সৃজনের জগতে এমন মানুষের সংখ্যা বোধকরি বেশি, যাঁদের জীবন ও কাজ দুটি স্বতন্ত্র পথে প্রবাহিত। শিল্প সাহিত্য যে জগতেরই হোন, অধিকাংশের ব্যক্তিজীবন আর শিল্পীসত্তা সব সময় এক গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে না। কলম হাতে লেখার টেবিলে অথবা রং-তুলি-ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানো শিল্পীমানুষটির সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের বিস্তর ব্যবধান ঘটতে দেখা যায়। আগুনঝরা কলমের পাশে নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সমঝোতা, এমনটা অজস্রবার হয়েছে। চিত্রী বা ভাস্করের ক্ষেত্রেও কি এমনটা ঘটে না? বিশেষত আজকের দিনে এমন উদাহরণের অভাব নেই। আবার সংখ্যায় নিতান্ত গুটিকয় হলেও এমন মানুষ আছেন যাঁদের জীবনচর্চা ও শিল্পচর্চা একই সুতোয় গাঁথা। জীবনের আদর্শ, শিল্পভাবনা জীবনযাপন আর কাজকে যাঁরা বেঁধে নিয়েছেন এক সঙ্গে। আজকের এই নড়বড়ে পটভূমিকায় বেপরোয়া  শিল্পী সোমনাথ হোরের অবস্থান যা দ্বিতীয় ভাগে চিহ্নিত – সেকথা নতুন করে বলতে যাওয়া বাহুল্যমাত্র। আমরা জানি, তাঁর জীবন আর শিল্পকাজ কতটা নিবিড়ভাবে সংসক্ত। সেখানে কোনও ফারাক নেই। সমগ্র জীবন ও শিল্পে সোমনাথ হোর কখনো আপোষ করতে শেখেন নি। বই ও শিল্পের আবাস ‘দেবভাষা’ থেকে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক বই “ক্ষতচিন্তা, ভাঙন” পুনরায় আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিল। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে একটি ছোট খাতায় স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে লিখে রাখা একগুচ্ছ পৃষ্ঠা এই বইটির আধার। শিরোনামও তিনি স্বয়ং সেই খাতায় লিখে রেখেছিলেন। নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হয়, শিল্পীকন্যা চন্দনা হোরের আন্তরিক ঔদার্য ছাড়া স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা সেই মানুষটির জীবন ও শিল্পভাবনার এই অপ্রকাশিত অংশ পাঠকের সামনে আনা সম্ভব ছিল না। তাই প্রকাশকের পাশাপাশি তাঁরও বিশেষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। 

শিল্পী সোমনাথ হোরের কাজের সঙ্গে আমরা অল্পবিস্তর সকলেই পরিচিত। ছাপাই ছবির জগতে তিনি যে স্পর্ধিত ইতিহাস রচনা করেছেন, তা একেবারে অজানা নয়। ছাপাই ছবির আঙ্গিক নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁর কাজকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা সোমনাথের পেপার ম্যাশের আধারে নির্মিত বর্ণহীন বিমূর্তধর্মী সেমি-রিলিফ কাজে দেখেছি। আবার জীবনের মধ্যপর্বে এসে সোমনাথের ভাস্কর্য আমাদের সামনে আরেকটা দিক উন্মোচিত করেছে। তাঁর অসাধারণ কিছু লেখাও আমরা পেয়েছি, তাই মনে হতে পারে এই বইতে এমন কী আছে – যা নিয়ে এত কথা বলে হচ্ছে? স্বীকার করতে হবে, এই লেখার কোনও কোনও অংশে তাঁর জীবনের পূর্ব অভিজ্ঞতার ছায়া এসে পড়েছে, তবুও বলতে হয় সেই ছায়াবৃত অংশটি আগের চেয়ে আলাদা। এ যেন দীর্ঘ বন্ধুর পথ পেরিয়ে জীবনের প্রান্তে এসে একবার পিছন ফিরে দেখা। সেই দেখার মধ্যে জীবনের জ্বলন্ত জেহাদ মিশে থাকলেও, বিস্তৃত সময়ের প্রলেপে চা অনেকটা দ্রবীভূত, প্রশমিত হয়ে এসেছে প্রকাশের তীব্রতা।

নিরাসক্ত দৃষ্টি নিয়ে নিজের জীবন আর সময়টাকে পাখির মতো অনেকটা ওপর থেকে দেখে নেওয়া। এই লেখা শুরু হয়েছে ১৯৩৫ সালের গোড়ায় তাঁর পিতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। সেই থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের ঘাত প্রতিঘাতে তৈরি পিতৃহারা কিশোরের পরিণত শিল্পীসত্তার অকুন্ঠিত আর্তি বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে। সেদিন পিতার মৃত্যু দিয়ে তাঁর জীবনে আঁকা হয়েছে যে প্রথম ক্ষতচিহ্ন, তাকে আজীবন বয়ে নিয়ে চলেছেন। তারপর থেকে সমস্ত আঘাত তাঁর মনে একের পর এক গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ, ক্ষুধায় অনাহারে মৃত্যু, রোগগ্রস্ত ক্ষুধার্তের অসহায় হাহাকারষ ফুটপাথে সার বেঁধে পড়ে থাকা মৃতদেহ – এই সমস্ত কিছু তাঁর হৃদয়ে লেপে দিয়েছে দগদগে গভীর ক্ষত।

এমন এক মানুষের শিল্পকাজে ক্ষতচিহ্ন যে এক প্রধান মোটিফ হয়ে দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। আবার একই সঙ্গে শিল্পীকে বিষয়ের গন্ডি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়, তবেই হাতে আসে কলাশিল্পের সিংহদ্বারে প্রবেশের চাবিকাঠি। অন্যথায় শিল্পী হয়ে ওঠেন তথ্যনিষ্ঠ সংবাদের বাহকমাত্র। সোমনাথ নিজেই বলেছেন ‘সাদার ওপরে সাদার কাজগুলি করতে গিয়ে করতে গিয়ে ক্ষতকে ক্ষতরূপেই দেখেছি। আমার এক ছাত্র ক্ষত কাজগুলি করার সময় আমাকে প্রশ্ন করেছিল – আমার হৃৎকম্প হয় কিনা। বলেছিলাম ‘না’। যে-কোনও শিল্পকর্মে নির্লিপ্তি জরুরি। নান্দনিক তার প্রধান আধেয়।‘ কী আশ্চর্য অনুভব, পড়তে পড়তে মনে হয়, এক প্রথিতযশা শিল্পীর কলমে রচিত হলেও নয়, এ শুধু শিল্পীর নয়, সাধারণ মানুষের কাছেও সমান জরুরি। নিজেকে চেনা, নিজেকে আবিস্কারের এ এক বিচিত্র উপাখ্যান। সচিত্র বইটির ছাপা-বাঁধাইয়েরও প্রশংসা না করে পারা যায় না।

sushobhan adhikary

বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুশোভন অধিকারী একইসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক এবং সংরক্ষক। একদা কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পরে সেখানেই তত্ত্বাবধায়ক পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘকাল। বর্তমানের রবীন্দ্র-গবেষকদের মধ্যে তাঁর নাম অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন ও চর্চা। মাস্টারমশাই নন্দলাল নামে তাঁর লেখা বই পাঠকমহলে বহুল সমাদর পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *