তাহলে আমরা ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিলের কাছে এসে দাঁড়ালাম। অর্থাৎ, শিল্পী সোমনাথ হোর এসে পৌঁছলেন শতবর্ষে,এই আজকের দিনটিতেই।
সোমনাথ হোর তাঁর “আত্মজীবনীর অন্যদিক” রচনায় লিখেছিলেন, “১৯২১ সাল নানা কারণে আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সালে আমার বাবা কাকা জ্যাঠারা তাঁদের পুরোনো বাড়িতে বিরাট যৌথ পরিবারের স্থানাভাব ঘটায় নতুন বাড়িতে উঠে আসেন।… আর এই সালে এই বাড়িতে আমি জন্মাই পিতামাতার প্রথম সন্তানরূপে। তারিখ ছিল ১৩ এপ্রিল, বাংলা বর্ষের শেষ দিন ৩০ চৈত্র, ১৩২৭ সাল।”

এরপর এই রচনায় সেই অমোঘ উচ্চারণ, “জন্মে আকস্মিকতা আছে। মৃত্যু অবধারিত। আমি নাও জন্মাতে পারতাম। কিন্তু মাতৃগর্ভে যেদিন আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই ভ্রূণাবস্থা থেকে আজ পর্যন্ত, মৃত্যু আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে… মৃত্যুকে অবধারিত জেনেও মৃত্যুর কথা ভাবতে চাই না। অমোঘ হয়েও মৃত্যু সত্য নয়। জীবনই সত্য।”
সোমনাথ হোরের কাছে ১৯২১ যেরকম তাৎপর্য নিয়ে আসে, আমাদের কাছে ২০২১ সেইরকম তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বলা যেতে পারে, শিল্প-ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই বছর অত্যন্ত সাংকেতিক। কেননা শতবর্ষকে স্পর্শ করা এক শিল্পীর কাজ আমাদের দৃষ্টি ও ভাবনাকে আজও আন্দোলিত করছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রামের বরমা গ্রামে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতার অকালপ্রয়াণে এই শিল্পীর জীবনে প্রথম “ক্ষত” দেখা দিল।
তারপর দেশভাগ, তারপর দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর। “ক্ষত” নামের কোনও চরিত্র এই শিল্পীকে তাড়িত করতে থাকল। দেশভাগের পর কলকাতায় আসা। কমিউনিস্ট রাজনীতিতে প্রবেশ। হরেন দাস, চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, জয়নুল আবেদিনের সাহচর্যে দেখার পথ খুলে গেল। অন্তরের সঞ্চয় আরও আগে থেকেই চলছিল। পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে মুক্তিগ্রহণ, আদর্শ থেকে নয়। কিছুদিন দিল্লিযাপন আর তারপর শান্তিনিকেতনের সবুজ পরিবেশ। কলাভবনের শিক্ষকতায় যোগদান।
ক্রমেই ছাপাইচিত্রে সোমনাথ হোর হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক বিশ্বে এক উদভাবন। শিল্পী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনের কথায়, “সোমনাথ হোর হলেন একমাত্র শিল্পী যিনি এই কাজের প্রশিক্ষণের জন্য কোনোদিনই বিলেত যাননি, কিন্তু তাঁর কাজের যা মান, তা পৃথিবীর উৎকৃষ্ট যে-কোনো প্রিন্টমেকারের কাজের থেকে কোনো অংশে কম নয়। ওরকম প্রিন্টের কাজ আগে কখনো হয়নি।” একই সঙ্গে ছাপচিত্রের কাজ ছেড়ে যখন ভাস্কর্য করেছেন, শিল্পমহলে নতুন দিগন্ত দেখা দিয়েছে। ছবিতে, মিউরালেও তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

এই যদি তাঁর চিত্ররচনার জগৎ হয়, তবে কলম যখন ধরেছেন রচিত হয়েছে ইতিহাস… “তেভাগার ডায়েরি”। শান্তিনিকেতনের জীবনপ্রবাহে রামকিঙ্কর আর বিনোদবিহারীর সঙ্গ এই শিল্পীর চিন্তার জগৎকে আরও প্রসারিত করেছিল। জীবনের সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন আর এক স্বাধীন শিল্পী রেবা হোরকে। কন্যা চন্দনা হোরও রঙের জীবনকে নিজের জীবন করে নিয়েছেন। এ যেন ত্রয়ী শিল্পীর শিল্পকর্মশালা একই ছাদের তলায়।
এই পর্যন্ত একরকম জানাশোনা আমাদের এই শিল্পী সম্পর্কে। আমি নিজে চিত্রকলা জগতের মানুষ নই। তাই চিত্রকলার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে যেতে অপারগ। আমি এই শিল্পী মানুষ সোমনাথ হোরের সঙ্গে নিজে কীভাবে সম্পৃক্ত বোধ করি, তা বলার চেষ্টা করব। লিখিত শব্দের পাঠ আর অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য কিছু স্মৃতিচারণ থেকে এ পর্বের ভাবনাবীজ।

ব্যথা ছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। দুর্বল শরীর সেই ব্যথাকে আরও অবহ করেছিল। এ কথা অবশ্য আমরা স্বীকার করি, যিনি আবিষ্কারক, ব্যথা তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। আর আমরা জানি, এই চিত্রী, এই ভাস্কর চিরদিন নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে কেবলই নতুন নতুন পথের দরজা খুলে দিয়েছেন। আর আমরা সেই খোলা দরজার কাছে এসে কেবলই বিস্মিত হয়ে চলেছি। তাঁর কাজের সামনে এসে মনে হতে থাকে, এভাবেও হয়!

তাঁর ছাপাইছবি দেখতে দেখতে আমাদের বিভ্রম হয়, এ কি লিথোগ্রাফ! না কি পেনসিল চারকোলের অনবদ্য রেখাচারণ! এই হল একরকমের সোমনাথ হোর। বিস্ময়ে রাখেন আমাদের। ভাস্কর্যের মায়ায় আমরা ভুলে যাই “মনুমেন্টালিটি” কথাটি, কে.জি.সুব্রহ্মণ্যন কথিত “ম্যান মেন্টালিটি” কথাটিকেই আগলে ধরি তখন।
আসল হল দেখা। একটা কুকুরছানাকেও আমরা ঠিক ভাবে দেখে উঠতে পারিনি। কিন্তু সোমনাথ হোর কেবলই তাঁর দু’চোখ দিয়ে, সারা অস্তিত্ব দিয়ে জীবন জুড়ে দেখে গিয়েছেন। তা একটা কুকুর হতে পারে, একটা হাঁস বা পাখি হতে পারে, হতে পারে হনুমানের ক্ষিপ্রতা। আর মানুষ। মানুষের ব্যথা বেদনা আনন্দ রাগ অভিমান মিলন বিরহ ক্ষুধা অবসর অবসন্নতা লড়াই হেরে যাওয়া এবং হেরে না যাওয়া।
কিন্তু সব থেকে বড় কথা, এত সব কিছু নিয়ে তিনি কোনও কিছুই করতে চাননি। তিনি এক নিভৃত সৃজনশীল মানুষের মতো আপন খেলার আনন্দে মেতে থাকতে চেয়েছিলেন। শৃঙ্খলা যেমন গ্রহণের, যে কোনও শিল্পমাধ্যমের নিজস্ব ছন্দ যেমন অবশ্যমান্য, তেমনই তা থেকে মুক্তির স্বাদও প্রার্থনীয়। কিন্তু প্রথমে সেই দক্ষতাকে গ্রহণ করা, তারপর তার থেকে মুক্তি। সোমনাথ হোরের কাজ ধারাবাহিক ভাবে দেখলে এই শিক্ষা অনুধাবন করা যায়।

ব্যক্তিগত জীবনেও একদিন তিনি পার্টির পোস্টার এঁকেছেন প্রাণ দিয়ে, ছলনায় নয়। আবার পার্টির লাইন মেনে যখন দম বন্ধ হয়ে আসে তখন সক্রিয়তা থেকে মুক্তি নিয়েছেন, নিবিষ্ট হয়েছেন নিজস্ব শিল্পকাজে। ছাপাইচিত্রের জন্য সমস্ত জীবন দিয়েছেন। তারপর একদিন মনে হয়েছে “ছাপচিত্রে একটা ক্লান্তি আসছিল, তাছাড়া ছাপচিত্রে সোজাসুজি চিত্রপটকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপায় নেই; চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যে যা পাওয়া যায়…” অতঃপর ধাতুর কাছে সমর্পণ।
বিষয়কে আগলে ধরেছেন কিন্তু বিষয়কে অতিক্রম করার জন্য স্পন্দিত হয়েছেন। তাঁর জীবনযাপন যেমন পরিমিত, তেমনই ড্রয়িং-এ রেখার সামান্য কিন্তু অনিবার্য অব্যর্থ ব্যবহার। দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর তাঁর কলমকে আশ্রয় করেছে।
কিন্তু সোমনাথ হোর অনেকরকম। তাঁর মিথুন সিরিজের অনুভূতির তীব্রতা আমাদের বাকহারা করে। প্রতিদিনের ছোট ছোট কিন্তু শাশ্বত দৃশ্যের দিকে তাঁর রেখা যখন অগ্রসর হয়, মনে হয় এ পৃথিবীতে এত সহজ কিছু ছিল! যত তাঁর ক্ষয়, ততই ভালবাসার সংক্রমণ ঘটান তিনি। তাঁর শিল্পকাজ ছিল তাঁর সন্তানসন্ততি। তাঁদের জড়িয়েমড়িয়ে বেঁচে থাকা।
আর কেবলই নতুনের অনুসন্ধান থেকে জন্ম নিল ” সাদার উপরে সাদা”, যা জীবনেরই অন্তর্গত। নিজের কাজ নিয়ে তাঁর কোনও উচ্চাশা ছিল না। চিত্রকলা বলতেই এসে পড়ে বাজার, অর্থনীতি। কিন্তু সোমনাথ হোর নিজে তাঁর কাজের মূল্য নির্ধারণ করেননি। ভবিষ্যৎকাল তাঁর মূল্য দিয়েছে। এই হল এক শিল্পীর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
আজীবন খেলার ছন্দে জন্ম নিয়েছিল তাঁর কাজেরা। কোথাও আপস করেননি। কী জীবনে, কী কাজে! জীবন আর কাজকে কেবলই অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে গিয়েছেন, আর তা থেকে স্বর্ণ ফলেছে। জীবনের গোধূলিকালে দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর আগলে রাখা কাজের আনন্দভূমিতে নেমে আসছে “শকুনেরা”।

আমরা যাঁরা শিল্পরসিক,আমরা যাঁরা শিল্পালোচক, যাঁরা আমরা ছবি নিয়ে জীবিকা অবলম্বন করি, আমরা সেই ” শকুনের” দল। আর একজন মানুষ নিজের জীবনপাত করেছেন, নিজের জীবন ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যপ্ত চরাচরে,তাঁকে আমরা কতটুকু অনুভব করি, বুঝতে পারি? আমাদের তারিফও একরকম ছলনা। শিল্পী সোমনাথ হোরকে তারিফ করতে পারলেও যে পেডিগ্রি বাড়ে।
এই ব্যর্থতা নিয়েই চৈত্র-বৈশাখের এই রৌদ্রময় দিনে, কন্যা চন্দনা হোর লিখিত “ব্যথাপথের পথিক” সোমনাথ হোরের শতবর্ষদিনে তাঁকে নিজেদের প্রণাম নিবেদন করে খানিক শুদ্ধ হওয়ার বাসনা রাখি।
* সোমনাথ হোরের ব্যক্তিগত ছবি ও তাঁর কাজের ছবি সৌজন্য: দেবভাষার তরফে দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়।
দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের পরিচিতি এককথায় বলা প্রায় অসম্ভব। তাঁর যে পরিচয়টি সর্বজনবিদিত তা হল, তিনি 'দেবভাষা' নামক বই ও শিল্পের আধার সংস্থাটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চালিকাশক্তি। তিনি কবি। তিনি প্রকাশক। তিনি সম্পাদক। তবে কোনও পরিচয়েই নিজেকে বেঁধে ফেলননি এখনও। মনে করেন, কুলীন বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি আজও বহিরাগত। যদিও তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই 'আঙুরভাব শেয়ালভাব' বাংলা কাব্যভাষায় নতুনত্বের দিশারী।