছ কাটার কাকু ও মাসিদের মতোই বাজার জুড়ে নিখুঁত কুচনো মোচা, বাঁধাকপি, ডুমুর এবং থোড় । সেই সঙ্গে রাজ্যের পেস্ট – সরষে, আদা, রসুন, তেঁতুল, নারকেল – কী নয়!

আর কম-বেশি রুখতে মস্ত হাতিয়ার তো ডাউনলোড। ঝপাঝপ নেমে যাবে বাটি চচ্চড়ি, লাউ কোপ্তা, বেগুন বাসন্তী বা ছানার গুলি ডালনা। রসালো, কষালো, ধোঁয়াটে বা স্যাঁকা –  আরবি, ফারসি, ইস্পাহানি বা কুর্গ। আছে পৃথিবী কাচিয়ে নানা রান্নার স্বাদ জাগানো গুচ্ছের রেসিপি উস্কানি। এমনকি তালের পিটুলি এবং ফ্যান ঝরানো ভাত-সমেত। সেই সব হেঁশেল জাগিয়ে রাখা জাঁদরেল গিন্নিরাও লোপাট। বৌমাদের চলনে বিরাট মুক্তি ঘটেছে হাল আমলের বয়স্কদের। তাঁরাও অনায়াসে ক্লাব, পার্টি এবং ওভারসিস পাড়ি। কে কাকে ধরে আর কে কাকে পাড়ে! উধাও হয়েছে কথায় কথায় বাক্যবাণ আর চোখে জল ঝরানো সব ছড়া। মুলো, সে ‘কচর কচর’ হোক বা ‘তুলো তুলো’ – মা বা বউ কেউই রাঁধেনি; রেঁধেছে কাজের মাসি। রান্নার কম বেশি নিয়ে অন্তত লড়িয়ে দেবার দিন প্রায় শেষ।

কিন্তু রান্নার কম বেশি নিয়ে বাড়ি বাড়ি বাক্যবাণ ফুসমন্তরে হাওয়া হলেও আর এক বিপত্তি জুটেছে নেমন্তন্ন বাড়ির খাওয়া নিয়ে। পাত পেড়ে খাওয়া বদলে, বুফে পর্যন্ত গড়িয়ে বল এখন ছক্কা মারছে অন্য ব্যবস্থায়। অসংখ্য কাউন্টারে হরেক কিসিমের রাঁধুনি। যেমন বলবে গরমাগরম বানিয়ে দেবে। ‘লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে!’ সুসজ্জিত এই সব কাউন্টারের সামনে হাসি হাসি মুখে ভুলভাল বললেই হয় বেজায় কম, নয় ভীষণ বেশি। বেশির ভাগ ব্যঞ্জন শুধু অজানাই নয়, অচেনাও বটে। যদিও বিচিত্র সব শব্দসম্ভারে খাস ইংরেজিতেই লেখা। রক্ষে কর। ফলের স্যালাড আর মিষ্টি খেয়ে কেটে পড়াই বুদ্ধির লক্ষণ। বাড়িতে যা হোক দু’টি সেদ্ধভাত তো জুটবে!

এই কম বেশির আবদার, আদিখ্যেতা আর আতিশয্যে কবে যে এমন এক হেঁশেল-কুনো উজবুক বনে গেলাম কে জানে! মানে, পাঁচফোড়ন আর হিং ছোঁকে একেবারে সেই  ‘গন্ধ ভুরভুর কপ্পুর দাস’ আর কী! ‘স্বাদ’- ‘তার’ আর গিন্নিদের সেই হাত ধোওয়া জলটুকু এমন জাদুটোনা করে রেখেছে! সম্পর্কের পরতে পরতে আসক্তির শিকড়ের এমন ঠাস বুনোট! ঝাল কম, চিনি কটকট, আলোনা, ফ্যান জবজব, ট্যারাবাঁকা – এই সব আক্রমণাত্মক শব্দগুলো যেন আজ সুনসান মনের অসংখ্য তাপ্পি। 

তা যা হোক, গামছা দিয়ে গা হাত পা না-মুছে জ্যাকেট বানিয়ে পরলেই বা মন্দ কী!

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

3 Responses

  1. রান্নাঘর যার দায়িত্বে আছে তার টেনশন কিন্তু এখনও আগের মতই আছে। আমরা হলাম স্যান্ডউইচ জেনারেশন। পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর আগে যখন আমরা সংসার শুরু করি আমাদের ব্যালেন্স করে চলতে হতো আমাদের আগের জেনারেশনের সঙ্গে। এখন করি পরের জেনারেশনের সঙ্গে। যতই অন্তর থেকে তুমি ছুটি চাও,ছুটি আর হয়না।এখনও রান্নাঘরের দায়িত্ব সাধারণত মায়েরাই সামলান। আজকাল অবশ্য দুজনের সংসার হলে কর্তা গিন্নি দুজনেই হাত মেলায়। যতই হোম ডেলিভারি বা বাইরে গিয়ে খাওয়ার চল হোক বাড়ি তে বসে হোটেলে র স্বাদের খাবার হলে তো কথাই নেই। বৌমা অফিস বেরোনোর আগে আদুরে গলায় জানতে চাইলো “মা রাতে আজ কি মেনু গো।”শাশুড়ি উত্তর দিলেন “ফুলকপি র রোস্ট খাবি?” “না মা অন্য কিছু ভাবো পরশু তো ফুল কপি খেলাম। টা টা মা দেরী হয়ে যাচ্ছে ” শাশুড়ি ভাবতে বসলেন বাঁধাকপি না মাটন।বাঁধাকপি তো।বৌমার পছন্দের নয় ।একই সপ্তাহে দুদিন তো মাটন চলবে না। তবে কি চিকেন? শাশুড়ি গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলেন আর নিজেকে স্যান্ডউইচের সঙ্গে তুলনা করলেন।কে বলেছে শাশুড়িরা হেঁসেল ছাড়তে চায় না। আমাদেরও পায়ে চাকা আছে করোনা আটকে রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *