দক্ষিণী আমিষের কথা মাথায় এলেই মনে পড়ে যায় হায়দ্রাবাদের মশলাদার ‘দম কা গোস্ত’ আর কেরল বা তামিলনাড়ুর ঝালঝাল, টকটক, ভুরভুরে কারিপাতার সুগন্ধে আমোদিত ‘চেট্টিনাড’ স্টাইলে আমিষের কথা। দমে বসানো রান্নার প্রযুক্তি ভারতীয় রান্নায় নতুন নয়। যদিও দম পুকথ বা দম পোক্ত এখন দেশীয় রেস্তোরাঁয় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে। নিমন্ত্রণ বাড়িতেও দমপোক্ত মাছ কিম্বা মাংসের স্বাদের সঙ্গে আমরা বেশ পরিচিত এখন। ‘দম’ মানে নিঃশ্বাস আর ‘পুকথ’ মানে রান্না করা। মানে গোদাবাংলায় সিল করা পাত্রের মধ্যে রান্না, যাতে কোনও গন্ধ বাইরে বেরুবে না।

কে এই রন্ধন পদ্ধতির প্রবর্তক জানেন? সপ্তদশ শতকের নবাব আসফ উদ দৌলাহ। বিরিয়ানির আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখি লখনউয়ের বড়া ইমামবাড়ার সূচনা হয়েছিল দুর্ভিক্ষের সময় গরিব প্রজাদের কাজ দেওয়ার জন্য। শ্রমিকরা দিনের বেলায় যেটা তৈরি করত, রাতে সেটাই রাজকর্মচারিরা ধূলিসাৎ করে দিতেন। নবাবের উদ্দেশ্য যতটা না ছিল ইমামবাড়া বানানো, তার চেয়েও বেশি দীর্ঘদিন ধরে প্রজাদের কাজ দেওয়া। প্রকাণ্ড হান্ডিতে চাল, মাংস, সবজি ইত্যাদি মিশিয়ে ঢাকা সিল করে দেওয়া হত। একসঙ্গে বহু মানুষের পুষ্টি জোগানোই ছিল এই রান্নার উদ্দেশ্য। মূলত এটি আওয়াধি খাবার।

dum_pukht_gosht_recipe_9
পারসিক ভাষায় ‘দম পুখত’ কথার অর্থ ঢিমে আঁচের উনুন। অল্প আঁচে ধিকি ধিকি করে মাংস রান্নাই হল দম পুখত গোস্ত

পারসিক মতে বিরিয়ানি তৈরির যথার্থ পদ্ধতি হলো দম পুখত। মানে ধীরে ধীরে রান্না হতে দিতে হবে। পারসিক ভাষায় ‘দম পুখত’ কথার অর্থ হলো, ঢিমে আঁচের উনুন। অর্থাৎ অনেকক্ষণ ধরে নীচে আঁচ, ওপরে আঁচ থাকবে। ভেতরে সব একসঙ্গে সুপরিপক্ব হবে, খাদ্যের গুণমান ঠিক থাকবে। মশলাপাতির সুঘ্রাণ বজায় থাকবে আঁটসাঁটো পাত্রের মধ্যে। বাঙালিদের বাটিচ্চচড়ি কিন্তু এমনি। অথবা যদি বলি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত মাখা মাখা আলুর দম? কিম্বা ভাপা মাছ বা মাংস? এই স্লো কুকিং হল দম পোক্তর মোদ্দা কথা, যার ফলস্বরূপ হায়দ্রাবাদের ‘দম কা গোস্ত’ বা মাংসের দম অনবদ্য রান্না।  আর সবরকম মশলাপাতির জোগাড় করে তবে এই রান্না দমে বসবে। 

আসল কথা হল ‘দম কা গোস্ত’ হল এই দম পোক্তের মতই আর একটি দমে বসানো খাসির বা ভেড়ার মাংসের রেসিপি। এটি হায়দ্রাবাদের বকরি ঈদের অন্যতম আইটেম। প্রধানতঃ স্থান-কাল এবং পাত্র-ভেদে রেডমিট হল যার মুখ্য উপাদান। আর দমপোক্ত গোস্ত বা ‘দম কা গোস্ত’ হল হরেদরে সেই একই রান্না যা লখনউতেই হোক কিম্বা হায়দ্রাবাদ, তার এক নবাবী ঐতিহ্য এখনও বর্তমান। তবে রন্ধনের বৃত্তান্ত ঘেঁটে যা দেখলাম সেখানে উপকরণেও বেশ ফারাক সাধারণ কষা মাংসের থেকে।  শুধু কাঁচা পেঁপে কুরোনোতে মিল কারণ দমে বসানো মাংস তো আর প্রেশার কুকড হবে না, তাই বহুক্ষণ ঢিমে আঁচে বসিয়েও তা যাতে নরম এবং তুলতুলে হয়।

কথাতেই বলে মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে। তাই রেডমিট একবার ধুয়ে প্যাট ড্রাই করেই তার মধ্যে একে একে কাঁচা পেঁপে কুরোনো, টক দই, ভাজা পেঁয়াজ বা বেরেস্তা, আদারসুন বাটা, নুন, লেবুর রস, লংকার গুঁড়ো, ধনে-জিরে-গোলমরিচ গুঁড়ো, গরমমশলা গুঁড়ো আর সামান্য লেবুর রস দিয়ে বেশ করে ম্যারিনেট করে ফেলা আর কী। এই অবধি ঠিকঠাক ছিল। আমাদের চিরাচরিত ম্যারিনেশন বেত্তান্ত। এর সঙ্গে যেটা স্পেশ্যাল টাচ, তা হল দুধ দিয়ে বাটা শুকনো নারকোল, কয়েকটা আমন্ড আর কাজুবাদামবাটা, লবঙ্গ, দারচিনি আর ছোটো এলাচ বেটে নিয়ে সেই মিশ্রণে যোগ করা। 

Dum Ka Gosht
মশলা, লঙ্কাগুঁড়ো আর ঢিমে আঁচ — তৈরি দম কা গোস্ত

এবার মেশাতে হবে খানিকটা টাটকা ধনেপাতা আর পুদিনাপাতা বাটা। এবার কাঁচালঙ্কা কুচি দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করার আগে রিফাইন্ড তেল বা ঘি ছড়াতে হবে। সারা রাত ঢাকনা বন্ধ করে সেই ম্যারিনেটেড মাংস থাকবে ফ্রিজে। পরদিন সবশুদ্ধ বসবে দমে। ডেকচির মুখ সিল করতে হবে আটা মাখা দিয়ে। এবার দমে বসে ধীরে ধীরে রান্না হবে যতক্ষণ না মাংস সেদ্ধ হয়। বেহুলার লোহার বাসর ঘরের মতো নিশ্ছিদ্র হবে সেই দমে বসানো পাত্রের নিরাপত্তা। কোনও মশলার গন্ধ যেন বাইরে না বেরোয়। এই হল নবাবী ‘দম কা গোস্ত’-এর রন্ধন বৃত্তান্ত।

এবার আসি আমিষী ‘চেট্টিনাড’-এ। ভারতীয় হেঁশেলে থরেথরে সাজানো মশলার তাকটি আদতে একটি মশলার বাগানবিশেষ এবং সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক ইমিউনিটি বুস্টারও বটে। পড়শিরাজ্য শ্রীলংকা থেকে বাংলাদেশও ঠিক তেমনি। আমাদের দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারতের আমিষ রন্ধনপ্রণালিগুলি মশলায় একেবারে ছত্রাকার। দক্ষিণী খানা মানেই শুধু বড়া, ইডলি, দোসা, সম্বর, আপ্পাম আর নারকোলের চাটনি নয়। এখানাকার বর্ধিষ্ণু চেট্টিনাড সম্প্রদায়ের নিজস্ব রান্নার ইতিহাস রয়েছে। 

দক্ষিণী সব রন্ধনপটিয়সীরা পৃথিবী ঢুঁড়ে নাকি সুযোগ্য মশলা সংগ্রহ করে আনেন যা দিয়ে তাদের আমিষ রেসিপিতে হয় যোগ্যতম সঙ্গত। কোচিনের বিশেষ গাছের ছাল, শ্রীলংকার বড় এলাচ, মাদাগাস্কারের লবঙ্গ, লাওস আর ভিয়েতনামের বিশেষ ধরনের আদা, এসব দিয়ে নাকি রান্না হয় বিশেষ আমিষ। এছাড়া নারকোল কোরা বা তার থেকে বের করা দুধ, তেঁতুল আর কারিপাতা তো সব দক্ষিণী রান্নার হাতের পাঁচ। কোঙ্কণী প্রণ বালচাও থেকে কুর্গের মাটন, চেট্টিনাড চিকেন থেকে মালাবারি ল্যাম্ব… প্রতিটি দক্ষিণী আমিষ পদেই থাকে এমন সব সুগন্ধি মশলার কেরামতি। এখনকার প্রজন্ম যার নাম দিয়েছে ‘ফায়ারি হট অ্যান্ড স্পাইসি।’

মূলতঃ গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদের ফল্গুধারায় পুষ্ট তামিলনাড়ুর মানুষ বেশিরভাগই কট্টর নিরামিষাশী, কিন্তু চেট্টিনাড অঞ্চলটিতে ভালোরকম আমিষ খাওয়ার রীতি আছে। চেট্টিনাড অঞ্চলের আওতায় পড়ে বিস্তীর্ণ ১৫০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে চেট্টিনাড সম্প্রদায়ের ৭৬টি গ্রাম এবং দুটি মোটে শহর। তামিলনাড়ুর চেট্টিনাড অঞ্চল থেকে উদ্ভূত এই বিশেষ ধরনের রান্না হল ‘নট্টুকোটাই চেটিয়ার্স’ বা ‘নাগরথার’ নামে পরিচিত এক বণিক সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র রন্ধন পদ্ধতি। এখানকার ‘চেট্টিনাড ক্যুইজ়িন’ বিখ্যাত তাদের মশলার সুঘ্রাণ এবং স্বাদের জন্য। ধনে, জিরে, গোলমরিচ, মৌরি, লবঙ্গ, এলাচ, দারচিনি আমরাও ব্যবহার করি আমিষ রান্নায়, কিন্তু এদের বিশেষত্ব হল মশলাগুলি শুকনোখোলায় ভেজে নিয়ে গুঁড়ো করে কষানোর সময় দেওয়া। এর সঙ্গে প্রচলিত আদা, রসুন, পেঁয়াজ, টমেটো তো আছেই। আর নারকোল থাকবেই। 

Chicken-Chettinad
‘চেট্টিনাড ক্যুইজ়িন’ বিখ্যাত তাদের মশলার সুঘ্রাণ এবং স্বাদের জন্য

এই অঞ্চলের অধিবাসীরা পুরোপুরি নিরামিষ খেতেন একসময়, বাকি তামিলনাড়ুর মতো। উৎসবে পালপার্বণে এখনও সেই নিয়ম বজায় আছে। এই ‘চেট্টিয়ার’ বণিক সম্প্রদায় একসময় স্থানীয় রাজারাজড়াদের চেয়েও নাকি বিত্তশালী ছিল তাদের নিজস্ব ব্যাবসার কারণে। লবণ এবং মশলাপাতি ছাড়াও তাঁদের প্রধান ব্যবসা ছিল মহাজনি। ব্যবসার কারণে বিশ্বভ্রমণ তাঁদের রান্নার উপকরণ এবং পদ্ধতিতেও বিস্তর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁদের আবিষ্কৃত ১২০০ বছরের পুরনো ‘ক্র্যাব রসম’ আজও সমাদৃত। তাঁদের ‘উপ্পু কারি’ বা মাটন ফ্রাই এক গ্রাম্য রান্না, যা জমিদার এবং কৃষক উভয় মহলেই সুপরিচিত। চেট্টিনার ‘মণ্ডি’ একধরণের বিখ্যাত তরকারি, যেটা এমনিই খাওয়া যায়। কথিত আছে, মূলত ‘নাগানাদু’ নামে এক স্থান থেকে তারা এসেছিল। সেখান থেকেই তারা ‘কেরাইকুডি’ এলাকাকে আর্থিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলে, যা ক্রমে ‘চেট্টিনাড’ নামে পরিচিত হয়। জানি না অন্ধ্রের রেড্ডি, কর্ণাটকের শেট্টি আর তামিলনাড়ুর চেট্টিয়ারের মধ্যে কোনও মিল আছে কিনা। শব্দের ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে যাই হোক, উৎপত্তির মূলে যে বণিক বা বাণিজ্যের গন্ধ আছে তা জানলাম ‘চেট্টিনাড চিকেন’ রাঁধতে গিয়ে।

Chettinad-prawns
চেট্টিনাড পদ্ধতিতে মটন চিকেন ছাড়াও চিংড়ি, ডিম এমনকী পনিরও জমে যাবে

কথিত আছে একের পর এক বন্যা এবং খরা কবলিত হতে হতে এই চেট্টিয়ার সম্প্দায় তাঁদের ঘরবাড়ি বানাত উঁচু ভিতের ওপর। সেখানে তারা প্রচুর খাবারদাবার মজুত রাখত। সেইজন্যেই বুঝি চেট্টিনাড রান্নায় ব্যবহৃত হতে দেখি রোদে শুকোনো মাংস এবং মশলা। জনশ্রুতি আছে, একবার এক চোর এখানকার বিশাল এক প্রাসাদে চুরি করতে এসে ভুলভুলাইয়ার মধ্যে হারিয়ে গেছিল। তারপর খাবারদাবার, বাসনকোসন হাতড়ে সেখানে থাকবার একফালি জায়গাও বের করে নেয় আর বেশ কিছুদিন রাঁধাবাড়া করে দিব্যি বেঁচেবর্তে তারপর একসময় প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে আসে। আর প্রাসাদোপম বাড়ি কেন, পাগলাগারদেও খাবারের জন্য ব্যবহৃত উপকরণে তারা কোনওকালে আপস করেনি। তাদের ঘরে ঘরে তেলকল বা ঘানি, চাটনির জন্য শিলনোড়া, আর চালের গুঁড়ি বানানোর জন্য জাঁতা থাকবেই। তিলে তিলে যেমন তিলভান্ডেশ্বর হয়েছিল তেমনি রান্নার সরঞ্জাম থেকে উপকরণ… এ সবকিছুর সমন্বয়ে ‘চেট্টিনাড’ রন্ধনপ্রণালি তেমনি আপসহীন স্বাদকাহন।

চেট্টিনাড চিকেন বানাতে ৫০০ গ্রাম মুরগি ধুয়ে জল ঝরিয়ে, নুন, হলুদগুঁড়ো, লঙ্কাগুঁড়ো, লেবুর রস, আদা রসুনবাটা দিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে ঘণ্টাখানেক। এবার গোটা ধনে, গোটা জিরে, মৌরি, গোলমরিচ, শুকনো লংকা, দারচিনি, লবঙ্গ, বড় এলাচ, ছোট এলাচ, নারকেলকোরা আর পোস্ত শুকনো খোলায় ভেজে নিয়ে গ্রাইন্ডারে অমসৃণ গুঁড়ো করে নিতে হবে। প্যানে রিফাইন্ড তেল গরম করে পেঁয়াজ, ট্যোম্যাটো দিয়ে অল্প ভাজা ভাজা হলে কারিপাতা। এবার ম্যারিনেটেড চিকেন এবং সেই মশলা গুঁড়ো। ভালো করে কষানো হয়ে গেলে সামান্য জল ও ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। চিকেন সেদ্ধ হয়ে মাখা মাখা হলে নামিয়ে নিতে হবে। 

চেট্টিনার সম্প্রদায় যেমন অবস্থাতেই থাকুক স্থান-কাল-পাত্র ভেদে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে রান্নার সঙ্গে তাঁদের চিরাচরিত সম্পর্ক যেন জন্মজন্মান্তরের বন্ধন। তার উপকরণ, প্রণালি সবেতেই শর্টকাট তাঁদের নাপসন্দ। মনে পড়ে যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা। দোকান থেকে এক পয়সার পাঁচফোড়ন আনিয়ে রান্না করিয়েছিলেন একবার। বলেছিলেন, যার জন্য যেটা বরাদ্দ, তাকে সেটা দিতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা এই মশলাদার স্টাইলে চিকেন ছাড়াও চিংড়ি, মাটন, এমনকি ডিম বা পনিরও কিন্তু দিব্য জমে যায়। চিকেন কারি খেতে খেতে থকে যাওয়া বাঙালির ঘরে এই মাংস দৌড়বে সে কথা বলাই বাহুল্য।    (সমাপ্ত)

 

ছবি ও ভিডিও সৌজন্য: Vaya, Fun Food Frolic, Faskitchen, Spice Eats, Youtube, Swatisani.net

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *