সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নানা কাজের ভেতর বিভিন্ন মুহূর্তে, ভিন্ন পরিস্থিতিতে যাঁরা একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন, সর্বার্থেই যাঁরা তাঁর নিত্য সহচর, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলালাইভের প্রতিনিধি পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমিত্রর চিত্রকলার কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের সেই স্মৃতিচারণ অনুলিখিত হল।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছবি আঁকতেন ডায়েরির পাতায়। উনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন এবং তাতেই ছবিও আঁকতেন। বলতেন ওই ডায়েরিটা নাকি পল্টনের মগ। উনি তো একসময় এনসিসি করতেন, সেই ক্যাডেটদের মগ যেমন দাড়ি কামাতেও কাজে লাগে আবার খাবার সময় ডাল আনতেও কাজে লাগে, তেমনই ওঁর ওই ডায়েরি ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী।
ওঁর ছবির প্রথম প্রদর্শনী আমিই করেছিলাম। সেইটি হয়ে যাওয়ার পর উনি আমায় বলেছিলেন, “তুমি এই প্রদর্শনী করে আমার বড় বিপদ করলে। আমি যে ছবি আঁকি সেটা এতদিন কেউ জানত না, কাউকে দেখাতামও না। নিজের খেয়ালখুশি মতো আঁকতাম। কিন্তু এখন আমার কাঁধে একটা দায়িত্ব এসে চাপল– মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করার দায়িত্ব।” তারপর থেকে উনি ডায়েরি ছেড়ে ইজেলে ছবি আঁকা ধরলেন। মূলত জলরঙ ব্যবহার করতেন আর পেন এণ্ড ইঙ্ক। কাগজেই আঁকতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন।

উনি যেটাকে খেয়ালখুশি মতো আঁকা বলছেন, সেই ছবির মধ্যেও এক ধরনের গভীরতা ছিল। ছবিগুলোর প্রত্যেকটাতেই একটা করে মুখ উনি তৈরি করতেন। আর সেই মুখগুলোর মধ্যে ছিল অদভুত এক বিষণ্ণতা। আমি ওঁর তিনটে প্রদর্শনী করি। সবচেয়ে ভাল কাজ করেছিলেন আমেদাবাদের প্রদর্শনীর জন্য। আমি সৌভাগ্যবান, আমাকে উনি নিজের ছবির কিউরেটরের সম্মান দিয়েছিলেন।
ছবি আঁকাই শুধু নয়, সৌমিত্রবাবুর ছবি দেখার চোখও ছিল অসাধারণ। নিয়ম করে প্রদর্শনীতে যেতেন। আমিও একাধিকবার সঙ্গ দিয়েছি। কিউবিজম এবং ইমপ্রেশনিজম ঘরানার ছবির দ্বারা উনি প্রভাবিত ছিলেন। ওঁর ছবিতে প্রায়ই কিছু অদ্ভুত এবং খানিকটা বীভত্স প্রাণীর দেখা পাওয়া যেত। ওঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করায় বলেছিলেন এগুলো তাঁর স্বপ্নের অন্ধকার কুঠুরির থেকে উঠে আসা ছবি। আর একটা জিনিস ঘুরে ফিরে ওঁর ছবিতে আসত– পাহাড় এবং জঙ্গল। রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিও ওঁকে প্রভাবিত করেছে। ছবির সঙ্গে ওঁর যোগ কিন্তু নতুন কোনও বিষয় নয়। ওঁর আত্মীয় ছিলেন চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায়, যিনি অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র। ছোট থেকে তাঁর ছবি আঁকা দেখে উনি বড় হয়েছেন। সুতরাং ছবির মূল্য়ায়ন ও বিশ্লেষণ করার চোখ ওঁর ছোট থেকেই তৈরি হয়েছিল। ছবি সংগ্রহও করতেন। উনি বলতেন রিটায়ার করে শুধু ছবিই আঁকবেন।
কিছুদিন আগে আমি ওঁকে একটা ছোট খাতা উপহার দিয়েছিলাম, যেটা উনি সঙ্গে রাখতেন। ২০১৯ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উনি কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেই সময় হাসপাতাল থেকে আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি যেতেই খাতাটা এগিয়ে দিয়ে হাসপাতালে বসে আঁকা ছবিগুলো দেখতে বললেন। প্রথম ছবিটা ছিল একটা জঙ্গলের মধ্যে একটা শববাহী গাড়ি। পরের ছবিটা একটা রাজহাঁস। তিন নম্বর ছবিটা ওঁর হাসপাতালের ঘর থেকে দেখা দৃশ্য এবং শেষ ছবি রবি ঠাকুরের পোর্ট্রেট। আশাকরি ওই খাতার ছবি পরে কখনও বই আকারে নিশ্চয়ই প্রকাশ পাবে।
আমাদের একটা সান্ধ্য আড্ডা হত। কখনও আমার বাড়ি বা অফিসে, কখনও অন্য কোথাও। উনি মদ্যপান করতে পছন্দ করতেন এবং এই বিষয়ে ওঁর ছিল অগাধ জ্ঞান– যাকে বলে কনোস্যর, তাই। ওঁর পছন্দের পানীয় ছিল কনিয়াক আর ব্র্যাণ্ডি। আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। কোন পানীয় কীভাবে পান করতে হয়, অনুষঙ্গ হিসেবে কী কী দেওয়া চলে, এমন অনেক কিছু। মদ্যপানটাও ওঁর কাছে নিছক নেশা নয়, ছিল চর্চার বিষয়।

লকডাউন চলাকালীন আমার বাড়ি থেকে হেঁটে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। একদিন কুকুরের তাড়া খেয়ে খুব নাকাল হই। তখন উনি আমাকে একটা সাইকেল কেনার বুদ্ধি দেন। উনি নিজেও এতবড় মাপের একজন মানুষ হয়েও অবলীলায় রিক্সায়, ট্যাক্সিতে চেপে ঘুরতে পারতেন। আমার বাড়িতেও এসেছেন ট্যাক্সি চেপে।
একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন, আমার লেখাই আমার শিরদাঁড়া। সাহিত্যই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। লকডাউনে কবিতা লিখতে পারছিলেন না বলে খুব আফশোস করতেন। কিন্তু কাজের প্রতি ওঁর কমিটমেন্ট ছিল দেখবার মতো। কোনো দায়িত্ব নিলে সেটা যেভাবে হোক পূরণ করতেন। চরম মানসিক চাপ ব্যক্তিগত সমস্যা সবকিছু সরিয়ে রেখে কাজে মনোনিবেশ করতে পারতেন। এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং বলতেন এই মনঃসংযোগের জন্য উনি রবীন্দ্রনাথ এবং মানিকদার কাছে ঋণী।
চিত্র সংগ্রাহক ও স্বাধীন আর্ট কিউরেটর। দেশে এবং বিদেশে ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। যোগেন চৌধুরী, আকবর পদমসী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অমলাশঙ্কর প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন।