আমরা তখন মালদায় থাকি; বাবা মালদা এবং অবিভক্ত পশ্চিম দিনাজপুরের চার্জে ছিলেন বলে প্রায়ই মালদা ছেড়ে বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর যেতে হত। মালদায়, আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন কলফিল্ড সাহেব। এককালে বেঙ্গল স্যাপার্সে মেজর ছিলেন। স্বাধীনতার পরেও এদেশেই থেকে যান। বহুদিন হল মিলিটারির কমিশন শেষ করে বিভিন্ন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্টে কনট্র্যাক্টে কাজ করতেন। লোকে বলত, ওঁর যা ছিটিয়াল মারকুটে স্বভাব, ইংরেজরা নাকি যাওয়ার আগে দেশভাগের সময়ে বলেছিল, “ওঁকে যদি তোমরা রেখে নাও, তাহলে মালদা জেলা পূর্ব পাকিস্তানে না ফেলে তোমাদের দিকে করে দেব।” এখানে বলে রাখি, মালদা জেলা ভারতের দখলে আসে স্বাধীনতার দুদিন পর, সতেরোই আগস্ট।
আমি ওঁকে ডাকতাম কলফিল্ড আংকল বলে। সত্তর বছর বয়সেও হাট্টাকাট্টা জোয়ান চেহারা। শিকারের ভীষণ শখ। যতদিন আইনি বাধা আসেনি, চুটিয়ে শিকার করেছেন। এখনও মাঝে মাঝে হাঁস শিকারে যান। জানুয়ারি থেকে মার্চ, ফরেস্ট অফিস থেকে পারমিট করিয়ে বুনো হাঁস শিকারে যেত কেউ কেউ। আমাদের বাড়ির গার্ড ডিউটি দিত দ্বিজেনদা, সেও তুখোড় শিকারী। ওরা অবশ্য স্থানীয় গ্রামের মানুষ, পারমিটের ধার ধারত না। চুপচাপ শিকার করে নিয়ে চলে আসত— আজকের দিনে হয়তো পোচিং বলা হবে। বাইরে বাগানে কাঠের উনুন জ্বেলে, একরাশ নক্ষত্র ভরা আকাশের নীচে বসে, বেশ অনেকটা পেঁয়াজ রসুন দিয়ে রান্না হত সেই হাঁসের মাংস।
সেবার দোলের আগে ছোটমামা এসেছিলেন মালদায় বেড়াতে। কদিন ধরে আমরা গৌড়, পান্ডুয়া ইত্যাদি ঘুরে দেখলাম। একদিন চায়ের টেবিলে বসে আলোচনা হচ্ছিল, আর কোথায় যাওয়া যায়। এমন সময় কলফিল্ড সাহেব এসে বললেন, “মিস্টার বোস, লেটস প্ল্যান অ্যান আউটিং অ্যাট দ্য কুলিক ভ্যালি। এই সময় পাখিতে পাখিতে ভরে যায় জায়গাটা। অ্যান্ড টেক ইয়োর রেমিংটন উইথ ইউ, উইল ইউ? ভালো শিকার পাব।”
বাবা বললেন, “কুলিক? সে তো স্যাংচুয়ারি! সেখানে শিকার?”
সত্তর বছর বয়সেও হাট্টাকাট্টা জোয়ান চেহারা। শিকারের ভীষণ শখ। যতদিন আইনি বাধা আসেনি, চুটিয়ে শিকার করেছেন। এখনও মাঝে মাঝে হাঁস শিকারে যান। জানুয়ারি থেকে মার্চ, ফরেস্ট অফিস থেকে পারমিট করিয়ে বুনো হাঁস শিকারে যেত কেউ কেউ। আমাদের বাড়ির গার্ড ডিউটি দিত দ্বিজেনদা, সেও তুখোড় শিকারী। ওরা অবশ্য স্থানীয় গ্রামের মানুষ, পারমিটের ধার ধারত না।
উনি তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে বললেন, “আহা, শিকার ওখানে করব না, পাগল নাকি? লেট এভরিওয়ান এলস এনজয় অ্যাট দ্য বার্ড স্যাংচুয়ারি। আমরা যাব জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা ঝিলের ধারে। হান্টিং পারমিট করিয়ে নিয়েছি।”

সেদিন বিকেলে বাবা টাউন ক্লাবে কলিগ ও অন্যান্য পরিচিতদের মধ্যে যখন আউটিংয়ের কথাটা পাড়লেন, অনেকে হৈ হৈ করে উঠেই আবার চুপসে গেল। ডক্টর রায় বললেন, “মিস্টার বোস, হি ইজ আ ফ্যান্টাস্টিক হান্টার, সন্দেহ নেই, কিন্তু রেগে গেলে মানুষও খুন করতে পারে। তবে আপনি থাকলে আমরা সাহস করে যেতে পারি। অন্তত বার্ড স্যাংচুয়ারি তো যাবই।” কলফিল্ডকে সবাই জানে যে তিনি বদরাগী। তাঁর এই স্বভাবের জন্য অনেকেই তাঁকে এড়িয়ে চলে। বাবা নির্বিবাদী মানুষ, তাই ওঁর সঙ্গে স্বচ্ছন্দেই মিশতে পারেন। আর তাছাড়া আংকল আমাকে খুবই স্নেহ করেন। উনি বাড়ি এলেই, একটা ক্যাডবেরি আর একটা টিনটিন, আমার জন্য বরাদ্দ। বাবা কত বারণ করতেন, উনি শুনতেন না।
যাই হোক, দোলের দিন সক্কালবেলা আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডে মালপত্র চাপিয়ে রওয়ানা দিলাম। কলফিল্ড তাঁর উইলিস জিপে দ্বিজেনদাকে, আর বাবার অফিসের দীনবন্ধুদাকে তুলে নিলেন। আরও কয়েকটা ফ্যামিলি চলল সঙ্গে। রায়গঞ্জ থেকেও বাবার কিছু কলিগ ফ্যামিলি নিয়ে আসবেন কথা ছিল। সারা রাস্তা ঝুলি, আমার বোন বকবক করতে করতে গেল— “হাঁসগুলো কি রাজহাঁস?” যত বলি, “আরে! বুনো হাঁস!”… বোঝেই না কথা!
কলফিল্ডকে সবাই জানে যে তিনি বদরাগী। তাঁর এই স্বভাবের জন্য অনেকেই তাঁকে এড়িয়ে চলে। বাবা নির্বিবাদী মানুষ, তাই ওঁর সঙ্গে স্বচ্ছন্দেই মিশতে পারেন। আর তাছাড়া আংকল আমাকে খুবই স্নেহ করেন। উনি বাড়ি এলেই, একটা ক্যাডবেরি আর একটা টিনটিন, আমার জন্য বরাদ্দ। বাবা কত বারণ করতেন, উনি শুনতেন না।
আমাদের অবশ্য ফরেস্ট বাংলোয় না গিয়ে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের একটা বাংলোয় থাকা ঠিক হয়েছিল। এখানে অন্য কোনও ট্যুরিস্ট নেই। হাইওয়ে থেকে একটু নেমে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা গিয়ে, কুলিক নদীর ধারে বাংলোটা। আশেপাশে আর কিচ্ছুটি নেই।
ছোট্ট নদী কুলিক, একটা হাওয়া-ভরা গাড়ির চাকার টিউব নিয়েই এপার ওপার করা যায়। আর চারিদিকের জঙ্গলে পাখির মেলা। সেইদিন সকালে পৌঁছে, অল্প আবির খেলে, নদীতে চান করে, দুপুরে চড়ুইভাতি করে, সবাই মিলে হৈ হুল্লোড় করে সময়টা দারুণ কেটে গেল। রাত্রে চাঁদের আলোয় বাংলোর বারান্দায় বসে, দীনবন্ধুদার হাতের ফাউল কারি আর পরোটা। উঃ, এখনও জিভে জল এসে যায়!

পরদিন ভোর হওয়ার অনেক আগে, ঘুমচোখে আমি, কলফিল্ড আংকল, বাবা আর দ্বিজেনদা বেরিয়ে পড়লাম। আর কেউ যাচ্ছেন না। বাকিরা বেলা বাড়লে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গেস্ট হাউসে গিয়ে ওখান থেকে কুলিক বার্ড স্যাংচুয়ারি ঘুরে দেখবেন। আমাদের পিঠে রাকস্যাকে জলখাবার আছে, ফ্লাস্ক ভরা চা আছে। আংকলের হাতে একটা বেরেটা সিলভার পিজন, আর বাবা নিয়েছেন দাদুর পুরনো রেমিংটনটা। পূর্ণিমার চাঁদ তখনও অস্ত যায়নি। জঙ্গলে ঝিঁঝিঁর ডাক আর জোনাকির আলো, হাওয়ায় একটা হালকা শিরশিরানি ভাব। প্রায় মাইল তিনেক হাঁটতে হবে, অন্তত ঘণ্টাখানেকের পথ। সকলেই চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম, মাঝে মাঝে দু চারটে কথা হচ্ছে।
খেয়ালি নদী কুলিক। কালের প্রবাহে নিজের গতিপথ পাল্টেছে বার বার। তারই জন্য এদিক ওদিক বেশ কিছু হর্স শ্যু লেকের সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখি এখানে এসে প্রতি বছর আস্তানা গাড়ে। যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেখানে নাকি এবার স্নাইপ নামে একজাতীয় জলার পাখি এসেছে বেশ কয়েক ঝাঁক।
এক সময় কলফিল্ড বললেন, “রাইট অ্যাবাউট দেয়ার।” এই অঞ্চলে লক্ষ করলাম, গাছপালা কম, বেশিরভাগই কাঁটাঝোপের জঙ্গল। জায়গাটা কেমন যেন নিস্তব্ধ। একটু এগোতেই একটা জলাভূমি চোখে পড়ল, সেখানে ঘন হয়ে আছে নলখাগড়ার বন। আর কিছু অযত্নে বেড়ে ওঠা পাটগাছের জঙ্গল। জলের ওপর একটা মিহি কুয়াশায় ঢাকা। হাওয়ায় সোঁদা সোঁদা গন্ধ, কেমন একটা থমথমে গুমোট ভাব ভারী হয়ে বুকের ওপর চেপে বসছে। খুবই ডিপ্রেসিং। মোটেই পছন্দ হল না আমার। জলার ওই পারে একটু নজর করতে ঠাহর করলাম, একটা ফাঁকা জায়গা ঘিরে বেশ কয়েকটা বটগাছ, একটা ছোট্ট মতন মন্দির, আর কয়েকটা খড়ের চালা দিয়ে ঢাকা খোলা চাতাল। দ্বিজেনদা বলল, “শ্মশান ঘাট।”
আমাদের পিঠে রাকস্যাকে জলখাবার আছে, ফ্লাস্ক ভরা চা আছে। আংকলের হাতে একটা বেরেটা সিলভার পিজন, আর বাবা নিয়েছেন দাদুর পুরনো রেমিংটনটা। পূর্ণিমার চাঁদ তখনও অস্ত যায়নি। জঙ্গলে ঝিঁঝিঁর ডাক আর জোনাকির আলো, হাওয়ায় একটা হালকা শিরশিরানি ভাব। প্রায় মাইল তিনেক হাঁটতে হবে, অন্তত ঘণ্টাখানেকের পথ। সকলেই চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম, মাঝে মাঝে দু চারটে কথা হচ্ছে।
আমার মনটা একটু দমে গেলেও আংকল খুব খুশি। বললেন, “জায়গাটা দারুণ না! এবার জমিয়ে শিকার করা যাবে। চলুন মিস্টার বোস, তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্টটা সেরে নিই।” জলখাবার সারতে সারতেই মেঘের ফাঁক দিয়ে সকালের সূর্য উঁকি মারলো, কুয়াশার ঘেরাটোপ ধীরে ধীরে হালকা হতে লাগল আর জলার ওপর পাখিদের দাপাদাপি শুরু হল।
সকলে মিলে এগিয়ে চললাম শিকারের সন্ধানে। কিন্তু কপাল খারাপ! আংকলের বন্দুক চলল বেশ কয়েকবার, বাবারও চলল। বাবা খানিক পর বন্দুকটা দ্বিজেনদাকে দিলেন, সেও নিশানা লাগালো। কিন্তু, শিকার যে অধরা সেই অধরাই রইল। কেউ যেন পাখিগুলোকে ভয় পাইয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। এই দেখি পাখিগুলো দিব্যি জলের ওপর চড়ে বেড়াচ্ছে, একেবারে নাগালের মধ্যে… বাবারা তাক করছেন, বন্দুকের ঘোড়া টেনে যেই না ট্রিগার টিপতে যাবেন, অমনি কী একটা খ্যাসখ্যাসে আওয়াজ পেয়ে পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে সারা সকাল ধরে জলাজঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোই সার হল।

দুপুরে ক্লান্ত হয়ে একটা গাছতলায় সবাই মিলে বসে লাঞ্চ সেরে নিলাম। শসার স্যান্ডুইচ আর চিকেন কাটলেট ছিল সঙ্গে। কলফিল্ড গোমড়া হয়ে খেয়ে গেলেন, হুঁ হাঁ ছাড়া বিশেষ কিছু বললেন না। ওঁর ধারণা কেউ ইচ্ছে করেই আমাদের শিকার নষ্ট করছে। খাওয়া শেষ করে সকলে বিশ্রাম নিচ্ছে, আমি আনমনে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি, বাবা কার্তুজের খালি খোলগুলো আলাদা করে একটা থলিতে ভরে রাকস্যাকের নীচের দিকে ঢুকিয়ে রাখছেন, দ্বিজেনদা একটু আড়ালে গেছে, বোধহয় বিড়ি খেতে— এমন সময় ঘটনাটা ঘটল।
একটা আধবুড়ো ভিখিরি গোছের লোক কোত্থেকে এসে “বাবু,বাবু” করে একটা চিমসে মতন হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল। লোকটার অদ্ভুত চেহারা, কোমরের কাছে একটা গামছার মতন জড়ানো, হাতে লম্বা একটা ছড়ির মতন। কিন্তু মুখের ভাব কী ভীষণ হিংস্র! ঠিক যেন শেয়ালের মতন সরু মুখে দুটো শ্বাপদের মতন চোখ ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। দেখে আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কলফিল্ড এতক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে ছিলেন, হঠাৎ লোকটাকে দেখে পাগলা বাইসনের মতন রে রে করে তেড়ে গেলেন। বললেন, “ব্যাটা,শুয়ার কা বাচ্চা, আমার পাখি উড়িয়ে দিয়ে এখন মজা দেখতে এসেছ!” বাবা, “আরেহ, আরেহ, করেন কী, করেন কী…”, বলতে বলতেই কলফিল্ড দৌড়ে গিয়ে লোকটার মুখে এক ঘুসি বসিয়ে দিয়েছেন। লোকটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি। দ্বিজেনদা গোলমাল শুনে ছুটে এসেছে। বাবা আর দ্বিজেনদা কোনোরকমে কলফিল্ডকে ধরে আটকে রেখেছে, বাবা বলছেন, “আরে, শান্ত হোন। দ্বিজেন, জলের ফ্লাস্কটা দাও তো।” আমি দেখলাম, লোকটা ধীরে ধীরে উঠে বসে এক পা এক পা করে চলে গেল। যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা হাসি দিয়ে গাছের আড়ালে মিলিয়ে গেল। কী বিভৎস সেই হাসি! সরু লম্বা মতন মুখে, দুটো শ্বদন্ত বের করে, রক্ত জল করা নিঃশব্দ এক হাসি।
স্বভাবতই এই ঘটনার পর আমরা সকলেই একটু বিচলিত। তখনকার মতো বাংলোতে ফিরে আসাই স্থির হল।

বিকেলে বাকি সকলে ফিরে এলেন বার্ড স্যাংচুয়ারি ঘুরে। সবার সঙ্গে চা খেতে খেতে কলফিল্ড আবার সেই খোশ মেজাজ ফিরে পেলেন। উনি ঠিক করলেন, সন্ধেবেলায় আবার যাবেন শিকারে। বললেন, “সানসেট ইজ আ বিউটিফুল টাইম ফর আ হান্ট মিস্টার বোস, হোয়েন দ্য বার্ডস আর কামিং ব্যাক টু রুস্ট।” কিন্তু আমাদের তো অন্য প্ল্যান। আমি তখন কার্শিয়াং-এ বোর্ডিঙে থেকে পড়ি। আমার ইস্কুলের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। ঠিক হয়েছিল যে, কুলিক থেকেই পরদিন বেরিয়ে বাবা মা আমাকে কার্শিয়াং-এ রেখে, ছোটমামাকে নিয়ে দার্জিলিং চলে যাবে। খুব সকালেই বেরোব আমরা, গাড়িতে প্রায় সাত আট ঘণ্টার রাস্তা। তাই বাবা আর গেলেন না। বিকেলের চা খেয়ে কলফিল্ড আংকল বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে গেল দ্বিজেনদা আর দীনবন্ধুদা।
আমি কার্শিয়াং-এ পৌঁছে স্কুলের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নতুন ক্লাসে আবার নতুন বছর শুরু করলাম। আবার ভোরবেলায় উঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা, বিকেলে ক্রিকেট খেলা… তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি মেঘের দল বল পাকিয়ে কেমন পাহাড়ের কোলে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসে, পাইন গাছের কাঁটা থেকে টুপ্ টুপ্ জল ঝরে পড়ে নীচে ফার্নের গায়ে, ভিজে শ্যাওলার গন্ধ ছাড়ে, জঙ্গলের ভেতর লোকচক্ষুর অন্তরালে সাদা অর্কিড ফুটে ওঠে। এভাবেই দিন যায়, মাস যায়…
সেবার সামার ভ্যাকেশনে আমার আর বাড়ি যাওয়া হল না। বাবা বললেন, “আমরাই আসছি, তারপর সবাই মিলে ওখান থেকে সিকিম যাব।” দেখা হতেই ঝুলি বলল, “জানিস তো, আমাদের ওখানে অনেক শেয়াল এসেছে, সন্ধে হলেই হুক্কা হু আ করে!” শুনেছিলাম মহানন্দার ওপারের গ্রামগুলোয় শেয়াল বেরোয়, কিন্তু মালদা শহরে শেয়াল বেরোনো অভাবনীয় ব্যাপার! তবে বেশ মজা লাগল, বললাম, “বাঃ, বাড়ির কাছেই শেয়াল!”
আমি তখন কার্শিয়াং-এ বোর্ডিঙে থেকে পড়ি। আমার ইস্কুলের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। ঠিক হয়েছিল যে, কুলিক থেকেই পরদিন বেরিয়ে বাবা মা আমাকে কার্শিয়াং-এ রেখে, ছোটমামাকে নিয়ে দার্জিলিং চলে যাবে। খুব সকালেই বেরোব আমরা, গাড়িতে প্রায় সাত আট ঘণ্টার রাস্তা। তাই বাবা আর গেলেন না। বিকেলের চা খেয়ে কলফিল্ড আংকল বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে গেল দ্বিজেনদা আর দীনবন্ধুদা।
কলফিল্ড আংকলের কথা জিজ্ঞেস করলাম। মা বললেন, “ওঁকে আজকাল আর দেখাই যায় না।”
অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”
বাবা বললেন, “সেই যে দোলের পর আমরা ফিরে গেলাম, তারপর থেকেই আর ঘর ছেড়ে বিশেষ বের হন না।”
মা বললেন, “বয়স তো আর দাঁড়িয়ে থাকবে না। একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন, সেই বরং ভালো।”
বাবা বললেন, “কী জানি! কয়েকবার গেছি দেখা করতে। কখনও আর্দালি জানিয়েছে, অসময়ে ঘুমোচ্ছেন। আর যখন দেখা হয়েছে, কেমন উসকোখুসকো ছন্নছাড়া চেহারা। বলেন, রাত্রে শেয়ালগুলো নাকি ওঁকে ঘুমোতে দেয় না।”
মা বললেন, “ইনসোমনিয়ায় ভুগছেন হয়তো!”
বাবা বললেন, “ঘুমের অভাবে হয়তো মেন্টালি একটু ডিরেঞ্জড। কয়েকবার তো বললেন, শেয়ালগুলো নাকি ওঁকে মারবার জন্যেই এসেছে। বাড়িতে দু’তিনটে বন্দুকে কার্তুজ ভরে রাখেন সারাক্ষণ। কোনদিন না কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন!”
সব শুনে খারাপ লেগেছিল। তাই পুজোর ছুটিতে যখন বাড়ি গেলাম, প্রথমেই ছুটলাম আংকলের বাড়ি। গিয়ে দেখি কোথায় সেই দাপুটে বুড়ো! তার জায়গায় এক কঙ্কালসার বৃদ্ধ, এক মুখ দাড়ি গোঁফ নিয়ে, ড্রেসিং গাউন পরে বসে রয়েছে। আমাকে দেখে অবশ্য চোখে ঝিলিক দিয়ে হেসে বললেন, “দেয়ার ইউ আর মাই বয়!”

অনেকক্ষণ গল্প হল। সেই পুরনো দিনের মতন আমার স্কুলের গল্প শুনলেন মন দিয়ে। এটা সেটা কথার পর হঠাৎ এক সময় বললেন, “হোয়েন আই অ্যাম গন, দ্যাট সিলভার পিজন ইজ ইওরস।” আমার চোখে জল এসে গেল, বললাম, “ও সব কথা বলছেন কেন?” উনি আনমনে বললেন, “পাপ করেছি, পাপ! ওনলি ডেথ ক্যান রিলিভ মি নাও।” তারপর আবার সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বললেন, “নাউ রান অ্যালং বয়। পুজোর ছুটি, এনজয় কর। আরেহ দেখ তো, তোমার পুজোর গিফটটা দিতেই ভুলে গেছি! এই নাও, আমার মায়ের জিনিস। পুরনো সিন্দুক পরিষ্কার করতে গিয়ে পেলাম। তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।” দেখলাম বহু আগেকার ছাপানো এক গল্পের বই, অ্যালিস পেরিনের লেখা ছোট গল্প সংকলন ‘ঈস্ট অফ সুয়েজ’।
অষ্টমীর দিন মা সারাদিন উপোস করে সন্ধিপুজোয় অঞ্জলি দিতে যান। আমরাও সঙ্গে যাই। এবার সন্ধিপুজো গভীর রাত্রে। অঞ্জলি দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখি, গেটের কাছে দ্বিজেনদা পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে। বলল, “কলফিল্ড সাহেবকে শেয়ালে কামড়েছে, বাবু গেছেন পরিমল ডাক্তারকে নিয়ে।”
বাবা ফিরলেন সেই ভোরবেলা। এসে বললেন, “না, না, শেয়াল টেয়াল কিছু কামড়ায়নি, ডিলিরিয়মে ভুগছেন। ওঁর মনে বদ্ধ ধারণা, ওঁকে শেয়াল কামড়েছে। কিন্তু কোথাও কোনও ক্ষত নেই। অবশ্য গায়ে ভীষণ জ্বর।”
মা বললেন, “এ কদিন আমি হালকা খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দেব নাহয়। আর্দালির তেল মশলা দেওয়া রান্না এখন না খাওয়াই ভালো।”
বিজয়া দশমীর পর সারা শহর কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। কদিনের হই হট্টগোলের পর, বাঙালির জীবনে আবার সেই থোড় বড়ি খাড়া ফিরে আসে। এমন সময় বোমাটা ফাটাল দ্বিজেনদা। জহরা কালীর জঙ্গলে গিয়েছিলাম আমার এয়ারগানটা নিয়ে। সেখানে গিয়ে দ্বিজেনদা হঠাৎ বললে, “মণিভাই, একটা কথা আমি চেপে রাখতে পারি না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী?”
দ্বিজেনদা বলল,”আগে জহরা মায়ের দিব্যি খেয়ে বল, বাবুকে কোনওদিন বলবে না।”
আজকে বাবা নেই, তাই বলতে বাধাও নেই। সেই কুলিকে শিকারের ঘটনা, দ্বিজেনদা বলতে শুরু করল:
সেদিন বিকেলে কলফিল্ড সাহেব অন্য রাস্তা ধরলেন। এবার প্রথমেই শ্মশানের দিকের রাস্তা। পাখিগুলো যেন ওইদিকেই বাসা করেছে বেশি। বিকেলে বেরোতে একটু দেরি হয়েছিল, তাই জলাভূমির পাড়ে পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য অস্ত গিয়েছে। প্রতিপদের চাঁদ উঠতে একটু দেরি। চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। তবে যাবার পথেই কয়েকটা শিকারের দেখা মিলেছে। সাহেব মহা খুশি, বলেছেন, “ওইগুলো পিন টেল ডাক দ্বিজেন। মার্ভেলাস! এইবার এখানে আসা সার্থক হবে।”
শ্মশানঘাটে এসে, আমরা আমাদের রাকস্যাকগুলো একটা বটগাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে জলের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছেই একটা উঁচু মতন ঢিপি। সাহেব বলল, “ঢিপির আড়াল দিয়ে চল, অ্যান্ড বি ভেরি ভেরি কোয়ায়েট।” ধীরে ধীরে আমরা ঢিপির আড়ালে নলখাগড়ার ঝোপের ভিতর দিয়ে জলে এসে নামলাম। উদ্দেশ্য বুকজলে নেমে পাখিদের আস্তানার নাগালের ভিতর এসে জলের লেভেলে ছররা চালাব। খুব সাবধানে এগোচ্ছি, ঘোড়া টেনে গুলি করার জন্য প্রস্তুত। হঠাৎ কে যেন খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল, আর পাখিগুলো অমনি চমকে উঠে ক্যাঁও ক্যাঁও করে সব আকাশে উড়ে গেল। ঘুরে তাকিয়ে দেখি, ঢিপির ওপর দুপুরবেলার সেই বুড়ো ভিখিরিটা। সাহেব তখন রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, “ইউ রাস্কাল” বলে তার দিকে বন্দুক তাক করে ট্রিগার টিপে দিলেন।
এই অবধি শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, “সে কি! লোকটাকে খুন করে ফেললেন?”
দ্বিজেনদা বলে যেতে লাগল-
লোকটা ঢিপির ওপর পড়ে গেল মনে হল। আমি বললাম, “সাহেব, এ কী করলেন!” বলে তাড়াতাড়ি জল থেকে উঠে দেখতে গেলাম। প্রথমে কিছুই দেখতে পেলাম না। বুঝলাম ঢিপির ওপর থেকে পড়ে নীচের দিকে গড়িয়ে গেছে লোকটা। দীনবন্ধুদা প্রথমে জলে নামেনি, সে তখন সাহেবকে জল থেকে উঠে আসতে সাহায্য করছে। আমি একাই আস্তে আস্তে ঢিপির পেছনে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। সেখানে ভীষণ নলখাগড়া আর আগাছার জঙ্গল মাথার ওপর উঁচু হয়ে রয়েছে। আমি খুব সাবধানে ধীরে ধীরে ঝোপ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছি, এমন সময় হঠাৎ ফ্যাঁস করে একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠি। তারপর সামনে যা দেখলাম তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখি অন্ধকারে সারি সারি কয়েক জোড়া লাল চোখ। শেয়ালের পাল, সব একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একটু দূরে সেই ভিখিরিটা পড়ে রয়েছে, বুকের কাছে একটা ক্ষত, আর সেই ক্ষত চেটে চেটে পরিষ্কার করছে বিরাট এক মাদি শেয়াল। আমি হতভম্ব হয়ে দঁড়িয়ে দেখছি, এমন সময় সেই মাদি শেয়ালটা মুখ তুলে আমার দিয়ে তাকিয়ে আস্তে করে একটা ক্রূদ্ধ গরর্ গরর্ আওয়াজ করল।
ঢিপির ওপার থেকে দীনবন্ধুদার গলা পেলাম, “কী রে দ্বিজেন, কিছু দেখতে পেলি?” আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে, কোনও কথা না বলে, ধীরে ধীরে পেছোতে পেছোতে সেখান থেকে চলে এলাম। এসে দেখি সাহেব মাটিতে বসে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন, আর মাঝে মাঝে আবোলতাবোল বকছেন। আমি আর দীনবন্ধুদা বলতে গেলে সাহেবকে কাঁধে-পিঠে করে ফেরত নিয়ে আসি। উনি তখন থেকেই কেমন যেন পাগলিয়ে গেছেন।
আমি এতক্ষণ প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। দ্বিজেনদাই মনে করালো। বলল, “চল মণি ভাই, সন্ধে হয়ে আসছে। বাড়ি চল।” বাড়ি এসে শুনলাম, কলফিল্ড সাহেবের জ্বরটা আবার বেড়েছে। একেবারে বিকারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিমল ডাক্তার নাকি বলেছেন, ‘হাইড্রোফোবিয়ার সিম্পটম।’ অথচ রেবিজ ভাইরাস এল কোথা থেকে? না কুকুরে কামড়েছে, না কিছু! কোনওরকম বাইট মার্কস বা ওই জাতীয় কোনও ইনজ্যুরি নেই।
দেখতে দেখতে লক্ষ্মী পুজোর দিন এসে গেল। কোজাগরী পূর্ণিমা! আজ রাত জাগতে হয়। গৃহস্থের ঘরে ঘরে মহালক্ষ্মী ডাক দিয়ে যান, “কে জাগে?” চারিদিক ভরে যায় তাঁর দেহের সুরভী কাঁঠালি চাঁপার গন্ধে। চাঁদের দুধে চাষির ক্ষেতে পরিপূর্ণ হয়ে বেড়ে ওঠে ধানের শিষ। দিদিমা ঠাকুমার দেখানো পথে, মা-ও কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রে বাইরে ভোগ রেখে আসেন। শৃগাল এসে সেই ভোগ গ্রহণ করলে তবেই পুজোর সমাপ্তি। তবে আজকাল আর শহরে শেয়াল কোথায়?
বাবা বললেন, “দেখ, এইবার হয়তো সত্যি সত্যিই শেয়াল এসে খেয়ে যাবে।”
পুজো শেষে মা গেলেন চাঁদের আলোয় ভোগ রেখে আসতে। বাইরে শেয়ালের ডাক শোনা গেল খুব কাছেই। একটু পরে মনে হল, মা যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন বাইরে। এত রাতে আবার কে? ফিরে আসার পর বাবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললেন, “একটা ভিখিরি। আমি বললাম, এত রাতে এলে কেন? খাবার তো যা ছিল শেয়ালের জন্য রেখে এলাম। একটা ধেড়ে মতন মাদি শেয়াল এসে খেয়েও গেল। তুমি বরং একটা বাতাবি লেবু আছে, নিয়ে যাও। তো সে বলল, শিবায় খেলেই আমারও জুটে যায় মা। বলে চলে গেল।”
বাবা বললেন, “কোন ভিখিরি? এমন সময় তো কেউ আসে না!”
মা বললেন, “একে আগে দেখিনি কখনও। অদ্ভুত চেহারা, দেখলে কেমন আনুবিসের কথা মনে পড়ে। পরনে একটা গামছা আর শেয়ালের মতন ছুঁচলো মুখ।”
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাবাও দেখি হাঁ করে তাকিয়ে আছেন।
এমন সময় দ্বিজেনদা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকলো। বলল, “কলফিল্ড সাহেবের আর্দালি এসেছে, খুব ঘাবড়ে গেছে, আপনাকে ডাকছে। সাহেব নিঃশ্বাস নিচ্ছেন না, বোধ হয় মারা গেছেন।”
সে রাতের পর থেকে যতদিন মালদায় ছিলাম, আর শেয়ালের ডাক শুনিনি।
* অ্যালিস পেরিনের ছোটগল্পের ছায়া অবলম্বনে…
ছবি সৌজন্য: Maxpixel, Wallpaper Flare, Creazilla,
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকোত্তর করার পর শিবু এখন ডালাসে এক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। জীবনের নানান উপাখ্যানের ওপর কল্পনার জাল বুনে বন্ধুদের শোনাতে ভালোবাসে। লেখা দেখে মনে হয়, বয়েস কয়েকবার ওঠানামা করে এখন হয়েছে তেরো!
দারুন গল্প
দুর্দান্ত লাগলো
লেখনী টি যে অত্যন্ত মনাগ্রাহী সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ভাষা খোঁজার যন্ত্রণার অবসান শুধু একটা অধ্যায় নয় , এটি বিধাতার আশীর্বাদ । রইল ঊষ্ম অভিনন্দন ।
Besh laaglo…
অসাধারণ খুব ভালো লাগলো
দুর্ধর্ষ
Khub সুন্দর গল্প
Darun laglo. Asadharan
দারুণ লাগল। ছোট্টবেলার দিন মনে পরে গেল।
অসাধারন খুব ভালো লেগেছে