আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২]

আশঙ্কা

১৯৮৪ সালের কথা। ছ’বছর চাকরি করার পর আমেরিকায় এসেছি উচ্চশিক্ষার্থে।

এসেছিলাম আগস্ট মাসের শেষের দিকে। খাতায় কলমে সেটা তখনও গ্রীষ্মকাল। রোদ উঠলে দিনের বেলাগুলো ঠিকই থাকতসন্ধ্যার দিকে একটু ছ্যাঁক ছ্যাঁক করত।

সরকারিভাবে হেমন্ত এল সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে। গাছের পাতায় লালের ছোঁয়া আগেই ছিল, সেটা আরও রক্তবর্ণ ধারণ করল। সে সময়ে হাতের কাছে ফোন ক্যামেরা থাকত না সবসময়। তাই কিছু অনির্বচনীয় সুন্দর দৃশ্য ধরে রাখতে পারিনি।

অক্টোবরের শুরু থেকেই ধোক্কর জ্যাকেটটা সব সময়ের সঙ্গী হয়ে গেল।

তারপর হঠাৎ একদিনসময়টা সঠিক মনে নেই, সম্ভবত নভেম্বরের শুরুতে পোঁজা তুলোর মতো তুষারপাত (Snowfall) দেখলাম। অস্বীকার করব না, অচেনাকে প্রথমবার প্রত্যক্ষ করার মধ্যে একটা শিহরণ ছিল।

শুরুর দিকের হালকা তুষারপাতে accumulation হত না। মানে বরফ জমে থাকত না, রোদ উঠলে গলে যেত। কিছুদিনের মধ্যেই, ভারত-চিন সম্পর্কের মতো সে বরফ আর গলল না। ঊর্ধাঙ্গের জ্যাকেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্নিকার জোড়ার বদলে পদযুগলের আশ্রয় হল ভারি ‘snow boot’

এই স্নো বুটে নাকি আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা কম। কিছু বোঝার আগেই বার দুয়েক ধরণীতলে পতন হল। বয়স কম ছিল, তাই বড় রকমের চোট খাইনি।

autumn Leaves
গাছের পাতায় লালের ছোঁয়া আগেই ছিল, সেটা আরও রক্তবর্ণ ধারণ করল

অনেকেই হয়তো টেলিভিশনে শীতকালের অলিম্পিক দেখেছেন কোনও না কোনও সময়ে। অংশগ্রহণকারী ক্রীড়াবিদরা নানারকম কারসাজি দেখান বরফের ওপর। পাঠককে অনুরোধ অধমের একটা উপদেশ মাথায় রাখবেন। ওসব ক্যারদানি সাহেবদেরই সাজে, বাঙালি শরীরে ঐ সব করতে গেলে ঘোর বিপত্তি (ডাকসাইটে মোটর রেসার মাইকেল শ্যুমাখার এক স্কি দুর্ঘটনার ফলে বহুদিন হল জীবন্মৃত অবস্থায় রয়েছেন)। 

***

খ্রিস্টমাসে কয়েক সপ্তাহের ছুটি। ব্যাবকক হল নামে যে ছাত্রনিবাসে থাকতাম সেটি প্রায় ফাঁকা। আমার মতো কিছু অভাগা দরিদ্র বিদেশি ছাত্র, যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তারাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছি কেবল। চারদিক মন খারাপ করা সাদা বরফে ঢাকা। বাঙালি মনের অবচেতনে কোথাও এই ফ্যাটফ্যাটে সাদা রঙের সঙ্গে মৃত্যুর একটা যোগসূত্র আছে।

তার মধ্যে আবার একটা উপসর্গ দেখা দিল। নাক দিয়ে থেকে থেকেই রক্ত পড়ছে। বছর পাঁচেক আগে বাবার কাশির সঙ্গে রক্তের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তবে কি…! সেই ভয়াবহ রোগটির কথা মনে পড়ছিল।

নাগার্জুনা চিন্তিত মুখে ঘরে এল। সিঙ্গারেড্ডি নাগার্জুনা অন্ধ্রপ্রদেশের ছেলে। আমারই বয়সী। কিছুদিন চাকরি করার পর আবার পড়াশোনা করতে এসেছে। আমেরিকানরা ওকে ‘Nags’ বলে ডাকত। মিলিটারি মার্কা গোঁফের জন্য আমি ওকে মাঝে মাঝে মশকরা করেকর্নেলনামে সম্বোধন করতাম। 

কী হল Nags? কোনও কারণে upset মনে হচ্ছে?

 ঠিকই ধরেছ Sid। মনে হচ্ছে আমার ক্যানসার হয়েছে।

 নড়েচড়ে বসলাম। 

প্রায় রোজই নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।

একটু যেন আশার আলো দেখলাম। জীবনের শেষ কটা দিনে পাশের বেডে অন্তত একজন নিজের দেশের মানুষ পাব! তবে ব্যাপারটা একটু বেশিই কাকতালীয় বলে মনে হয়েছিল। ২৯ বছরের দুজন ভারতীয় যুবকের একই হস্টেলে একই সঙ্গে শরীরের একই অঙ্গে বাসা বেঁধেছে একই মারণরোগ…!

snowfall
চারদিক মন খারাপ করা সাদা বরফে ঢাকা

গেলাম মুশকিল-আসান সমস্ত ভারতীয় ছাত্রদের স্বনিয়োজিত পরামর্শদাতা বব একহার্টের কাছে, কীভাবে চিকিৎসা শুরু করা উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করতে।

বব এক ব্যর্থ চিত্রপরিচালক। এক সুপার ফ্লপ ছবি পরিচালনা করেছিলসর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসায়িক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য MBA করছে। ওর কথাবার্তা একটু নাটকীয়।

গম্ভীর হয়ে বলল,ডাক্তারের কাছে পাঠানোর আগে তোমাদের আমিই একটা নিদান দেব।

— “কী সেটা বব?”

— “আজ রাতে শোবার আগে একটা বড় থালা জাতীয় পাত্রে  জল ভরে মাথার কাছে রাখবে। দিন তিনেক বাদে জানিও কোনও উন্নতি দেখছ কিনা। এই নিদানে কাজ না হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাবে।

ডাক্তার ববের দাওয়াই-এ রাতারাতি ফল পেয়েছিলাম। দুদিন পর ডাক্তার বব রহস্য উন্মোচন করলেন। শীতকালে ঘরে সারারাত হিটার চলার জন্য বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুব কমে গিয়ে এই ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করে। জলভরা থালাটা আর কিছুই করে না, বাতাসের আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে মাত্র।

অতি সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। 

Winter in city

এই ‘Nags’-এর সঙ্গে পরবর্তীকালে আর যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি জেনেছি Nags আর নিউ হ্যাম্পশায়ার ছাড়েনি। ওখানেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। যেমন আমার খড়গপুরের সহপাঠী কাঞ্চন চৌধুরী ‘Alma Mater’-এই সারাজীবন অধ্যাপনা করে গেল। যাকে বলে জিনা য়ঁহা, মরনা য়ঁহা, ইসকে সিওয়া জানা কঁহাআমিও একসময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম শ্যামবাজার ছেড়ে কোনোদিনও নড়ব না। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

মোহনবাগানেরঘরের ছেলেসুব্রত ভট্টাচার্যের একবার দুর্মতি হয়েছিলওবাড়ির কোচ হয়েছিলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনে বিক্ষুব্ধ মোহনবাগানিদের বলেছিলেন: “যে ইস্কুলে পড়েছি সেখানেই হেডমাস্টারি করতে হবে না কি?” অল্প ক’দিনেই নিজের ভুল উপলব্ধি করে অবশ্য ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে এসেছিলেন। 

***

আর একটি ঘটনার কথা লিখব এই পর্বে। বছর তিনেক আগের কথা। কদিন ধরেই চশমা পরেও ঝাপসা দেখছিলাম। বার বার কাচ মুছেও সুবিধা হচ্ছিল না। দু-তিন পাতা পড়ার পরেই চোখটা ক্লান্ত হয়ে বুজে আসছিল।

নানা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছিল। প্রেসারটা বাড়ল নাকি? নাকি সুগার? কদিন একটু অনিয়মও গিয়েছিল। কিছু অযৌক্তিক ভয়ও হচ্ছিল। এক বন্ধুর বাবা শুনেছিলাম রাতারাতি একটা চোখের দৃষ্টি হারিয়েছিলেন। আমারও কি তাই হবে?

হঠাৎ চন্দনাও একই সমস্যার কথা বলল। এবারে অঙ্কটা কেমন যেন গুলিয়ে গেল। কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে বটে, তবে এটা যেন একটু বাড়াবাড়ি। তবে কি এটা কোনও ভাইরাস?

Book & Reading Glasses
দু-তিন পাতা পড়ার পরেই চোখটা ক্লান্ত হয়ে বুজে আসছিল

লাগাতার দুশ্চিন্তা করতে করতে বছর পঁয়ত্রিশ আগের উপরোক্ত ঘটনাটা মনে পড়ল। সমস্যাটা অন্য, কিন্তু মিল একটা জায়গায় একই সঙ্গে দুজন সমবয়সী মানুষের শরীরের একই অঙ্গে সমস্যায়। কোনও একটা সহজ সমাধান থাকতে পারে কি? স্রেফ ঘরে একটা থালায় জল রাখার মতো?

বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো একটা ভাবনা মাথায় এল। চশমা দুটির একইরকম ফ্রেম, কোনওভাবে বদল হয়ে যায়নি তো? হোক বা না হোক, চেষ্টা করতে দোষ কোথায়?

বহুদিন আগে মালাবদল করেছিলাম। এবার চশমা বদল করলাম। ম্যাজিকের মত দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলাম। 

***

জীবনে এই ধরণের আতঙ্ক ঘুরে ফিরে আসে। সব health scare-এর এই পর্বে বলা দুটি ঘটনার মতো লঘু সমাপন হয় না। কদিন আগেই ক্যানবেরার ছোট বাঙালি সমাজের এক মহিলা, আমার কাছাকাছি বয়সীই চার বছর কর্কট রোগের সঙ্গে লড়াই করার পর চলে গেলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের চমকপ্রদ উন্নতি সত্ত্বেও অনেক রোগকেই মানুষ এখনও জয় করতে পারেনি। হয়তো কোনোদিনও পারবে না। গত তিনবছর ধরে কোভিডের তাণ্ডব চলছে। গত এক বছরে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও এই রোগের শেষ কোথায়, বা আদৌ আছে কিনা কেউ জানে না এই মুহূর্তে।

রোগ জরা নিয়েই জীবন। মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তা সত্ত্বেও আমরা ভয়ে ভয়েই থাকি। পৃথিবীটা বড় সুন্দর জায়গা যে

 

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৩ মার্চ , ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Lavinya Net, Max Pixel, Istock

Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *