-‘আবার সেখানে যাওয়া দরকার, নাহলে বসন্ত আসবেনা।’ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ে নারীটি।

-‘অভিশাপ লাগবে?’ পুরুষটি শিশুসুলভ গলায় প্রশ্ন করে। 

-‘হ্যাঁ।’

-‘সে তো চিন্তার ব্যাপার!’   

নারীটি পুরুষের মাথায় গালে হাত বোলায়… ‘চিন্তা কোরো না। আমরা আবার যাব তো!’

– ‘শুনেছি সব বদলে গেছে। ওইরকম কিছুই আর নেই। জায়গাটা আবার চিনব কীভাবে?’ 

– ‘আমি চিনতে পারব। সব মনে আছে আমার।’   

– ‘স-অ-ব?’   

– ‘হ্যাঁ, সব। নদী, পাহাড়ের গায়ে পায়ে চলা পথ, শালপলাশের জঙ্গল, সব মনে আছে আমার। আমি, তুমি, বুরু, দীপান, ভুটান, পিকাই, টুবলু, সবাই গিয়েছিলাম। এছাড়া গ্রামের ছেলে মংরু, সেও গিয়েছিল। উফফ, তুমি মংরুর সঙ্গে কী ভাব জমিয়ে ফেলেছিলে… মনে আছে?’   

-‘আচ্ছা, সাম্য যায়নি?’   

-‘ধ্যাত, সাম্য তখন কোথায়? তুমি তো মোটে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে। আমাদের বিয়েই হয়নি তখন। সাম্য জন্মাবে কোত্থেকে?’  

-‘ইসস, ওকে কিছুই দেখানো হলনা।’  

-‘কী দেখাতে চাও রাজ? কিছু মনে পড়ে তোমার?’  

-‘হ্যাঁ, নদীটা, নদীর ধারে চিকচিকে বালি, সোনা বলে ভ্রম হয়। নদীর নামটা…’ রাজ নিজের মাথায় টোকা মারে। 

-‘আমি বলবোনা। তুমি জানো।’ নারীটি গম্ভীর হয়।      

-‘সোনাতরঙ্গ।’       

-‘উত্তর একইসঙ্গে ঠিক এবং ভুল!’   

-‘ভুল কেন?’   

-‘ঐ নামটা তোমার দেওয়া। সেটা ঠিক। কিন্তু আসল নামটা কি? ম্যাপে কিম্বা জিপিএসে তো তুমি সোনাতরঙ্গ নামে কোনো নদী পাবেনা।’ নারীটি মুচকি মুচকি হেসে মাথা নেড়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে… ’ম্যাপের অ্যাপে খুঁজতে গেলে, তখন তুমি কোন নামে খুঁজবে, রাজ?’      

রাজ চুপ করে থাকে। নারীর চোখ চিকচিক করে, নদীর ধারের বালির মতো। সে হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে, ‘আচ্ছা, বাদ দাও। অন্য কথা বলো। আজ কি খেতে ইচ্ছে করছে তোমার?’   

-‘খিচুড়ি!’ শব্দটা উচ্চারণ করে রাজ বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে চোখ বুজে। তারপর হাওয়ায় হাতড়ানোর ভঙ্গি করে দু হাতের আঙুল দিয়ে; তারপরে একটা একটা শব্দ একটু একটু করে, কোনোটা অস্ফুটে, আবার  কোনোটা সজোরে বেরিয়ে আসে রাজের মুখ থেকে… ‘আমি… আর দীপান… পাথর… মাটি দিয়ে… নদীর ধারে… উনুন…, রান্না… কাঠকুটো… তুমি… তুমি… রেঁধেছিলে।’ রাজ অনেকক্ষণ ধরে থেমে থেমে বলে। ‘তুমি’ শব্দটায় জোর দেয়।         

-‘এই তো! এই তো অনেককিছু মনে আছে তোমার।’ নারীটি খুশিতে যেন নদীর মত ঢেউ তোলে। দুহাতে হাল্কা করে করতালি দেবার ভঙ্গি করে… ‘আচ্ছা, নদীর নামটা নাহয় এখন থাক। আমার নাম বলো। আমি কে?’  নারীটি নিজের বুকের উপরে হাত রাখে, নিজের হৃদস্পন্দন অনুভব করে।  

-‘এ আবার কেমন প্রশ্ন? তুমি আমার স্ত্রী। সঙ্ঘমিত্রা। মিসেস সঙ্ঘমিত্রা রায়চৌধুরী।’   

-‘এটা তো পোশাকি নাম। তুমি, রাজ… তুমি আমাকে যে নামে ডাকতে… মনে আছে?’     

রাজ মাথা নিচু করে। নারীটি তার হাতে হাত রাখে। রাজ শূন্য চোখে সামনের জানালায় বরফঢাকা প্রান্তরের দিকে চেয়ে থাকে।

—–  ——   —- ———     

-‘ভালো হয়েছে? আর এক হাতা নাও। সেই পিকনিকের মত স্বাদ হয়নি, না?’ নারীটি রাজের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে নরম গলায় বলে।     

রাজ টেবিলের বাসনপত্রের দিকে তাকায়। নিজের খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে চুপচাপ।  হঠাৎ নিচুস্বরে বিড়বিড় করে বলে ওঠে – ‘হাতাটা একদম ঠিকঠাক। গাছের ডাল বাঁধবার দরকার নেই।’       

নারী চমকে ওঠে, ‘এই তো! কতকিছু মনে আছে তোমার।’ হাত নেড়ে নেড়ে নদীর তরঙ্গের মত তাড়াতাড়ি বলতে থাকে নারী, -‘পিকনিকে খিচুড়িটা ঠিকভাবে নাড়তে পারছিলাম না আমি। হাতে গরম ভাপ লাগছিল। তুমি একটা গাছের ডাল বেঁধে হাতাটা লম্বা করে দিয়েছিলে।’   

রাজ যেন ঘুম থেকে উঠেছে, এমন গলায় বলে, -‘তাই? তারপর?’     

-‘তারপর তুমি শালপাতা আনতে গিয়েছিলে মংরুর সঙ্গে জঙ্গলের ভেতরে।’       

-‘তারপর?’  

-‘এদিকে রান্না হয়ে গিয়েছিল। খিচুড়ি, ডিমভাজা সব। কিন্তু তোমরা ফিরছিলে না। শালপাতা ছাড়া আমরা খাওয়া শুরু করতেও পারছিলাম না। টুবলুটা সবচেয়ে ছোট। ‘খিদে পেয়েছে’ বলে নাকিকান্না কাঁদছিল। আমাদের কাছে বেশি বাসনপত্রও ছিল না। ওকে তাড়াতাড়ি করে একটা টিফিনকৌটোর ঢাকনায় অল্প অল্প করে খিচুড়ি দেওয়া হচ্ছিল। কী কাণ্ড!’       

‘কেন ঋতু, আমি কি ঐখানেও পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম, যেমন এখানেও…মাঝে মধ্যে …’   

‘কী বললে? কী বললে তুমি?’ নারীটি উল্লসিত হয়ে চলকে ওঠে বর্ষার উচ্ছল নদীর মত।    

‘কী বললাম?’     

‘কী বলে ডাকলে এখনই আমাকে? আরএকবার বলো।’ 

রাজ চুপ করে থাকে। ঋতু থামেনা… আহ্লাদে বলতে থাকে… ‘এবার হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। কিন্তু বসন্ত আসবে। শুনছ রাজ? শালপাতা নেওয়া হয়ে গেলে, তারপর তুমি জঙ্গলে পলাশ খুঁজতে গিয়েছিলে। তোমার মনে হয়েছিল যে পলাশফুল পেলে আমি খুশি হব, মাথায় গুঁজব, তাই। এদিকে নদীর ধারের গাছগুলোয় সরাসরি শীতের হিমেল হাওয়া লাগে বলে, সেগুলোতে তখনও ফোটেনি। মংরু বলেছিল, জঙ্গলের ভিতরে এক দুটো গাছে ফুটেছে। সেইজন্য দেরি হয়েছিল, পথ হারাওনি তুমি।’          

এক শীতের প্রবাসে বরফঢাকা প্রান্তরের দৃশ্যাবলীর সামনে বসে ঋতু আর রাজ, দুজনে মিলে বসন্তের অপেক্ষা করে। পৃথিবীতে এখন হিমযুগ এসেছে। এ দেশে, এই প্রবাসে তার প্রকোপ সাঙ্ঘাতিক। কিন্তু এখন কেউ জানেনা বসন্ত কবে আসবে কিম্বা আদৌ আসবে কিনা! বিজ্ঞানীরাও বলতে পারছেন না। সূর্যের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন হয়েছে; যার ফলে পৃথিবীর ঋতুবদলে বিশেষ প্রভাব পড়েছে। বসন্তের চিহ্ন ততটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা। বসন্ত আসছে না বলে, প্রাকৃতিক শস্য, ফল, ফুল কিছুই ঠিকঠাকভাবে জন্মাচ্ছে না এই গ্রহে।  গ্রিনহাউসে অবশ্য চাষ হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। তবে পৃথিবীর খাদ্যভাণ্ডারে বিশেষ টান পড়েছে এখন।

গত বেশ কয়েক মাস, ঋতু এবং রাজ- ওরা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছেনা। জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অবশ্য সবই রোবট-ড্রোন এসে হোম ডেলিভারি দিয়ে যায়। ওদের দুজনেরই যৌবন বহুকাল অতিক্রান্ত। তবুও ওরা পৃথিবীর যৌবনের জন্য, বসন্তের জন্য অপেক্ষা করে। দুজনেই অপেক্ষা করে? নাকি একজন! ঋতু কি একাই কষ্ট পায় স্মৃতির তাড়নায়? কে বলবে কার কষ্ট কম, কারটা বেশি!   

রাজের আলঝাইমার-আক্রান্ত মস্তিষ্কের কোষে কোষে নানারকম তরঙ্গ তুলে ঋতু স্মৃতির টুকরোগুলো  মিলিয়ে দিতে চায়। বিস্মরণের শৈত্য অতিক্রম করে থেকে ফিরতে চায় স্মৃতির বসন্তে। এ জন্মে না হোক,  হয়তো অন্য কোনো জন্মে ওরা আবার বসন্তের বার্তা নিয়ে আসবে এই গ্রহের কোনো না কোনো গোলার্ধে, কোনো এক পিকনিকে, সোনাতরঙ্গ নামে কোনো নদীর ধারে।                     

জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।

8 Responses

    1. খুব ভাল লাগল। কিছুটা সায়েন্স ফিকশন বলতে পারি। আজকাল যে কোনও সায়েন্স ফিকশন এলিয়েন আর ইউএফও ছাড়া হয়না। এটা ব্যতিক্রম বলেই খুব ভাল।

  1. খুবই ভাল লাগল। এটিকে সায়েন্স ফিকশন স্পর্ধাতেই ধরব। আজকাল এলিয়েন আর ইউএফও ছাড়া সায়েন্স ফিকশন লেখা হয়না। ব্যতিক্রমী বলেই আরও ভাল।

  2. খুব ভাল লাগল। এটিকে সায়েন্স ফিকশন স্পর্ধাতেই নিলাম। আজকাল সায়েন্স ফিকশন বললেই এলিয়েন আর ইউএফও। তাই ব্যতিক্রমী বলেই আরও ভাল লাগল।

  3. খুব ভাল লাগল। এটিকে সায়েন্স ফিকশন স্পর্ধাতেই নিলাম। আজকাল সায়েন্স ফিকশন বললেই এলিয়েন আর ইউএফও। তাই ব্যতিক্রমী বলেই আরও ভাল লাগল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *