গ্রীষ্মপ্রধান শ্রীলঙ্কার হোটেলে ওয়েলকাম ড্রিংক এক এক জায়গায় এক এক রকমের। ক্যান্ডি তে বেশ গরম ছিল তাই যাওয়া মাত্রই তেঁতুল আর গুড়ের ঠাণ্ডা শরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিল। বেশ রিফ্রেশিং লেগেছিল সেই মূহুর্তে। আবার শৈল শহর নুয়ারা এলিয়ায় বেশ ঠান্ডা। তাই পৌঁছনো মাত্রই সেখানে দুধের মধ্যে হট চকোলেটের গ্লাস পেয়ে বেশ ওম নেওয়া হল। ভারত মহাসাগরের সমুদ্র সৈকত বেন্টোটায় আরও গরম। সেখানে গোলাপি পেয়ারার শরবত আর কালচে বাদামী কয়েদ বেলের শরবতে চুমুক দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল।
গরমের জায়গা বলে দক্ষিণী লম্বা ধরণের আম তোতাপুলির খুব প্রাচুর্য এখানে। সেই আম কাঁচা ও পাকা দুইই কেটে নুন-লংকা ছড়িয়ে রাস্তায় প্যাকেটে ভরে বিক্রি হচ্ছে। শ্রীলংকার ডাবগুলি হলুদ রঙের। এতে নাকি প্রচুর মিনারেল আর জলও খুব মিষ্টি। শাঁসও জম্পেশ। তাই হলুদ ডাব, কাঁচামিঠে আম আর বৈঁচির মত আরেক রকমের ছোট ছোট ফল খেয়েই দুপুরটা কাটিয়ে দিতাম আমরা।
শ্রীলঙ্কার স্টেপল ফুড হল মিল্ক রাইস আর কারি। সঙ্গে নানাবিধ সম্বল বা আচার। লুনু মিরিস বা মশলাদার পিঁয়াজের আচার অথবা সিনি সম্বল বা মিষ্টি পেঁয়াজের চাটনি কিম্বা শুঁটকি মাছের ঝাল আচার দিয়ে এই ভাত খেতে হয়। পল সম্বল বা নারকোলের আচার বা নারকোল কোরাও এই মিল্ক রাইসে মেখে খায় ওখালকার মানুষ। মিল্ক রাইস বা কিরিবাথ হল দুধে সেদ্ধ করা ভাত। সেদ্ধ হলে নারকেলের দুধ উদার হস্তে ছড়িয়ে নামাতে হয় এই ভাত । জমে গেলে কেকের মত পিস পিস করে কেটে রেখে বিক্রি হয় ধবধবে সাদা এই রাইস কেক ।

ট্রপিকাল জায়গা বলে কুমড়োর খুব দাপট সিংহলী হেঁশেলে। মিক্সড ভেজিটেবিলে কুমড়ো থেকে পামকিন স্যুপ আর ডেসার্টে পামকিন পুডিং। পামকিন পুডিং টি বেশ লাগল। পিচ রঙের এই পুডিং গারনিশ করা ছিল দারচিনি লম্বা লম্বা টুকরো দিয়ে। দেখতেও ভালো, খেতেও। কালুপল ওয়াট্টাকা ওদের পছন্দের কুমড়োর ঘ্যাঁট। এ হয়ত বঙ্গের বিজয় সিংহের প্রভাব। বঙ্গসন্তানদের যেমন হয় আর কি! শয়নে স্বপনে জাগরণে তারা চোখে কুমড়ো ফুল দেখে। হয়ত বিজয়সিংহ সমুদ্রযাত্রার সময় কুমড়োর বীজ নিয়ে গেছিলেন সেখানে।
পল রুটি বা নারকোলের রুটিও একটি উল্লেখযোগ্য স্টেপল ফুড। এখন আবার সেই সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে সবুজ রঙের ভেষজ রুটি। তবে রুটি গুলি বিস্কুটের মত ছোট ছোট। এছাড়াও আমাদের রুটির মত হয় বড় বড় রুটি বা কোত্তু রোটি ওদের ভাষায়। রুটির সঙ্গে থাকে স্টার ফ্রায়েড কাবলি চানা বা কাডালা তেল ডালা । পথ চলতে চলতে যেসব হোটেল চোখে পড়ল সেখানে সর্বত্র লেখা রাইস-কারি। তবে এদের এই কারি আমাদের চেয়ে অনেকটাই বেশী মশলাদার। আর তেঁতুল আর আখের গুড়ের গন্ধ পাওয়া গেল। ইয়েলো ডাল বা পারিপ্পু বেশ ঘন। আমাদের ডাল ফ্রাইয়ের অনুরূপ। তবে চিকেনের যে কারি আমাদের ভাল লেগেছে তা হল নারকোলের দুধ দেওয়া, লেমন গ্রাস আর খুব কাঁচা লংকা দেওয়া মাখা মাখা। ঝিরিঝিরি করে কাটা আদার জুলিয়েন দেওয়া ছিল তার মধ্যে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব লক্ষ করা যায় এই কারিতে।
সবজির মধ্যে বাতু মোজু বা ছোট ছোট এক ধরনের বেগুনের তরকারি পাওয়া যায়। নারকেল তেলে কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ আর নানাবিধ মশলা দিয়ে রাঁধা হয়। কাঁচকলার কারির চল আছে দেখলাম একটি হোটেলে। সাহেবরা খুব খাচ্ছিল বটে। পোলোস কারি বা এঁচোড়ের ডানলাও পাওয়া যাচ্ছিল। তবে শুধু এঁচোড় নয়, পাকা কাঁঠাল আর কাঁঠালের বিচির তরকারিও পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালের তরকারির নাম কির কস আর কাঁঠালের বিচির তরকারি হলো কস আট্টা কারি। এক জায়গায় ব্যুফের মেন্যুতে ছিল মোচার কারি বা কেসেল মুয়া মালুওয়া। দেখতে আমাদের মোচার মত হলুদ হলেও আমার ঠিক মনে ধরল না। আমাদের নিরামিষ মোচার ডানলার কাছে এক্কেবারে গোহারান হেরে যাবে।
সাদা ভাতের পাশাপাশি রেড রাইস অথবা ফ্রায়েড রাইস দিব্য চলে সেখানে। আর ভারতীয় খাবারের প্রভাবে বিরিয়ানিও সেখানে বুরিয়ানি রূপে বিরাজ করে যা রায়তা ও সেদ্ধ ডিম সহযোগে সারভ করা হয়। পর্ক, বিফ, চিকেন অথবা সবজি বুরিয়ানির খুব কাটতি।
সমুদ্রসৈকতে বেন্টোটায় গিয়ে সৌভাগ্য হল বাগদা চিংড়ি আর কাঁকড়া খাওয়ার। পেঁয়াজ রসুন, লংকা দিয়ে শুকনো ঝাল ঝাল গ্রিল্ড সিফুডের বেশ তার হয়েছিল শ্রীলঙ্কার পাচকের হাতে।

আরেকটা জিনিস ব্রেকফাস্টে বা ডিনারে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়, তা হল হপার। চালের গুঁড়োর ব্যাটার দিয়ে মাদ্রাজী আপ্পাম স্টাইলে তবে এর আকৃতি হল বাটির মত। ছোট্ট লোহার কড়াতে তেল মাখিয়ে খুব ধৈর্যের সঙ্গে বানাতে হয়। কেউ আবার ফুলের মত শেপ দেয় এই হপারের। মধ্যে একটি ডিম ভেঙে পোচ দিয়ে সার্ভ করলে তা হয় আরো দৃষ্টিনন্দন এগ হপার। সম্বল দিয়ে খেতে লাগে অনেকটা দোসার মত। এগ হপার ছাড়াও প্লেন হপার কিম্বা তার মধ্যিখানে একটু গুড় দিয়ে আমাদের সরু চাকলির মত কিম্বা নারকোলের ঘন দুধ দিয়ে কোকোনাট হপারে বেশ পিঠের মত স্বাদ। তবে হপার খেতে হবে আগ জ্বলন্ত। ঠাণ্ডা হলে সব মাটি।
শ্রীলঙ্কার এই স্থানীয় প্যানকেক হপারের আরেকটি ভার্সান লক্ষ্য করা গেল। নুডলসের মত দেখতে। ধবধবে সাদা চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো অথবা রেড রাইসের গুঁড়ো দিয়ে বানানো। এর নাম স্ট্রিং হপারস বা ইন্ডি আপ্পা। খোঁপা চাউয়ের মত দেখতে। কারি দিয়ে খায় ওরা।
এখানকার আরেকটি প্রচলিত খাবার হল হুলাপা। সেটি হল কেন্দু পাতার মধ্যে মিলেটের আটা, গুড় আর নারকোল দিয়ে বানানো চ্যাপ্টা রুটির মত একরকম মিষ্টি।
শ্রীলঙ্কায় শেষ পাতে স্যুইটডিশের চেয়েও ব্রেকফাস্ট ব্যুফে তে মিষ্টি পদের বেশ রমরমা। চালের গুঁড়ির নরম প্যানকেকের মধ্যে নারকোল আর মধুর পুর চালান করে পরিপাটি করে মুড়ে আমাদের পাটিসাপটার মত মিষ্টিটা বেশ লাগল খেতে। ওদের ভাষায় “পানি”অর্থাৎ মধু এবং “পল” বা নারকোল একত্রে “পানি-পল” স্টাফড প্যানকেক। মধুর বদলে আমাদের মত গুড় দিয়েও বানায় এই পুর।
স্থানীয় আরেকরকম ক্যান্ডি খেলাম যার নাম “থালাকরালি”। সিংহলী তে “থালা” হল সাদা তিল আর “করালি” হল রোল। হোটেলে জিগ্যেস করতে জানাল আমাদের তিলের নাড়ুর মত সাদা তিল, আদা, গুড় দিয়ে বানিয়ে তৈলাক্ত কাগজে রোল করে রাখে ওরা।
দক্ষিণী মিষ্টি অথিরসা বা অথিরসম শ্রীলঙ্কায় খুব জনপ্রিয়। অনেকটা আমাদের পুরভরা গোকুল পিঠে রসে ফেললে যা হবে তেমন দেখতে তবে স্বাদ আমাদের মুখরোচক গোকুল পিঠের ধারেকাছে নয়।
আরেকটি অথেন্টিক মিষ্টি হল শ্রীলঙ্কার রোজ কুকিস বা আছু মুরুক্কু। ডিম দেওয়া কেকের ব্যাটার কে ফুলের মোল্ডে ফেলে ডিপ ফ্রাই করা। এটিও মধু ছড়িয়ে খাওয়ার রীতি। এই মিষ্টিতে দক্ষিণ ভারতের যথেষ্ট প্রভাব। কারণ বেসনের নোনতা মুরুক্কুর সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত। রোজ কুকিস ওদের মিষ্টি মুরুক্কুর তুতো ভাই । প্রতিদিন রাতের মিষ্টির তালিকায় ওয়াটালাপ্পান বা ক্যারামেলাইজড ভাপা পুডিং থাকবেই । তবে ডিম, গুড় নারকোলের দুধ, ছোট এলাচের গুঁড়ো বা দারচিনির গন্ধ দেওয়া। এই মিষ্টি প্রধানত রামদানে বানানো হয়।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।