জ্ঞান হওয়া ইস্তক অধিকাংশ মানুষই একটি সার কথা জেনেই বড় হয়েছে যে, মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সাধারণভাবে পূর্বনির্দিষ্ট সমাজ নামক একটি প্রথাগত ধাঁচার মধ্যেই নিজেকে আঁটিয়ে নিতে হয়। এবং এই আঁটিয়ে নেওয়ার জন্য সময় সময় নিজেকে বাড়ানো, অধিকাংশ সময় কমানো অর্থাৎ নিজেকে দমিয়ে সমাজের ধাঁচার মতো করে নিজেকে গড়ে-পিটে নিতে হয়। এর কিছু নিয়মকানুন আছে, যা পালন না করলে সমালোচনা তো বটেই, কপালে মার, চরিত্রে দাগ, খাপ পঞ্চায়েত, অশুচি, দলিত, সাম্প্রদায়িক, মানসিক বিকারগ্রস্ত, অসভ্য— ইত্যাদি বহু অসহনীয় যন্ত্রণা ও নানাবিধ অলঙ্কারে ভূষিত হতে হয়। মেয়ে হলে তো কথাই নেই। কারণ সমাজ বলে, মেয়েদের চরিত্রের ওপরই সমাজের পবিত্রতা নির্ভর করে। সুতরাং বাকিটা বলা নিষ্প্রয়োজন।
মোটামুটি সমাজবদ্ধ জীবের সংজ্ঞা এবং কাজকর্ম এমনটাই চলে এসেছে সেই আদিকাল থেকে। কিন্তু মাঝে মাঝে এর ব্যত্যয় ঘটে। যেমনটা এখন ঘটেছে। করোনা ভাইরাস এসে মানুষের শেকড়, জ্ঞানের নাড়ি, শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিক ভাবে সমাজের প্রতি দায়বোধকে ভয়ঙ্কর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে সামাজিক ভাবে সংঘবদ্ধ না হলে এই বিপর্যয় থেকে বাঁচা মুশকিল। মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব, এটা প্রমাণ করার দায় এখন সবচেয়ে বেশি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম— এখন আর নয়। এখন সবাই বাঁচলে নিজের বাঁচার একটা সম্ভবনা আছে। সুতরাং বাধ্য হয়ে সবার কথা ভাবতে হবে। কেবল নিজের হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা পাকা করলেই হবে না। অন্যের জন্য হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক ডজন স্যানিটাইজ়ার কিনে ঘরে মজুত রাখলে বাঁচা যাবে না। অন্যের জন্য দোকানে স্যানিটাইজার ছাড়তে হবে। আবেগে ভেসে গিয়ে থালা বাজিয়ে মিছিল করলে হবে না। মনে রাখতে হবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জানলায় বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থালা বাজাতে। যে ভাবে অন্যান্য দেশ নিজের মতো করে স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছে। রাস্তায় বেরিয়ে নয়। ঘরে থেকে। রাস্তায় বেরিয়ে আনুগত্য দেখালে বা আনন্দ করলে, হিতে বিপরীত হতেই পারে। হবেও হয়তো। মনে রাখতে হবে, আপনি আপনার বাড়িটুকু সামলালেও বিপদ আটকানো না-ও যেতে পারে। সুতরাং সমাজ সামলাতে গেলে, সতর্ক হতে হবে, সতর্ক করতে হবে। সাবান-স্যানিটাইজ়ারের আড়তে বসে থেকেও আপনি ঈশ্বরের পছন্দের অমৃতের পুত্র বা কন্যাটি না-ও হতে পারেন। এখন ঘোর ঝড় চলছে। মাথা নিচু করে ঘাপটি মেরে থাকতে হবে, ঝড় পেরিয়ে যেতে দিতে হবে। মাথা তুললেই বিপদ।
সুতরাং চালু সমাজের সংজ্ঞা থেকে সরে এসে, সমাজ থেকে বিযুক্ত হয়ে সমাজকে বাঁচাতে হবে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো আলাদা থাকতে পারলে, তবেই ভবিষ্যতে জোটবদ্ধ হয়ে অন্য সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব করা যাবে। ততদিন আলাদা থেকে সংঘবদ্ধ থাকতে হবে। আলাদা থাকার জন্য অন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সমাজবদ্ধ জীব প্রমাণ করতে হলে সমাজকে একটি করে একাকী ইউনিটে ভেঙে দিতে হবে। তবেই জোড়া লাগবে সব—মনুষ্যত্ব, সমাজ, আশা, ভরসা, সব।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।