জীবনে মাতৃত্ব এলে চাকরি করা বা না করা একেবারেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। জানালেন কলাসলটেন্ট সায়কোলজিস্ট অনুত্তমা বন্দ্য়োপাধ্যায়।

মাতৃত্ব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মাইলফলক বলা যেতে পারে। সন্তানের সঙ্গে একজন মারও জন্ম হয়। সন্তানের ভাল-মন্দ নিয়েই তখন যেন মা-র ভাল থাকা। বাচ্চার হাসি-কান্নার সঙ্গে জড়িয়ে যায় মা-র অনুভূতি। আগেকার দিনে সন্তান মা-র কাছেই বড় হয়ে উঠবে এটাই ছিল স্বাভাবিক ছবি। কিন্তু এখন সময় বদলেছে, যুগ বদলেছে। এখন পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহিলারা চাকরি করেন। অন্যদিকে সমান দাপটে সংসারও সামলান। কিন্তু সন্তান আসার পরে চাকরি নিয়ে দোটানায় ভোগেন অনেকেই। বিশেষ করে যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে চাকরি করেছেন, তাঁদের জীবন কিছুটা হলেও যেন পাল্টে যায়। চাকরি করা বা না করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ব্যক্তিগত, কিন্তু কোনও মা কেন চাকরি ছাড়তে চাইছেন, সেই কারণটাও বোঝা প্রয়োজন।

যাঁরা চাকুরিরতা, তাঁরা যখন মাতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেন, তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তও নেন যে তাঁরা আর চাকরি করবেন না করবেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বাচ্চাকে কেউ দেখার নেই বলেই মা-কে চাকরি ছাড়তে হয়। স্বেচ্ছায় তাঁরা চাকরি ছাড়তে চান না। এই সিদ্ধান্তটা নেহাতই বাধ্যতামূলক, স্বতপ্রবৃত্ত নয়। তার মানে কর্মস্থানে কিন্তু তাঁর কোনও সমস্যা নেই, বা সম্পূর্ণভাবে মাতৃত্ব উপভোগ করবেন বলে চাকরি ছাড়ছেন, তেমনও নয়। সেক্ষেত্রে এই দোটানা আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। যদি মায়েরা ভাবেন যে নতুন ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ হতে চান, সেই ভূমিকা বাদে অন্য কিছু করতে চান না, তাই কাজের জগৎ থেকে সাময়িক বিরতি নেবেন, তা হলে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। সিদ্ধান্তটা যেই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়, তখনই সমস্যা শুরু হয়।

সন্তানের আগে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করতেন। অথচ সন্তান হওয়ার পর স্বামীকে চাকরি ছাড়তে হয় না, তাঁর জীবনে সেরকম আমূল পরিবর্তন আসে না। আর তা দেখে স্ত্রীর মনে হতাশা তৈরি হয়। তাঁর মনে হয় সন্তান তো দুজনেরই, তা হলে কেন বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে? কেন তাঁকেই চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকতে হবে? এই নিয়ে স্বামীর সঙ্গেও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। আসলে সন্তান হওয়ার পর পর তো সে আর মা-কে সঙ্গ দিতে পারে না। ফলে মা-র নিজেকে তখন বাচ্চার কেয়ারটেকার ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। বাচ্চার সমস্ত দায়-দায়িত্ব পূরণ করার পরও মায়ের আবেগের জায়গায় একটু ফাঁক থেকে যায়। কাজের জায়গায় মন মাথা অনেকটাই অধিকৃত থাকে। কোথাও একটা নিজের সত্ত্বাও পূর্ণতা পায়। কিন্তু চাকরি ছাড়লে সেই জায়গায় একটা ফাঁক তৈরি হয়ে যায়। নিজের প্রতি বিশ্বাস খর্ব হয়ে যায়। সংশয় তৈরি হয়, হতাশ লাগে। কোথাও যেন এই নতুন পাওয়ার মধ্যেও একটা খারাপ লাগা তৈরি হয়।

তবে এর সবটাই খারাপ বলছি না। এই যে কেউ একজন আমার উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আছে, এই বোধটা কিন্তু মায়েদের কাছে বেজায় ওভারহোয়েলমিং। এক মাত্র সন্তান ছাড়া কেউই কিন্তু আমাদের উপর এ ভাবে নির্ভর করে না। এটা একটা বিশাল পাওয়া। কিন্তু বাস্তব এটাও, যে সেও কিন্তু সারাজীবন তার মায়ের উপর নির্ভর করে থাকবে না। কয়েক মাসের মধ্যেই সে নিজের ইচ্ছে মতো উঠে বসতে চাইবে, গায়ের চাদরটা টেনে ফেলে দেবে, নিজের খেলনা নিজে বাছতে শুরু করবে, খাট থেকে নেমে হাঁটতে চাইবে, এবং ক্রমশ এই স্বাধীনতার পরিধিটা বাড়তেই থাকবে। ফলে মা-র তখন হতাশ লাগাটাই স্বাভাবিক। কারণ তাঁর কাছে তো আর কিছুই থাকবে না। তখন মন বিষাদগ্রস্থ হতে বাধ্য।

তাই আমি বলব চাকরি করা বা না করার সিদ্ধান্ত খুব ভেবেচিন্তে করতে। তাঁরা যদি খুব সচেতন ভাবে মনে করেন যে শুধুই তাঁরা মাতৃত্ব উপভোগ করবেন, সেখানে অনুশোচনার কোনও জায়গা নেই, তা হলে তাঁদের হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু শুধুমাত্র পরিস্থিতির চাপে চাকরি ছাড়তে হলে, পরবর্তী পর্যায় তা মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। অনেকেই আছেন কিন্তু যাঁরা দিব্য়ি দু’কূল সামলাচ্ছেন। এখানেই আসে টাইম ম্যানেজমেন্ট আর প্রায়োরিটির কথা। বাচ্চার দায়িত্ব শুধু মা-র নয়, তাই বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের মধ্যে একটা শিডিউল তৈরি করে নেওয়া যেতেই পারে যে কে কখন কীভাবে বাচ্চার কাছে থাকবেন। এ ছাড়াও ক্রেশ আছে অনেক। বাচ্চা ক্রেশে থাকবে বলে চোখ কপালে তোলার কিছু নেই। কারণ ক্রেশে বাচ্চারা কিন্তু অনেক সোশ্য়াল স্কিল শেখে যা বাড়িতে হয়তো সম্ভব নয়।

পাশাপাশি বলব বাচ্চারও ছোট থেকে বোঝা উচিত যা তার মায়ের জীবনে সে ছাড়াও আরও কিছু আছে। ছোটবেলা থেকেই যদি সে এটা বুঝতে পারে তা হলে বড় হয়ে নিজের কাজকে সম্মান করবে। অনুপস্থিতির সঙ্গে সহাবস্থানটাও বাচ্চাদের শিখতে হয়। সারাক্ষণ মা মুখের সামনে থাকবে, সব করে দেবে, এটা কিন্তু কোনও পজিটিভ লার্নিং হতে পারে না।

পেশায় একজন মনোবিদ | জীবনের রোজনামচায় মনের তল্লাটে ঘনিয়ে ওঠা নানান ভাবনা, দ্বন্দ্ব, ইচ্ছে, বিষাদ তাঁর লেখার রসদ |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *