সিঁড়িতে পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর বিশ্বনাথের পাশে এসে বসল মেঘা। “এ শালা কানাইপুরের ছোটতরফকে বিশ্বেস নেই রে বিশে। লোভের টোপ দিয়ে হয়তো নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল কোম্পানির ফৌজের সামনে। সাপের চেয়েও বেইমান এ হারামজাদা।” হেসে বন্ধুর দিকে তাকালো বিশ্বনাথ।

-কথাটা আমিও ভেবেছি রে মেঘা। আড়কাঠিদের খবর পাঠা। খোঁজ নিয়ে জানাক খবরটা সত্যি কিনা।

-ঠিক আছে সর্দার। বলল মেঘার পাশে দাঁড়ানো কেষ্ট সর্দার।

সামনে এসে দাঁড়াল নলেডোবা।

-সর্দার, চাকদায় ওই ছিদেম বেনের বাড়িতে দু’হাজার টাকা চেয়ে যে চিঠি পাঠিয়েছিলে, আজ বিকেলেই বেনের গোমস্তা ব্যাটা এসে হাগতে মুততে পৌঁছে দিয়ে গেছে। সঙ্গে একঝুড়ি বেগমপসন্দ আম আর এক পেটি বিলিতি মাল। চল ওস্তাদ, সবাই মিলে একটু আচমনে বসা যাক।

-নাঃ রে। উদাস চোখে নলের দিকে তাকিয়ে হাসলো বিশ্বনাথ। “আজ ভালো লাগছে না। তোরা যা বরং।”

-বলিস কী রে! ফিচেল হাসি ঠোঁটের কোণে। নকল বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল মেঘা। “বিশে বাগদীর কারণে অরুচি, এ তো বেড়ালের মাছে অরুচির চেয়েও তাজ্জব ব্যাপার। চ’ চ’, আর দেয়ালা করিসনি।”

-না রে। সত্যিই আজ ভালো লাগছে না। আমি বরং ফরাসে একটু গড়িয়ে নিই।

আর কিছুক্ষণ পিড়াপীড়ি করে নেমে গেল সবাই। ফিরে এসে চিৎ হয়ে ফরাসে শুয়ে পড়ল বিশ্বনাথ। শনশন হাওয়া বইছে। মাথার ওপর বিশাল চাঁদ। ঝাঁক ঝাঁক তারা। যেন মোটা চিনির দানা বস্তা থেকে উপুড় করে আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ। মাঝে মাঝে পেঁজা পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে আসছে। হাল্কা আস্তরনে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। উদাস চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল বিশ্বনাথ। ঠিক তখনই মাথায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। কখন নিঃশব্দে পাশে এসে বসেছে দুর্গা। দুর্গা বিশ্বনাথের বিবাহিতা স্ত্রী নয়, তবু অনেকদিন হল একসঙ্গে রয়েছে ওরা দু’জন।

-কি ভাবছ বিশ্বনাথবাবু? মাঝে মাঝে রসিকতা করে ওকে এ নামেই ডাকে দুর্গা।

-নাঃ, তেমন কিছু না। ওর দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত চোখে হাসল বিশ্বনাথ।

-সে বললে তো শুনছি না। কিছু না হলে তো এমন চুপচাপ শুয়ে থাকার লোক তো বিশ্বনাথবাবু নয়।

এই হচ্ছে দুর্গা। বাপ-মা মরা মেয়ে, কায়েত ঘরের বালবিধবা। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে টিঁকতে না-পেরে ফিরে এসেছিল বাপের বাড়িতে। দাদা-বৌদির সংসারে। ওর মতো সহায়সম্বলহীন বিধবা চিরকালই সংসারের গলায় বোয়াল মাছের কাঁটার মতো। সারা দিন অমানুষিক খাটুনি। তবু দাদা-বৌদির গঞ্জনা থেকে রেহাই নেই। গঞ্জনা ক্রমে ক্রমে পরিণত হয়েছিল শারীরিক অত্যাচারে। নিত্যনৈমিত্তিক মারধর খাওয়াটা প্রায় জলভাত হয়ে গিয়েছিল দুর্গার কাছে।

বছর চারেক আগেকার কথা। বাড়ির উঠোনে ফেলে ঝাঁটা দিয়ে দুর্গাকে সাপপেটা পিটছিল বৌদি। “মর মর ভাতারখোয়ারি শতেকখাকি, এতো শ্যালকুকুর মরে। তুই মত্তে পারিসনি হারামজাদি?” মাটিতে লুটোপুটি খেয়ে কাঁদছিল দুর্গা। কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়। পাশে দাঁড়িয়ে গর্জাচ্ছিল দাদা- “মার, মার হারামজাদিকে…।” শিমুলিয়ায় এক জমিদার বাড়িতে ডাকাতি সেরে দলবল নিয়ে ওই পথ ধরেই ফিরছিল বিশ্বনাথ। দৃশ্যটা চোখে পড়ে যায়। রণপা থেকে নেমে এক লাথিতে বেড়ার দরজা খুলে ঢুকে গিয়েছিল উঠোনে। হাতের লাঠি দিয়ে টানা পিটেছিল দুর্গার দাদাকে যতক্ষণ না জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বৌদির চিলচিৎকারে ছুটে এসেছিল পাড়াপড়শিরা। সামনে দাঁড়ানো বিশে ডাকাত। সাক্ষাৎ যমের দোসর। সবাই চেনে ওকে। ভয়ে টুঁ শব্দটি কাড়ার সাহস হয়নি কারও। হাতের লাঠিটা মেঘার হাতে দিয়ে সটান দুর্গার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বনাথ। চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছিল “আমার সঙ্গে যাবে? সেখানে গেলে ভালো থাকবে কিনা জানি না, তবে অসম্মান হবে না এটুকু কথা দিতে পারি…।” ভয়ে-বিস্ময়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা দুর্গা ভাবতে সময় নিয়েছিল দু’চার মুহূর্ত। তারপর পাড়াপড়শিদের হতবাক চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে এসে উঠে পড়েছিল ডাকাতদলের পালকিতে। সেই থেকে বিষমকুলের গড়েই রয়ে গেছে ও। ওকে ভালবাসে কিনা জানে না বিশ্বনাথ। তবে এটা জানে, দুর্গা ওর কাছে একটা আয়নার মত। সুখ, দুঃখ, জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো পর্যন্ত ধরা পড়ে যায় ওর সামনে দাঁড়ালে। আসলে দুর্গা একটা অমোঘ অস্তিত্ব বিশ্বনাথের কাছে। শরীরের কোনও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।

-কি গো বিশুবাবু, কথার উত্তর দিচ্ছ না যে বড়? গভীর চোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে ফের প্রশ্ন করল দুর্গা। ওর দিকে তাকিয়ে আরও একবার সেই বিষণ্ণ হাসিটা হাসল বিশ্বনাথ।

-সত্যি জানি না রে দুর্গা। এক একটা দিন এরকম হয়। কোনও কারণ নেই, তবু খুব ক্লান্ত লাগে…। এই তো পীতু, মেঘা সবাই মিলে মদ খাওয়ার জন্য কত পিড়াপীড়ি করল। তবু যেতে ইচ্ছে করল না। তার চেয়ে বরং এই খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকতেই ভাল লাগছে।

গভীর চোখে অনেকক্ষণ ধরে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে রইল দুর্গা। যেন বোঝার চেষ্টা করছে কিছু একটা। তারপর নিচু হয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল বিশ্বনাথের ঠোঁটে। শান্ত গলায় বলল, “ভালোই করেছ না গিয়ে। তুমি শুয়ে থাকো। আমি বরং তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।” কপালে ঠান্ডা কোমল আঙুলের স্পর্শ, ধীরে ধীরে বিলি কেটে উঠে যাচ্ছে ঘন চুলের মধ্যে। চোখ বন্ধ করে ফেলল বিশ্বনাথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে।

****

খাজাঞ্চিখানায় বসে রয়েছেন ভূপতি রায়। কানাইপুরের বড় তরফের জমিদার। দীর্ঘকায় অনিন্দ্যকান্তি চেহারা। শ্বেতশুভ্র মাথার চুল। চোখে পাঁশনে চশমা। পরনে পাটভাঙ্গা সরু শান্তিপুরী ধুতি পাঞ্জাবি। বদ্ধ প্রায়ান্ধকার ঘরে বড় বড় কয়েকটা সুদৃশ্য খাগড়াই বাতিদানে রেড়ির তেলের বাতি জ্বলছে। দু’পাশে অনেকগুলো তাকে সার দিয়ে সাজানো একের পর এক গুনচটে বাঁধা লোহা আর কাঠের সিন্দুক। জমিদারির সমস্ত দলিলপত্র রাখা রয়েছে ওর মধ্যে। মাঝখানে বিশাল এক টেবিল। তার ওপর উপুড় করে রাখা স্তূপীকৃত নগদ মুদ্রা। তিনজন কর্মচারি ঘেমেনেয়ে একাকার। টাকা গুনে চলেছে অবিশ্রান্ত। পিছনে দাঁড়ানো খাজাঞ্চিবাবু রামগতি সরকার। বেঁটেখাটো রোগাপাতলা গড়ন। নাকের ডগায় চশমা। বয়স ষাট টপকেছে বেশ কিছুদিন। মাথা জোড়া টাকে বিনবিনে ঘামের ফোঁটা। পিছনে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন পুরো ব্যাপারটা। জমিদারবাবুর পাশে দাঁড়ানো নায়েবমশাই কেদার চক্রবর্তী। খড়্গের মত নাক। উঁচু কণ্ঠনালি। দুধ-মারা ক্ষীরের মত পাকানো চেহারা। গলায় কণ্ঠির মালা। ওঁর পিতৃদেব অঘোরনাথ চক্রবর্তীও নায়েব ছিলেন কানাইপুর এস্টেটে। ভূপতি রায়ের পিতৃদেব গজপতি রায়ের মৃত্যুর পর এস্টেট দু’ভাগ হলো। কেদারবাবু থেকে গেলেন বড় তরফেই। বিশ্বস্ত লোক। দক্ষতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে আসছেন বহু বছর ধরে। খাজনা আদায়ের জন্য যে কোনও পদ্ধতি অবলম্বনে দু’বার ভাবেন না কখনও। কানাইপুরে প্রবাদ আছে মরা প্রজার পেট কেটে টাকা বের করে আনতে পারে কেদার চক্কোত্তি। ওঁর বহু কীর্তিকলাপের কাহিনি ত্রাস হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বড় কানাইপুরের বিশ বাইশটা গাঁয়ে।

সরকাটি গাঁয়ের হারু বাউরি। আগামীকাল লেঠেল পাইক নিয়ে চক্কোত্তি মশাই খাজনা আদায়ে আসবেন শুনেই একবস্ত্রে বউ-বাচ্চা নিয়ে’ পালিয়েছিল গাঁ ছেড়ে। আর ফিরে আসেনি কোনওদিন। সে ভিটেয় এখন ঘুঘু চড়ে। সাপখোপের আড্ডা। ইসমাইলপুরের মোবারক আলি। খাজনা বাকি পড়েছিল এক বছরের। নায়েব মশাইয়ের আদেশে পাইক দিয়ে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল খোলা মাঠে। হাত-পা পিছমোড়া করে বেঁধে। ঠা ঠা বোশেখ মাসের ভর দুপুরে। খাবার তো দূরস্থান, জলটুকু পর্যন্ত না দিয়ে। মোবারক আলি। তাগড়া শা-জোয়ান। পাথরে কোঁদা চেহারা। দু’দিন পর্যন্ত সহ্য করতে পেরেছিল। তারপর শেষ বিকেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল শরীরটা। নিথর, প্রাণহীন। পুরো গাঁয়ের লোক দাঁড়িয়ে দেখেছিল। মুখে এক ফোঁটা জল দেবার সাহস হয়নি কারও।

তবে চক্কোত্তি মশাইয়ের সেরা দাওয়াইটা বোধহয় জমিদারবাড়ির গুমঘর। প্রাসাদের পিছনে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ ধরে সোজা নেমে যাওয়া যায় গুমঘরে। আলো বাতাসের প্রবেশ নিষেধ সেখানে। ঠান্ডা স্যাঁতস্যাঁতে। খুব ব্যাদড়া ধরনের প্রজাকে ধরে এনে ঠেলে দেয়া হয় গুমঘরে। মেঝেতে বিছানো ঘন কাঁটাতারের চাদর। এতটাই ঘন যে একজন মানুষ ফাঁকে ফাঁকে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বড়োজোর। শোওয়া বা বসার কোনও উপায় নেই। কেদার চক্কোত্তি নির্দয় নন। প্রতিদিন সকালে এক শানকি পান্তাভাত ঠেলে দেওয়া হয় দরজার তলা দিয়ে। হাজার হলেও কেষ্টর জীব। যে কদিন টেঁকে। তবে নায়েবমশাই খেয়াল করেছেন এ খেলাতেও বড়জোর দু’হপ্তা। তার বেশি টিঁকতে পারেনি কেউ। খেলা শেষ হলে গুমঘরের পেছনের দরজা খুলে ঢালু পিছন-রাস্তা বেয়ে সোজা নদীতে। ঘোড়েল আর বেঁশেল কুমিরে ভর্তি। ওদের পেট ভরানোর কাজে লাগে। খেলাপি প্রজারা খাজনা মকুব করার জন্য পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করলে খুব খারাপ লাগে নায়েবমশাইয়ের। জপের মালায় হাত ঘোরাতে ঘোরাতে মিহি হেসে বলেন, “আরে বাবা, তোরা খাজনা না মেটালে কোম্পানি চলবে কী করে আর জমিদারই বা খাবে কী? রাধেমাধব, রাধেমাধব।”

এহেন নায়েবমশাই, শ্রী কেদার চক্রবর্তী উশখুশ করছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। হাত কচলাচ্ছিলেন ঘনঘন। ভঙ্গিটা বিলক্ষণ চেনেন ভূপতি রায়। কিছু বলতে চাইছেন নায়েব। “কিছু বলবেন?” কেদার চক্কোত্তির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ভূপতি।

-হেঁ হেঁ, বলছিলাম কি হুজুর, এতগুলো টাকা যাচ্ছে। শুধুমাত্র নিজেদের ওপর ভরসা না করে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে দরখাস্ত দিয়ে কোম্পানি থেকে কয়েকটা সেপাই আনিয়ে নিলে হত না? এতখানি পথ। নীল, ঠ্যাঙামারি আর বাঙালচি, সব মিলিয়ে তিন তিনটে জঙ্গল পড়বে রাস্তায়। কত রকম বিপদআপদ পথে…

-ব্যাস, ব্যাস।কথার মাঝখানেই চক্কোত্তিকে হাত তুলে থামালেন ভূপতি। “জমিদারি থাকলে বিপদ থাকবে। আর সেই জন্যই এদের মত পঞ্চাশটা কুত্তা পুষছি।” আঙুল তুলে দেখালেন পিছনে দাঁড়ানো লেঠেল সর্দার হারু আর জীতেন বাউরির দিকে। তারপর চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন দরজার দিকে। দরজার দুই পাশে দুই ভোজপুরি সেপাই। রামখেলাওন যাদব আর ছেদিলাল সিং। দানবাকৃতি চেহারা। মাথায় পাগড়ি। গাল জোড়া পাকানো গালপাট্টা। দু’জনের কাঁধেই দোনলা বন্দুক। সেদিকে তাকিয়ে বিরক্তি আর ব্যঙ্গমিশ্রিত একটা হাসি হাসলেন জমিদারবাবু।

-আর এই দুটো ষাঁড়? প্রতিমাসে নগদ কুড়ি টাকা করে মাইনে। দিনরাত আখড়ায় কাদামাটি মেখে জাপটাজাপটি করছে। ঘি-দুধ আর দিস্তে দিস্তে রুটি ওড়াচ্ছে। তারপর ছিলিম ছিলিম গাঁজা আর লোটা লোটা ভাং টেনে রাতের বেলা ঘুমোচ্ছে ভোঁস ভোঁস করে। কাজ বলতে তো ন্যাঙ্গাপ্যাংলা মড়াখেকো যত রায়তদের ঘেঁটি ধরে টেনে এনে আপনার পায়ের কাছে ফেলা। এ বার একটু আসল পরীক্ষা হোক! এত্ত লোকলস্কর, পাইক পেয়াদা নিয়ে যদি তিনটে জঙ্গল পেরতে না পারি, তাহলে তো সব ছেড়েছুড়ে কাশিবাসী হয়ে যাওয়া ভালো!

জমিদারবাবুর কথায় বিলকুল চুপ মেরে গেলেন নায়েবমশাই। পাশে রুপোর গেলাসে রাখা দুধ-পেস্তা-বাদামের সরবত। গেলাসের ঢাকনা সরিয়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিলেন ভূপতি রায়। পকেট থেকে রেশমি রুমাল বের করে গোঁফটা মুছে নিলেন ভালো করে। তারপর ফের ঘুরে তাকালেন নায়েবমশাইয়ের দিকে।

-তা টাকাপয়সা নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কী ভেবেছেন?

-আজ্ঞে হুজুর, পঞ্চাশটা কলসি, পেটি আর টুকরিতে করে নজরানা যাবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। ওপরে চাল ডাল ঘি বাদাম পেস্তা আখরোট আর মদের বোতল। তলায় খাজনার টাকা। টেরটিও পাবেনা কেউ।

-হুম। সন্তুষ্টির ছাপ ভূপতির গলায়। “আর যাত্রার সময়?”

-আগামী পরশু। বুধবার ঊষা লগ্নে। একদম কাকভোরে। পুরুতমশাইকে দিয়ে পাঁজি দেখিয়ে রেখেছি আমি। একদম শুভলগ্ন। বচনে বলে ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা/যথা ইচ্ছা তথা যা’ বিকেল বিকেল পৌঁছে যাওয়া যাবে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কুঠিতে।

হাত কচলে উত্তর দিলেন ভূপতি।

-ঠিক আছে। আপনি তাহলে সব ব্যবস্থা করে ফেলুন। আমি মহালে যাচ্ছি।

বলতে বলতে ধুতির কোঁচা হাতে উঠে দাঁড়ালেন ভূপতি রায়। সঙ্গে সঙ্গে শশব্যস্ত হয়ে উঠল পিছনে দাঁড়ানো দুই লেঠেল হারু আর জীতেন। সসম্ভ্রমে দরজা খুলে দিলো ভোজপুরি সেপাইরা। ধীর পায়ে খাজাঞ্চিখানা থেকে বেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি ভেঙে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন ভূপতি রায়। একটা চাপা খুশির ছাপ চোখেমুখে। আদায় পত্তর ভালোই হয়েছে এবার। কেষ্টনগরে কোম্পানির ঘরে খাজনাটাও পৌঁছে দেয়া যাচ্ছে সময়মতো। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ঠারেঠোরে খবর পাচ্ছেন ছোট তরফের ওই নেপোটা, সে ব্যাটার নাকি হাঁড়ির হাল এবার। খাজনার টাকা দিতে পারবে না শোনা যাচ্ছে। তা পারবে কী করে? জুয়ো আর মদ-মাগীতে টাকা উড়িয়ে দেউলে একেবারে। অথচ টাকা তো কম কামায়নি! কিন্তু উড়িয়েছে কাছা খুলে। এরকম হলে জমিদারি চলে? আরে বাবা পুরুষমানুষের একটু আধটু বারদোষ থাকেই। বিশেষ করে বড়মানুষদের। ভূপতিরও রয়েছে। শান্তিপুরে বছর উনিশ কুঁড়ির একটিমাত্র রাঁঢ়। তা বলে নেপোর মত মুক্তকচ্ছ হয়ে টাকা ওড়াননি কখনও। নেপোটার সব্বোনাশ হবে, ভাবতেই হিলহিলে খুশির একটা স্রোত বয়ে গেলো শরীর জুড়ে।

প্যাঁচ ছকেই রেখেছেন ভূপতি। খবর পাওয়ামাত্র দরখাস্ত ঠুকে দেবেন ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কাছে। ছোট তরফের ওই সাতটা গাঁ তার চাই-ই চাই। তাছাড়া বড় তরফ হিসেবে তার দাবিই তো সবার আগে এবং ন্যায্যও সেটা। ব্যাটা নেপো মাগ-বাচ্চা নিয়ে কেষ্টনগরের বাজারে ভিক্ষে করছে, এ রকম একটা দৃশ্য কল্পনায় ভেসে উঠল ভূপতির। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে খুশির মাত্রাটাও বেড়ে গেল কয়েকগুণ। সিঁড়ি ভেঙে অন্দরমহলে ঢুকে গেলেন। ভোজপুরি সেপাই দু’জন দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির বাঁকে। এটাই নিয়ম। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল হারু আর জীতেন। খাজাঞ্চিখানার গরম থেকে বেরিয়ে একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন নায়েব কেদার চক্কোত্তি। ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি ভিজে জ্যাবজ্যাব করছে ঘামে। পিছনে দাঁড়িয়ে বড় হাতপাখা টেনে টেনে বাতাস করছে একজন চাকর। গুটি গুটি পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো হারু। “কী চাই?” খ্যারখ্যারে গলায় প্রশ্ন করলেন কেদার।

-একটা আর্জি ছিল নায়েবমশাই। বাড়িতে মেয়েটার খুব জ্বর। একবার যদি অনুমতি দ্যান…রাতের মধ্যেই ফিরে আসব।

আমতা আমতা করে বলল হারু। একই সঙ্গে বিরক্তি আর প্রশ্রয়মাখা দৃষ্টিতে হারুর দিকে তাকালেন কেদার চক্কোত্তি।

-মেয়ের জ্বর না হাতি। আসলে মাগের মুখ না দেখে আর থাকতে পারছিস না। এই শালা তোদের ছোটলোকদের এক রোগ। দু’দিন অন্তর একবার মাগের আঁচলের তলায় গিয়ে না ঢুকলে সোয়াস্তি নেই। তবে দেউড়ির পেটা ঘড়িতে দশটা বাজার আগেই ফিরে আসবি। নইলে অনত্থ বাধিয়ে ছাড়ব বলে দিলাম।

-পেন্নাম। বলেই সুট করে সামনে থেকে সরে এল হারু। কে জানে বাপু কর্তাদের মতিগতি! এক্ষুনি হয়তো ফের না করে বসবে। জোরে জোরে পা চালিয়ে সিংদরজার বাইরে এসে পড়লো হারু। আড়চোখে এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিল একবার। তারপর পা চালালো বঁদিকের কাঁচা রাস্তাটা ধরে।

পর্ব ২ https://banglalive.today/shonitmontro-part-two/

পর্ব ৪  https://banglalive.today/shonitmontro-part-four/

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

3 Responses

  1. সেই অনবদ্য ডিটেইলিং , প্রাক্তন জমিদার পরিবারের সন্ততি রা ভাবে কিনা তারাই বলতে পারে , তবে আমরা নাকি lumpen proletariat শুনেছি, lumpen landlord বা লুম্পেন সামন্তী শুনিনি , এই ডিটেইলিং বুঝিয়ে দে কেন শুনিনি , কারণ জমিদার কি কখনো লুম্পেন না হয়ে যায় ? তবে বসে আছি এক লুম্পেন রানী র কাহিনী শনিবার অধীর অপেক্ষায়। অন্ত্যজ রা লুম্পনে হলেও মনুষ্যত্ব থাকতেই হয় হয়তো , দেখা যাক , এ যুগের ঔপন্যাসিক নেতা কোন দিকে আমাদের নিয়ে যান !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *