স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ মানে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার অপার দিগন্ত। শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিতে এক অনন্য আলোড়ন ও ধাবমান উচ্ছ্বাস। তারুণ্যের প্লাবন, কল্পনার বিস্তার এবং দৃপ্ত অঙ্গীকারের নিবিড় বুনন। যেন মুহূর্তেই সব পুরাতন ভেঙে সমতার-সততার নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ। চাকচিক্য নয়, বিলাস-বৈভব নয়, তবে অকপট বাহ্যবেশ ছিল তাই। কিন্তু বাহ্য সতেজ আনাজের ভিতরে যেমন থাকে গোপন কীট, তেমনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও ছিল গুপ্ত কীটাণুর নিযুত সমাবেশ।
পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী এবং বণিকপুঁজি ও শিল্পপুঁজির উচ্ছিষ্টভোজী আপাতদমিত দুর্বৃত্তরাও সঙ্গোপনে কীটাণু ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। ওরা সব অপেক্ষায় ছিল প্রত্যাবর্তনের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ওরা আবির্ভূত হয়। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কীটাণুদের পথযাত্রা মসৃণ হয় এবং তাদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় বাঙালি জাতির একটি বড় অংশ আত্মহত্যায় সমবেত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসিত সত্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র অপসৃত হয় বাঙালির জীবনচর্চা থেকে। ধীরে ধীরে স্বপ্নের বাংলাদেশও পিছনে হাঁটতে থাকে।
বাঙালির এই আত্মহননকে প্রবল করে তোলে সামরিক শাসকরা। তারা নতুন রাষ্ট্রনৈতিক চৈতন্যে অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির অন্ধকারে জাতিকে টেনে নেয়। সাম্প্রদায়িকতা, লাভ ও লোভের আকৃষ্টতা, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি পরায়ণতা ইত্যাদির অতল তলে সমাহিত হলো স্বপ্নের বাংলাদেশ। এ সময় শোষিতের কাঙ্ক্ষিত প্রতিরোধ অনিবার্য থাকার পরও হল না। জাতি ও জাতির পিতার হত্যার আবশ্যক প্রতিবাদ রাজনীতিকরা যথার্থরূপে করতে ব্যর্থ হলেন। তখন বরাবরের মতো এই ব্যর্থ ও নিষ্ফল সময়ে কীটাণু বিনাশে সোচ্চার হলেন কবি-শিল্পীরা। বাংলাদেশ ও বাঙালির এই নিভৃত মৃত্যুকালে সশব্দে ও সগৌরবে মৃত্তিকার মৃদঙ্গ বাজিয়ে নাট্যাঙ্গনে প্রবেশ করলেন নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, গীতিকার, সুরশিল্পী এস এম সোলায়মান (১৯৫৩-২০০১)।
এসএম সোলায়মানের প্রাথমিক উপস্থিতি ঘোষিত হয়েছিল চট্টগ্রামে নিজ জন্মজেলায়। ‘শিকল পরিয়ে দাও’, ‘তিন রোস্তমের গপ্পো (১৯৭৮)’, ‘সূয্যিমামার বরযাত্রী’, ‘কবর’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ মৌলিক নাটক ও নাট্যরূপের মাধ্যমে সে ঘোষণা শোনা গেল খুবই স্বাভাবিক স্বরে। এর মধ্যে এস. এম সোলায়মান লিখলেন ‘খ্যাপা পাগলার প্যাচাল’ (১৯৭৮)। নাটকটি পথনাটক হিসেবে মঞ্চায়নের পর তুমুল আলোড়ন হল। বলা যায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নবনাট্যধারায় সবচেয়ে আলোচিত, নন্দিত ও মঞ্চস্থ এ নাটকটি শাণিত সংলাপে, গল্পগাঁথুনিতে এবং গন্তব্য অভিমুখী নাট্যোৎকর্ষে অনন্য ও অসামান্য।
প্রকৃতপক্ষে ‘খ্যাপা পাগলার প্যাচাল’ নাটকের মাধ্যমে রণতূর্য বাজিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে এস এম সোলায়মান অবিরাম নাট্যযোদ্ধায় পরিণত হলেন। লিখলেন মৌলিক নাটক ‘মুখোমুখি কংস (১৯৭৯)’, ‘ইলেকশান ক্যারিকেচার (১৯৮০)’, ‘ইঙ্গিত (১৯৮৪)’, ‘গণি মিয়া একদিন (১৯৮৬)’, ‘এই দেশে এই বেশে (১৯৮৮)’, ‘বার্থ ফ্যান্টাসি (১৯৯৬)’ ইত্যাদি। রূপান্তর ও নাট্যরূপেও রাখলেন মৌলিকতার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর। ‘কোর্ট মার্শাল (১৯৯৩)’ নাটকটি তো মূলের সৌন্দর্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে সমূলে মৌলিক হয়ে উঠেছিল। তাঁর এই সগৌরব উপস্থিতি রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে ত্রিবদ্ধ হয়ে প্রোজ্জ্বল হয়েছে। আমৃত্যু তিনি সৃজনশীল প্রতিভা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে আলোকশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন। মৃত্যুনিকটপূর্বকালে নানান কারণে তাঁকে নিঃসঙ্গতা ছুঁয়েছিল কিন্তু পেয়ে বসেনি। ভিতরে যে অগ্নিদহন ছিল তা দ্বিগুণ হয়ে নাট্য সংলাপ ও বিষয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বাঙালির এই আত্মহননকে প্রবল করে তোলে সামরিক শাসকরা। তারা নতুন রাষ্ট্রনৈতিক চৈতন্যে অর্থাৎ ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির অন্ধকারে জাতিকে টেনে নেয়। সাম্প্রদায়িকতা, লাভ ও লোভের আকৃষ্টতা, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি পরায়ণতা ইত্যাদির অতল তলে সমাহিত হল স্বপ্নের বাংলাদেশ। এ সময় শোষিতের কাঙ্ক্ষিত প্রতিরোধ অনিবার্য থাকার পরও হল না। জাতি ও জাতির পিতার হত্যার আবশ্যক প্রতিবাদ রাজনীতিকরা যথার্থরূপে করতে ব্যর্থ হলেন।
বস্তুত এস এম সোলায়মানের নাটকের এই দ্বিগুণ আগুন জ্বলেছিল যে শলাকায়, তার নাম রাজনীতি। তাঁর নাটকের রাজনীতি বা তাঁর রাজনৈতিক নাটক, যে অভিধাই দেওয়া হোক না কেন, সে আলোচনার সময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে নাটক ও রাজনীতির যুগ্মযোগের প্রেক্ষিত। সেই যুগ্মযোগের খতিয়ানে দেখা যায়, ইংরেজি নাটকে রাজনীতি ছিল সেই এলিজাবেথের সময়েও। লিলি, ক্রিস্টোফার মার্লো, টমাস কিড, শেক্সপিয়ার, প্রমুখের নাটকে যে রাজনীতি ছিল, তা মূলত রাজতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্য রাজনীতির প্রতিফলন। সে সময়ের নাট্যকাররা টিউডর রাজবংশ ও স্টুয়ার্ড রাজবংশের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা প্রজ্ঞা⎯ এসবকে অনুষঙ্গ করেছেন স্বকালের রাজনীতির প্রেক্ষিতে।
এসকল নাট্যকারদের স্বকালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন রানি এলিজাবেথ। তাঁরা দেখেছেন যে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য রাখার জন্য এলিজাবেথ বিয়ে পর্যন্ত করতে পারেন না। রাজনীতির কারণে ইউটোপিয়ার টমাস মুরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। প্রধান বিচারপতি কোককে হত্যা করা হয়। এ সকল রাজনৈতিক আলোড়ন, দ্বন্দ্ব, সংঘাতকে নাট্যকাররা উপেক্ষা করতে পারেন না। তাঁদের নাট্যবিষয়ে এ সকল রাজনীতি অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
সংস্কৃতের নাট্যকার বিশাখদত্ত, রাশিয়ার আন্তন চেখভ, আয়ারল্যান্ডের জর্জ বার্নাড শ, ব্রায়েন ফ্রেইল, ফরাসিদেশের জাঁ পাল সাত্রে, জার্মানির বের্টোল্ড ব্রেখট, মার্কিনদেশের আর্থার মিলার, প্রমুখ যে সকল নাটকে রাজনীতিকে নাট্যবিষয় করেছেন, সেগুলি নাটক ও রাজনীতির যুগল সমন্বয়ে স্বকালের প্রেক্ষিতেই করেছেন। যেমনটি আমরা বর্তমান জার্মান নাট্যকার শেরমিন লাংহফের নাটকে উত্তর-অভিবাসন বিষয়ক রাজনীতি দেখছি। দেখছি মার্কিন নাট্যকার ডানাই গুরিরার নাটকে সাদা-কালো, আগ্রাসন, নিপীড়ন। যেমনটি দেখেছিলাম বাংলা নাটকে নীলদর্পণ, সিরাজুদ্দৌলা, শাজাহান, রাজা প্রতাপাদিত্য, রক্তকরবী ইত্যাদিতে। দেখেছিলাম বিজন ভট্টাচার্য, পানু পাল, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র প্রমুখের নাটকে। তেমন দেখেছি মুনীর চৌধুরী, মমতাজউদদীন আহমদ, মামুনুর রশীদের নাটকে।

এই যে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, সংস্কৃত থেকে বাংলা নাটকে রাজনীতির অনুপ্রবেশ এবং অপূর্ব সমন্বয়, সেই পরম্পরায় এস এম সোলায়মানের রাজনৈতিক নাটক রচিত হয়। সঙ্গত প্রশ্ন, এস এম সোলায়মানের নাটকে প্রতিফলিত রাজনীতির স্বরূপ, তাঁর রাজনৈতিক নাটক রচনার প্রেরণা ও প্রেক্ষিত কী? এ সরল জিজ্ঞাসার সরাসরি উত্তর মার্কসবাদ ও ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির নষ্ট আবহ ও দূষিত পরিবেশ। খতিয়ান নেয়া যাক সোলায়মানের রাজনৈতিক নাটকের স্বরূপের। মার্কসবাদের প্রধান সুর যে দ্বান্দ্বিকতা, যা পরম্পরায় পুঁজিবাদী সমাজ নির্মাণ করেছে এবং ওই দ্বান্দ্বিকতার সূত্রে পুঁজিবাদী সমাজ ভেঙে তৈরি হবে সাম্যবাদ⎯ এই সুর সোলায়মানের নাটকে সুউচ্চ স্বরে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজের যে বিচিত্র ক্লেদ, যা নানান নামে পল্লবিত আছে, যেমন রাষ্ট্রনৈতিক শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণিসংঘাত, ক্লিন্ন আচার, সামন্ত বেনিয়াদের আগ্রাসন, প্রান্তবর্তী জনগণের দুর্বহ দুঃখভোগ ইত্যাদি তাঁর নাটকে স্বচ্ছন্দে অনুষঙ্গ হয়েছে। তাছাড়া সমাজ ও সময়ের আন্দোলন ও অভিঘাত রাজনৈতিক প্রেক্ষিত হয়ে তাঁর নাটকে সংলগ্ন হয়েছে।
খতিয়ানে দেখা যায় যে, ভীষণ তীর্যক সংলাপে সোলায়মানের নাটকের রাজনৈতিক ভাষ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
…কইবারও পার না মনের মিনার কবেই মইরা গ্যাছে। একাত্তরের খুনি শোকসভায় বইসা প্যাচাল ছাড়ে, ভুইল্যা যাও নাই? হেরা যহন চানতারা মার্কা পতাকা উড়াইবার কথা কয়, তখন তো হগল মিয়াই মুখ বুইজ্যা থাক⎯ ভুইল্যা যাও নাই? শহিদগো নাম ভাঙাইয়া, চাঁদা তুইল্যা চা পানি খাও, ভুইল্যা যাও নাই? মগর ভুলি নাই আমি। খোড়া পাত্তয়ের কাটা ঘায়ের ওপর চালাই নখ, দরদর কইরা মইরা পড়ে খুন।… মাথায় উঠছে যন্ত্রণা, বুকে বইছে নড়।… দালালের দল মর। হায়নার দল মর। রাজাকারের দল মর (খ্যাপা পাগলার প্যাচাল)।
এই একটি সংলাপেই সোলায়মানের নাটকে রাজনীতির স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। বোঝা যায় ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি দালাল-রাজাকারদের যে অভয়ারণ্য হয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহিদের বাংলাদেশ, তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মীমাংসিত ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে। এ রাজনৈতিক ভাষ্যই তাঁর নাটকের রাজনীতি।
মথুরার অত্যাচারী রাজা কংস। প্রজাপীড়নে ও নিষ্ঠুর শাসনে ত্রস্ত-ত্রাহি প্রজা সাধারণ। রাজ নিষ্পেষণে-নিগ্রহে প্রজা অতীষ্ঠ। এই শোষিত প্রজা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এই রাজা-প্রজার দান্দ্বিকতা সামন্ত সমাজের অনিবার্য অংশ। শোষক-শোষিতের চিরন্তন দ্বান্দ্বিকতার চিত্র এবং শোষিতের পক্ষে নাট্যকারের অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায় ‘কংসের মুখোমুখি’ নাটকে। এ নাটকেও সোলায়মানের রাজনীতির স্বরূপ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
‘ইলেকশান ক্যারিকেচার’ সোলায়মানের একটি মঞ্চ সফল নাটক, যেখানে তিনি সিংহাসনের জন্য রাজা, ও রাজনীতিবিদদের লোভের ইতিহাস বর্ণনা করে দেখিয়েছেন যে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, তা আসলে একটি লোক দেখানো, মনভোলানো ও স্বপ্ন বানানো পদ্ধতি মাত্র। এই নির্বাচনে কেউ সিংহাসনে বসে, কেউ যায় কারাগারে। জনগণের সামান্য অর্থেও কোনও লাভ হয় না। প্রান্তীয় জনগোষ্ঠী পথপ্রান্তে ও সর্বপ্রান্তে পড়ে থাকে। রাজা ও নেতা-নেত্রীর জন্য নির্বাচন লাভজনক হলেও ব্রাত্য ও অভুক্তের জন্য কোনও সম্ভবনার স্বর্ণদুয়ার খুলে দেয় না। পুঁজিবাদী সমাজের অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাট্যকার তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত করেছেন।
‘ইঙ্গিত’ নাটক সোলায়মানের আর একটি অসামান্য সৃষ্টি। স্বকালের সমাজবাস্তবতা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে অবান্তর বিতর্ক, শিক্ষাক্রমের ধ্বংসান্মুখ চিত্র, শহিদদের অসম্মান, চলচ্চিত্রের বেহায়াপনা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির শেকড় বিচ্ছিন্নতা এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের অমানবিক জীবনযাপন ইত্যাদি ফুটে উঠেছে আলোচ্য নাটকে। এ নাটকের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সমাজ পরিবর্তন করে সাম্য-সততার সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন নাট্যকার, যা তাঁর রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট প্রতিফলন।
গ্রামীণ সামন্ত শোষণের প্রেক্ষাপটে রচিত নাটক ‘গনি মিয়া একদিন’। প্রাথমিকের পাঠ্যপুস্তকে পঠিত গরিব কৃষক গনি মিয়ার নতুন সংস্করণ রচনা করেন সোলায়মান। দরিদ্র শিক্ষক গণি মিয়ার সর্বস্ব হারানোর গল্প নাটকে নতুন মাত্রা পায়। শোষক নেয়ামত মণ্ডল, বিশ্বাসঘাতক কাসেম, ময়নার আশাহীন জীবন এবং গনি মিয়ার স্বপ্নভঙ্গের সকরুণ কাহিনি নাটকের প্রাণ। সামন্ত সমাজের শোষণ-প্রতারণার রাজনীতি এ নাটকের গল্পবিছানো সংলাপে মূর্ত হয়ে উঠেছে। নাট্যপ্রান্তে জীবন সংগ্রামে পরাজিত গণি মিয়া বিপ্লবীর মতো অমিত দীপ্তিতে জ্বলে ওঠে। বলে⎯
নতুন কইরা আমারে জন্ম দিতে পারো না? কোনও সাধারণ কৃষাণের ঘরে, অতিরিক্ত আশা যেখানে মানুষরে কলুইর বলদের মতন ঘানি দিয়া টানায় না? মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন এখনো ভালো করে শুনতে পাইলো না টিনের চালায় বৃষ্টির সঙ্গীত নৃত্য। গাংগের কুলুকুলু ধ্বনি, সমুদ্দের বিশাল নিঃশ্বাস আর বাদলা দিনের পাগলা বাতাস। শুধু একবার, শুধু একবার আমারে নতুন কইরা জন্ম দাও। আমি মুক্ত বাতাসে পরান ভইরা নিঃশ্বাস লই।… জন্ম দাও। জীবন দাও (গনি মিয়া একদিন)।
গনি মিয়ার এই জ্বালাময়ী সংলাপের ভিতর দিয়ে নাট্যকার শোষিতের প্রতিবাদের রাজনীতিকে তুলে এনেছেন।
সময়ের বিচারে সোলায়মানের সাহসী রচনা ‘এই দেশে এই বেশে’। প্রহসনধর্মী এই নাটকটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, জহীর রায়হান এসে উপস্থিত হন স্বকালের পাটাতনে। তাঁরা তাঁদের সামগ্রিক অর্জনের বিকৃতিতে বিভ্রান্ত হন এবং সমকালের গড্ডলিকা প্রবাহ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রেখে হতাশা নিয়ে প্রস্থান করেন। এই যে চিরায়তের অসম্মান এবং রাজাকার চিকন আলিদের উত্থান, এই সমসাময়িক সামাজিক সাংস্কৃতিক আবহ তুলে ধরেছেন আলোচ্য নাটকে। এখানে ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আত্মহত্যার নির্মম রাজনৈতিক চিত্র অংকন করেছেন তিনি।
‘ইঙ্গিত’ নাটক সোলায়মানের আর একটি অসামান্য সৃষ্টি। স্বকালের সমাজবাস্তবতা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে অবান্তর বিতর্ক, শিক্ষাক্রমের ধ্বংসান্মুখ চিত্র, শহিদদের অসম্মান, চলচ্চিত্রের বেহায়াপনা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির শেকড় বিচ্ছিন্নতা এবং ক্ষুধা-দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের অমানবিক জীবনযাপন ইত্যাদি ফুটে উঠেছে আলোচ্য নাটকে।
সোলায়মানের আলোচিত প্রহসনধর্মী নাটক ‘বার্থ ফ্যান্টাসি’। হত্যা, গুম, যানজটে আতংকিত ও পীড়িত নগরবাসীর ত্রাহি অবস্থা দেখে এবং নষ্ট বুর্জোয়া রাজনীতির তল্পিবাহক পেটি বুর্জোয়া গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও আস্ফালনের কথা শুনে মর্মাহত ও বিচলিত গর্ভস্থ শিশু পৃথিবীতে আসতে চায় না। বস্তুত, শিশুর জন্ম আতঙ্কের ভয়াবহ চিত্র অংকন করে, নাট্যকার সময়ের ও কালের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্রই অংকন করেছেন। প্রস্থিত শতাব্দীর আট ও নয়ের দশকের বেনিয়া-বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির বাস্তব ও কালঘনিষ্ঠ চিত্রের অসামান্য রূপায়ণ হয়ে উঠেছে ‘বার্থ ফ্যান্টাসি’।
সোলায়মানের পূর্বোক্ত মৌলিক নাটকের রাজনীতির খতিয়ান করতে বসে সহজ চোখে যে পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতি তাঁর স্পষ্ট পক্ষপাতের রাজনৈতিক চিত্র পাওয়া যায় এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করা যায়; ওই একই ছবি দেখা যায় তাঁর রূপান্তরিত নাটকগুলিতেও। ‘ইন্সপেক্টার জেনারেল (১৯৮০)’, ‘তালপাতার সেপাই (১৯৮২)’, ‘কোর্ট মার্শাল’ নাটক তিনটিতেও ওই একই রাজনীতির সুর ও স্বর লক্ষ্য করা যায়। তাঁর রূপান্তরিত নাটকে স্বকালের সকরুণ দশা, সময়ের সমালোচনা, সমাজের কদাকার রূপ, রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা, লুম্পেন পেটি বুর্জোয়াদের দেউলিয়াপনা, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এবং সমতা ও মমতার প্রতি পক্ষপাত, সত্যাশ্রয়ী জীবনবোধ ইত্যাদির প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘কবর’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ নাট্যরূপ অথবা লোককাহিনি নির্ভর ‘আমিনা সুন্দরী’, মৌলিক নাটক ‘খানদানি কিস্সা’ ইত্যাদি নাটকেও সামন্ত সমাজের শোষণের বিপরীতে সাম্যের, নারীমুক্তির, শৃঙ্খলভাঙার ধ্বনি বারংবার তাঁর নাটকের রাজনীতির স্বরূপকে তুলে ধরেছে।
একজন আত্মনিবেদিত সম্পূর্ণ নাট্যজন এস এম সোলায়মান নাটককে হাতিয়ার করেছিলেন সমাজ বদলের। সমকালীন সমাজের বিচিত্র অসঙ্গতি-অসামঞ্জস্য, ক্লেদ-ক্লিন্নতা, পতন-পঙ্কিলতাকে রঙ্গরসে, সুর সঙ্গমে, নৃত্য উল্লাসে এবং প্রহসনভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। জীবন ও স্বপ্নের দান্দ্বিকতার মধ্য দিয়ে জীবনস্বপ্নের সরল সহবাসকে সত্য ও মূর্ত করার যে মার্কসীয় বীক্ষণ ও প্রয়োগের রাজনীতি, সেই রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার সুস্পষ্ট ও সশব্দ আত্মপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর সকল নাটকে। ১৯৭৫-পরবর্তী সিকি শতাব্দীর কাল পরিধির জন্মক্রোড়বিচ্যুত বাংলাদেশ এবং বাঙালির সমবেত আত্মহত্যার পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের আকস্মিক পতন আবার সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন ও ঐতিহ্যের প্রত্ন বাঙালির পুনর্জাগরণ প্রত্যাশার যে রাজনীতি তাই লক্ষ্য করা যায় এস, এম সোলায়মানের নাট্যসমগ্রে।
বিচ্ছিন্নতার বেদনা, নিঃসঙ্গতার ক্লেশ, স্বপ্নভঙ্গের হতাশা কখনও তাঁকে আক্রান্ত করেছে কিন্তু নিঃশেষ করে দিতে পারেনি। ক্রিস্টোফার মার্লোর মতো সৃজনশীল প্রজ্ঞার অধিকারী নাট্যকার অকালে হারিয়ে ছিলেন ওই সব কারণে। কিন্তু সোলায়মান হারিয়েও যাননি বা ফুরিয়েও যাননি। এখনও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। বাংলাদেশের নবনাট্যধারার যে অবিনাশী প্লাবন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, যা বিগত পাঁচ দশক ধরে বহমান, তারই সাড়ে দুই দশক (১৯৭৭-২০০১) দাপটে ও অকপটে প্রবল ও সবল করেছেন তিনি। তাঁর নাটকে প্রতিফলিত রাজনীতির স্বরূপ অন্বেষণে ও বিশ্লেষণে সে সত্যই প্রকট হয়ে ওঠে।
উল্লেখ্য, নৃত্য-গীত, কথা-বাদ্য-অভিনয়সমৃদ্ধ যে বাংলা নাট্য এবং চরিত্রাভিনয়সম্পন্ন যে পাশ্চাত্য থিয়েটার⎯ এ দুয়ের অপূর্ব সমন্বয়ে সোলায়মানের যে নাটক তার রাজনীতির খতিয়ান একথাই মনে করিয়ে দেয়, নাট্য ও রাজনীতি একই সমান্তরালে চললেও তাঁর নাটক তত্ত্বভারাক্রান্ত বা বক্তব্যসর্বস্ব না হয়ে শিল্পসঙ্গত ও সুষমাময় থেকেছে। আর তাই বাংলাদেশ ভুলেও কখনও ভুলে যাবে না তাঁকে। কারণ তাঁর নাটকে প্রতিফলিত রাজনীতি সমকালীন হয়েও কালোত্তীর্ণ। সে রাজনীতি নাট্যকারের একান্ত মানসপ্রসূত হলেও সকলের। একার হয়েও সমষ্টিতে লীন এবং তা অক্ষয় ও অমলিন।
ড. রতন সিদ্দিকী স্বনামখ্যাত অধ্যাপক, নাট্যকার ও নাট্যগবেষক। তাঁর জন্ম ১৯৬৩ সালের ২২ অক্টোবর। পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর সদর উপজেলার মুরাদনগর গ্রাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ১৯৮৫ ও স্নাতকোত্তর ১৯৮৬। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন নাটক ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে। ড. রতন সিদ্দিকী নাট্যগবেষণা ও নাট্যরচনাসহ সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য লাভ করেছেন অতীশ দীপঙ্কর পুরষ্কার-২০১৫, মাদার তেরেসা পুরষ্কার ২০১৬, হিউমেনিটোরিয়াল এওয়ার্ড-২০১৯। উল্লেখ্য, নাটকে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নাট্যশিক্ষক ড. রতন সিদ্দিকীকে ২০১৯ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।