-প্রথমেই একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে নিই সম্বিত। আপনার সঙ্গে কিন্তু আমার পারসোনাল কোনও প্রবলেম নেই। আমি যা করতে এসেছি, পুরোটাই পার্টির নির্দেশে। আই হোপ, আপনি সেটা বুঝতে পারছেন।

-আপনার এত দ্বিধার কোনও কারণ নেই গোপা। আমি জানি, আপনাকে কেন পাঠানো হয়েছে।

-থ্যাঙ্কস, কিন্তু আমি আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

-সেটা জানবেন বলেই তো এই শো-কজ। নিন, শুরু করুন।

-সরি। আমি ঠিক এ ভাবে শুরু করতে চাইছি না।

-তাহলে?

-কী ভাবে বোঝাব আপনাকে জানি না। আমি মনে করি পার্টির ভিতরে রাজ্য কমিটি, জেলা কমিটি, লোকাল কমিটি যেমন একটা করে ইউনিট, তেমনই প্রতিটি পার্টি সদস্যও একটা করে ইউনিট। তারা কেউ ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তৈরি কাঁচামাল নয়। প্রত্যেকে একজন স্বতন্ত্র মানুষ, একটি করে প্রাণ। পার্টির প্রাণ।

-কিন্তু মানুষ আগে তো নিজেই নিজের প্রাণ, তাই না?

-তা হতে পারে। কিন্তু যখন উই ডেডিকেট আওয়ারসেলভস তখন তো আর নিজের কথা, ফ্যামিলির কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ থাকে না।

-আপনি কি জে.এন.ইউ–এর ছাত্রী?

-না, আমি প্রেসিডেন্সি। তারপর দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স। আপনি?

-আমি গুরুদাস কলেজ, তারপর কেঁদে ককিয়ে সি.ইউ। কিন্তু এম.এ পার্ট-টু টা দিতে পারিনি।

-কেন দিলেন না, জানতে পারি?

-কী ভাবে দেব? আমি তো সেসময় উত্তরাখন্ডে। গাড়োয়ালের মানুষদের জমি কেড়ে নিয়ে, ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে কারখানা যাতে না হয় তাই নিয়ে লড়তে চলে গেলাম।

-আপনাকে কি ফোর্স করা হয়েছিল, ওখানে যেতে?

-ঠিক তা নয়। আসলে আমি হিন্দিটা মোটামুটি ভাল বলতে পারি আর বক্তৃতা দেবার একটা সহজাত ক্ষমতা আমার মধ্যে আছে বলে পার্টি নেতৃত্ব মনে করেছিলেন। তাই আমাকে গাড়োয়ালে যেতে বলা হয়েছিল। আমি চাইলে রিফিউজ করতে পারতাম। কিন্তু পার্টি আমার থেকে কিছু চাইছে আর আমি রিফিউজ করছি – এরকমটা ভাবতেও পারতাম না।

-কথাটা পাস্ট টেনসে বলছেন কেন? এখন ভাবতে পারেন?

-আপনার প্রশ্নের ধাঁচ দেখেই বোঝা যায় আপনার ট্রেনিংটা বাইরে হয়েছে। আপনি বাংলায় পার্টি করা শিখলে এভাবে শো-কজ করতেন না।

-ওয়েট আ মিনিট। আমি পড়াশোনার সূত্রে বছর পাঁচেক দিল্লিতে থাকলেও আদতে বাঙালি। আর বাংলার রাজনীতি দেখেই বড় হয়েছি।

-তাহলে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। যদিও আজ আমার শুধু উত্তর দেবার কথা। তবু জানতে চাইছি, বাঙালি প্রধানমন্ত্রী যখন হল না, দুঃখ পেয়েছিলেন?

-সম্বিত এই ব্যাপারটা অনেক পুরনো আর এই মুহুর্তে অপ্রাসঙ্গিকও। আমরা বরং অন্য একটা বিষয়ে যাই। আপনি হিন্দি শিখলেন কী ভাবে, আই মিন ফ্লুয়েন্টলি বলার মতো?

-উত্তরটা দিতেই পারি, কিন্তু এই বিষয়টাও কি খুব প্রাসঙ্গিক??

-দেখুন, আমি আপনাকে শাস্তি দিতে এসেছি- এ রকমটা ভাবতে আপনাকে বারণ করছি প্রথম থেকে। ইনফ্যাক্ট আমাকে যখন এই কাজটার কথা বলা হয়, তখনই আমি বলে নিয়েছিলাম যে আমি আগে মানুষটাকে চিনব, জানব তারপর…

-আপনার কথা মেনে নিলেন পার্টি নেতৃত্ব?

-মেনে নিলেন কথাটার মধ্যে একটা অবমাননা আছে। ওঁরা আমার যুক্তিটা শুনলেন, বুঝলেন এবং অ্যাকসেপ্ট করলেন। আর করলেন বলেই আমি আজ এখানে আপনার সামনে, আপনার সঙ্গে…

-হিন্দি কীভাবে শিখলাম তাই নিয়ে কথা বলছেন।

-সেটাও কি জরুরি নয় আপনাকে বোঝার জন্য?

-হয়তো। কিন্তু এত কিছু কনসিডার করে কি পার্টিতে কোনও বিচার হয়? এখানে তো বিচার হয়েই থাকে। শুধু মুখরক্ষার জন্য একটা সভা ডাকা হয় আর রায় শুনিয়ে দেওয়া হয়।

-এটা অ্যাবসলিউটলি ভুল ধারণা আপনার। পার্টিতে একটা গণতান্ত্রিক ব্যাপার আছে। আগে যা ছিল তার থেকে বেশি আছে এখন। এটা কোনও মাওবাদী অরগানাইজেশন নয়, যে কারও কাজ ভাল লাগল না আর ওমনি রাতের অন্ধকারে সালিশি সভা বসিয়ে ফেললাম। তারপর রাত ফুরোনোর আগেই দিলাম গুলি করে তার খুলিটা উড়িয়ে।

-মাওবাদী সংগঠনে এরকম সব জিনিস হয় বুঝি?

-কেন, আপনি জানেন না?

-একটু আধটু জানি হয়তো। কিন্তু আপনি আমার চাইতে অনেক বেশি জানবেন।

-বেশি কিছু, ওদের বিষয়ে, জানার ইচ্ছে হয়নি। শুধু জানি, এত মানুষের রক্ত যদি মানুষের উপকারের জন্য বইয়ে দিতে হয়, তাহলে তেমন উপকার না হওয়াই ভাল।

-এ তো আপনি স্ট্যাটাসকো’র কথা বলছেন গোপা। আপনি সমাজ পরিবর্তনের আদর্শে বিশ্বাসী নন?

-সমাজ পরিবর্তন করার জন্য আমাকে মার্ডারার হতে হবে?

-মার্ডারার কেন হবেন? বিপ্লবী শব্দটা তো ডিকশনারি থেকে উঠে যায়নি।

-কী বলছেন? রেভোলুশনারি আর মার্ডারার এক? এদের ভিতরকার তফাতটা মানবেন না?

-একশোবার মানব। কিন্তু সেই তফাত কি প্রলেতারিয়েত আর লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের তফাতের থেকে বেশি? আপনি একটু আগে আমার কাছে হিন্দি কী ভাবে শিখলাম, জানতে চাইছিলেন। উত্তরটা হল, চটকল শ্রমিকদের বস্তিতে কাজ করতে গিয়ে। শুধু হিন্দি কেন, ভোজপুরিও শিখেছিলাম কিছুটা। কিন্তু ওই দেহাতি মজুরদের বস্তিতে থেকে আমি শুধু হিন্দিতেই ফ্লুয়েন্ট হইনি, অন্যরকম একটা জীবনদর্শনও আয়ত্ত করেছিলাম। আর সেটা হল যা ভয়ংকর, যা বীভৎস, তা কেবলমাত্র ভয়ের নয়, একই সঙ্গে মজারও।

-মানে?

-মানে মদ খেয়ে একটা লোক তার বউকে পেটাচ্ছে কিংবা একটা লোক সুদ দিতে না পারলে কাবুলিওয়ালা তার চোখ দুটো গরম সাঁড়াশি দিয়ে উপরে নিল– এই জাতীয় দৃশ্য মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কাছে সাংঘাতিক ঠেকতে পারে কিন্তু একটা রিকশাওয়ালার কাছে এটা এন্টারটেইনমেন্ট।

-আপনি শিওর?

-অ্যাবসলিউটলি শিওর। এই আপনার রিপোর্ট পাওয়ার পরপরই যখন পার্টি আমাকে তাড়িয়ে দেবে, তখন আপনারা এটা ভেবে মজা পাবেন যে লোকটার সামাজিক সম্মান ধুলোয় মিশেছে। ও যেখানে যাচ্ছে ওকে চেনা-হাফচেনা লোকেরা প্রশ্ন করছে, ‘আপনি পার্টিতে নেই কেন, কী হয়েছিল, আচ্ছা খবরের কাগজে যেটা দেখলাম সেটা সত্যি না মিথ্যা?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাজারের ফলওয়ালা কি ও ভাবে ভাববে?

-হয়তো ভাববে না, কিন্তু তাই বলে সে মজা পাবে?

-মজা ছাড়া অন্য কী পেতে পারে, আমাকে বলুন? সিঁড়ি দিয়ে স্যার গড়িয়ে পড়ছে দেখলে ছাত্ররা যেরকম মজা পায়, কলার খোসায় মোটা কাউকে আছাড় খেতে দেখলে আমরা যেমন মজা পাই, সমাজের নিচুতলার মানুষের কাছে রাজা-বাদশা কিংবা এসট্যাবলিশড মানুষের পতন একটা ফুর্তির খোরাক। আপনার সর্বনাশে আমাদের কার্নিভাল- এই রকম একটা ব্যাপার আর কি!

-আপনি কি নিজেকে এসট্যাবলিশমেন্টের অংশ ভাবেন, সম্বিত?

-কেন আপনি ভাবেন না?

-না। কখনই ভাবিনি।

-ভাবতেন না বলেই হয়তো চন্দ্রমাধব যাদবেন্দুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আবার…

-স্টপ ইট। কী যা তা বকছেন আপনি?

-যা তা বকছি?

-হোয়াট এলস? মিনিমাম এথিক্স জানেন না? একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কী ভাবে কথা বলতে হয় সেই শিক্ষা পার্টি ক্লাসে হয়নি আপনার?

-পার্টি ক্লাসে তো এই শিক্ষা দেওয়া হয় না ম্যাডাম। সেখানে তো সবাইকে কমরেড ভাবাই নিয়ম। আলাদা করে পুরুষ-মহিলা ভাবতে যাব কেন?

-আর যে সমাজে থাকেন, সেই সমাজও কিছু শেখায়নি?

-প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে শেখাচ্ছে। আর সেই শেখানোর ফল দেখছেন না? বন্ধ চেম্বারের ভেতর মালিক তার কর্মচারিকে, অফিসার তার সেক্রেটারিকে, শিক্ষক তার ছাত্রীকে মলেস্ট করছে। আর সেই শিক্ষা চুইঁয়ে এতটা নেমে এসেছে যে ট্যাক্সির ভিতর ট্যাক্সি ড্রাইভার পর্যন্ত তার মহিলা প্যাসেঞ্জারকে রেপ করছে।

-উফ, হরিবল।

-জঘন্য, নৃশংস। এই সমাজের গোটাটা। আর সেটা পরিবর্তনের জন্য চন্দ্রভূষণ যাদবেন্দুর মতো লোক দরকার। আপনার তো ওঁর সঙ্গে থাকা উচিত ছিল গোপা। আপনি ওঁকে ছেড়ে চলে এলেন কেন?

-আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি আপনার স্পর্ধা দেখে! শো-কজ কি আমার হচ্ছে না আপনার?

-হয়তো আমাদের দু’জনেরই। কিংবা কারওরই নয়। তবে আমার একারও হতে পারত। কিন্তু আপনিইই তো সেই রাস্তা থেকে সরে এলেন, আমাকে জানতে চান, বুঝতে চান, বলে। গল্প শুরু করলেন। এ বার গল্প করতে গেলে পরে তো গল্প বলতেও হবে।

-আপনি অপমান করছেন আমাকে!

-ইমপসিবল! চন্দ্রভূষণ যাদবেন্দুর মতো লোককে ছেড়ে চলে এসে আপনি আপনার বৈপ্লবিক আদর্শকে অপমান করেছেন। তার পেছনে হয়তো গভীর, গোপন কিছু কারণ ছিল! আপনি চাইলে বলতে পারেন, না বলতেও পারেন। কিন্তু একটা কথা বলুন, যাদবেন্দু ব্যাপারটা ঠিক কী? শুনলে পরে কি রকম প্রণবেন্দু-প্রণবেন্দু লাগে।

-কেন আপনি কি থিসিস লিখবেন নাকি? ওটা যাদবদের একটা ভ্যারিয়েশন, আমাদের যেমন চট্টোপাধ্যায় আর চট্টরাজ, মুখোপাধ্যায় আর মুখোটি, ওদেরও তেমন। বাট এনাফ অফ ইট। আমরা যে জন্য মুখোমুখি বসেছি সেই ব্যপারটায় এবার ঢোকা দরকার। জানা দরকার, সঞ্চারীর সঙ্গে আপনার ইকুয়েশানটা কী?

-ইকুয়েশন কিছু নেই। আলাপ হয়েছিল। অবশ্য আলাপ হওয়ার আগে একটা মুগ্ধতা জন্মে ছিল।

-আলাপ হওয়ার আগেই মুগ্ধতা? এক্সট্রা-অরডিনারি নাকি?

-না, একেবারেই অ্যাভারেজ। কিন্তু অ্যাভারেজ একটা মেয়ে যখন স্পেকট্যাকুলার কোনও কাজ করে, তখন মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়, না?

-ওহ! তা কী করল সঞ্চারী?

-পুজোয় আমরা যে বইয়ের স্টলগুলো দিই, তার একটার সামনে একটা আইস্ক্রিমওলা দাঁড়িয়েছিল, বুঝলেন। তা পাঁচ-ছটা বাচ্চা ওখানে এসে কুড়ি টাকার আইসক্রিম পনেরো টাকায় নেবে বলে দরাদরি করতে লাগল। ছেলেটা দিতে পারছে না, কিন্তু এতগুলো খরিদ্দার হাতছাড়াও করতে পারছে না।

-তারপর?

-যে ছেলেটা সবার হয়ে দরাদরি করছিল, সে সম্ভবত সঞ্চারীর পাড়ার। এবার সেই ছেলেটাকে একদিকে সরিয়ে এনে সঞ্চারী জিজ্ঞেস করল, ‘তোর পুজোয় কটা জামা হয়েছে রে’? ছেলেটা, চার কিংবা পাঁচ এরকম একটা সংখ্যা বলল। সঞ্চারী উত্তরে বলল, ‘ওই ছেলেটার একটাও জামা হয়নি জানিস। নিজের ভাল থেকে অন্যকে একটু ছেড়ে দে, দেখবি পৃথিবীটা কত সুন্দর হয়ে উঠবে।’

-ব্যস? এই কথাটার জন্য আপনার ভাল লেগে গেল সঞ্চারীকে?

-কথাটা শেষ করতে দিন। ওই ছেলেটা তখনও জেদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সঞ্চারী ওকে বলল, ‘তোর অনেকগুলো জামার পাশাপাশি ওই ছেলেটার যদি একটাও জামা না হয়, তাহলে কিসের পুজো?’

-ছেলেটা কী করল?

-ছেলেটা ঠিক কী করল আমি আর খেয়াল করিনি। আমার মনে তখন অন্য এক কার্নিভালের রং লেগে গেছে। আমি তো আমার চারপাশে কম্প্রোমাইজ আর কোকাকোলা দেখে আসছি শুধু। দেখছি বাড়ির তাকভর্তি লেনিনের বই, ওদিকে কাজের লোক দু’দিন কামাই করলে তার মাইনে কেটে নেওয়া। এইসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত আমি হঠাৎ একটা ঝরনার খোঁজ পেয়ে গেলাম, যেখানে জলের সাতটা রং। বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু এই সিস্টেমের মধ্যে থেকেও কেউ এ ভাবে ভাবতে পারছে! এই ব্যাপারটা নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে। আচ্ছা, গোপা আপনার কখনও এমন হয়নি? মানে রূপ দেখে নয়, পজিশন দেখে নয়, ছোট্ট একটা ঘটনার সূত্রে একটা মানুষকে ভাল লাগার ব্যাপারটা ঘটেনি কখনও?

-ওই চন্দ্রভূষণের ক্ষেত্রেই হয়েছিল।

-স্বীকার করছেন তাহলে?

-স্বীকার করছি না। বলছি। স্বীকার করব কেন? আমি কি খুন করেছি না ডাকাতি?

-ভালবেসেছেন, পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে গিয়ে। সেটা তো অপরাধ, নয় কি?

-জানি না। আমার তো শো-কজ হয়নি। আর ভালোবাসা যদি বলেন তো হ্যাঁ ভালোবেসেছি। কিন্তু আমি কোথাও পালিয়ে যাইনি।

-চন্দ্রভূষণ তো ওয়ান্টেড ছিল পুলিশের খাতায়…

-সেটা পুলিশের প্রবলেম। তাতে আমার কী? আর পালানো কাকে বলে সম্বিত? মানুষ যখন নিজের থেকে নিজে পালায় সেটাকে পালানো বলে। সে যখন পরিস্থহিতির কারণে কোথাও লুকোয় কিংবা আত্মগোপন করে, সেটা কি পালানো নাকি? সেটা তো একটা কৌশল! চন্দ্রভূষণ সেই কৌশলটাই অবলম্বন করেছিল শুধু।

-কিন্তু পার্টি?

-ওই যে বললাম, আমার মতবাদ আমার কাছে। ওঁর মতবাদ ওঁর কাছে।

-একটু আগে যে বললেন মাওবাদীদের রক্তপাতের রাজনীতি ভালো লাগে না?

-সেই লড়াইটা ইডিওলজির সঙ্গে। কিন্তু যখন ছাপরা জেলার একটা গ্রামে মোষের পিঠে চেপে চন্দ্রভূষণকে ছোট্ট একটা নদী পেরোতে দেখেছিলাম, তখন ইডিওলজি কোথায় ছিল বলুন তো?

-আমার ক্ষেত্রে আইসক্রিম আর আপনার ক্ষেত্রে মোষ? ইস, গোরু হলে পরে চন্দ্রভূষণকে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করতে পারতাম। তবে আমি জানি না ওর জীবনে কত নারী ছিল…

-অনেক। তবে তারা তো সবাই ওকে কমান্ডার ডাকত। ওর হুকুম তামিল করার জন্য এক পায়ে খাড়া থাকত।

-ও তার মানে বিরাট কেউ ছিল। আমি অবশ্য তেমনটাই শুনেছিলাম।

-ভুল শুনেছিলেন। বিরাট কিছু হওয়াকে চন্দ্রভূষণ ঘেন্না করত। ও মনে করত, যে কোনও জায়গায় বিরাট কেউ হতে গেলে মানুষকে তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে এগোতে হয়। কারণ বিরাট হতে পারে শুধু ব্রক্ষ্মদৈত্যরা। আর চন্দ্রভূষণ কখনও ব্রক্ষ্মদৈত্য হতে চায়নি।

-কিন্তু ওর মাথার দাম ছিল তো?

-হ্যাঁ, ওঁর মাথার দাম ছিল। কিন্তু ওঁর ওই জ্যান্ত, ক্রিয়াশীল মনটার কোনও দাম ছিল না দেশ কিংবা সরকারের কাছে। পটনা থেকে একঝুড়ি ডিম নিয়ে গিয়েছিল ও একবার ওর দেশের বাড়িতে, কারণ গ্রামের বাচ্চারা ডিম খেতে পায় না। কোনও একটা অনুষ্ঠানের শেষে ওই ডিমগুলো ফেলে দেওয়া হচ্ছিল।

-ওকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছিল না?

-তখনও না। কারণ সেই সময় ও নকশালদের যে দলটার নেতা, তারা বাইরে থেকে কাজ করছে, ভোটে দাঁড়াচ্ছে। চন্দ্র নিজেও দিল্লিতে ওপেনলি সভা করেছে, বক্তৃতা দিয়েছে। অসুবিধে হয়নি কিছু।

-কিন্তু নকশাল নেতার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে তোলপাড় হয়নি পার্টিতে?

-আমি তখনও ঠিক সেভাবে ইনভলভ হইনি পার্টির সঙ্গে। আর দিল্লিতে যেহেতু পলিটিক্যাল কালচারটা একটু ভিন্ন, এই দলের লোক আর ওই দলের লোক একসঙ্গে ড্রিংক করছে, তাই এতটা পাত্তা দেয়নি কেউ।

-বেঁচে গেছ, কলকাতা হলে ধান থেকে খিচুড়ি বানিয়ে দিত একমিনিটে। সরি, তুমি বলে ফেললাম।

-ইটস ওকে, আমারও আপনি-আজ্ঞে করতে অসুবিধে হয়।

-পার্টিতে কিন্তু এই কালচার নেই। তুমি বলা নিয়ে আবার গসিপ না শুরু হয়ে যায়।

-দুনিয়া বদলে গেছে, পার্টি বদলাবে না?

-ওই কথাটা আমিও ভাবি। ছোট থেকেই ভাবি। কিন্তু কোনও বদল তো টের পাই না।

-কোথায় কেটেছে তোমার ছোটবেলা? এই শহরেই?

-শহরের প্রান্তে, দমদমে। এবার দমদম জায়গাটার মধ্যে অনেক প্লাস-মাইনাস কাজ করে। মানে এয়ারপোর্টের দিকটায় গেলে পরে বিশ্বজগতের হাতছানি আবার অলিতে গলিতে শহিদ বেদি; বলতে পারও একটা অদ্ভুত দোটানার মধ্যে বড় হয়েছি আমি। সুতোয় কাটা ডিমসেদ্ধর দুদিকেই সমান কুসুম কিনা ঠিক করতে না পেরে বারবার এটা বাদ দিয়ে ওটা নিতে চেয়েছি।

-দমদম তো দূর্গ সেই সময়।

-হ্যাঁ। কিন্তু দূর্গের ভিতরে বাস করতে করতেই তো দূর্গের বাইরে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওই পরিখাটা পেরিয়ে গিয়ে একটু দেখি, কোথায় কী আছে। আমি ছোটবেলায় কিছুটা একচোরা ছিলাম। মানে খেলতাম-দেলতাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে একটু একা থাকতে ইচ্ছে করত। কিন্তু প্রাইভেট প্লেসের ধারণাই ছিল না কারও মধ্যে। আমি একটু ছবি আঁকতে পারতাম। ওই কী আঁকছি না আঁকছি দেখার জন্য সবাই এসে উঁকি মারত। কী ভাবে যেন রটে গেছিল সার্কাসে এক নতুন জন্তু এসেছে।

-সবার এত কৌতুহলের পিছনে কিছু তো কারণ থাকবে? আর কেউ ছবি আঁকত না তোমার পাড়ায়?

-আঁকত। তবে আমার মতো নয়। আমি আসলে কার্টুন আঁকতাম।

-তাই বলো। তোমার ওই উলটো রকম কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে লোক ছুটে আসত। তোমাকে প্রতিভাবান মনে করত তাই।

-ধুস! ওইসব প্রতিভা-টতিভা কেউ বুঝত বলে আমার মনে হয় না। সবাই আসলে কঠোর ভাবে রেজিমেন্টেড একটা জীবনে অভ্যস্ত ছিল। উনুনের কয়লা ভাঙতে ভাঙতেও, ‘এগিয়ে যেতে হবে, গড়ে তুলতে হবে’, এই সব বাঁধা বুলি শোনায় অভ্যস্ত ছিল। কয়লার জায়াগায় স্টোভ, তারপর গ্যাস যখন চলে এল, তখনও কিন্তু মানসিকতাটা পালটাল না কারও।

-এরকমটা আমারও মনে হত জানো। আমার এক কাকু ছিল। মিষ্টিকাকু বলতাম আমরা। ছোটবেলা থেকে যত সুন্দর সুন্দর বাড়ি আছে পাড়ায়, সেগুলো আমায় দেখিয়ে বলত, এরা সব আমেরিকার দালাল। আর যত ভাঙাচোরা ঝুপড়ি, সেগুলোর দিকে আঙুল তুলে বলত, এরা হচ্ছে সোভিয়েতের সৈনিক। সেই দেখে দেখে কেমন একটা জিদ চেপে গিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল যা সুন্দর আমাকে তার পাশেই থাকতে হবে।

-চন্দ্রভূষণ দেখতে কীরকম ছিল? হিরোদের মতো?

-না, একদম সাধারণ। কিন্তু তাতে কী? ততদিনে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। আমি জি.আর.ই-তে খারাপ স্কোর করে বুঝে গেছি যে আমেরিকা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ, আমেরিকার আর দালালের দরকার নেই। ওদিকে সোভিয়েত তো কবেই ভেঙে গেছে। রাশিয়ার সৈনিক রাখার পয়সা বা ক্ষমতা কিছুই নেই। একটা একমেরু বিশ্বে, গলাকাটা কম্পিটিশনে যে পারবে সেই টিকে থাকবে। যে পারবে না সে ফক্কা। কোনও গডফাদার নেই, গডল্যান্ড নেই কোনও। আছে শুধু এক ভয়াবহ শূন্যতা আর …

-পরস্পরের ক্ষতি করে একটা গর্তে হাত-পা ছোড়ার প্রবল বাসনা।

-এটা মানতে পারছি না। ছোটবেলায় তো মানুষকে মানুষের ভাল চাইতেই দেখতাম। একজনের গলা কেটে অন্যজনকে জিততে হবে, এ রকম ব্যপার বোধহয় ছিল না।

-ছিল। ডেফিনিটলি ছিল। পাঁচশো-সাতশো বছর আগে মানুষ নিজের দাদাকে, ভাইকে, বাবাকে মেরে রাজা হয়নি? সবাই খুব ভাল ছিল আর হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গেল? এমনটা আবার হয় নাকি? একটা বই পড়লাম রিসেন্টলি, মানুষের ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে কারণ মানুষের জিন তাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী একই কাজ করায়। ডাকাতের নাতির ছেলের মনে ডাকাতির ইচ্ছে জেগে ওঠে। অভিনেত্রীর নাতনি আধন্যাংটো হয়ে শুয়ে থেকে প্রাচীন জনতার মনে তার দিদিমার স্মৃতি উস্কে দেয়। জমিদারের ছেলে জমিদারি হারালেও অন্যের লেবুগাছটা নিজের পাঁচিলের ভিতরে নিয়ে আসতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এসবই জিনের কারসাজি। আমাদের বাপ-ঠাকুরদার জিন আমাদের ভিতরে বলেই আমাদের কাজগুলোও ওদের মতোই হবে। ওদের ঘেন্না করলেও ওদের কাজগুলোও অন্য অন্য চেহারায় আমাদের হাত দিয়েই ঘটবে।

-কিন্তু তোমার হাত দিয়ে তো কার্টুন বেরোত?

-চারপাশের উলটোটাকে সোজা করে দেখানোর চেষ্টা দেখাতে দেখাতে আমার হাত দিয়ে সোজাটাই উলটো হয়ে বেরোতে থাকল। আর সবাই হামলে পড়ে বুঝতে চাইল, ছেলেটা কী বলতে চাইছে। আমি যে আসলে কিছু না বলে চুপ করে থাকার স্বাধীনতা চাইছিলাম, সেটা কেউ বুঝল না। আমি অবশ্য বোঝাবার খুব একটা কিছু চেষ্টাও করিনি। যারা স্বভাবে নিষ্ক্রিয়, তারা কোনও ব্যাপার নিয়ে বেশিদূর যাবে না, এই বোধ তখন থেকেই ছিল আমার।

-নিষ্ক্রিয় কারা? আমাদের বাবার জেনারেশনটা? নাকি এখনকার ফেসবুকে ডুবে থাকা পাবলিকরা?

-তুলনায় যাব না, শুধু বলি কাজকম্মের দিক দিয়ে দেখলে হয়তো আগের জেনারেশনটাই বেশি অ্যাকটিভ ছিল। ওরা একজোড়া শার্ট-প্যান্ট কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবিতে বছর পার করে দিয়েছে। অফিস থেকে ফিরে স্টোভের কালি পরিস্কার করে নতুন ফিতে ভরেছে। কিন্তু আমার ওই লোকগুলোর বিরুদ্ধে যা বলার সেটা হল, ওরা মনে মনে মরে ছিল। ওদের সাহস হয়নি একটা কারও হাত ধরে বলার, চলো পালিয়ে যাই।

-তুমি বলেছিলে সঞ্চারীকে এরকম কিছু?

-সঞ্চারী তো পালিয়ে যাবার বিরুদ্ধে। ও জীবনের শিং ধরে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায়, আর ওর পাল্লায় পড়ে আমারও সেই নেশাটা ধরল। যে আমি চটকল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেও নিজের এলিটিস্ট সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইতাম, সেই আমাকেই সঞ্চারী এমন একটা স্কুলে নিয়ে গেল যেখানে বাচ্চারা দুপুর তিনটের পর পড়া ধরলে বলে, ‘ছেড়ে দিন, এখন পেটের মধ্যে কুকুর ঠাপাচ্ছে, এখন পড়া-ফড়া বলতে পারব না’।

-কী বলে?

-শুনলে তো একবার। কিন্তু একবার শুনলেও কথাটা আমার মাথার মধ্যে হাজারবার বেজেছিল। আমি ভেবে কুল পেলাম না যে ঠিক কতটা খিদে পেলে, কুকুরের দমবন্ধ যৌনতার সঙ্গে মানুষ নিজের খিদে রিলেট করতে পারে। ভেবে উত্তর পেলাম না ঠিকই, কিন্তু একটা নতুন ইমেজারি পেলাম। কুকুরের যৌনতার ইমেজারি। যার ডাকনাম খিদে। আচ্ছা চন্দ্রভূষণের সঙ্গে এরকম কোনও লাস্টিং ইমেজারি পাওনি?

-সে কথায় পরে আসছি। তুমি তোমার গল্পটা শেষ কর আগে।

-হ্যাঁ, তোমার তো আবার আমার বিচার করতে হবে। কিন্তু গল্পের কিছু নেই এখানে, পুরোটাই স্টার্ক রিয়ালিটি। আর এমন বাস্তব যাকে জিভে ফেলে চাখা যায় না, হাতে নিয়ে ঘাঁটা যায় না। আমি সঞ্চারীর প্রেমে কখনওই পড়িনি। কিন্তু ওঁর সঙ্গে মিশতে মিশতে আমি ওই আকাঁড়া বাস্তবের প্রেমে পড়ে গেলাম।

-তাই ওপেন রিভোল্ট করলে?

-ওপেন রিভোল্ট করার মতো শিরদাঁড়ার জোর আমাদের আছে নাকি? হয়তো চন্দ্রভূষণের আছে। কিন্তু আমার নেই। আমি জাস্ট একটা প্রতিবাদ করেছিলাম।

-কিন্তু এখানে যে দেখছি…

-ভুল দেখছ, ওদের সাজানো জিনিস দেখছ। আমার মুখ থেকে আসল কথাটা শোনও।

-সেটাই স্টার্ক রিয়ালিটি?

-একদম। ঘন লাল বাস্তব। সেই বাস্তবে জল মিশিয়ে খাওয়াব না তোমায়। একদম নিট খাওয়াব। সহ্য করতে পারবে?

-বলেই দেখো।

-তাহলে শোনও, মলি বিশ্বাস বলে যে মেয়েটা অ্যাবরশন করাতে গিয়ে মারা গেছে, তার পেটের বাচ্চাটা আসলে ট্রেড ইউনিউয়নের জাঁদরেল লিডার শিবু পুরকায়স্থর।

-কিন্তু এখানে যে পরিষ্কার লেখা আছে সৌমিক বসু, বয়স সাঁইত্রিশ, ঠিকানা…

-স্টপ ইট। আমি জানি সৌমিক বসুর ঠিকানা কী। ও সঞ্চারীর দাদা। কিন্তু তোমাকে একটা জিনিস জানানো হয়নি আর সেটা হল লোকটা পনেরো বছর ধরে নার্ভের পেশেন্ট। সঞ্চারীর মা বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল লোকটার চোখের সামনেই। তারপর থেকে ও দিনে তিনটে করে ওষুধ খায়। দরকার হলে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখে এসো, ওষুধগুলো আড়াইশো না পাঁচশো মিলিগ্রাম। কিন্তু যে লোকটা একা বাজারে গেলেও থরথর করে কাঁপে, সে একটা মেয়েকে ফোর্সফুলি প্রেগন্যাণ্ট করে দেবে?

-মেডিক্যাল ব্যাপারটা নিয়ে আমি ঠিক শিওর নই, আমাকে একটু খোঁজখবর করতে হবে।

-সে তুমি করো। সিস্টেমের দালালরা তোমায় হেল্প করতে এগিয়ে আসবে চার হাতে পায়ে। কিন্তু যেটা সত্যি আমি সেটা বললাম।

-সবাইকে ছেড়ে সঞ্চারীকে টার্গেট করল কেন?

-কারণ, ওর বাবা-মা নেই। ওই পাগল দাদার দায়িত্ব ওর ওপরে। ওর মতো একটা মেয়েকে সহজে এক্সপ্লয়েট করা যাবে ভাবা গিয়েছিল।

-কিন্তু এখানে যে দেখছি একটা চাকরির কথা খুব…

-ঠিকই দেখছ। একটা কোনও টোপ না দিলে ওঁর দাদাকে বলির পাঁঠা করে শিবুকে বাঁচানোর প্ল্যান মেনে নেবে কেন সঞ্চারী? তাই ওই চাকরির মোয়া। কিন্তু এরপরও সঞ্চারী বেঁকে বসবে ওরা ভাবতে পারেনি। ভাবতে পারেনি যে ব্যাপারটা মিডিয়ায় ফাঁস হয়ে যাবে।

-ফাঁস তো তুমিই করে দিয়েছ?

-হ্যাঁ করেছি। বেশ করেছি।

-সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়?

-তুমি যদি মনে করো শাস্তিযোগ্য, তবে তাই। আমাকে শাস্তি দাও, কে বারণ করেছে?

-কিন্তু আমি তো জানতে চাইছি, যে পার্টিকে তুমি ভালবাসো তার বিরুদ্ধে কেন গেলে?

-তুমি আমেরিকার দালাল হতে চাইতে না ছোটবেলায়? তাহলে তুমি কেন পালটি খেয়ে এইদিকে এলে?

-কারণটা আগেই বলেছি, আমেরিকার আর আমাকে দরকার ছিল না। কিন্তু পার্টির তো তোমাকে দরকার ছিল।

-হ্যাঁ ছিল। কিন্তু কী রকম দরকার জানো? আগেকার বড় বড় বাড়িতে সেই ঘোরানো সিঁড়ি থাকত না মেথরের যাতায়াত করার জন্য? পার্টির ওরকম একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে আমাদের জন্য। আমরা, মানে কম ক্ষমতা সম্পন্নরা ওই ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্ষমতাশালীদের যত নোংরা, যত বিষ্ঠা সব পরিস্কার করে দিয়ে আসব, সপ্তাহে, দু’সপ্তাহে। আর পুরো বাড়িটা ভীষণ চকচকে দেখাবে। এটাই হল সিস্টেম। এবার সেই সিস্টেমটাকে একটু উলটে দেওয়া দরকার।

-আমার মনে হচ্ছে ওইসব সিস্টেম ওলটানো-ফোলটানো বাজে ব্যাপার, তুমি যা করছ তার সবটাই সঞ্চারীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে।

-হতে পারে। কিন্তু তুমি সেই প্রেম বুঝবে কী করে ? তুমি তো সিস্টেমের পক্ষে। তুমি চন্দ্রভূষণের মতো বিপ্লবীকে ছেড়ে কফিশপ-পলিটিক্স-এর নিশ্চিন্ত আরামে ফিরে এসেছ।

-শাট আপ। ভালোবাসা বুঝিও না আমায়। চন্দ্রভূষণের ছাপরার ডেরায় আমি মোষকে খড় খাওয়াতাম, ঘুঁটে দিতাম দেওয়ালে। লন্ঠনের আলোয় বাজরার রুটি বেলতাম।

-সে তো কয়েকদিনের পিকনিক।

-সেটাই চিরজীবনের রুটিন হত, যদি না…

-থামলে কেন?

-যদি না গোয়ালঘরে চন্দ্রভূষণ ওঁর এক মহিলা কমরেডের সঙ্গে উন্মত্তের মতো মিলিত হত। আর ওটাই বিপ্লবকালীন পরিস্থিতির চাহিদা বলে বর্ণনা করত স্তম্ভিত আমায়।

-ওই মেয়েটার সঙ্গেও রিলেশন ছিল ওর?

-ধুস! রিলেশন তো শুধু বিপ্লবের সঙ্গে। আর আমি কিংবা ওই মেয়েটা তো মোষের মুখের খড়। আমি নিতে পারিনি জানো তো, এতটা বিপ্লব নিতে পারিনি। তাই ফিরে এসেছিলাম, মা-বাবার কাছে। সিস্টেমের কাছে।

-কী হল গোপা, গলা চোক করে যাচ্ছে কেন তোমার? মনে রাখবে যাই ঘটুক না কেন, কান্না আমাদের মানায় না।

-তুমি বলতেই পারো, তুমি তো জিতেছ। ইনফ্যাক্ট তোমরা জিতেছ।

-ঠিক বলেছ, জিতেছি। আর কী ভাবে জিতেছি – সেটা শুনবে না?

-বলো, শুনছি।

-পার্টি যখন দেখল আমাকে আর সঞ্চারীকে তাড়াতে হবে, তখন দুজনকে একসঙ্গে তাড়াল না কেন বলো তো? কেন বোমাটা বাইরে ফেলে বোমার সুতোটা ঘরের ভিতর রাখল?

-হয়তো দোষের মাত্রা বিচার করে ব্যাপারটা ঠিক করেছিল।

-উঁহু! দু’জনকে যদি একসঙ্গে তাড়ানো হত তাহলে দু’জনকে এক করে দেওয়া হত। একটা ইউনিট করে দেওয়া হত। আর পার্টি সেটা চায় না। বাঘ যেমন শিকারের আগে হরিণকে একা করে দিতে চায়, পার্টিও ঠিক সেটাই চায়। তাই তোমাকে মঞ্চে নামিয়ে এই নাটক সাজানো হয়েছে। কিন্তু নাটকের সংলাপটা আমি একটু বদলাব। আর আমাকে হেল্প করবে তুমি। আমাকে বহিষ্কার করবে পার্টি থেকে।

-কিন্তু আমার তো এক্সপেল করার ক্ষমতা নেই।

-তুমি দিল্লির পাঠানো লোক। তোমার রেকমেন্ডেশন ওরা ফেলতে পারবে না। আমি জানি। আর তোমাকে এই কাজটা করতেই হবে আমার জন্য।

-কিন্তু তোমাকে বহিষ্কার করলে তোমার কী লাভ?

-সব বহিষ্কারই শেষ বিচারে একটা মুক্তি। সেই মুক্তির জন্য পাগল-পাগল লাগছে আমার।

-মিথ্যে বোলো না। আমি নির্জলা মিথ্যে ধরতে পারি। আমার ট্রেনিং আছে।

-তাহলে নির্জলা সত্যিটাই বলছি। মলি বিশ্বাস বলে যে মেয়েটা মারা গেল, সে থাকত আমরা যেখানে বসে আছি, তার পরের বাসস্টপে। সেই হিসেবে কাছে হলেও জায়গাটা অন্য বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। আর সেই বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক মারা যাবার ফলে উপনির্বাচন হবে।

-হ্যাঁ জানি। এখানে আসার আগেই শুনেছিলাম বাই ইলেকশানের কথা।

-ওই বাই-ইলেকশনে সঞ্চারী ক্যান্ডিডেট হচ্ছে।

-নির্দল হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

-তোমাদের অপোনেন্ট পার্টি ওকে দাঁড় করাচ্ছে।

-কী বলছ?

-আমরা একদম পাকা প্রতিশ্রুতি পেয়ে গেছি। কিন্তু একটা ব্যাপার আছে। আর সেটা হল যে হেতু এটা নতুন পার্টি, ভাবধারা এবং অ্যাক্টিভিটি দু’টোর কোনওটাই আমাদের সঙ্গে মেলে না। এখানে সঞ্চারীর আইসোলেটেড ফিল করাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আমি পাশে থাকলে সেটা হবার চান্স কম।

-তুমি থাকো না পাশে। কে বারণ করেছে?

-পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য পার্টির কাজ করলে যতখানি সমর্থন পাওয়ায়া যায়, পার্টি বহিষ্কার করলে সেটা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

-তুমি চলে গেলে সেটা অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু আমরা তাড়ালে পরে সেটা একটা বদলা, তাই না?

-এগজ্যাক্টলি। এই বদলাটা নিতে আমাকে সাহায্য কর।

-টিঁকতে পারবে? একদম অন্যরকম একটা পরিবেশে?

-চেষ্টা করব। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে টিঁকে থাকার নামই তো জীবন।

-কিন্তু আমি যদি এই কাজটা করি, তাহলে তো পার্টির ক্ষতি করা হবে।

-একটু ব্রডলি ভাবো; হয়তো লাভই হবে পার্টির। যারা বেরিয়ে গিয়ে অন্যত্র ঢুকছে তারা তো পার্টিরই এক একটা কোষ।

-নেতৃত্বের ভাষায়, ক্যান্সারাস সেল।

-তাহলে ক্যান্সারটা অন্য পার্টিতে ছড়াবে, তোমাদের ভিতরে না।

-কিন্তু…

-কোনও কিন্তু নয় গোপা, কথা বলতে বলতে আমরা কখন বন্ধু হয়ে গেছি, আমরা নিজেরাই জানি না। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে এইটুকু করতেই হবে তোমায়।

-এত ভালবাসো সঞ্চারীকে?

-ভালোবাসি কিনা জানি না, শুধু জানি ওই আইসক্রিমওলাকে সঞ্চারি যেমন হারতে দেয়নি, আমিও ওকে হারতে দিতে পারব না।

-ব্রাভো! আর তার জন্য যা করার করবে, এমনকি আমাকে এক্সপ্লয়েট পর্যন্ত।

-সেটা চন্দ্রভূষণ যাদবেন্দু করেছিল। আমি করছি না।

-স্টপ টকিং রাবিশ, তুমিও করছ। কিন্তু এবার আমি আর আগের মতো বোকা নই। তাই আমিও একটু এক্সপ্লয়েট করব তোমাকে।

-বন্ধু তো বন্ধুকে এক্সপ্লয়েট করে না, হেল্প করে।

-সেন্টু দিও না। তোমাকেও আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। তোমায় চন্দ্রভূষণকে হাওড়া স্টেশন থেকে চেন্নাই মেলে তুলে দিয়ে আসতে হবে। আরও ভাল হবে যদি সঞ্চারী যায় ওকে সি.অফ করতে।

-বলছটা কী? চন্দ্রভূষণ কোথায় এখন?

-আমার মামার ফ্ল্যাটে। আর কলকাতা পুলিশ কোনও ইনফর্মারের থেকে খোঁজ পেয়েছে যে কলকাতা কিংবা আশেপাশে আছে। তাই এখানকার কাজ শেষ হয়ে গেলেও চন্দ্র বেরোতে পারছে না। ওদিকে ওর অন্ধ্রে যাওয়া জরুরি। ওকে গাড়িতেও পাঠানো যেত। কিন্তু ট্রেনটাই সেফ। তাই…

-আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

-কিন্তু এটাই স্টার্ক রিয়ালিটি। তোমার ভাষায়।

-সেই গোয়ালঘরের কাণ্ডটার পরও…

-ভালোবাসা রয়ে গেছে। বোমা বাইরে ফেললেও, বোমার সুতো যেমন ঘরের ভেতরে থেকে যায়। আর তুমি সেই লাস্টিং ইমেজারির কথা বলেছিলে না? আমার চন্দ্রভূষণ যাদবেন্দুর কাছ থেকে পাওয়া লাস্টিং ইমেজারির কথা শুনবে?

-প্রেমিক অন্য মহিলার সঙ্গে ক্লোজ, এর চাইতেও বড় কোনও ছবি?

-হ্যাঁ, আর সেই ছবিটা কীসের বলো তো? একটা এক্স-রে’র। সেই এক্স-রেটা হচ্ছে, যে মেয়েটার সঙ্গে চন্দ্রভূষণ শুয়েছিল, সেই মেয়েটার।

-কিছু বুঝতে পারছি না।

-বুঝতে আমিও পারিনি প্রথমটা। ভেবেছিলাম চন্দ্রভূষণ গুলতাপ্পি দিয়ে কলকাতায় লুকিয়ে থাকার সুবিধে চাইছে আমার কাছে। কিন্তু যখন ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল, তখন মনে হচ্ছিল একটা বুলেট আমাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে।

-বুলেট?

-হ্যাঁ, বুলেট। জ্যোৎস্না হেমব্রম বলে ওই মেয়েটার পিঠের নিচের দিকে একটা বুলেট এখনও আটকে, বার করা যায়নি। সেদিন রাত্রে একটা জোতদারের বাড়ি অপারেশনে যাওয়ার আগে ওর অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়। চন্দ্রভূষণ যখন জিজ্ঞেস করে যে কী করলে ও বেরতে পারবে, তখন জ্যোৎস্না ওকে বলে, ‘এই অসহ্য যন্ত্রণাটাকে ভুলতে পারি, এমন কোনও অসহ্য সুখ দিতে পারও আমায়?’

-ব্যস? এতেই চন্দ্রভুষণ রাজি হয়ে গেল? চন্দ্রভূষণের নিজের ইচ্ছা ছিল না?

-থাকলেই বা কি? কুকুরের যৌনতার সঙ্গে অসহ্য খিদেকে রিলেট করেছিল যে ছেলেটা, তার কাছে তোমায় নিয়ে গিয়েছিল বলে যদি তুমি সঞ্চারীকে ভালোবাসতে পারো, মানুষের যৌনতার সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণার সম্পর্ক গড়তে চাওয়া ওই মেয়েটার সামনে আমায় দাঁড় করাবার জন্য, চন্দ্রভূষণকে আমি ভালোবাসতে পারব না কেন?

-ওর ট্রেন ক’টায়?

-তুমি যাবে?

-সঞ্চারী যাবে। আমি বেরিয়ে গিয়ে সেই ব্যবস্থা করছি।

-আমি তোমার এক্সপালশান রেকমেন্ড করে লেখাটা লিখে ফেলছি ততক্ষণে।

-থ্যাঙ্কস গোপা।

-নো থ্যাঙ্কস, জিতে ফেরো।

-আর যদি না ফেরা হয়?

-তাহলেও রাস্তার বাঁকে কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবে। ভালোবাসা ফলো করেই তো এগোচ্ছি, তাই না?

পেশায় শিক্ষক | মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা | পেয়েছেন কৃত্তিবাস ও বাংলা আকাদেমি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার | ‘নেহাত গরিব নেহাত ছোটো’, ‘দাঁড়াচ্ছি দরজার বাইরে’, ‘যতটুকু মেনে নিতে পারো’, ‘পতাকা নয় দিগন্ত’ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি |

6 Responses

  1. পড়লাম। খুব ভাল। পার্টির এই ময়নাতদন্তগুলো খুব প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে অনেক অন্যায় চলেছে দীর্ঘদিন।

  2. খুব ভালো লাগলো। টানটান উত্তেজনা। রাজনৈতিক পার্টি বদলের উপর অসম্ভব সুন্দর গল্প লিখেছেন বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *