জ্যৈষ্ঠের দুপুরের অসহ্য গরম কেটে গিয়ে ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া ছেড়েছে সন্ধের পর থেকে। আজ পূর্ণিমা। কাঁসার থালার মত বিশাল চাঁদ উঠেছে আকাশে। জোছনায় জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। খড়ে চূর্ণী নদীর জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে কুলকুল করে। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে চূর্ণীর জল। ঘাটের ধারে বাঁধা একটি সুদৃশ্য বজরা। ঘাটের খানিকটা দুরে বিষমকুলের গড়। দোতলা পাকা ইঁটের তৈরি গোলাকৃতি এই দোতলা বাড়িটিকে স্থানীয় মানুষ রাজা বিশ্বনাথ বা বিশ্বনাথবাবুর গড় নেমেই চেনে। অতি দুর্গম এ স্থান। সাঁড়াশির মত দুদিক থেকে জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে চূর্ণী। কেল্লার চারপাশে ঘন জঙ্গল। দু’দশ ঘর দুলে বাগদী পরিবার ছাড়া আর কারও বাস নেই এ চত্বরে। বিশেষ অনুমতি না থাকলে কোনও নৌকা ভিড়তে পারেনা বিষমকুলের ঘাটে। কেল্লার চারিদিকে গভীর পরিখা কাটা। ঢোকা আর বেরনোর রাস্তা বলতে মূল ফটকের দুপাশে মোটা শিকলে আটকানো একটা কাঠের পাটাতন। পারাপারের প্রয়োজনে নামিয়ে দেয়া হয় সেটাকে। এছাড়াও একটা গোপন সুড়ঙ্গ রয়েছে কেল্লার পিছনে। বিপদ বুঝলে সেই সুড়ঙ্গ পথ ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় আধ মাইলটাক দুরে শিয়ালমারির ঘাটে। ঘাটে বাঁধা রয়েছে সার সার ছিপ নৌকোদাঁড় টেনে চূর্ণীর জলে উধাও হয়ে যেতে এক মুহূর্ত লাগবেনা। যদিও সেই গোপন রাস্তা ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি আজ পর্যন্ত। এই মুহূর্তে কেল্লার ছাদে ফরাশের ওপর তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে রয়েছে বিশ্বনাথ। খালি গা। নিম্নাঙ্গে পাটভাঙা সাদা ধুতি। নাতি দীর্ঘ সুঠাম চেহারা। একমাথা ঝাঁকড়া বাবরি চুল। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। একনজরে দেখলে আরও কম মনে হয়। বিশ্বনাথের সামনে করজোড়ে বসে রয়েছেন কানাইপুরের ছোট-তরফের জমিদার নৃপতি রায়। দুধে আলতা গাত্রবর্ণ। পরনে মসলিনের আচকানচোখে আকুতিমাখা দৃষ্টি“আমাকে বাঁচান বিশ্বনাথবাবু। আপনি কৃপা না করলে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে ধনেপ্রাণে মারা পড়বো একেবারে।” শোনামাত্র হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো পাশে দাঁড়ানো বিশ্বনাথের সাকরেদ মেঘা। “ লিচ্চয় বাবুর নাক অবধি জল ঠেকছে রে বিশে। নইলে রাত বিরেতে এরকম কাপড়ে চোপড়ে হয়ে তোর কাছে ছুটে আসেন।” ভয়ে ভয়ে আড়চোখে চারপাশে তাকালেন নৃপতি। বিশ্বনাথের দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়ানো চারজনএদের সবাইকেই ভালভাবে চেনেন তিনিন। একটু দুরে ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো পীতাম্বর ওরফে পীতু হাড়ি আর প্রেমচাঁদ ডোম। ওদের দুজনের তুল্য দঢ় লেঠেল আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবেনা গোটা হুগলী, নদে আর মুকশুদাবাদ(মুর্শিদাবাদ) জেলা ঢুঁড়ে ফেল্লেও। প্রবাদ, বন্দুকের গুলিও নাকি আটকে যায় এই দুজনের লাঠির সামনে। তাড়া করে ছুটন্ত গুলবাঘকেও নাকি পিটিয়ে মারতে পারে প্রেমচাঁদ এমনটাই বলে সকলেসিঁড়ির মুখে দরজার সামনে নলে। সিরিঙ্গে পাকানো চেহারা। সাপের মতো দ্রুত। একটা লম্বা সরু বাঁশের নল মুখে লাগিয়ে ভাগীরথী আর চূর্ণীর জলে ডুবে থাকতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ধনী গৃহস্থের নৌকা কাছাকাছি এলেই জলের তলা থেকে হিংস্র কুমীরের মত বিদ্যুৎগতিতে উঠে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে নৌকোয়। কী ঘটছে সেটা যাত্রীরা বুঝে ওঠার আগেই লুটে পুটে সাফ করে দেয় পুরো নৌকা। নল লাগিয়ে জলে ডুবে থাকতে পারার জন্য ওর নাম হয়েছে নলেডোবারোগাপাতলা চেহারা কিন্তু সড়কির হাতটা মারাত্মক। হাতে ল্যাজা মানে সড়কি থাকলে বিশ বিশটা শা-জোয়ানের মহড়া নিতে পারে নলে- এমনটাই বলে সবাই। বিশ্বনাথের পাশে দাঁড়ানো মেঘা শেখ। বিশ্বনাথের ডানহাত। সবচেয়ে বিস্বস্ত অনুচর। ল্যাজা, বল্লম আর তলোয়ার তিনটেতেই সমান ওস্তাদ। এছাড়া সর্বক্ষণের সঙ্গী কোমরে গোঁজা পাবড়া। চেরা মুলি বাঁশের আধহাত ছোট লাঠি। পা তাক করে ছুঁড়লে হাঁটুভাঙ্গা দ হয়ে  মুহূর্তে মাটিতে লটকে পড়বে শিকার। নড়চড়ার শক্তিটুকুও থাকবে না, পালানো তো দুরের কথা। দলের মধ্যে যে সামান্য দুএকজন বিশ্বনাথের সঙ্গে তুইতোকারি করে কথা বলার সাহস রাখে তার মধ্যে মেঘা অন্যতম। সেই মেঘা এই মুহূর্তে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে জমিদারবাবুর অবস্থা দেখে। এত দাপুটে জমিদার, বিশের বাপের বয়সি। পাঁচ সাতটা গাঁয়ের মালিক। কেমন জোড়হাত হয়ে রয়েছে বিশের সামনে। “আঃ মেঘা,” মৃদু ধমক দিয়ে মেঘাকে থামালো বিশ্বনাথ। তারপর ঘুরে তাকালো নৃপতি রায়ের দিকে “বলুন জমিদারবাবু, কেন এসছেন আমার কাছে?” আচকানের ট্যাঁক থেকে সিল্কের রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন নৃপতি রায়। নিজেকে গুছিয়ে নিলেন একটু। তারপর শুরু করলেন নিচু গলায়-“আপনি তো আমার অবস্থা সবই জানেন বিশ্বনাথবাবু। মাত্র সাত-আটটা ছোট গাঁয়ের জমিদার। প্রজাদের অবস্থাও ভালো নয় মোটে। বেজায় গরীবগুর্বো মানুষজন সব। খাজনাপত্তর আদায় হয় না ঠিকঠাক। তার মধ্যে আবার নয়া এক কানুন বের করেছে ইংরেজ কোম্পানি বাহাদুর। সূর্যাস্ত আইন। প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট দিনে সূর্য  ডোবার আগে গিয়ে কোম্পানির খাজনা পাইপয়সা মিটিয়ে দিয়ে আসতে হবে। একটি দামড়ি পর্যন্ত ধার বাকী রাখার জো নেই। নইলেই কোম্পানি জমিদারী জব্দ করে নেবে। তারপর নিলেম হেঁকে তুলে দেবে অন্য জমিদারের হাতে। আগামী মাসের পয়লা তারিখ আমার খাজনা মেটানোর শেষ দিন। এদিকে আদায়পত্তরও হয়নি একফোঁটা। তাই বড় দায়ে পড়ে ছুটে এসছি আপনার কাছে। আপনি ছাড়া আর কেউ এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না আমাকে।” বলতে বলতে প্রায় ডুকরে উঠলেন নৃপতিবাবু। শান্ত চোখে নৃপতির দিকে তাকালো বিশ্বনাথ। একটা মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে। “দেখুন জমিদারবাবু, সেই হুগলী থেকে হাওড়া, কোলকেতা হয়ে চব্বিশ পরগণা, নদে, মুকশুদাবাদ এই এত্তগুলো জেলার যত গরীবগুর্বো মানুষজন আমাকে বিশ্বনাথ বাবু, রাজা বিশ্বনাথ নামে ডাকে। কিন্তু আপনাদের মত জমিদার, দেওয়ান, কোম্পানির সায়েব আর বাবুদের কাছে তো আমি বাগদীর ব্যাটা বা বিশে ডাকাত বই আর কিছুই না। আড়ালে যে আমাকে মুখ্যু বাগদীর ব্যাটা, হেলে কৈবত্ত বলে গাল দ্যান আপনারা সেটাও অজানা নয় আমার, তা বলে সত্যি সত্যি আমাকে অতটা মূর্খ ভাববেন না দয়া করে। আপনি বলছেন আপনার খাজনা আদায় হয়নি। কিন্তু আমি জানি পাইক লেঠেল পাঠিয়ে গরীব প্রজারায়তদের বুকে বাঁশডলা দিয়ে তাদের গলা চিরে শেষ রক্তবিন্দুটুকু পর্যন্ত চুষে নিয়েছেন আপনি। লাখ লাখ টাকা আদায় করেছেন আর সেই টাকায় মোচ্ছব-ফুর্তির ফোয়ারা ছুটিয়ে দিয়েছেন একেবারে। কোলকেতা থেকে পেটি পেটি বিলেতি মদ আসে আপনার। সেখানে জানবাজার আর রামবাগানে সব মিলিয়ে ছ-ছটি রাঁঢ় পুষেছেন আপনি। তালতলায় ফেতোবাবু, ঠগ আর নৌসেরাদের আড্ডায় জুয়ো খেলতে গিয়ে জলের মত টাকা খুইয়েছেন। ফরাসডাঙ্গায় তিন লাখ টাকা খরচ করে সুন্দরী রক্ষিতাকে গঙ্গার ধারে প্রাসাদের মত বাড়ী করে দিয়েছেন। যে ব্যবসা বোঝেননা সেই নুনের দেওয়ানি করতে গিয়ে গুচ্ছের টাকা লোকসান গুনেছেন। কি মনে করেন, এসবের খবর পাইনা আমি? মনে রাখবেন জমিদারবাবু, আমার নাম বিশ্বনাথ বাগদী। মুকশুদাবাদ থেকে সেই কোলকেতা… আপনাদের মত বাবুদের এক এক আঙ্গুল পা ফেলার খবর রাখি আমি। চারদিকে আমার মাছি(চর) আর আড়কাঠিরা ছড়িয়ে রয়েছে। তারা সব খবর দেয় আমাকে। যাক গে, ওসব ছেঁদো কথা ছেড়ে আমাকে বলুন কি প্রয়োজনে এসেছেন এখানে?” কথাগুলো বলার সময় একবারের জন্যও জমিদারবাবুর চোখ থেকে চোখ সরায়নি বিশ্বনাথ। তীব্র অন্তর্ভেদী সেই দুচোখের দৃষ্টি। সবকিছু ভেদ করে ভিতরটা পড়ে ফেলবে যেন। অথচ ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মৃদু শান্ত হাসিটা মেলায়নি একটুও। তীক্ষ্ণ বর্শার মত সেই দৃষ্টির সামনে ভিতরে ভিতরে থর থর করে কেঁপে উঠলেন নৃপতি রায়। বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হলো না  বিশ্বনাথের কথার প্রতিবাদে আর একটা কথাও বলা চলবে না। সুতরাং ভণিতা না করে কাজের কথাটা পেড়ে ফেলতে হবে এইমুহূর্তে। শুকিয়ে যাওয়া গলাটা কেশে একটু সাফ করে নিলেন নৃপতি। তারপর শুরু করলেন বিনীত গলায়- “একটি ছোট আবেদন রয়েছে আপনার কাছে, বিশ্বনাথবাবু। আপনি তো জানেন আমার পিতৃদেব জমিদার স্বর্গত শ্রী গজপতি রায় দুবার দার পরিগ্রহ করেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান আমি। স্বাভাবিকভাবেই পিতার সম্পত্তিতে আমার সমান উত্তরাধিকার। কিন্তু কি অবিচার দেখুন। মৃত্যুর আগে বাবামশাই দলিল করে সম্পত্তির সিংহভাগ দিয়ে গেলেন আমার বৈমাত্রেয় বড় ভাই বড়তরফের জমিদার ভূপতি রায়কে। উনি পেলেন বাইশটা গ্রামের জমিদারী আর আমার কপালে সেখানে মাত্র আটটা গ্রাম। এটা চূড়ান্ত অন্যায় নয় কি, আপনিই বলুন বিশ্বনাথবাবু।” করুণ চোখে প্রশ্ন করলেন নৃপতি। শোনার পর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা আরেকটু চওড়া হল বিশ্বনাথের। মাথা নামিয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন গজপতি। একথা মানতেই হবে। জমিদারী কার হাতে বেশি সুরক্ষিত থাকবে একথা বুঝতে পেরেছিলেন আগেভাগেই। মুখে সেটা প্রকাশ না করে ফের চোখ তুলে তাকালো নৃপতির দিকে। “রায়মশাই, আপনি কি চাইছেন আমি আপনাকে টাকাটা দিই?” শোনামাত্র আধহাত জিভ কেটে দুকানে আঙুল ছোঁয়ালেন নৃপতি রায়। “ আরে ছি ছি! আপনার মত মানী মানুষকে সেকথা আমি বলতে পারি কখনও।” বলতে বলতে ধূর্ত চোখদুটো সরু হয়ে উঠল নৃপতির “ তার বদলে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে আপনাকে।” “কী কাজ?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল বিশ্বনাথ। প্রশ্নের জবাবে শেয়ালে একটা হাসি হাসলেন নৃপতি। “এ মাসের সাতাশ তারিখ, বড়তরফ মানে আমার দাদা ভূপতি রায়ের খাজনার টাকা জমা দেয়ার দিন। দাদা নিজে যাবে টাকা জমা করতে লোকলস্কর নিয়ে কেষ্টনগরে ম্যাজিস্ট্রেটের কুঠিতে। মাঝপথে আপনাকে দলবল নিয়ে একটু দর্শন দিতে হবে শুধু…।” শোনামাত্র চিড়িক করে বিদ্যুৎ খেলে গেল বিশ্বনাথের মাথায়“ আপনার খাজনার পরিমাণ কত?” “বিশ হাজারের কাছাকাছি।” জবাব দিলেন নৃপতি। “আর আপনার দাদার?” ফের প্রশ্ন করলো বিশ্বনাথ। “হেঁ হেঁ, ভিতরের খবর যা পাচ্ছি, তাতে মেরেকেটেও পঞ্চাশ হাজারের কম তো কিছুতেই নয়।” কান এঁটো করা একটা হাসি হাসলেন নৃপতি। “ওঃ জমিদারমশাই” পাশ থেকে ফুট কাটলো মেঘা “জীবনে বহুত শেয়াল দেখেছি হেঁড়েশেয়াল, পাতিশেয়াল, খ্যাঁকশেয়াল, কিন্তু বড়পীরের কিরে, আপনার মত ভেমোশেয়াল আর দুটি দেখিনি, মাইরি বলছি।” মেঘার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীসাথীরা, এমনকি বিশ্বনাথও। একটু বাদে হাসি থামিয়ে ঘুরে তাকানো নৃপতির দিকে। “তার মানে রায়মশাই, আপনি আমাকে আপনার বড়ভাইয়ের খাজনার টাকাটা ডাকাতি করতে বলছেন। কিন্তু তাতে আমার স্বার্থটা কি আর কাজটা তো আপনিই আপনার পাইক লেঠেলদের পাঠিয়েই করতে পারতেন। তারা শুধু মুখে কাপড় বেঁধে নিতো যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে।” বিশ্বনাথের প্রশ্নের জবাবে গম্ভীর হয়ে গেলেন জমিদারবাবু। “আপনার দ্বিতীয় জবাবটা দিই আগে। বড়দার লেঠেল পাইকের সংখ্যা আমার প্রায় তিনগুণ। এছাড়া বিহার থেকে সম্প্রতি দুটো ভোজপুরি পালোয়ান আনিয়েছেন বড়দা। কাঁচাখেগো যমদূতের মত চেহারা ব্যাটাদের। ইয়া পাকানো গালপাট্টা মোচ। ভাঁটার মত চোখ। দোনলা দুটো গাদাবন্দুক নিয়ে সবসময়য় ছায়ার মত লেগে থাকে বড়কর্তার সঙ্গে। ওই ফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে এক মিনিটও টিকতে পারবেনা আমার লেঠেলরা। মাঝখান থেকে পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবে। কোম্পানির খাঁড়ার মুখে পড়বো আমি। বাকী রইল আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটা। আপনার স্বার্থ কি? ডাকাতির টাকায় আমার খাজনা মিটিয়েও হাতে থাকবে তিরিশ হাজার। আমার প্রস্তাব মেনে যদি আপনি কাজটা করতে রাজি থাকেন তাহলে ওই তিরিশ হাজার টাকা পুরোটাই আপনার। রাজি?” মৃদু চোখ নাচালেন রায়মশাই। দু এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবলো বিশ্বনাথ। তারপর হাতখানা বাড়িয়ে দিলো নৃপতি রায়ের দিকে। “রাজি।” “যাক, আপনি নিশ্চিন্ত করলেন আমাকে।” খুশিতে দুহাতে বিশ্বনাথের হাতটা চেপে ধরলেন রায়মশাই। “এবার তাহলে আজ্ঞা হোক, আমি উঠি।” “বসুন রায়মশাই।” ওঠার মুখে জমিদারবাবুকে থামালো বিশ্বনাথ “আর দুটো কথা আছে আমার। লুঠের বাড়তি টাকা পুরোটা আমি নেব না। এর অর্ধেকটা আপনার গরীব রায়তদের মঙ্গলের কাজে লাগাবেন আপনি। কাজে লাগানো বলতে ধানধ্যান, পুকুর কাটা, অন্নসত্র…এইসব আর কি। বাকি অর্ধেকটা আমার। আগেই বলেছি, চারিদিকে আমার লোক ছড়ানো আছে। ওই পনের হাজার টাকার মধ্যে একটা পাই পয়সাও যদি গরমিল করার চেষ্টা করেন, ঠিক খবর পেয়ে যাব আমি। আর সেক্ষেত্রে আমার চেয়ে বড় শত্রু আপনার জন্য আর কেউ হবেনা। দয়া করে মনে রাখবেন কথাটা। আর শেষমেশ যেটা আপনাকে বলার, লোকের মুখে খবর পাচ্ছি আপনার সাতটা গাঁয়ের মধ্যে নসিবপুর মৌজাটা নাকি ওই নীলকর ফেডি সায়েবের কাছে দাদন দেয়ার বন্দোবস্ত করছেন আপনি এ কাজটা করবেন না। আপনি অত্যাচারী ঠিকই, কিন্তু এই নীলকর সায়েবরা নরপিশাচ একেবারে। বাপঠাকুরদার আমলের প্রজাদের মানুষখেকোদের হাতে তুলে দেবেন না, দোহাই আপনার। গরীবের ওপর এইটুকু অনুগ্রহ করবেন দয়া করে।” শোনামাত্র শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা জল নেমে গেল নৃপতি রায়ের। খুব গোপনে সবে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন ফেডি সায়েবের সঙ্গে। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুয়েকজন সহচর  ছাড়া যা জানা সম্ভব নয় আর কারো পক্ষে। সে খবর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে শালা বিশেটার কানে! আপাততঃ শিকেয় তুলে রাখতে হবে পরিকল্পনাটা।“আপনার কথা আমার মনে থাকবে বিশ্বনাথবাবু।” তোষামুদে হাসিটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখে জবাব দিলেন নৃপতি। “পেমা”। একটু দূরে দাঁড়ানো প্রেমচাঁদকে ডাকলো বিশ্বনাথ। “নীচে ছেলেছোকরাদের দুএকজনকে বল জমিদারবাবুকে ঘাটে বজরা অবধি ছেড়ে দিয়ে আসতে।” “আমি তাহলে?” নমস্কারের ভঙ্গীতে হাতজোড় করলেন নৃপতি রায়“আসুন” হেসে প্রতিনমস্কার করলো বিশ্বনাথ। প্রেমচাঁদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন জমিদারবাবু।

পর্ব ৩ https://banglalive.today/shonitmontro-part-three-episodic-historical-fiction-by-supriyo-chowdhury/

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

4 Responses

  1. পলে পলে পরত খুলছে , কৈবর্ত ডাকাত রাজ, মানুষ কে ভরপুর খাইয়ে ও নিজে ভরপুর খেত – লুম্পেন দের মধ্যেও ছিল কিছুটা দিয়ে খাওয়ার মানসিকতা যা কখনই জমিদারদের ছিল না । সাধারনের কাছহে নীলকর আর জমিদার একি বস্তু , মাঝে কয়েকটা নেপো ও দাঁও মারত ।। এটাই ছিল সামন্তবাদ – কান পেতে রই এক কৈবর্ত নিরন্ন কুলের কিসসা শনবার জন্যে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *