জমি জঙ্গল পাহাড় মালভূমি উপত্যকা নদী ঝরনা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠা মেঘালয়ের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় খেয়াল থাকে না যে এখানকার ভূগর্ভে জমে আছে অপার খনিজ সম্পদ। কয়লা জিপসাম লাইমস্টোন ছাড়াও গ্রানাইট, কাওলিনাইট, সিলিকা-ঋদ্ধ গ্লাস স্যান্ড, বক্সাইট ক্লে ইত্যাদি । আর রয়েছে ইউরেনিয়াম।
ভূতাত্ত্বিকদের অনুমান, মেঘালয়ের মাটির গভীরে রয়েছে ১৩৩ মিলিয়ন টন কয়লা। আরও ৫৭৭ মিলিয়ন টন কয়লা লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা আছে যা মাটির উপরে তুলে আনার প্রযুক্তি এখনও সহজলভ্য নয়। অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রায় সাড়ে নয় হাজার মিলিয়ন টন লাইমস্টোন। সময়বিশেষে অন্যান্য শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী এইসব মহার্ঘ খনিজ সম্পদ মাটি খুঁড়ে বের করে এনে সরাসরি উৎপাদন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সাড়ে বাইশ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এক ছোট্ট ভূখণ্ড মেঘালয়— যেখানে ২০১১-র আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষের বসবাস, সেখানকার ভূগর্ভে সঞ্চিত সম্পদের হিসেব সরাসরি টাকার অঙ্কে করা বোধ হয় সম্ভব নয়। কেন? ইউরেনিয়ামের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে?
ইউরেনিয়াম খননের ফলে সৃষ্টি হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ঘটনা প্রথম আন্দাজ করতে পারেন ‘কঙ স্পেলিটি’ নামে পরিচিত এক প্রবীণ গৃহবধূ। তাঁর পোশাকি নাম স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন। সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলার ডমিয়াসিয়াট এলাকার বাসিন্দা কঙ স্পেলিটি খেয়াল করলেন ইউরেনিয়াম খননের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গৃহপালিত পশুগুলিও অসুস্থ হচ্ছে। এমনকী মারাও যাচ্ছে। কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। নদীর মাছ মরে যাচ্ছে।
ভারতের সবচেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে উত্তর-পূর্বের এই পার্বত্য রাজ্যে৷ বিশেষজ্ঞদের অনুমান মেঘালয়ের ডমিয়াসিয়াট, লস্টোওন এবং ওয়াখিনে মজুত রয়েছে প্রায় ৯২ লক্ষ টন ইউরেনিয়াম৷ দেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির প্রয়োজনে ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলায় ইউরেনিয়াম আকরিক উত্তোলনের একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল৷ তবে তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি৷
মেঘালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই বোধ হয় শুরু হয়েছিল ইউরেনিয়াম উত্তোলনের প্রকল্প। ১৯৭২-এর ২১ জানুয়ারি স্বতন্ত্র রাজ্যের সম্মান পায় মেঘালয়। রাজধানীর নাম শিলং । ১৮৭৪ থেকে যে বানানে শিলং লেখা হত— Shyllong, তা পাল্টে গেল, হল Shillong। আর ১৯৭২-এ ভারত সরকারের অ্যাটমিক মিনারেল ডাইরেক্টরেট ফর এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড রিসার্চ (AMDER) ঘোষণা করে মেঘালয়ের ডমিয়াসিয়াট, লস্টোওন এবং ওয়াখিন এলাকায় মাটির গভীরে প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম মজুত রয়েছে। খাতায়-কলমে অনেক হিসেবনিকেশ কষে পাহাড়-জঙ্গলের ভূমির গভীরে সরেজমিনে সমীক্ষা করার পর ১৯৮৬ নাগাদ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় খননের কাজ শুরু করা হবে। খননের দায়িত্ব পায় ইউরেনিয়াম করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড বা ইউসিআইএল (UCIL)।
দেখতে দেখতে আরও পাঁচ- ছ’ বছর কেটে গেল। জায়গাটা বেশ দুর্গম। ভূতাত্ত্বিক ইঞ্জিনিয়ার আধিকারিক থেকে শুরু করে গাড়ির চালক শ্রমিক সকলেই বহিরাগত। স্থানীয় ভাষা কারও জানা নেই। নেই দোকান বাজার। পরিস্থিতির প্রতিকূলতা এত বেশি যে সময় বয়ে চলে, কাজ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এগোয় না।
স্থানীয় লোকজন প্রথম প্রথম বুঝতে পারেননি কী হতে চলেছে। তাঁদের ধারণা ছিল স্বতন্ত্র রাজ্য হওয়ার পর বোধ হয় উন্নয়নের পালে হাওয়া বইবে। মেঘালয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় থাকার জন্য এখানে বহিরাগতদের জন্য জমি বাড়ি কেনা-বেচা আইনত নিষিদ্ধ। প্রথম দিকে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের বুঝিয়েসুঝিয়ে কাজ শুরুর অনুমতি আদায় করে। কিছুটা জমিও পাওয়া যায়। গাছপালা কেটে জমি সমতল করে রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় মানুষের মনে দ্বিধা ছিল। ইউসিআইএল-এর কথায় বিশ্বাস করে অনেকের ধারণা হয় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এলাকার উন্নতি হবে। রাস্তাঘাট দোকানপাট তৈরি হবে। স্থানীয় যুবক-যুবতীরা কাজ পাবে। এতসব দ্বিধা -দ্বন্দ্বের মধ্যেই ১৯৯২ নাগাদ শুরু হল ইউরেনিয়াম খনি তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজকর্ম।
ধীরেসুস্থে কাজ এগোচ্ছে। স্থানীয় মানুষ বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকরা পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন। ইউরেনিয়াম খননের ফলে সৃষ্টি হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ঘটনা প্রথম আন্দাজ করতে পারেন ‘কঙ স্পেলিটি’ নামে পরিচিত এক প্রবীণ গৃহবধূ। তাঁর পোশাকি নাম স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন। সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলার ডমিয়াসিয়াট এলাকার বাসিন্দা কঙ স্পেলিটি খেয়াল করলেন ইউরেনিয়াম খননের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গৃহপালিত পশুগুলিও অসুস্থ হচ্ছে। এমনকী মারাও যাচ্ছে। কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ -আলোচনা শুরু করলেন। একই সঙ্গে শুরু করলেন প্রচার। বিকিরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে স্থানীয় লোকজনকে বোঝাতে পারায় ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার বার্তা পাঠালেন কঙ স্পেলিটি ওরফে স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন-এর নেতৃত্বাধীন প্রমীলা বাহিনী। ইউসিআইএল অনেক কাকুতি-মিনতি করে তাঁর কাছে আবেদন -নিবেদন জানাতে থাকে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে অর্থ দিয়ে তাঁদের স্বাধীনতা কেনা যাবে না। নিজের বাড়ির সামনে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ এবং ‘অবৈধভাবে প্রবেশ নিষেধ’ লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দিলেন। নবীন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কঙ স্পেলিটির বক্তব্য ভীষণ সাড়া ফেলে। এই জন-আলোড়নের ফলে ইউসিআইএল কোনও রকমে খুঁড়ে ফেলা খনি গহ্বরের মুখে পাথর চাপা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। সেই পাথর আজও সরেনি।
এতদিন বিষয়টি চাপা পড়ে থাকার পর হঠাৎ করে ২০২০-র অক্টোবর মাসে ডমিয়াসিয়াট আবার একবার সংবাদের শিরোনামে চলে আসায় চতুর্দিকে সাড়া পড়ে গেছে। মেঘালয়ে ইউরেনিয়াম খনির বিষাক্ত বর্জ্য বাইরে বেরিয়ে আসছে বলে উদ্বিগ্ন স্থানীয় মানুষের অভিযোগ পেয়েই সরকার বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস জেলার ইউরেনিয়াম খনি প্রকল্প এলাকায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বিভিন্ন পরীক্ষায় ধরা পড়েছে বলে স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা। তবে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই চলে গেলেন কঙ স্পেলিটি অর্থাৎ স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন। পরিণত বয়সে (৯৫) গত ২৮ অক্টোবর, ২০২০ তাঁর মৃত্যু হয়।
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৩ ডিসেম্বর ২০২০, সন্ধে ৭টা।
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
Skilful writer!