নারী দিবসের উদযাপন তখনও চলছিল পুরোদমে। দোকানে দোকানে ছাড়, মঞ্চে মঞ্চে অনুষ্ঠান, সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা। তার মধ্যেই নিশ্চুপে চলে গেলেন এক অনন্যা, অগ্রগামিণী, যাঁকে প্রায় ভুলেই গিয়েছে ভারতীয় তথা বাঙালিরা। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতপ্রেমী মুষ্টিমেয় মানুষের মনেই হয়তো তাঁর চিরস্থায়ী আসন। তিনি, ভারতের প্রবীণতমা বেহালাশিল্পী বিদূষী শিশিরকণা ধর চৌধুরী। পঞ্চাশের দশকে, যখন বেহালা বাদনে মহিলাদের কোনও স্থানই ছিল না, সেই সময় ছড় হাতে মঞ্চে উঠে এসেছিলেন এই অনন্য প্রতিভাময়ী। তাঁর সারাটাজীবনই সঙ্গীতের উদ্দেশে নিবেদিত।

পুরুষশাসিত বেহালাবাদনের জগতে চিরকাল নিজের এক স্বকীয় স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করে সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তিনি। পরবর্তীকালে মঞ্চে বাজানো ছেড়ে দিলেও সঙ্গীতগুরু হিসেবে পূজনীয় হয়ে ওঠেন। ১৯৯৩ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী প্রয়াত হন ৮৩ বছর বয়সে গুরুগ্রামে, নিজের কন্যা সুররঞ্জনীর কাছে।

সংবাদপত্রে মায়ের কথা বলতে গিয়ে মেয়ে বারবার উল্লেখ করেন তাঁর সাধারণ জীবনযাপনের কথা। বলেন, ‘মা ছিলেন আমার কাছে জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তাঁর অবিচল সঙ্গীতসাধনা তো বটেই, তাঁর সাদামাটা জীবনযাপনও আমার উপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমার সুখেদুঃখে মা-ই ছিলেন আমার শক্তিস্তম্ভ। গত বছর চারেক ধরে মা অসুস্থ। আমার কাছেই থাকতেন। শেষজীবনে ওঁর এই সেবাটুকু করতে পেরে আমি ধন্য।’

এক একান্ত সাক্ষাৎকারে সুররঞ্জনী বাংলালাইভকে জানান, ‘মা নেই, এ কথা বিশ্বাস করাই আমার পক্ষে অসম্ভব। জানি না কোনওদিন করতে পারব কিনা। তিনি আমার জীবনের এক স্তম্ভস্বরূপ। আমরা সবাই জানি, মাকে সমস্ত স্টিরিওটাইপ ভেঙে নিজের জায়গা তৈরি করতে হয়েছিল। মা হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়া। তাঁর দায়িত্ববোধের কোনও সমতুল্য উদাহরণ আমি দিতে পারব না। তিনি মহান শিল্পী, এ কথা আমার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বজুড়ে তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রীর কাছে তিনি ছিলেন অতিপ্রিয় গুরুমা। সবার উপরে তিনি ছিলেন এক অসামান্য মানুষ। তাঁর সততা আমার কাছে চিরকাল অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমি বিশ্বাস করি মা আমার কাছে চিরকাল থাকবেন।’

কিন্তু যাঁদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে সঙ্গীতসাধনা করে গেলেন শিশিরকণা, সেই ভারতীয় তথা বাঙালি শ্রোতা তাঁকে সেভাবে স্মরণ করল কই? অর্থহীন ভোটরঙ্গে মেতে টেলিভিশনের পর্দায়, রেডিওর স্পিকারে শুধুই কথার খেলা। কোনও সংবাদের চ্যানেল, এমনকী কলকাতা শহরের প্রধান বাংলা কাগজগুলির একটিতেও তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

SSDC and Swapan Chaudhury
পণ্ডিত স্বপন চৌধুরী ও তাঁর ‘বড়দি’

একটি বড় ইংরেজি কাগজে অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয়েছিল সে সংবাদ। তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন শিশিরকণাদেবীর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সহকর্মী পণ্ডিত স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর কথায়,

‘শিশিরকণা দেবী ছিলেন এক ছায়াঘেরা বটবৃক্ষের মতো। তাঁর স্নেহ থেকে কোনওদিন বঞ্চিত হয়নি তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। শুধু সঙ্গীত শিক্ষাই নয়, তাঁরা প্রত্যেকে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেছেন কিনা, সেদিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি থাকত। অন্নপূর্ণা দেবীর চরিত্রেরর সঙ্গে ওঁর খুব মিল পাই। ওঁর সঙ্গে সেই ষাটের দশক থেকে আমার পরিচয়। চিরকাল আমরা ওঁকে ‘বড়দি’ বলে ডেকে এসেছি। আমেরিকাতে নতুন করে দেখা হবার আগে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছিলাম সহকর্মী। যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগে উনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্রছাত্রীরা ওঁকে অসম্ভব ভালবাসত।’

১৯৩৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর মেঘালয়ের শিলং শহরে জন্ম শিশিরকণার। মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় বেহালা। প্রথম শিক্ষক মোতি মিঁঞা। তারপরেই পণ্ডিত ভি জি যোগের কাছে তালিম। ১৯৫৬ সাল থেকে উস্তাদ আলি আকবর খানের কাছে নাড়া বাঁধলেন শিশিরকণা। এরপর গবেষক-সঙ্গীতজ্ঞ আচার্য টি এল রানার সংস্পর্শেও আসেন। তাঁর কাছ থেকে শিখতে থাকেন হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের তাত্ত্বিক খুঁটিনাটি। রেডিওতে নিয়মিত বাজানো শুরু হয়। শুরু হয় একক অনুষ্ঠান।

ভিওলা ও ভায়োলিন (বেহালা) দু’টি যন্ত্রই বাজাতে পারতেন শিশিরকণা। দু’টি যন্ত্রেই অতিরিক্ত সুরসংবলিত তার যোগ করে স্বরাষ্টক-এর বিস্তৃতি (range of octave) অনেক বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। মঞ্চানুষ্ঠানে সাধারণত আলাপ, জোড় আর ঝালা ভিয়োলাতেই করতেন শিশিরকণা। গৎ বাজানোর সময়ে হাতে তুলে নিতেন বেহালা। এতে এক আশ্চর্য বৈচিত্রের সৃষ্টি হত। আলি আকবরের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে বেহালায় সরোদের বাদনরীতির প্রয়োগ করতেন শিশিরকণা।

Sisirkana Dhar Chowdhury
শ্রী শংকর ঘোষের তবলার সঙ্গে শিশিরকণার গোড়ার দিকের রেকর্ড

১৯৭১ সালে  রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন শিশিরকণা। ১৯৯৭ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন সেখানে। প্রথমে যন্ত্রসঙ্গীত ও পরে কণ্ঠসঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হিসেবেও কাজ করেছেন বহু বছর। দীর্ঘদিনের শিক্ষকজীবনে তৈরি করেছেন অগণিত কৃতী ছাত্রছাত্রী। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া প্রদেশের সান রাফায়েল শহরে আলি আকবর কলেজ অফ মিউজ়িকেও বেশ কিছুদিন অতিথি অধ্যাপকের দায়িত্ব সামলেছেন শিশিরকণা। সেখানে খাঁ সাহেব ও বাবা আলাউদ্দিন খানের সঙ্গীত বিষয়ে অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী কাজ করেছিলেন তিনি। 

সঙ্গীত-গবেষকেরা বলেন, ভায়োলিন বা বেহালা এত বহুমুখী সুরস্বরের সৃষ্টিতে সক্ষম যে, যতরকম সাঙ্গীতিক ঐতিহ্যে বেহালাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, প্রত্যেকটি জায়গায় বেহালাবাদনের রীতি এবং স্বর ভিন্ন। স্বতন্ত্র। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

যেমন ইউরোপীয় মার্গসঙ্গীতের ধারায় বেহালার স্বর হয় স্থির, নিয়মিত ও অচঞ্চল। ফরাসি জিপসি ধারায় আবার বেহালার সুর চলবে প্রশস্ত চটুল স্পন্দিত গতিতে। ক্যাজুন সঙ্গীতে আবার খসখসে ছড়ের শব্দই বৈশিষ্ট্য। শিশিরকণা এই সমস্ত ধারাকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা করেছিলেন তাঁর স্বকীয় সঙ্গীতে, তাঁর নান্দনিক সুরসমাজে। শুধু তাই নয়, মাঝে মধ্যেই বাজনার মধ্যে একাধিক ধারাকে একে অপরের বিপরীতে লড়িয়ে দিয়ে এমন এক আশ্চর্য সুরসঞ্জাত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করতেন, যে শ্রোতারা আবিষ্ট হয়ে যেতেন।

ভিওলাতে দীর্ঘ আলাপে রাগের অব্যক্ত কাব্যরস নিংড়ে বের করে আনতেন শিশিরকণা। তাঁর হাতের দরবারি কানাড়া, শ্রী, মুদ্রা কি টোড়ি, পলাশ কাফি, চন্দ্রনন্দন যাঁরা একবার শুনেছে, তাঁরা চিরকালের মতো মোহাবিষ্ট হয়ে থেকেছে তাঁর সঙ্গীতে।  

আশ্চর্যের বিষয়, এইসব রেকর্ডিংয়ের একটিও আজ আর পাওয়া যায় না কোনও দোকানে। ক্যাসেট-সিডি-র অবলুরপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যাবতীয় বাণিজ্যিক রেকর্ডেরও অবলুপ্তি ঘটল কী করে, এ প্রশ্ন বহু সঙ্গীতপ্রেমীর মনেই আজও নাড়া দিয়ে যায়। তবে কি তাঁর জীবদ্দশাতেই আমরা তাঁকে ঠেলে দিয়েছি বিস্মৃতির আঁধারে? সঙ্গীতের প্রতি তাঁর এই অচলা ভালবাসা এবং দায়বদ্ধতার কোনও মূল্যই দেয়নি তাঁর পরম আদরের শ্রোতারা?

বিশিষ্ট সাংবাদিক-লেখক তথা উত্তরবঙ্গ সংবাদের কার্যনির্বাহী সম্পাদক রূপায়ণ ভট্টাচার্য শিশিরকণাদেবীর মৃত্যুর পরে গভীর হতাশায় ফেসবুকে লিখেছিলেন এই লাইনগুলি:

‘শিশিরকণা কি একটা লাইনও দাবি করেন না? তাঁর ভক্তকূল কি বাংলা থেকে লোপাট হয়ে গেলেন রাতারাতি? পরের দিন ফেসবুকে অনেকের হাহাকার দেখো তো মনে হল না।… আমরা দোষ দেব অবাঙালিদের, আমরা গালাগাল দেব গুটখা সংস্কৃতিকে, আ মরি বাংলা ভাষা লেখা পাঞ্জাবি বা শাড়ি পরে ঘুরব, নারী দিবসে নারীদের অবমাননা নিয়ে লিখব, ভাষণ দেব। আর ভুলে যাব বেহালার ছড়ে প্রথম সুর তোলা ভারতীয় তরুণী শিশিরকণাকে। এর চেয়ে দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে?…

নারীবাদ নিয়ে বাংলায় ইদানীং চুটিয়ে দারুণ লেখালেখি করেন যাঁরা, দায় কিন্তু আপনাদেরও। শিশিরকণা যা করে দেখিয়ে গিয়েছেন, ভারতের কোনও নারী তখনও ভাবেননি। নারীদিবসের দু’দিন পরে যে তিনি চলে গেলেন বাঙালির অবহেলার ভেলায় ভেসে, তাঁকে নিয়ে কি লিখলেন কেউ? লজ্জা বা অসম্মানটা শিশিরকণার নয়। পুরো বাঙালির। আমাদের এখনকার স্বনামধন্য বাঙালি মেয়েদের। তাঁরাও তো কেউ কিছু বললেন না! তাঁরা কি শিশিরকণার অবদান জানতেন না? … তবু শিশিরকণাকে হয়তো মনে রেখে দেবেন অজস্র মধ্যবয়সীরা। আকাশবাণীতে অনেকবার বাজনা শুনেছেন যাঁরা। ছোটবেলায় এত চমৎকার নামের অন্য কোনও ক্লাসিকাল শিল্পীকে কেউ জানত না।

শিশিরকণাকে ভুলবে না কলকাতার অজস্র গানের ঘর, হল। তাঁর বাজানো অজস্র রাগ মাথায় ঘুরঘুর করবে সে সব জায়গায়। পলাশ কাফি রাগটা খুব ভালো বাজাতেন শিশিরকণা। এখন পলাশ শেষের সময়। সেই হারিয়ে যেতে বসা পলাশের দলও হয়তো মনে মনে বলবে, শিশিরকণা আরও একটু স্বীকৃতি পেতে পারতেন এই বাংলায়।’

*কৃতজ্ঞতা: রূপায়ণ ভট্টাচার্য
*ছবি ও ভিডি সৌজন্য: Indiatimes, discogs, Indiacurrents, Youtube

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

2 Responses

  1. একটি বাংলা সিনেমায় ছিল এই রকম সংলাপঃ
    -ছাদে যাব
    -কেন?
    – একটু কাঁদব, বেশি নয়, অল্প কাঁদব। একটু কেঁদেই চলে আসব।
    সংলাপ শুনে দর্শক আপাত হাসে। তারপর বাড়ি গিয়ে ভাবে। তারপর ছাদে যায়।
    শিশিরকণার দরবাড়ি কানাড়া শুনে মনে হয়েছিল এই আমাদের সেই ছাদ।
    লেখাটির জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *