আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] []

কালো মানুষের কথা

মুম্বই-লন্ডনের উড়ান। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের জানলার সিট আমার। ১৯৮৪-র অগস্ট মাসের সেই দিনটিতে মন খুবই বিক্ষিপ্ত। নানা সংশয়, অস্বস্তি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

মনে পড়ছিল ৭৮-এর এক রবিবারের দুপুরের সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের কথা। বাড়ির ভাত খেয়ে কলকাতায় চাকরি করি তখন। ব্রিফকেস হাতে সেজেগুজে শেয়ার ট্যাক্সি ধরে এসপ্ল্যানেডের অফিসে যাই– নটা-পাঁচটা কাজ, বিশেষ চাপও নেই। প্রেমিকার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, রেঁস্তোরায় খাওয়া, মোহনবাগানের খেলা দেখা– আর কী চাই! কিন্তু মধ্যাহ্নের ভাতঘুমে বাধ সাধল সেই বিশ্রী স্বপ্ন। আমি আমেরিকা যাচ্ছি, বাক্স বাঁধা, সন্ধ্যায় প্লেন, বাড়ির সবার মুখ ঝড়ের আগের মতো থমথমে। ধড়মর করে উঠে বসে প্রথম অনুভূতি ছিল “ভাগ্যিস এটা সত্যি নয়!”

বছর ছয়েক বাদে সেই আমিই চলেছি আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার্থে। চাকরি ছেড়ে। স্বেচ্ছায়। শুভানুধ্যায়ীদের উপদেশের বিরুদ্ধে। 

কথায় বলে, রাজনীতিতে একটি সপ্তাহ অতি দীর্ঘ হতে পারে। সেভাবে দেখলে এক জীবনে ছ বছর তো অনন্তকাল। যেমন আমার হয়েছিল। বাবার মৃত্যু, বিয়ে, চাকরি বদল, বিদেশে কাজ– অনেক কিছুই ঘটে গেছে মাঝে। নিষ্ঠুর কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ঘটেছে। নিজের ক্ষমতার, দক্ষতার, দুর্বলতার, মূল্যায়নও কিঞ্চিৎ করতে শিখেছি ক’বছরে। পিছন ফিরে তাকিয়ে বলতে পারি ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টসের আপাত ভালো চাকরি, নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে স্রেফ নিজের instinct-এর ভরসায় একটা বড় রকমের ঝুঁকি নিয়েছিলাম সেই সময়ে।

Esplanade Kolkata
ব্রিফকেস হাতে সেজেগুজে শেয়ার ট্যাক্সি ধরে এসপ্ল্যানেডের অফিসে যাই

পাশের বড়সড় চেহারার ভদ্রলোককে প্রথম দর্শনে দক্ষিণ ভারতীয় মনে হয়েছিল। দীর্ঘ যাত্রার আলাপে জানলাম উনি ভারতীয় বংশোদ্ভুত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ, তবে অ্যাকসেন্ট (accent) বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পরনে এক বিদঘুটে মেরুন রঙের সাফারি স্যুট ধরণের পোশাক। জনা কুড়ির এক দলের সঙ্গে পিতৃপুরুষের দেশ দর্শনে এসেছিলেন। ভারত সম্পর্কে গদগদ। রীতিমত ধর্মনিষ্ঠ গোঁড়া হিন্দু।

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলির আর্থসামাজিক অবস্থা, ভূগোল বা ইতিহাস বিষয়ে বিশেষ ধারণা ছিল না সে সময়ে। শুধু জানতাম দুরন্ত ক্রিকেট খেলে। গ্যারি সোবার্স, অ্যান্ডি রবার্টস প্রমুখ কিংবদন্তিদের খেলা চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ইডেন উদ্যানে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বলতে বুঝতাম রোহন কানহাই আর আলভিন কালীচরণ। পরবর্তীকালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী বিদ্যাধর নাইপলের নামও শুনিনি তখনও। তবে আমার ছোট পিসেমশায় ডঃ সুবীর মজুমদার কিছুদিন জামাইকাতে অধ্যাপনা করেছিলেন– সেই সূত্রে কিছু গল্প শুনেছিলাম। 

একটা অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হল হিথরোতে অবতরণের আগে অভিবাসনের কার্ড ভরার সময়। পাশের ভদ্রলোক পাসপোর্ট বের করে আমায় ভরে দিতে অনুরোধ করলেন। বুঝলাম মুনস্বামী নামের সহযাত্রী ভদ্রলোক নিরক্ষর। এরপর আরও তিন চারটি পাসপোর্ট আমার কাছে চলে এল ভর্তির অনুরোধ সহ।

হিথরো থেকে নিউ ইয়র্কের উড়ানের মাঝে ঘণ্টা চারেকের অপেক্ষা ছিল। সেখানে আবার দলটির সঙ্গে দেখা। কিছুটা কৃতজ্ঞতাবশত হয়তো তাঁরা দেখলাম আমার সঙ্গে আলাপ করতে বেশ আগ্রহী। আশ্চর্য হলাম কালো মানুষদের প্রতি এঁদের বৈরিতা দেখে। শুনলাম কৃষ্ণাঙ্গদের আপাত সহজাত নিষ্ঠুরতার কিছু উদাহরণ। ৭৬-এর সফরে বিষেন বেদীর ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে লাগাতার বাম্পারে অর্ধেক দলকে হাসপাতালে পাঠানোর ঘটনা মনে ছিল– তাই বিশ্বাস করতে ভালই লাগছিল।

Caribbean Countries
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলির আর্থসামাজিক অবস্থা, ভূগোল বা ইতিহাস বিষয়ে বিশেষ ধারণা ছিল না সে সময়ে

২০০০ সাল নাগাদ সিডনিতে কর্মসূত্রে এক কনফারেন্সে কেনিয়ার এক ভারতীয় বংশোদ্ভুত অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়। মধ্যাহ্নভোজনের সময়ের কথাবার্তার অল্পক্ষণের মধ্যেই কালোদের নিন্দে করতে শুরু করলেন ভদ্রলোক। নিজের দেশবাসীর প্রতি এতটা বিদ্বেষের কারণ জানতে চেয়ে বুঝলাম নানা অভিযোগের অন্যতম হল ভারতীয় নারীদের প্রতি কালো পুরুষদের আকর্ষণ। তর্কের খাতিরে অস্ট্রেলিয়াতে শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের সঙ্গে আমার পরিচিত কিছু ভারতীয় মহিলার সফল বিবাহের উদাহরণ দিলাম। অধ্যাপক মশাইয়ের দেখলাম তাতে বিশেষ আপত্তি নেই। যুক্তি হল আমাদের দেব-দেবীরা নাকি অধিকাংশই ফরসা! এর পর আর কথা চালাতে প্রবৃত্তি হল না।

কলকাতায় আমাদের কলেজের পরের ব্যাচের এক ইঞ্জিনিয়ার সহকর্মীর ইচ্ছে, মেধা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা যাওয়া হয়নি। কারণটা ঠাকুমার ফতোয়া। ওর কুষ্ঠিতে নাকি কৃষ্ণাঙ্গিনীর সাথে বিবাহের সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে! সাধে Fair and Lovely-র এত দাপট ভারতবর্ষে!

আমাদের বর্ণবিদ্বেষের কথা সারা বিশ্ব জানে। ‘মিসিসিপি মসালা’ (Mississippi Masala) নামে হলিউডের একটি ছবি আছে এই বিষয় নিয়ে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে আমি প্রচুর সাদা-খয়েরি দম্পতি দেখেছি, রাজনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও ভারতীয়-চৈনিক যুগলও কিছু চোখে পড়েছে, কিন্তু কালো-খয়েরি জুড়ি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

অবশ্য বিশ্বায়নের পরবর্তীকালে পরের প্রজন্মের ভারতীয়দের আচরণের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এদের আমি আর কতটুকু জানি? ভবিষ্যতে হয়তো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সঙ্গে ভারতীয়দের দাম্পত্য অত বিরল হবে না।  

Black bride wedding Couple

বিতৃষ্ণা বা তাচ্ছিল্য এক তরফা হয় না। কালোরাও ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। বহুনিন্দিত ক্রিকেট আম্পায়ার বাকনরের ভারত-বৈরিতা হয়ত কিছুটা তারই প্রতিক্রিয়া।

অবসর জীবনে দাসপ্রথা নিয়ে কিছু বই পড়েছি। অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দী ছিল আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস আমদানির রমরমা যুগ। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আখ এবং তুলো চাষ করানো হত এই দুর্ভাগাদের দিয়ে। অমানুষিক খাটুনি, মনুষ্যেতর খাদ্য ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের ফলে এদের একটা বড় অংশ অকালে প্রাণ হারাত। সে যুগের ইংরেজ ও ফরাসি ব্যবসায়ীদের বর্বরতা হিটলারের নৃশংসতার চেয়ে কিছু কম ছিল না। 

বড় করুণ সেই ইতিহাস। 

***

অস্ট্রেলিয়াতে দেখতে দেখতে ৩২ বছর কেটে গেল। প্রথমদিকে নগ্ন বর্ণবৈষম্য দেখেছি। কিছু মানুষ খোলাখুলিভাবে আদি বাসিন্দাদের ‘black people’ বলে উল্লেখ করত। ৯০-এর দশকের কর্মক্ষেত্রে উঁচু পদে ভারতীয়রা চট করে যেতে পারতেন না। কোনও না কোনও অজুহাতে আটকে দেওয়া হত। 

তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব হালে অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। আধুনিক দুনিয়ায় দক্ষতার কোনও বিকল্প নেই। সামাজিক স্তরেও আমরা আজকাল অনেক বেশি সম্মান পাই। সরকারি দফতরগুলির উচ্চতম স্তরে ঠিক ছড়াছড়ি না হলেও ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী-পুরুষের উপস্থিতি বর্তমানে নজর এড়ায় না।

অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দী ছিল আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস আমদানির রমরমা যুগ। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে আখ এবং তুলো চাষ করানো হত এই দুর্ভাগাদের দিয়ে। অমানুষিক খাটুনি, মনুষ্যেতর খাদ্য ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের ফলে এদের একটা বড় অংশ অকালে প্রাণ হারাত।

আমেরিকাতে প্রকৃত মেধার সমাদর বহুদিনই। সত্য নাদেলা, সুন্দর পিচাইদের জন্য আমরা রীতিমত গর্ব অনুভব করি। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বারাক ওবামা আট বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন, বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি কমলা হ্যারিসের মা ভারতীয়। খোদ ব্রিটেনে ঋষি সুনক প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত। তা সত্ত্বেও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বিপুল। কারণটা কিছুটা অর্থনৈতিক হলেও খুল্লাম খুল্লা বর্ণবিদ্বেষ ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার একটা বড় স্তম্ভ। পরিসংখ্যান নেই, তবে আমার ধারণা ভারতীয় আমেরিকানদের একটা বড় অংশ ট্রাম্প সমর্থক। আমার পরিচিত বৃত্তের বেশ কিছু ভারতীয় অন্ধ ট্রাম্পভক্ত। তা হলে কি কিছুই বদলায়নি? 

***

অনেকে হয়তো জানেন না, বর্তমান দুনিয়ার সমস্ত নারীর আদি মাতা আজ থেকে দু লক্ষ বছর পূর্বের এক কৃষ্ণাঙ্গিনী রমণী, বর্তমান ইথিওপিয়া দেশের এই নারীর নাম দেওয়া হয়েছে mitochondrial Eve। বাইবেলের ইভের সঙ্গে এঁর কোনও সম্পর্ক নেই। এই ইভের সন্তানসন্ততি ক্রমে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে মানুষের নানা রং, নানা রূপ। তাই আধুনিক যুগেও এই আপেক্ষিকভাবে পিছিয়ে থাকা কালো মানুষদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখলে খারাপ লাগে। কেন এই একবিংশ শতাব্দীতে আপাতসভ্য দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের Black Lives Matter আন্দোলন করতে হয়? 

প্রকৃত সভ্যতার বিবর্তন এখনও অসমাপ্ত।

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Flickr, WikiMedia Commons,  

Siddhartha Dey

জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *