সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আলো এসে পড়ল দেড়তলার ল্যান্ডিংয়ে। এখন তো দীর্ঘ বিকেল। ফাল্গুনের পড়ন্ত দিনে রোদের তাত দখিনা বাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে শিরশিরে ভাবের জোগান দেয়। তবু কার কাছে যাবে? কেন যাবে? এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে, চাইলেই কি যাওয়া যায় ইচ্ছেমতো? ফ্ল্যাটের ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে আলফানসো গাছটা মুকুলে মুকুলে ছয়লাপ। মুকুল বললেই ইদানিং দলবদল মনে হয়। অথচ দলের তো সে কোনওদিনই ছিল না। একক ছিল। নিজের, একার। আজও তাই আছে। এই ষাটোর্ধ্ব জীবনে বিফলতার কলরোল সত্য, তবু শেষ সত্য নয়। টপ ফ্লোরের দুকামরার ফ্ল্যাট থেকে আমের বোলের গন্ধ পাওয়া যায়।

**

এই মেয়েটির লাল সুতির শাড়ি দেখে আচমকা সমীরণের মাথার ভেতর ঝড় বইতে থাকে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মনে হয়৷ একেবারে চোখে চোখ রেখে বসে আছে দৃপ্ত ভঙ্গিমায়। কে ও? কেন এসেছে একবার ডাকতেই? কী অভিপ্রায়? প্রেম? হাঃ! একুশ শতকের তরুণতরুণীরা প্রেমে বিশ্বাস করে? শাড়িটার রং কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল৷ ম্যাচিং ব্লাউজও। ফর্সা গোড়ালির ওপর সামান্য পেটিকোট দেখা যায়। রক্তের মতো লাল।

সালটা কত হবে? সত্তর-একাত্তর? বাবার হাত ধরে দত্তপুকুর সংলগ্ন গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণচূড়া, শিমুল আর মাদারের তফাত করতে শিখেছিল সমীরণ। শিখেছিল লাল মানে সাম্যের লড়াই। এই মেয়েটা কেন বসে আছে সামনে? উঠে যাক, উঠে যাক এক্ষুনি। এই ক্যাফেটেরিয়ার মধ্যে ধুন্ধুমার কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই শাল্মলীর ফোন বেজে ওঠে। সেতারে, এই আকাশে আমার মুক্তি। ঢাউস ট্যাব হাতে কাচের দরজা ঠেলে ও বাইরে যায়, দৃষ্টির আড়ালে।

 

আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের বড়গল্প: যত দূরেই যাই: প্রথম পর্ব 

**

না, এতদ্বারা কিছুই প্রমাণিত হয় না। তিন দশকের ছোটো মেয়েটি ক্যাব থেকে নেমে যাওয়ার সময় জানলা দিয়ে তার হাত ছোঁয়। “উইল মিস ইউ সমীরণ।” শুধু নাম! হাঁটুর বয়সী মেয়ের এত স্পর্ধা! তার হাসি পায়, রাগ হয়, সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে আঘাত লাগে। নাহ, আজ রাতে আর কিছুতেই ফোন করবে না একে। ভাবতে ভাবতে গন্তব্য আসে। এফএম চলছে গাড়িতে। হাঁ হামকো মোহব্বত হ্যায়, মোহব্বত হ্যায়।সিলসিলা, ১৯৮১, ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। প্রদীপ, শ্যামলেন্দু আর সমীরণ। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার আগের দিন নাইট শো৷ হল থেকে বেরিয়ে প্রদীপ বলেছিল, “গুরু, পাপিয়া তো তোমার জন্য পাগল।”
পাপিয়া
, মানে পরিযায়ীর মা। 

“সাবজ়ি আপকা লোকেশন আ গয়া।”
ভাড়া দিতে হল না। অনলাইনে দিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। মিলেনিয়াল চিলড্রেনরা কত আধুনিক। এক-কন্যে পরিযায়ীও তো মিলেনিয়াল। একটা গোটা দুপুর শহরতলির নির্জন কফিশপে বসে
, কেটে গেছে। মেয়েটার চারটে-বারোটা কল সেন্টার। টকটকে লাল শাড়ি পরে কেউ কর্পোরেট অফিসে যায়? সমীরণ ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে আম্রমুকুলের গন্ধ রক্তস্রোতের ভেতরে গেঁথে নিয়ে জামাকাপড় তোলে। দুটো সাদা পাজামা, দুটো শার্ট, একটা গেঞ্জি, একটা তোয়ালে। রিটায়ারমেন্টের পরে এ-ই তার নৈমিত্তিক পোশাক। জামাকাপড়গুলোতে মিষ্টি গন্ধ। ডিটারজেন্টের? ওই মেয়েটা কী যেন পারফিউম মেখেছিল…

**

দল তার নয়। ছাত্র-রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই একটি কারণই যথেষ্ট ছিল তার কাছে। বাবাও প্রশ্ন করেনি, পার্টি ছাড়ছ কেন। দল ছাড়া মানে তো বিশ্বাস ছাড়া নয়। দত্তপুকুরের বাড়ির লাল মেঝেয় ছুটির দুপুরে রোদ্দুর পড়ত দক্ষিণের জানলা দিয়ে। মা না-বলে চলে গেল একদিন রাতে। খেয়েদেয়ে ঘুমলো, আর উঠল না।

পাপিয়াও তো না-বলেই।
দফতর থেকে ফিরতে রাত হয়েছিল সেদিন। নটা দশ-পনেরো। এই ফ্ল্যাটের মেন এন্ট্রান্স-এর সামনে আবদুল নামে এক দারোয়ান বসত নাইট শিফটে। উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “বৌদি চাবি দিয়ে গেছে।” রোজ রাত বারোটার পর পাপিয়ার সদ্য-পাওয়া সেলফোনে ফোন আসছিল এক বছর যাবৎ। পাপিয়াকে যেতেই হত। নিশিডাক। তাই বলে একরত্তি মেয়েটাকে নিয়ে? বাবুয়া গান না গাইলে কচিমুখ পরির ঘুম আসে না, মেয়েটার জন্ম-ইস্তক এমনই জেনেছিল সমীরণ।

 

আরও পড়ুন: অবন্তিকা পালের বড়গল্প: যত দূরেই যাই: শেষ পর্ব

**

শাল্মলীর জন্য পুরনো অ্যালবাম খুঁজে বার করে সে। স্কুলের ছবি। বাবা-মা। বিয়ে। মেয়ের অন্নপ্রাশন। এতকিছু যাকে দেখাবে বলে আজ সকাল হল, সে আসবে, থাকবে আজ সারাদিন, বলেই তো সূর্য উঠল এত আড়ম্বর করে। সমীরণ তার টুলটুলে গালে হাত রাখবে বলেই আমের মুকুলের ঝাঁঝালো গন্ধে হাওয়া উতরোল হল। চাকার শব্দে সমীরণ ড্রয়িং রুমের মস্ত জানলাটায় গিয়ে দাঁড়ায়।

সাদা গাড়ি থেকে যে যুবতী নামছে, সে কে? শাল্মলী? না না। সে তো দীর্ঘাঙ্গী আর ফর্সা। এই মেয়েটা ছিপছিপে, শ্যামবর্ণা, অনেকটা তার নিজের মুখের আদল! বেলা এগারোটার রোদ্দুর এসে পড়েছে তার চুলের গুছিতে। বড্ড চেনা ওই রোদ্দুর। বাবুয়ার গান শুনে ঘুমিয়ে পড়া কচি মেয়েটার মুখে লেগে থাকা অনিঃশেষ আলো যেমন। 

ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকে সে। ভয়? যাবতীয় অপারগতা থেকে পালিয়ে ফের তাদেরই মুখোমুখি হয়ে পড়লে অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নচিহ্নের ভয়? সব্বাই চলে গেছে? নাকি পার্টি, পরিবার, বন্ধুজন সকলকে ছেড়ে আদতে সে-ই চলে এসেছে বারবার? দেওয়ালে স্নিগ্ধ রবীন্দ্রনাথ চেয়ে আছে সমীরণের আজীবনের ব্যর্থতার দিকে। বন্ধ দরজার অন্য পারে, এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়৷ কলিং বেলের আওয়াজে মিশে যাচ্ছে রিংটোন। মেঝের ওপর কুঁকড়ে বসে আছে একটা প্রৌঢ় লোক৷ এবং আবারও, দরজা খুলতে ব্যর্থ, একটা হেরে যাওয়া লোক।

অবন্তিকা পাল। জন্ম ১৭ জুন ১৯৮৬, হাওড়া। কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জে.বি.রায়. স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হসপিটাল থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক। স্নাতকোত্তর স্তরে মনস্তত্ত্বের পাঠ দ্বিতীয় বর্ষে অসমাপ্ত থেকে গেছে। তবে লেখার পরিসরে সমাজবিজ্ঞান ও মানবাধিকার চর্চা অব্যাহত। কবিতার সঙ্গে নৈকট্য আশৈশব। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ২০১৩-তে। ২০১৭-এ প্রথম প্রবন্ধের বই। প্রথম সারির বাংলা দৈনিক, একাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা ও ওয়েবম্যাগাজিনে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হয় নিয়মিতভাবে। সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের সময়ে কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজ-এর সর্বজনবিদিত 'হম দেখেঙ্গে' (দেখে নেবো আমরাই) কবিতাটির বাংলা অনুবাদ করে অবন্তিকা জাতীয় স্তরের সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *