রতি নাপিতের বাড়িটার অবস্থানক্ষেত্র বড়ো চমৎকার—বাড়ির পুবে নদী কামদা, পশ্চিমে বাগান; উত্তরে বেণুবন; দক্ষিণে যতোদূর দৃষ্টি চলে ততোদূর বিস্তৃত শস্যক্ষেত্র। সূর্যদেব দিগন্তরেখা স্পর্শ করিতে না করিতে তার টকটকে হিঙুল আভাটি রতির গৃহচূড়া চুম্বন করে; রতি ঠিক পাখির ডাকেই জাগে, — গোধুলিতে তারা বৃক্ষাবাসে ফিরিয়া আসিতেই তাদের কলকাকলির সঙ্গে সঙ্গে সেই শান্তির সুরে সুর মিলাইয়া তার তুলসীতলার সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলিয়া ওঠে, দক্ষিণের হাওয়ায় উত্তরের বাঁশ শিরশির করে, পশ্চিমে তার প্রতিধ্বনি জাগে, সুচিক্কণ শ্যামল দোলের অন্ত থাকে না, কিন্তু এই এতো বড়ো কাণ্ডটার প্রতি রতির দৃকপাতও নাই—তার চোখ-কান এ-সব দেখিতে শুনিতে শেখে নাই। সে যে চাকরান জমি ভোগ করে তাহাই তার একমাত্র ধ্যান, রতি বস্তুতান্ত্রিক।
একগুঁয়ে কোপনস্বভাব না হইলে রতিকে মন্দ লোক বলা যাইতো না; এবং রতির বাড়ির পশ্চিমে যে বাগান তাহার মালিক যাদব দাস আম-কাঁঠাল সম্বন্ধে তাহাকে যে সন্দেহের চক্ষে দেখে তাহা যদি অমূলকজ্ঞানে বিশ্বাস না করা যায়, তবে রতি নিষ্কলঙ্ক চরিত্র। কিন্তু লোকে সে কথা বিশ্বাস করে। দু-ক্রোশ দূরবর্তী রামচন্দ্রপুরের হাটে রতিকে গ্রামের ইতর-ভদ্র অনেকেই আম-কাঁঠালের কালে আম-কাঁঠাল বিক্রয় করিতে দেখিয়াছে; কিন্তু আশ্চর্য এই যে, তাহা আহরণের উপায় সম্বন্ধে রতিকে সতর্ক প্রশ্ন করিয়াও তাহারা খুব সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই।

রতির একটি মাত্র ছেলে, নাম পাঁচু ও বয়স পাঁচ। রতির স্ত্রী নারানী তিনটি পুত্রকে প্রসবগৃহ হইতে নদীগর্ভে নিক্ষেপ করিয়া পাঁচুগোপালের মাদুলি ধারণ করে—তারপর পেটে আসে এই পাঁচু। তাই অসংখ্য মাদুলি-কবচ-তাবিজ প্রভৃতি আধিদৈবিক প্রহরণ পাঁচুর অঙ্গে নিয়ত উদ্যত থাকিয়া যাবতীয় অমঙ্গলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রহরা দিতেছে। কিন্তু এত করিয়াও নারানীর মনে তিলমাত্র স্বস্তি নাই। যুঝিতে-যুঝিতে জাগ্রত মন্ত্র কখন নিদ্রাভিভূত হইয়া পড়িবে তাহার স্থিরতা নাই; দেবতার নির্মাল্য ও প্রসাদ এক সময় কমজোর হইয়া পড়িতেও পারে–তাই পাঁচু চোখের আড়াল হইলেই নারানীর মনে হয় পাঁচু বুঝি নাই— এমনি সশঙ্ক তার উৎকণ্ঠা।
বহু আরাধনার ধন এই পাঁচু একদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়াই যে-কথাটি বলিয়া বসিলো তাহা যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনি অবিশ্বাস্য। নারানী তাহাকে হাত ধরিয়া খেতের দিকে লইয়া যাইতেছিল— নিঃশব্দে যাইতে যাইতে পাঁচু মায়ের মুখের দিকে মুখ তুলিয়া বলিলো, ‘মা, আজ আমায় কুমিরে নেবে।’
নারানী চমকাইয়া উঠিয়া বলিলো, ‘সে কি রে?’
‘হ্যাঁ, মা, আজ আমায় কুমিরে নেবে।’
‘কী ক’রে জানলি?’
পাঁচু বলিলো, ‘তা জানিনে।’
ছেলের সর্বনেশে কথা শুনিয়া নারানী প্রথমটা ভয়ানক চমকাইয়া উঠিলেও একটু ভাবিতেই দুর্ভাবনা কাটিয়া তাহার বুক হাল্কা হইয়া গেলো। পাঁচু অসংলগ্ন অনেক কথাই আজ পর্যন্ত বলিয়াছে;— একদিন পাঁচু সন্ধ্যাবেলায় একটি পেচককে তাদের ঘরের চালে বসিয়া অট্টহাস্য করিতে দেখিয়াছিল; আর-একদিন একটি বৃহৎ কচ্ছপকে বাচ্চাসহ তাহাদেরই উঠানে দাঁড়াইয়া নৃত্য করিতে দেখিয়াছিল। এমনই সব অসম্ভব কথা পাঁচু নিত্য বলিয়া থাকে, পাগল ছেলে!
রতি স্ত্রীর মুখে পাঁচুর উক্তি শুনিয়া পাঁচুকেই চোখ রাঙাইয়া ধমকাইয়া দিলো। এই সংশ্রবে তাহার মনে পড়িয়া গেলো তাদেরই গ্রামের মৃত অধর বকশির কথাটা। অধর বকশি সে-বার নৌকা যাত্রা করিবার ঠিক পূর্বদিন সন্ধ্যাবেলায় আবছায়া জ্যোস্নায় নিজেরই ছায়া দেখিয়া আঁৎকাইয়া উঠিয়াছিল,— প্রাঙ্গণে লাফাইয়া লাফাইয়া সে নিজেরই ছায়ার দিকে আঙুল দেখাইয়া ভীতস্বরে কেবলই চিৎকার করিয়াছিল— ও কে? ও কে ? …সে-দিন তার রক্তবর্ণ নিস্পলক চক্ষুর দিকে ভালো করিয়া চাহিয়া থাকিতে কাহারও সাহস হয় নাই। বহু চেষ্টায় সেদিনকার মতো আতঙ্কের নিবৃত্তি হইয়া সে নিরস্ত হইয়াছিল বটে, কিন্তু তার নৌকা আর ফেরে নাই, সে-ও না। জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তি সে-দিন রতিকে ডাকিয়া বলিয়াছিল।— ‘রতি, রকম ভালো নয়, এটা মৃত্যুর লক্ষণ; এ-রকম মনের ভুল হয় পাগলের কিংবা যার মরণ ঘনিয়েছে।’
কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য হইয়াছিল।
তাই রতি ছেলেকে কঠোর কণ্ঠে শাসন করিয়া দিলো, ‘খবরদার, ফের যদি ও-কথা মুখে আনবি তবে কাঁচা কঞ্চি তোর পিঠে ভাঙবো।’

তখন আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগ—নদী বাড়িয়া চড়া ডুবাইয়া জল খাড়া পাড়ের মৃত্তিকা ছল ছল শব্দে লেহন করিতেছে; স্বচ্ছ শান্ত জল পঙ্কিল ও খরগতি হইয়া উঠিয়াছে; তবু ভয়ের কোনো কারণ নাই।—এই নদী, কামদা, তার দুই তীর, আর তার জল তাহাদের চিরপরিচিত; এ নদী তো নরঘাতিনী রাক্ষসী নহে, স্তন্যদায়িনী জননীর মতো মমতাময়ী — চিরদিন সে গিরিগৃহের সুপেয় শীতল নীর তাদের পল্লি-কুটিরের দুয়ার পর্যন্ত বহিয়া আনিয়া দিতেছে। তাকে ভয় নাই।
স্নানের বেলায় রতি পাঁচুকে ডাকিয়া বলিলো, ‘আয়,
নেয়ে আসি।’
কাঁচা কঞ্চির ভয়ে পাঁচু সেখানে কোনো প্রতিবাদ না করিয়া মায়ের কাছে গেলো; মায়ের পিঠের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই হাতে তার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিলো, ‘আমি আজ নাইবো না, মা।’
‘কেন রে?’
‘ভয় করছে।’
নারানী ছেলেকে কোলে করিয়া ঘরের বাহিরে আসিয়া বলিলো, ‘পাঁচু নাইবে না আজ।’
রতি ভ্রুভঙ্গি করিয়া বলিলো, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘হয়নি কিছু।’
‘তবে ?’
‘নাইতে চাইছে না, থাক না আজ।’
রতি আরো শক্ত হইয়া বলিলো, ‘না, ওর ভুলটা ভাঙা দরকার। বাবুকে বললুম, শুনে তিনি হাসতে লাগলেন। তিনি তো হাসলেনই, আরো কতোজনে হাসলে।’

গ্রামের বাবু চৌধুরী মহাশয়ের সম্মুখে বসিয়া চামড়ায় ক্ষুর ঘষিতে-ঘষিতে রতি পাঁচুগোপালের উদ্ভট উক্তিটা বিবৃত করিয়াছিল। শুনিয়া বাবু নিজে তো হাসিয়াছিলেনই, উপস্থিত অপরাপর সকলেও হাস্যসংবরণ করিতে পারে নাই। কামদায় কুমির? ইহা অপেক্ষা হাস্যকর উক্তি আর কী হইতে পারে! চৌধুরী বাবু বলিয়াছিলেন, ‘না কিছু না, তুই সঙ্গে ক’রে নাইয়ে নিয়ে আসিস; কুমিরে যদি নেয় তো তোকেই নেবে—‘
রসিক পোদ্দার বাবুর মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলিয়াছিল, ‘বাবু বলেছেন ঠিক, যাতে তার খোরাক হবে।’
হলধর রাজবংশীবাবুর সম্মুখ হইতে দূরে সরিয়া কলিকা টানিতেছিল; সে একগাল ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিয়াছিল, ‘রতি, তুই বাবুর আশ্রয়ে থেকেও এমন অজ্ঞ? তাতে আবার জেতে নাপিত!’
ইত্যাদি বিরক্তিকর বিদ্রুপে মনে মনে রুখিয়া উঠিয়া এবং অধর বকশির এই শ্রেণীর ভুলের দরুণ সদ্য-সদ্য নিধন প্রাপ্তির কথাটা স্মরণ করিয়া, পাঁচুকে আজ নদীতে লইতেই হইবে সংকল্প করিয়া রতি বাড়ি আসিয়াছিল।
নারানী পাঁচুকে বলিলো, ‘যাও, বাবা, নেয়ে এসো। সঙ্গে বড়ো একটা মানুষ যাচ্ছে—ভয় কিসের?’ বলিয়া সস্নেহে মুখচুম্বন করিয়া পাঁচুকে নামাইয়া দিলো। মনে মনে তাহার সহস্র বৎসর পরমায়ু কামনা করিলো।
অন্যদিন তেল মাখিবার সময় পাঁচু ছটফট করিতো, আজ সে দাঁড়াইয়া নির্বিবাদে তেল মাখিলো, এবং বাপের গামছাখানা হাতে করিয়া তার পিছন-পিছন ঘাটে আসিলো।
স্নানার্থিগণের উঠা-নামার সুবিধার জন্য পাড় কাটিয়া জল পর্যন্ত ঢালু করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
জলের ধার পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া রতি থমকিয়া দাঁড়াইল—তার কেমন ভয়-ভয় করিতে লাগিলো।

নিস্তরঙ্গ বিস্তীর্ণ আবিল জলরাশি যেন ভয়ঙ্কর নিঃশব্দে মধ্যহ্ন রৌদ্রে শাণিত অস্ত্রের মতো ঝকঝক করিতেছে। …দুর্লঙ্ঘ্য তীব্র স্রোত ছুটিয়া চলিয়াছে—এতো বড়ো একটা গতিবেগ, অথচ তার শব্দ নাই, অবয়ব নাই, ভালো করিয়া সে যেন চোখে পড়ে না; যেন গঙ্গাধরের সমস্ত দুঃশাসিত নির্মম শক্তি এই নিঃশব্দ গম্ভীর গতির অনির্দেশ্য বহিরাবয়ব ব্যাপিয়া স্তম্ভিত হইয়া আছে।—এমন নিদারুণ নিষ্করুণ রূপ লইয়া এই প্রিয় নদীটি আর কোনোদিন তার চোখে পড়ে নাই। ইহার বাহিরটাই আজ এমন ভয়াবহ, না জানি ইহার দুর্নিরীক্ষ্য অতল গর্ভে কতো হিংসা দংষ্ট্রা মেলিয়া ফিরিতেছে! …রতি শিহরিয়া উঠিলো। শঙ্কিত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে সম্মুখে দক্ষিণে ও বামে বহুদূর পর্যন্ত চাহিয়া দেখিলো—নদীর নিষ্কম্প বক্ষে একটি বুদবুদও কোথাও নাই। …ঠিক সম্মুখে ওপারের বালুচর দুটি গ্রামের বনপ্রান্তের মধ্য দিয়া বহিয়া বহুদূরে গিয়া দিক-প্রান্তে মিশিয়াছে—সন্ধিস্থলটা ধুম্রপূসর দীর্ঘ একটা রেখার মতোন! প্রসারিত বালুকারাশির নগ্ন রিক্ত শুভ্রতাকে সবুজ বুটিতে সাজাইয়া দূর-দুরান্তে স্থানে-স্থানে তৃণস্তুপ জন্মিয়াছে। —নদীর দুই তীর নির্জন, নিঃশব্দ। রতি ভাবিতে লাগিলো।…
পাঁচু হঠাৎ সভয়ে একটা চিৎকার করিয়া ছুটিয়া আসিয়া দুই হাতে রতিকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলো, ‘ওটা কী ?’
পাঁচুর ভয়ের কারণটাকে রতিও দেখিয়াছিল—একটা জলচর কদাকার জানোয়ার হুশ করিয়া ভাসিয়া উঠিয়াই ডিগবাজি খাইয়া তলাইয়া গিয়াছিল।
পাঁচুর ভয় দেখিয়া রতি হাসিয়া বলিলো, ‘শুশুক, মাছ তাড়া করেছে।’
পাঁচু জিজ্ঞাসা করিলো, ‘কেন, বাবা?’
‘খাবে ব’লে’। ওরা বড়ো রুই-কাৎলা মারিয়া খায় শুনিয়া পাঁচুর বিশ্বয়ের সীমা রহিলো না—জলের ভিতর তো অন্ধকার, কেমন করিয়া খুঁজিয়া পায়?
– এই ক্ষুদ্র ঘটনায় এবং একটু হাসিতে পাইয়া রতির ভয়ে অভিভূত ভাবটা কাটিয়া গেলো। তখন তাহার মনে পড়িলো, কামদায় কুমির ভাসিতে এ-গ্রামের কেহ কখনো দেখে নাই, এমন কি সুদূরের জনশ্রুতি আসিয়াও এ-গ্রামের কানে কখনও পৌঁছায় নাই। তবে ভয় কিসের ?
ঝপ করিয়া পাছে গভীর জলে পড়িতে হয়, এই ভয়ে অতি সন্তর্পণে পা বাড়াইয়া রতি হাঁটুজলে নামিলো; পাঁচুকে হাঁটুর কাছে টানিয়া লইলো এবং একহাতে তার ডানা ধরিয়া অন্য হাতে তার গা মাজিয়া দিলো, দুই ডানা ধরিয়া তাহাকে ডুব দেওয়াইলো, তারপর উপরে তুলিয়া গা-মাথা মুছিয়া দিয়া পাঁচুকে বাড়ি পাঠাইয়া দিলো।

রতি আসিয়া হাসিতে-হাসিতে বলিলো, ‘পাঁচু কই রে?’ রান্নাঘরের ভিতর হইতে ভারি গলায় পাঁচু বলিলো, ‘খাচ্চি, বাবা।’
‘কেমন কুমিরে নেয়নি তো?’
মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া পাঁচুও হাসিতে-হাসিতে বলিলো, ‘না’।
নারানী বলিলো, ‘ছেলের আমার এতোক্ষণে হাসি ফুটেছে।’
সেইদিন বিকালে ঘুম ভাঙিয়া নারানী বারান্দায় আসিতেই তাহাকে দেখিয়া পাঁচুরই সমবয়সী অনেকগুলি ছেলে-মেয়ে বিদ্যুদ্বেগে অদৃশ্য হইয়া গেলো। তাহাদের এই অকস্মাৎ পলায়নের হেতু নির্ণয় করিতে আসিয়া যে-ব্যাপারের ভগ্নাবশেষ নারানীর চোখে পড়িলো তাহার তুলনা বুঝি কোথাও নাই। নারানী গালে হাত দিয়া একেবারে থ’ হইয়া গেলো। হাঁকিলো, ‘পাঁচু?’
পাঁচুর সঙ্গীরা বোধহয় এক দৌড়ে বাড়ি যাইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু পাঁচু তাহদের দেখাদেখি ছুটিতে আরম্ভ করিলেও বাড়ির সীমানার বাহিরে যাইতে পারে নাই। মায়ের ডাক শুনিয়া সে রান্নাঘরের আড়াল হইতে বাহির হইয়া অত্যন্ত জড়োসড়োভাবে আসিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইলো। ছেলের মূর্তি দেখিয়া নারানীর ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিয়া উঠিলো।
ব্যাপার এই—
নারানী যখন ঘুমাইতেছিল তখন পাঁচু ও তার সঙ্গীরা ঘরে রাখা ছোটো একটা পাকা কাঁঠাল চুরি করিয়া ভাঙিয়া খাইয়াছে, কিন্তু কাঁঠাল ভাঙিয়া খাইবার ঠিক পদ্ধতিটা জানা না থাকায় ছেলে কাঁঠালের গাঢ়রসে সর্বদেহ আপ্লুত করিয়া ফেলিয়াছে—তাহার উপর আনন্দের আবেগে উঠানের ধুলায় গড়াগড়িও দিয়াছে; কাজেই ছেলের মূর্তি দেখিয়া মায়ের ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিয়া উঠিবারই কথা।
অপরাধীগণের মধ্যে পাঁচুই একা ধরা পড়িয়া মায়ের রুষ্ট চক্ষুর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াই কাঁদিয়া ফেলিলো।
পাঁচু মার খাইতে খাইতে বাঁচিয়া গেলো— এতো বেলা পর্যন্ত সে যে বড়ো ত্রাসের ক্লেশ সহ্য করিয়াছে; কিন্তু তার অকারণ আর্তনাদের এবং নারানীর ক্রুদ্ধ চিৎকারে রতির ঘুম ভাঙিয়া গেলো। সে বাহিরে আসিয়া গা-মোড়া দিয়া বলিলো, যেমন ছেলের গলা তেমনি তার-হয়েছে কী ?
নারানী বলিলো, হয়েছে আমার শ্রাদ্ধ, চুরি করে কাঁঠাল খাওয়া হয়েছে। ছেলের বিদ্যে কতো!—বলিয়া সে এমনিভাবে রতির দিকে চাহিলো যেন চুরি করিয়া কাঁঠাল খাওয়াটা পুরুষজাতির মধ্যে অত্যন্ত ব্যাপক। রতি ভ্রুভঙ্গি করিয়া বলিলো, থামো, আর চেঁচিও না। আমি গিয়ে ধুইয়ে আনছি, তা হলে তো হবে? বলিয়া সে উঠানে নামিলো। পাঁচুর হাতে খেলার একটা ঘট ছিলো— সেইটি হাতে করিয়া অপরাধী পাঁচু চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে বাপের আগে আগে নদীর দিকে চলিল। রতি তাহাকে জলে ফেলিয়া বেশ করিয়া রগড়াইয়া ধুইয়া তুলিয়া আনিলো। খানিকটা দূর উঠিয়া আসিয়া পাঁচু হঠাৎ থামিয়া বলিয়া উঠিলো, ‘বাবা আমার ঘট!’
উভয়েই ফিরিয়া দেখিলো, জলের ধারেই ঘট পড়িয়া আছে।
রতি বলিলো, ‘যা।’
পাঁচু হেঁট হইয়া ঘট তুলিয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়াছে, এমন সময় তাহারই একান্ত সন্নিকটে দুটি সুবৃহৎ চক্ষু নিঃশব্দে জলের উপর ভাসিয়া উঠিলো; পরমুহুর্তেই সে-স্থানের জল আলোড়িত হইয়া উঠিলো, লেজটা একবার চমক দিয়া বিদ্যুদ্বেগে ঘুরিয়া গেলে- এবং চক্ষের পলক না পড়িতেই পাঁচু জলে পড়িয়া অদৃশ্য হইয়া গেলো। মুদিতচক্ষু আড়ষ্টজিহ্বা ভয়ার্ত রতির স্তম্ভিত বিমূঢ় ভাবটা কাটিতে বেশি সময় লাগিলে না পরক্ষণেই তাহার মুহুর্মুহু তীব্র আর্তনাদে দেখিতে দেখিতে নদীতীর জনাকীর্ণ হইয়া উঠিলো।
যখন ওপারের কাছাকাছি পাঁচুকে পুনর্বার দেখা গেলো তখন সে কুম্ভীরের মুখে, নিশ্চল। জনতা হায় হায় করিয়া উঠিলো, পাঁচুর মৃত্যু-পাণ্ডুর মুখের উপর সূর্যের শেষ রক্তরশ্মি জ্বলিতে লাগিলো, সূর্যকে ভক্ষ্য নিবেদন করিয়া লইয়া কুম্ভীর পুনরায় অদৃশ্য হইয়া গেলো।
কেবল পাঁচুর মা সে-দৃশ্য দেখিলো না। সে তখন মূর্চ্ছিতা।
(বানান অপরিবর্তিত)
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia
জগদীশ গুপ্ত বাংলাভাষার এক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। লিখেছেন বিজলী, কালিকলম, কল্লোল প্রভৃতি পত্রিকায়। তাঁর পরিচিতি বাংলা সাহিত্যে অন্যধারার গল্পলেখক হিসাবে। জন্ম ব্রিটিশ ভারতের কুষ্টিয়ায়।
সাহিত্যজীবন শুরু কবি হিসাবে। তাঁর সাহিত্যে ধরা পড়েছে মানুষের কদর্য অবচেতন ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।