আগের পর্ব পড়তে: [১]
স্বপ্ন দেখে মন
মানুষ তো স্বপ্ন হরবখত দেখে– সুখস্বপ্ন, ভয়ের স্বপ্ন, মাথামুণ্ডুহীন স্বপ্ন। এক অগ্রজ ফেসবুক বন্ধু বিমোচন ভট্টাচার্য মশায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন উনি দেশবন্ধু পার্কে বসে অভিনেত্রী রেখার সঙ্গে প্রেম করছেন। ফুট কেটেছিলাম– খুব বেঁচে গেছেন দাদা, সারা জীবন ইডলি, ধোসা, সম্বর খেতে খেতে জীবন কালিয়া হয়ে যেত। আমার ক্ষেত্রেও সেই খোয়াবটা ছিল ভয়াবহ। ১৯৭৮ সাল। সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মহানন্দে কলকাতায় জীবন কাটাচ্ছি। একটা বাড়তি রোজগারে সামান্য হলেও পরিবারে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছল্য এসেছে বাবা-মায়ের প্রায় বছর দশেকের সংগ্রামের পর। দুপুরবেলা ভরপেট ভাত খেয়ে বাঙালি যে কাজটা সবচেয়ে ভাল করে, সেই ভাতঘুম দিচ্ছি। খড়খড়ি টানা আধো অন্ধকার ঘর।
আমেরিকা যাচ্ছি উচ্চশিক্ষার্থে। স্যুটকেস বাঁধা। পাসপোর্ট ভিসা রেডি। একটু বাদে প্লেন। বাবা-মা-ঠাকুমার থমথমে মুখ। আমারও যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। কিন্তু কোনও উপায় নেই। যেতেই হবে। সাধের কলকাতা ছেড়ে ভীষণ পাজি এক সাহেব-মেমের দেশে। বুকের মধ্যে হাহাকার। ঘুমটা ভেঙে একটা কথাই মনে হল “ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন!”
***
১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে বাবার ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ল। লাগাতার ৪৯ বছর সিগারেট খাওয়ার ফল বা শাস্তি। অতি বুদ্ধিমান মানুষও নেশার খপ্পরে পড়ে নিজের ভাল মন্দের বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সাত মাস ছিলেন রোগ নির্ণয়ের পর। যখন চলে গেলেন আমার বয়স চব্বিশ। পারিবারিক সঞ্চয় প্রায় কিছুই নেই। দাদা তখনও সিএ ফাইনাল পাশ করেনি। একটা বড় অসুখের মোকাবিলায় একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কী দশা হয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল। উপলব্ধি হল অর্থের প্রতি দার্শনিকসুলভ নিস্পৃহতা কোনও কাজের কথা নয়। এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, সাধের কলকাতা আঁকড়ে বসে থাকলে ছাপোষা জীবনযাপনই হবে। আমার মতো মধ্যমেধার মানুষের জীবনে আর্থিক স্বাচ্ছল্য পেতে হলে কিছু ঝুঁকি নেওয়া প্রয়োজন। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। জীবনে প্রথম বিদেশে যাওয়ার তাগিদ তীব্রভাবে অনুভব করলাম।

অবশ্য জীবনের এই কঠিন সময়ের মাসখানেক আগে একবার ‘বিলেত’ যাবার সুযোগ এসেছিল। আবার বাবার মৃত্যুর বছর দুয়েক বাদে আর একবার। সে ছিল টানজানিয়াতে যাবার। কথায় বলে, there’s many a slip between the cup and the lip ! সুরার পাত্র এবং ওষ্ঠের মধ্যে দূরত্ব ক্ষেত্রবিশেষে বিস্তর। দুটি সুযোগের কোনওটাই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে দুটি ঘটনাই আমার জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। পরবর্তী কোনও এক পর্যায়ে লিখব। ধারাবাহিকের শুরুতেই আশাভঙ্গের কাহিনি শোনাতে চাই না। যাইহোক, বিদেশ যাওয়ার বাসনা জাগ্রত হওয়া এক ব্যাপার, আর যেতে পারা আর এক। কলেজে পড়াকালীন ৪২ জনের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসের অন্তত জনা দশেকের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই লক্ষ্য ছিল আমেরিকা যাবার! প্রক্রিয়াগুলি সম্বন্ধে তখন থেকেই ওয়াকিবহাল ছিল তারা। গেছেও পাশ করার কয়েক মাসের মধ্যেই। আমার কিন্তু সেরকম ইচ্ছে সেই সময়ে জাগেনি। কারণ ছিল অনেকগুলি। বাড়ির এবং কলকাতার টান ভীষণরকম ছিল। আর এটা বুঝতে পারছিলাম বাবার শরীর ভাঙছে– পরিবারের আমার ওপর অনেক আশা। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম স্কলারশিপ নিয়ে পাশ করার পরে পরেই বিদেশে চলে যাওয়া চূড়ান্ত স্বার্থপরতা হবে।

উপরন্তু জীবনদর্শনে বাবার ভাল রকম প্রভাব ছিল। জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝতে পারছি, ওঁর কি ভীষণরকম দূরদৃষ্টি ছিল। কোনদিনও বিদেশে জাননি। মানে যাবার পরিস্থিতি আসেনি পরিবারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে হাসিমুখে তুলে নেওয়ায়। কিন্তু প্রবাসজীবন সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল বরাবর। বলতেন, উন্নত দেশে গিয়ে ভারতীয়রা ভাল খায়দায়, গাড়ি বাড়ি করে, কিন্তু আদতে রয়ে যায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। কথাটার সঙ্গে অনেক প্রবাসীই সহমত হবেন না হয়তো। কিন্তু দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার পর বলতে পারি প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে ধারণাটা কিয়দংশে সত্যি। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমার মায়ের মাতামহ আইসিএস বীরেন্দ্রনাথ দে-র বিদেশে পাড়ি দেওয়া প্রসঙ্গে আমাদের পরিবারে বেদবাক্য জ্ঞান করা একটি মন্তব্যের উল্লেখ করব। আমাদের পরিবারের এই সুপারস্টারের বক্তব্য ছিল: বিদেশে যাওয়া মানে lost to the family, lost to the nation! মনে রাখতে হবে, উপরোক্ত মন্তব্যটির সময়টা ছিল ষাটের দশকের প্রথমার্ধ। সদ্যস্বাধীন ভারতবাসীর চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। এই পর্বের শুরুতে যে স্বপ্নটির কথা বলেছিলাম সেটি হয়তো অবচেতনে প্রোথিত তৎকালীন জীবনদর্শনের প্রতিফলন ছিল।
***
কিছু মানুষ যা চায় খুব সহজেই পেয়ে যায়। কিছুটা মেধা, কিছুটা ভাগ্যের জোরে। অনেকের স্বপ্নগুলি আবার আজীবন অধরাই রয়ে যায়। আবার কিছু মানুষকে জীবন অনেক কিছুই দেয়, তবে সহজে নয়। রীতিমতো ধাক্কা খেতে খেতে তাদের পথ চলা। আমি এই তৃতীয় দলের। বেশ মধ্যমেধার মানুষ। খুব সহজে কোনও কিছুই পাইনি। তবে জীবনসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এই বেলাশেষে এসে বলতে পারি এই অকৃতি অধম মানুষটাকে ভাগ্যদেবী কম করে কিছু দেননি। আসলে অজ্ঞেয়বাদী হলেও জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় বিশ্বাস জন্মেছে, যে আমরা নিমিত্তমাত্র। কোনও অদৃশ্য শক্তি আমাদের জীবনের চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখে রেখেছেন। জীবনের সুখ দুঃখ, সাফল্য ব্যর্থতা সবই পূর্বনির্ধারিত। নইলে একসময়ে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই নিরুৎসাহ এক মানুষের জীবনের সিংহভাগ প্রবাসে কাটল কীভাবে?
আত্মজীবনী লিখতে বসিনি। কিন্তু প্রবাসজীবনের নানা ঘটনা, নানা অভিজ্ঞতা লিখতে বসে কিছু আত্মকথন এসেই পড়বে। এ পর্যন্ত আমার ৬৭ বছরের জীবনের ৩২ বছর কেটেছে অস্ট্রেলিয়ায়, দু বছর আমেরিকায়, দেড় বছর উত্তর আফ্রিকার এক বিচিত্র দেশ লিবিয়ায়। এছাড়া আরো দুই বছর থেকেছি মুম্বইতে– সেটাও প্রবাসই। কালানুক্রমিক ভাবে লেখার পরিকল্পনা নেই। একঘেয়েমি কাটাতে হয়তো এক দেশ থেকে আর দেশে চলে যাব থেকে থেকে। জীবন আমার বাঁধা গতে চলেনি। প্রবাসীর নকশাও সেভাবে চিত্রিত হবে না মনে হয়।
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ আগস্ট ২০২২
*ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।