আমাদের পাড়ার নরেনবাবু রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে পড়লেন, আর আমি পড়লাম গভীর বিপদে। 

আগে কোনটা বলব?‌ নরেনবাবুর বিখ্যাত হওয়ার গল্প?‌ নাকি আমার বিপদ?‌

আগে নরেনবাবুর কথাই খানিকটা বলে নিই।

অতি নগন্য নরেনবাবু যে রাতারাতি এমন অতি বিখ্যাত হয়ে পড়বেন কে ভাবতে পেরেছিল?‌ কেউ পারেনি। খবরের কাগজে ছবি, টিভিতে খবর, ওয়েব পোর্টালে জীবনী, ফেসবুকে ভাইরাল, ব্লগে ব্লকব্লাস্টিং… সব মিলিয়ে একবারে নেড়াবেড়া অবস্থা। 

উত্তর কলকাতার নামকরা রুটিআলুরদমের দোকান হল ‘‌উনুন।‌ এক সময় এই দোকানের রুটি নাকি মনীষীরাও খেয়েছেন। সাক্ষী কেউ নেই, তবে দোকানের ভিতরে দেওয়ালে পরপর ছবি টাঙানো রয়েছে। সে ছিল বাংলার নবজাগরণের সময়। তখনও ‘‌হোম ডেলিভারি’‌ ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি। বড় বড় মানুষদের বাড়ি থেকে কাজের লোক, শিষ্যরা এসে রুটি নিয়ে যেত। এরও অবশ্য কোনও সাক্ষী নেই। সে যাই হোক, ‘‌উনুন’‌ পাড়ার মোড়ে হোর্ডিং ঝুলিয়েছে। হোর্ডিংয়ে ছবি। ধুতি পাঞ্জাবি ক্যাম্বিসের জুতো পরা ছোটখাটো নরেনবাবু তাড়া করেছেন টাক মাথা, খোঁচা দাড়ি, খাড়া চুল, হাতে রিভলবার ধরা এক গুন্ডাকে। নরেনবাবুর উঁচু করা দু’‌হাতে গদার মতো ধরা গোল করে পাকানো রুটি। নীচে লেখা— 

               ‘‌আমাদের হাতের রুটি
                নরেনবাবুর শক্ত খুঁটি‌‌‌।’‌‌

এরপরে আর বিখ্যাত হওয়ার বাকি কী রইল? তবে ওই যে বললাম, এই কাহিনিতে নরেনবাবুর বিখ্যাত হয়ে ওঠার থেকে আমার বিপদ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আলোর পাশে যেমন অন্ধকার থাকে, সুখের পাশে থাকে দুঃখ, কমেডির গায়ে লেগে থাকে ট্র্যাজেডি, এই ঘটনাও সেরকম। নরেনেবাবু যদি আকাশে উঠেছেন, আমি পড়েছি এক গলা জলে। নরেনবাবু যদি ফুরফুরে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছেন, আমি জলে হাবুডুবু খাচ্ছি।




নরেনবাবু কে
?‌

কেউ নয়। নোবডি। দু’দিন আগে আমাদের পাড়ার লোক তো দূরের কথা, পাশের বাড়িরও কেউ নরেনবাবুর খবর রাখত না। রাখবে কেন?‌ নরেন প্রামাণিক খবর রাখবার মতো কোনও লোকই নন। তিনি সাধারণের সাধারণ, ভিতুর ভিতু, এড়িয়ে যাওয়ার এড়িয়ে যাওয়া। ‘‌এড়িয়ে যাওয়ার এড়িয়ে যাওয়া’‌ মানে কোনও ঝামেলা দেখলেই সরে পড়েন। জটলা দেখলেই ফুটপাথ বদল। দায়িত্ব এলেই পালান। ঝামেলা এড়াতে গিয়ে নরেনবাবু জীবনে পকেটমারি, ছিনতাইও চুপচাপ মেনে নিয়েছেন। টুঁ শব্দটি করেননি। সে-ও গল্পের মতো। 

একবার বাসে নরেনবাবুর পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে দিল এক ছোকরা। মানিব্যাগ নিয়ে হাত বের করবার পথে কোনও এক রহস্যময় কারণে পকেটে গেল হাত জড়িয়ে। হাত যত টেনে বের করতে যায় তত কাপড়ে যায় পেঁচিয়ে। পকেটমারের হাত অন্যের পকেটে আটকে যাওয়ার ঘটনা কোটিতে একটাও কি হয়?‌ ক্রাইম রিপোর্টে এমন রোমহর্ষক ঘটনার হদিশ কি মিলবে? নিশ্চয় মিলবে না। কিন্তু সেদিনও রোম‌হর্ষক কাণ্ড করলেন নরেনবাবু। পাছে বাসের অন্য যাত্রীরা দেখে ফেলে, তাই তিনি পকেটমারের ‘‌দক্ষিণ হস্ত’‌টি সযত্নে বের করে দিলেন। নিচু গলায় বললেন,‘‌মানিব্যাগে অফিসের আইডেনটিডি কার্ডটা রয়েছে, ওটা কি ভাই ফেরত পাওয়া যাবে?‌’‌

সে ছিল বাংলার নবজাগরণের সময়। তখনও ‘‌হোম ডেলিভারি’‌ ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি। বড় বড় মানুষদের বাড়ি থেকে কাজের লোক, শিষ্যরা এসে রুটি নিয়ে যেত। এরও অবশ্য কোনও সাক্ষী নেই।

পকেটমার ছোকরা চাপা গলায় বলেছিল, ‘‌না। ওসব দেওয়া নেওয়া করতে গেলে পাবলিক দেখে ফেলবে। বাসের মধ্যে ক্যাওড়া কিচাইন লেগে যাবে। এগুলো আমরা ম্যানহোল খুলে ফেলে দিই। ফোন নম্বর দিন, কোন ম্যানহোলে ফেলেছি বলে দেব।’‌ নরেনবাবু ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘‌থাক তবে, ঝামেলা করে লাভ নেই।’‌

ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে এক বৃষ্টির রাতে। সেদিন বিকেল থেকেই ভাসিয়ে দিয়েছিল। অফিস ছুটির পর কোমর ডুবুডুবু। ট্রেন বন্ধ। টেম্পোর মাথায় চড়ে নরেনবাবু কলকাতা ফিরলেন। এসপ্ল্যানেড থেকে জল ভেঙে হাঁটা। বাড়ির কাছে আসতে রাত বারোটা পেরিয়ে গেল। গলির মোড়েই রেনকোটে আগাপাশতলা মোড়া দু’‌জন আগুপিছু এসে পথ আটাকে দাঁড়াল। ছোটবেলার গল্পের বইয়ে আঁকা ছবির মতো। এক ‌ছিনতাইকারী চাপা গলায় বলল, ‘‌যা আছে দিয়ে দে। নইলে এই জমা জলে চুবিয়ে মারব।’‌

ছিনতাইয়ের অস্ত্র হিসেবে ‘‌জমা জল’‌ কাজে লাগানোর কথা আগে কেউ ভাবতে পেরেছে?‌ দ্বিতীয় ছিনতাইকারী বলল, ‘‌চিল্লামিল্লিতে নো ফায়দা। জল ভেঙে কেউ আসবে না।’‌ নরেনবাবু ঝামেলা না বাড়িয়ে পকেটে যা ছিল বের করলেন। 

আসলে এক ধরনের মানুষ রয়েছে যারা চায়, জীবন যেমন চলছে, তেমন চলুক। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, মহাকালের পর মহাকাল। একটু এদিক ওদিক হলেই তাদের সমস্যা। যদি দরজার পিছনের হুকে ছাতা, গামছা ঝোলে, তো সেই ছাতা–‌গামছা যেন জন্মভর সেখানেই ঝোলে। রাতে চিন্তায় ঘুম ভেঙে যায়। ওরা ওখানেই আছে তো?‌ এদের বলে ‘‌ছাতা–‌গামছা মানুষ’‌। আমাদের নরেনবাবুও একজন ‘‌ছাতা–‌ গামছা মানুষ’‌

নরেন প্রামাণিকের বয়স বিয়াল্লিশের শেষদিকে। সংসারে একা। থাকেন ভাড়া বাড়িতে, দেড় কামরার চৌখুপ্পি। পুরনো কলকাতার তিনতলা বাড়ির একতলায়। ঘর নিয়েছেন পিছনদিকে। ‌বাড়ির সামনের দিকে থাকা মানেই‌ লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, দুটো পাঁচটা কথা। ওসব তার পোষায় না।‌

নরেনবাবু চাকরি করেন মফসসলে, কর্পোরেশন অফিসে। শিয়ালদা থেকে আটটা সাতচল্লিশের লোকাল ধরে অফিসে যেতে হয়। নইলে লেট। পরের গাড়ি ন’টা সতেরো। তখন আবার নেমে ছুটতে হয়। বেতন কমের দিকে। যাবার সময় শিয়ালদা পর্যন্ত বাসে গেলেও, ফেরবার সময়  হন্টন। পাক্কা সাঁইতিরিশ মিনিটের হাঁটাপথ। গলির মাঝবরাবর ইটরঙা বাড়ি। গলিতে ল্যাম্পপোস্ট র‌য়েছে, বাল্ব নেই। বাল্ব রয়েছে আলো নেই। ফলে অন্ধকার। বাড়ির পিছন দিক তো আরও অন্ধকার। পাশের বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে হুমড়ি খেয়ে আছে হাড়গিলে পেয়ারা গাছ। যেন সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে দেখছে। ফল টল দেওয়ার নাম নেই, খানিকটা অন্ধকার জমাট বেঁধে রাখে।

নরেনবাবু গোছানি লোক। ব্যাগে টর্চ থাকে। বগলে ব্যাগ ধরে, পকেট হাতড়ে চাবি বের করেন। টর্চ জ্বেলে তালা খোলেন। কোনওবারই টর্চ এক চান্সে জ্বলে না। পিছনে চাপড় দিতে হয়। ভিতরে কোথাও লুজ হয়েছে। নরেনবাবু রোজই ভাবেন, অফিসফেরতা দোকানে গিয়ে সারিয়ে নেবেন। মানিকতলায় দোকান রয়েছে। পরে ভাবেন, থাকগে, শেষপর্যন্ত জ্বলছে তো। তাহলেই হল। সবাইকে যে এক চান্সে কাজ করতে হবে, তার তো কোনও নিয়ম নেই।‌




নিজের ডেরায় ঢুকে পড়লে নিশ্চিন্তি। বাইরের দুনিয়া থেকে
‘‌টা টা। এরপর‌ হাত মুখ ধুয়ে কখনও নিচু ভল্যুমে টিভি দেখা, কখনও দু’দিন আগের বাসি খবরের কাগজ পড়া। রাত ন’‌টা তিরিশ থেকে বত্রিশে জানলায় ঠক্‌ঠক্‌। দুটো ‘‌ঠক্‌’‌, থেমে আবার দুটো ‘‌ঠক্‌’‌। জানালায় ঠকঠক মানে রুটি এসেছে। তিনটি আটার রুটি। পাড়ার মোড়ে রুটির দোকান। আগেই বলেছি নাম ‘‌উনুন’‌। কয়লা-ঘুঁটের উনুনের আমল উঠে গিয়েছে। এখন ঘরে ঘরে গ্যাস। আমাদের এই দোকানে কিন্তু এখনও উনুনের কারবার। এ ব্যাপারে দোকানের বর্তমান মালিক বিশু সাঁতরার বক্তব্য রয়েছে।আমাদের ফোর্টিন পুরুষের রুটির কারবার। গোরা সৈনিকরা একসময় ময়দানে লেফট রাইট করে এসে ঝোলাগুড় দিয়ে আমাদের রুটি খেত। তখন থেকেই এখানে উনুন সিস্টেম। স্টোভের আগুন, গ্যাসের ‌আগুনে সব আছে, গনগনা ভাব নেই। আগুন গনগনা না হলে হাতে গড়া রুটি কখনও রুটি হয় না।‌

‘‌কেন গ্যাসের আভেনেই তো এখন সবাই রুটি বানায়। রুটি মেকারও পাওয়া যাচ্ছে। রুটি কেমন ফুস্‌স্‌ করে ফুলে যাচ্ছে।’‌

বিশু হাত নেড়ে বলে,‘‌দূর দূর, ওই ফোলা সেই ফোলা নাকি?‌ ও‌ তো ভেজাল ফোলা। উনুনের আগুন পেলে আটা ময়দা নেত্য করে।’‌

‘‌নেত্য!‌ মানে নাচে বলছ?‌’‌

বিশু বলে,‘‌অবশ্যই নাচে। ফুলে ওঠা তো নাচই হল। তার ওপর রুটিতে কয়লার ছাই, আগুনের পোড়া, মাটির গুঁড়ো লেগে না থাকলে স্বাদ হয়?‌ খাবার সময় রুটি ঝেড়ে না খেলে মজাই নাই।’‌

সামান্য রুটির ভিতরে যে এত আর্ট লুকিয়ে রয়েছে কে জানত?‌

সম্ভবত এত সব কারণেই আমাদের পাড়ায় ‘‌উনুন’-এর হাতে গড়া রুটির এত কাটতি। সন্ধ্যের পর বিশু তার ফুল ব্যাটেলিয়ন নিয়ে নেমে পড়ে। সেই ব্যাটেলিয়নে থাকে তার বউ শেফালি, বারো বছরের ছেলে ভজা, সতেরো বছরের মেয়ে নিনি। এতেও সামলাতে পারে না। একজন আটা মাখছে, একজন বেলছে, একজন সেঁকছে, একজন বিলোচ্ছে। এর সঙ্গে ক্যাশ সামলানো রয়েছে। কোনও কোনও বাড়িতে আবার বিশু ‘‌হোম ডেলিভারি’‌ও করে। এর জন্য আলাদা লোক রেখেছে। রামধন। তার সাইকেল র‌য়েছে। এই নিয়ে শেফালির আপত্তি।

পকেটমারের হাত অন্যের পকেটে আটকে যাওয়ার ঘটনা কোটিতে একটাও কি হয়?‌ ক্রাইম রিপোর্টে এমন রোমহর্ষক ঘটনার হদিশ কি মিলবে? নিশ্চয় মিলবে না। কিন্তু সেদিনও রোম‌হর্ষক কাণ্ড করলেন নরেনবাবু।

সে বলে, ‘তোমার বাপ ঠাকুর্দার আমলে ‌বড় বড় মনীষীরা পর্যন্ত একসময়ে দোকানে লোক পাঠিয়ে রুটি নিয়ে যেতেন, এখন হাবিজাবিদের বাড়িতে তুমি লোক পাঠাচ্ছ!‌’‌

বিশু হেসে বলে,‘‌আরে বাপু, দু’ চারটে ভালমানুষের সেবা করতে হয়।’‌

নরেনবাবু ‘‌ভালমানুষ’‌ কেন বিশু পুরোটা জানে না, তবে মানুষটার প্রতি তার নানা কারণে দুর্বলতা রয়েছে। কোনওদিন দরাদরি করেননি। ফাউ চাননি। ‌সাত বছর ধরে তার রুটি চিবোচ্ছেন। যতই সুনাম থাকুক, খাবারে তো কতই গোলমাল ঘটে যায়। রুটি পুড়ে যায়, আলুরদমে নুন পড়ে না, আটায় খস্‌খসা থাকে, দিতে দেরি হয়ে গেলে ঠান্ডা হয়ে যায়। তারপরেও নো কমপ্লেন। মাসকাবারি বন্দোবস্ত। এ পাড়ার অনেকের সঙ্গেই তাই। খাতা রয়েছে। নরেনবাবু মাসের এক তারিখে পুরো টাকা মিটিয়ে যান। অফিসফেরত ঘুপচি দোকানের সামনে এসে হাজির হন নরেনবাবু। একদিন রুটি নিয়ে এমন ভাষণ দিয়েছিলেন যে বিশুর চোখ একবারে ছানাবড়া। ‘‌কেউ নয়’‌ মানুষটার এত জ্ঞান!‌ 




কই হে বিশু?‌ খাতাটা খুলে দেখ কত হল।‌ গত মাসে তিনটে দিন বাদ ছিল মনে আছে তো বাপু?‌’‌

বিশু বলে, ‘‌ও কাল পরশু হবে দাদা।’‌

নরেনবাবু বলতেন, ‘‌ না না, বাপু, ধারবাকিতে আমি নেই। এত বছর তো দেখছ।’‌

বিশু বলে, ‘‌ধারবাকির কী হয়েছে?‌ আপনি তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না।’‌

নরেনবাবু বলেন, ‘‌কে জানে?‌ দুম্‌ করে হয়তো আজ রাতেই পটকে গেলাম। ধার রেখে মরেও শান্তি পাব না।  খচ্‌ খচ্‌ করবে, অথচ কিছু করতেও পারব না। তার থেকে বরং নিয়েই নাও।’‌

বিশু জিভ কেটে বলে, ‘‌কী যে বলেন দাদা। আচ্ছা, দিয়েই দিন। সামান্য ক’টা রুটির জন্য আপনার যখন তর সইছে না।’‌

নরেনবাবু মুচকি হেসে বলেন, ‘‌রুটি কোনও সামান্য ব্যাপার নয় বিশু। বলতে পার দুনিয়ার সব থেকে জটিল ব্যাপার। তাকে ছোট করে দেখো না মোটে।  দুনিয়ায় রুটি নিয়ে কম মারামারি কাটাকাটি হয়নি। আজও সমানে হচ্ছে। আমরা ভাবছি সীমান্ত নিয়ে লড়াই, আসলে লড়াই রুটি নিয়ে। অন্যের এলাকায় জোরজবরদস্তি নাক গলালে, তার রুটিতেও খাবলা দেব। এই যে তেলের বাজার দখলের জন্য এত হম্বিতম্বি, সে তো গ্যালন গ্যালন তেল নয় বাপু হে, সে তো দিস্তে দিস্তে রুটি। যার হাতে তেলের ট্যাঙ্ক, তার হাতে রুটির ভাঁড়ার। সবাই রুটির জন্য হন্যে। কেউ দুটো রুটি, কেউ দশটা, কারও রুটি তোমার মতো আটা দিয়ে তৈরি, কারওটা সোনার।’‌

বিশু অবাক হয়ে বলে, ‘সোনা?‌‌ সোনার রুটি!‌ এ কী বলছেন নরেনবাবু!‌’‌‌

নরেনবাবু মাথা নেড়ে বলেন,‘‌ঠিকই বলছি। সোনার বিস্কুট হয় শোনোনি?‌ তাহলে সোনার রুটি হতে সমস্যা কোথায়?‌ আসলে এক এক জনের কাছে এক এক রকম। গরিব মানুষের কাছে রুটি এক, তো বড়লোকের কাছে আর এক। খিদের সময় ক’টা রুটি পেলেই কেউ খুশি, কবিতা শোনোনি?‌ চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। শুনেছ?‌ বড়লোকের আবার রুটি খেলে চলে না, ছিনিয়ে নিতে লাগে। নইলে পেট ভরলেও মন ভরে না। সে খালি উস্‌খুস্‌ করে, কার রুটি কেড়ে নেব। খাই না খাই কেড়ে তো নিই।’‌

বিশু চোখ বড় করে বলে, ‘‌কী যে বলেন নরেনবাবু, কঠিন কথা সব, কিছুই তো মানে বুঝি না। রুটির এত ক্ষমতা?‌’‌

নরেনবাবু মিটিমিটি হেসে বলেন, ‘‌তবে আর বলছি কী?‌ আমার মতো ছাপোষা মানুষ আবার সারা জীবন নিজের রুটি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অন্যে পেল কী পেল না, তাতে তার কিছু যায় আসে না, ফিরেও তাকায় না। বরং রুটি নিয়ে ঝামেলা হুজ্জুতি দেখলে পালাই। তাই আমরা বাঁচি মরি, কারও মাথাব্যথা নেই। আবার দেখ বিশু, সকলের যাতে দুটো রুটি জোটে তার জন্য কত মানুষই না মাথা কুটেছে। মোটা মোটা বই লিখেছে, বন্দুক হাতে লড়াই করেছে, বছরের পর বছর জেল খেটেছে। আজও তাই। কেউ চায়, সব রুটি নিজের হাতে থাকুক, কেউ চায়, সব রুটি বিলিয়ে দিতে। কেউ রুটি চুরি করে, কেউ করে দান। রুটি বড় মজার জিনিসও। একই অঙ্গে কত রূপ!‌

নরেনবাবু ‘‌ভালমানুষ’‌ কেন বিশু পুরোটা জানে না, তবে মানুষটার প্রতি তার নানা কারণে দুর্বলতা রয়েছে। কোনওদিন দরাদরি করেননি। ফাউ চাননি। ‌সাত বছর ধরে তার রুটি চিবোচ্ছেন।

বিশু হকচকিয়ে যায়। সামান্য রুটির এত মাহাত্ম্য!‌ আর বলছে কে?‌ সে-ও তো অতি সামান্য। এসব কথা কি শেফালিদের মতো মূর্খদের বোঝানো যায়?‌ দরকার নেই বুঝিয়ে। নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলেই হল। সেই দায়িত্বটুকুও তো অতি ক্ষুদ্র। রাত ন’‌টা তিরিশ থেকে বত্রিশ মিনিটে তিনটে রুটি ভাল করে কাগজে মুড়ে নরেনবাবুর বাড়ি পৌছে দেওয়া।

 ঠক্‌ ঠক্‌ ঠক্‌। নরেনবাবু জানালা একটু ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে সেই কাগজের মোড়কটা নিয়ে নেন। ব্যস। এ ক’টা বাড়িতে রুটি পৌঁছে দেবার জন্য সাইকেল করে রামধন আসে। সেদিন আসেনি। জ্বর, খুক্‌খুকে কাশি। রুটি বিলির দায়িত্ব পেল বিশুর ছেলে ভজা। সে বেচারির আবার সাইকেলের চেন গিয়েছে কেটে। ফলে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে সময় লাগবে। বিশু মেয়েকে ডাকলেন।

‘‌নিনি, তুই চট করে নরেনবাবুকে দিয়ে চলে আয়।’‌

শেফালি বলল, ‘‌এত রাতে মেয়েকে পাঠাচ্ছ কেন?‌ দাও আমি যাই।’‌

বিশু বলল, ‘‌খেপেছ? এত রুটি বেলবে কে?‌’‌

শেফালি বলল, ‘‌তুমি যাও।’‌

নিনি রেগে বলল, ‘তুমি থাম তো মা। বাবা দোকান ছাড়লে ক্যাশ সামলাবে কে?‌ এই সময়টাতেই তো যত ভিড়। আমাকে দাও দেখি। নিজের পাড়ায় আবার ভয় কিসের?‌ আমি কি এখনও ছোট নাকি?‌ এক ছুটে যাব, এক ছুটে চলে আসব।’‌

বিশু বলল, ‘‌তাই কর। জানালায় টোকা দিবি।’‌ 

নিনি অন্ধকার গলি পেরিয়ে, অন্ধকার পেয়ারা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নরেনবাবুর জানালায় টোকা দিল। নরেন‌বাবু জানালা ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে রুটির মোড়ক নিতে গিয়ে একটু থমকালেন। হাতটা কেমন মেয়েদের মতো না?‌ রোগা। চুড়িও রয়েছে যে। রামধন বেটা হাতে চুড়ি পরতে শুরু করল নাকি!‌ যাক পরুক। তাঁর মাথাব্যথা কিসের?‌ এই ভেবে রুটির মোড়ক নিয়ে সবে জানালাটা বন্ধ করতে যাবেন, আর তখনই ঘটল ঘটনা। নরেনবাবুর বিখ্যাত হওয়ার ঘটনা।




নিনির পিছু নেওয়া বেপাড়ার গুন্ডাটা পেয়ারা গাছের অন্ধকারে সিঁটিয়ে ছিল। এবার খপ্‌ করে নিনির ওড়নাটা ধরে টান দিল। এই হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত
, আতঙ্কিত নিনি ‌চিৎকার করে উঠল, ‘‌ফেরত দিন, আগে ফেরত দিন।’‌

জানালায় ছিটকিনি দিচ্ছিলেন নরেনবাবু। হাতে রুটির মোড়ক। নারীকণ্ঠের আর্তনাদে চমকে উঠলেন। তাহলে রামধন নয়, রুটি পৌঁছে দিতে সত্যি কোনও মেয়ে এসেছে?‌  লজ্জায় অপমানে কাঁদতে কাঁদতে নিনি তখনও বলে চলেছে, ‘‌দিন, ফেরত দিন.‌.‌.‌।

জানালার ওপাশে নরেনবাবু ভয় পেলেন, থমকে গেলেন। ওই মেয়ে কে?‌ রুটি কেন ফেরত চাইছে?‌ কোনও ঝামেলা?‌ কী ঝামেলা?‌

যা খুশি হোক, আগে তো রুটি ফেরত দেওয়া যাক। ঝামেলা দূর হোক। দ্রুত হাতে আবার জানালা ফাঁক করলেন নরেনবাবু। রুটির মোড়ক ছুড়ে দিলেন গায়ের জোরে। জানালা বন্ধ করলেন ‌‘‌দড়াম্‌’‌ আওয়াজে। কিন্তু ততক্ষণে যা ঘটবার ঘটে গেল। ছুড়ে দেওয়া রুটির মোড়ক সজোরে এসে লাগল গুন্ডা নাটুর কপালের একপাশে, জ্ঞান হারিয়ে দেওয়ার নার্ভে। আচমকা আক্রমণে ভীত নাটু সেই নার্ভ সামলাতে পারল না। সে নিনির ওড়না ছেড়ে ধপাস্‌ করে পড়ল তার পায়ের কাছে।

পরের ঘটনা এতই সহজ যে বলবার অপেক্ষা রাখে না। নিনির চিৎকারে লোক জড়ো হওয়া, বিশু শেফালির ছুটে আসা, পাড়ার লোক বেরিয়ে আসা, পুলিশে খবর, জল ছিটিয়ে নাটুর জ্ঞান ফেরানো, তাকে আটক করাএকটার পর একটা ঘটতে লাগল। পরদিন খবর ফাঁস। রুটি যখন বন্দুক। এখন সাতদিন ধরে চলছে খবরের কাগজে নরেনবাবুর ছবি, টিভিতে নরেনবাবুর খবর, ওয়েব পোর্টালে নরেনবাবুর জীবনী, ফেসবুকে নরেনবাবুর কথা ভাইরাল, ব্লগে ব্লগে নরেনবাবুকে নিয়ে আলোচনা। 

এবার আমার বিপদ। 

বিধি আমার সঙ্গে আর মিশবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আমার পাড়ায় এত বিখ্যাত একজন মানুষ থাকা সত্ত্বেও, কেন তাকে এতদিন জানাইনি?‌ একজন প্রেমিকা কি তার প্রেমিকের কাছ থেকে এইটুকুও আশা করতে পারে না?‌ বিধি আমার ফোন নম্বর ব্লক করে দিয়েছে। ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করেছে। শত অনুনয় বিনয়েও আমি তার অভিমান ভাঙাতে পারছি না। ঠিক করেছি, আজ গাদাখানেক গোলাপফুল নিয়ে ওর বাড়িতে হাজির হব। ক্ষমা চাইব।

আচ্ছা, গোলাপের বদলে বিশুর‌ দোকান থেকে কিছু গরম রুটি নিয়ে গেলে কেমন হয়?‌ রুটি এত কিছু পারে আর রাগ কমাতে পারবে না?‌‌    

জন্ম কলকাতায়, ১৯৬২ সালে। বাঙুর এভিনিউতে স্কুলের পড়াশোনা, বড় হওয়া। স্কুলজীবন থেকেই খেলাধুলার সঙ্গে লেখালেখির নেশা। প্রথম লেখা মাত্র ১২ বছর বয়সে আনন্দমেলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তারপর বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখা চলতে থাকে। স্কুল শেষ হলে স্কটিশ চার্চ কলেজ। অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়া। তাঁর বহু জনপ্রিয় বইয়ের কয়েকটি, 'ধুলোবালির জীবন', 'মাটির দেওয়াল', 'সাগর হইতে সাবধান', 'গোপন বাক্স খুলতে নেই', 'দোষী ধরা পড়বেই'।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *