মাঘ মাস। গভীর রাত।
হাড় ফুটো করে দেয়া ঠান্ডা আর চাপ চাপ কুয়াশায় থম মেরে রয়েছে চৌরঙ্গির ঘন জঙ্গল। বিশাল বিশাল সব গাছ। তাদের মাথা ভেদ করে দিনের বেলাতেও সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না ভালো করে, রাতে তো দূরের কথা। ঠাসবুনোট অন্ধকার চারদিকে। বনের গভীরে দূরে এক জায়গায় উজ্জ্বল আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে।
দিঘির গায়ে জীর্ণ একটা দেউলের পাশে ভাঙাচোরা একটা বেদির মতো। তার ওপর পঞ্চমুন্ডির আসন। চারপাশে সাজানো নরকরোটি। সামনে ধুনি জ্বলছে। পাশে চৌখুপি একটা গর্ত। গর্তের মধ্যে জ্বলন্ত যজ্ঞের কাঠ। দাউ দাউ লেলিহান অগ্নিশিখা লাফ দিয়ে উঠছে শূন্যে। স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ওঠার মৃদু শব্দ উঠছে- চড়বড় চড়বড়। পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে বাঘছালের ওপর বসে রয়েছেন ভৈরব জঙ্গলগিরি মহারাজ। বিশাল শরীরে চার রঙের তাপ্পিমারা একটা কম্বলের আলখাল্লা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, রঙবেরঙের পাথর আর বাঘনখের হার। রক্তবর্ণ একজোড়া চোখ। কপালে রক্ততিলক। একগাল রুক্ষ জঙ্গুলে দাড়ি। বিশাল লম্বা চুলের জটা নেমে গেছে ঘাড় ছাড়িয়ে কোমর অবধি। “জয় কালী কলকত্তাওয়ালি! হর হর মহাদেও!”- থেকে থেকে মেঘমন্দ্র গলায় হেঁকে উঠছেন ভৈরব জঙ্গলগিরি। যজ্ঞকুণ্ডের পাশে রাখা দুটো মড়ার খুলি। একটায় কারণবারি, অন্যটায় তৈলাক্ত তরলজাতীয় কী একটা। থেকে থেকে কমণ্ডলু থেকে ছিটিয়ে দিচ্ছেন যজ্ঞকুণ্ডে। ইন্ধন পাওয়ামাত্র দ্বিগুন তেজে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠছে আগুন। “জয় তারা!”- মহোল্লাসে ফের হুঙ্কার দিয়ে উঠছেন ভৈরব। সেই হুঙ্কার গাছে গাছে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে জঙ্গলে।
কে এই রহস্যময় ভৈরব? একাকী কী ভাবে থাকেন এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে? ঠ্যাঙাড়ে, ডাকাত, মানুষখেকো বাঘ আর কুমিরে ভর্তি জঙ্গল আর জঙ্গলের মধ্যে বিশাল বিশাল দিঘিগুলো। লোকালয় বলতে খানিকটা দুরে গঙ্গার ধারে গোরাদের কেল্লা। কেল্লার গায়ে বড়ষের জমিদার রায়চৌধুরী বাবুদের বানিয়ে দেওয়া একটা রাস্তা। আর এর থেকে অনেকটা দুরে জানবাজারে মাঢ়রাজা আর সিঙ্গিবাবুদের প্রাসাদ। এছাড়া চারপাশে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ঠিক একইভাবে জঙ্গলগিরি ভৈরবকে নিয়ে জনশ্রুতি, গুঞ্জন আর রহস্যেরও শেষ নেই গা-লাগোয়া তিনটে গ্রাম সুতোনুটি, গোবিন্দপুর আর ডিহি কলকেতার বাসিন্দাদের মধ্যে। কারো মতে কয়েকশো বছর আগে ইব্রাহিম লোদির আমলে উত্তর ভারত থেকে চলে এসেছিলেন অঘোরতন্ত্রী কয়েকজন সাধু। তাদেরই কারও এক ভৈরবী বা সাধনসঙ্গিনীর গর্ভে জন্ম নেন জঙ্গলগিরি। কেউ কেউ বলে-“আরে দুর দুর, জঙ্গলবাবা আসলে এক বাঙালি কাপালিকের সন্তান। বাবার বয়সের গাছপাথর নেই। যৌবনে বাংলা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে। শ’খানেক বছর সেখানে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ শেষে ফের ফিরে এসেছেন বাংলায় শ’দুই বছর হল। কিন্তু বাংলার বাইরে দীর্ঘকাল থাকার জন্য কথার মধ্যে হিন্দি টানটা রয়ে গেছে।” আরেকদলের বিশ্বাস, বাবা স্বয়ম্ভূ। হাজার হাজার বছর আগে ভয়ঙ্কর এক ঝড়তুফানের রাতে ধরিত্রী কাঁপিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয়েছিল জঙ্গলে। বাজে পুড়ে যাওয়া বিশাল এক গাছ থেকে মানুষে পরিণত হয়েছিলেন বাবা। তিনি আসলে অগ্নিদেবের সন্তান। জঙ্গলে জন্মেছিলেন তাই দেবতা নাম দিয়েছিলেন জঙ্গলগিরি।
এ রকম অসংখ্য কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে কলকেতা-সহ তিন গ্রামে। একইসঙ্গে প্রচলিত রয়েছে একাধিক প্রবাদ, যা মানুষের মুখে মুখে ফেরে এ সব অঞ্চলে। একদিন জঙ্গলের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন সাধুবাবা। হঠাৎই চোখে পড়ল বিশাল এক আদিম বটগাছ। গাছের তলায় দাঁড়ানো এক হৃষ্টপুষ্ট দুগ্ধবতী গাভী। বাঁট থেকে অঝোরে দুধ ঝরে পড়ছে মাটিতে। অবাক হলেন জঙ্গলগিরি। ভরা বাঘের জঙ্গলে এরকম একটা দুগ্ধবতী গাভী এল কি করে? জঙ্গলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তো ওর বাঘের পেটে চলে যাওয়ার কথা। অথচ এর দু’চোখে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে দুধ দিচ্ছে মাটিতে। এরকম চলল বেশ কিছুক্ষণ। একসময় ‘হাম্বা’ গলা তুলে ডাক দিল গাভীটি। তারপর ধীর পায়ে দুলকিচালে হেঁটে মিলিয়ে গেল জঙ্গলে। সামনে এগিয়ে গেলেন সাধুবাবা। দুধে ভিজে সাদা হয়ে রয়েছে জায়গাটা। নরম হয়ে গেছে মাটি। হাতের চিমটে দিয়ে একটুখানি খুঁড়তেই শক্ত একটা কিছু ঠেকল হাতে। দু’হাতে চারপাশের মাটি সরাতেই একটা বিশাল চওড়া চ্যাটালো পাথর। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। লোকে বলে, সেই মুহূর্তে নাকি প্রচণ্ড এক ঝড় উঠেছিল জঙ্গলে। অন্তরীক্ষ থেকে অশরীরী বামাকণ্ঠে আদেশ উচ্চারিত হয়েছিল-“আমি মাটির তলায় চাপা পড়ে রয়েছি বহুকাল। আমাকে তুই কালীঘাটের থানে পৌঁছে দিয়ে আয়।” শিহরিত হয়েছিলেন জঙ্গলগিরি।
আদিগঙ্গার ধারে চেতলার গভীর জঙ্গলে বলা ঠ্যাঙাড়ের দলবলের আড্ডা। নিজে গিয়ে ডেকে এনেছিলেন তাদের। রনপায় চড়ে পাবড়া-সড়কি নিয়ে এসেছিল ঠ্যাঙাড়েরা। মাটি খুঁড়ে পাথর তুলে কাঁধে করে সতীর থানে নিয়ে গেছিল। সেই পাথর দিয়েই নাকি তৈরি হয়েছিল কালী কলকাত্তেওয়ালী, দেবী কালিকার মুখ। এমনটাই বিশ্বাস করে সুতোনুটি, গোবিন্দপুর, কলকেতা- এই তিন গাঁয়ের দেবদ্বিজে ভক্তি-বিশ্বাস রাখা অসংখ্য মানুষজন। অবিশ্বাসীরা বলতেই পারে বুজরুকি। বাবার ওসব অলৌকিক ক্ষমতাটমতা সব ফক্কিকিরি। তাতে তাদের ভারি বয়েই গেল। ওই যে কথায় রয়েছে না-‘বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর।’ লোকে আরও বিশ্বাস করে, জঙ্গলগিরি বাবা ত্রিকালদর্শী। অলৌকিক সব ক্ষমতার অধিকারী। গভীর রাতে তিনি ভূতপ্রেত পিশাচদের নামিয়ে আনেন তাঁর পঞ্চমুন্ডির আসনে। বাবার থানে রাতের বেলায় বাঘ এসে শুয়ে থাকে। ভোরবেলা তিনি যখন দিঘির জলে অবগাহনে স্নান করেন, তখন চারপাশে খেলে বেড়ায় বিশালকায় সব হিংস্র কুমিরের দল। মাঝে মাঝে মর্জি হলে বাবা নাকি তাদের পিঠে চেপে একপাক ঘুরেও আসেন সরোবরে।
সুতোনুটি, অনেক বছর আগে যেখানে হোগলাবন কেটে সুতো, নুটি ও মেয়েমানুষ চালানের কারবার ফেঁদেছিল আরমানিরা…সেই সুতোনুটির শোভাবাজার, বাগবাজার, গরানহাটা, দর্জিপাড়া, হাটখোলা, পাথুরেঘাটা, বউবাজার, ঠনঠনে, শ্যামপুকুর থেকে কালীঘাটে পুজো দিতে আসেন শীল, মল্লিক, শেঠ, দত্ত, মিত্তির বাড়ির ধনী বাবুরা। বাহন বলতে পাল্কি। সঙ্গে লোকলস্কর, পাইক পেয়াদা লেঠেল। কারণ মাঝখানে পড়বে চৌরঙ্গির জঙ্গল। ডাকাত ঠ্যাঙাড়ের ভয়। এছাড়া রয়েছে দক্ষিণ রায়ের বাহন বড়মিয়াঁ। সাক্ষাৎ শমন! সামান্য অসতর্ক হলেই পিছন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে যাবে জঙ্গলে। পথে পড়বে জঙ্গলগিরি ভৈরবের থান। সেখানে থামবে পাল্কি। বাবার থানে সিধে চড়াবেন বাবুরা। ফলমূল, চিঁড়েমুড়ি, চাল, ঘি দুধ, নগদ দক্ষিণা। প্রার্থনা করবেন করজোড়ে। “হে বাবা ভৈরব জঙ্গলগিরি। এই পথটুকু যেন নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেতে পারি।” বেশিরভাগ সময় চুপ করেই থাকেন সাধুবাবা। মাঝে মাঝে ক্ষেপে ওঠেন। কাঁচা গালাগাল দ্যান- “সুয়ার কে বাচ্চো! গরিব প্রজা-রায়তের রক্ত চুষে টাকার পাহাড় বানাচ্ছিস। আর সেই টাকায় কলকাত্তেওয়ালির পুজো দিতে যাচ্ছিস! শরম নেহি আতা হ্যাঁয় তুঝলোগকো? তেরা ওহ পাপকা পয়সাসে দিয়া হুয়া দক্ষিণা কভি কবুল নেহি করেগি কালী কলকাত্তেওয়ালি। নরক মে যাওগে তুমলোগ। শাপ দেতা হুঁ ম্যায়!” তবু শোনে না ধনী ভক্তের দল। পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে-“দয়া করো ভৈরববাবা। তুমি আশীর্বাদ না করলে এই ভয়ানক চৌরঙ্গির জঙ্গল পেরব কি করে?” লাথি মেরে পা ছাড়াতে চান সাধুবাবা। ছাড়তে চায়না নাছোড়বান্দা ভক্তের দল। আঁকড়ে ধরে আরও জোরেসোরে। অক্ষম অসহায় ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে একসময় চুপ করে যান জঙ্গলগিরি। গুমরোতে থাকেন অব্যক্ত রাগে। পায়ের কাছে নৈবেদ্য, দক্ষিণা সবকিছু নামিয়ে রেখে একসময় লোকলস্কর নিয়ে চলে যায় ধনী ভক্তের দল। ‘হুমহুঁনা, হুমহুঁনা’ জঙ্গলের গভীরে মিলিয়ে যায় পাল্কির আওয়াজ।
তবে শুধু ধনী ভক্তরাই নয়, গরীবগুরবোরাও আসে মাঝে মধ্যে। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পদব্রজে চলেছে কালীঘাট দর্শনে অথবা দরিদ্র ব্রাহ্মণ, সঙ্গে স্ত্রী পুত্র পরিবার, সবাই এসে থামে বাবার থানে। আশীর্বাদ চায়-“হে বাবা, হে জীয়ন্ত ভৈরব, আশীর্বাদ করো বাপ। পথে যেন ঠ্যাঙ্গাড়ে ডাকাতে না ধরে, বাঘে না খায়। দেখো ঠাকুর।” খুশি হন জঙ্গলগিরি। কত দরিদ্র মানুষজন সব। কত কষ্ট করে চলেছে পায়ে হেঁটে মহাতীর্থ দর্শনে। আলখাল্লার চৌখুপি থেকে লাল অথবা নীল রঙের একটা পাথর বের করে ছুঁড়ে দেন দরিদ্র ভক্তের কোলে। “ইয়ে পাত্থর লেকে চলা যা। পথে ডাকাত পড়লে, বাঘে ধরলে এই পত্থর দিখাবি। এ হল জঙ্গলবাবার মোহর। তোদের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস পাবে না কেউ।” পায়ে মাথা ঠেকিয়ে চলে যায় ভক্তেরা।
রাত আর ঠাণ্ডা দু’টোই বাড়ছে জঙ্গলে। হাতের চিমটে দিয়ে যজ্ঞকুণ্ডের আগুনটাকে ফের একবার খুঁচিয়ে দিলেন জঙ্গলগিরি। করোটিপাত্র থেকে একচুমুক কারণ পান করলেন। চৌরঙ্গা আলখাল্লাটাকে টেনে নিলেন বুকের কাছে। এই চার রঙের আলখাল্লার জন্যই ভক্তদের অনেকে চৌরঙ্গিবাবা নামেও ডাকে ওঁকে। আর সেই থেকেই এই জঙ্গলের নাম হয়েছে নাকি চৌরঙ্গির জঙ্গল। অবিশ্বাসীরা ফুট কাটে ফের। চৌরঙ্গা কম্বল না ছাই। আসলে জঙ্গলের মাঝখানে মেঠো চৌরাস্তার একটা মোড় রয়েছে। সেই থেকেই চৌরঙ্গি। ভক্তদের মুখে এসব শুনে হাসেন জঙ্গলগিরি। ওপরওয়ালার এই আজিব কারখানায় কোনটা যে সত্যি আর কোনটা বা মিথ্যে, তিনি নিজেও কি জানেন আজ অবধি ভালো করে। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ভাঙাচোরা দেউলটার দিকে তাকালেন সাধুবাবা। ভিতরে ভয়ালদর্শন কালভৈরবের মূর্তি। যজ্ঞকুণ্ডের আগুন আর অরণ্যের অন্ধকার। এ দু’য়ের আলো আঁধারিতে আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে মূর্তিটাকে।
ঠিক এই সময়, একটু দূরে জঙ্গল কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠল- ‘ঘ্রা উ উ ম!’ যেন বিশাল গভীর একটা জালার মধ্যে থেকে উঠে এল ডাকটা। কিছুক্ষণ বাদে দেউলের পাশে ঘসঘস ঝোপঝাড় নড়াচড়ার আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মত হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো জঙ্গলগিরির মুখখানা। “কে? ভীমা এলি নাকি? আয় আয়।” পরমুহূর্তেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বিশালকায় এক বাঘ। উজ্জ্বল পাটকিলে হলুদ রঙের ওপর কালো ডোরাগুলো চকচক করছে যজ্ঞকুণ্ডের আগুনে। লাফ দিয়ে বেদির ওপর উঠে পড়ল বাঘটা। তারপর পোষা বেড়ালের মত হাত পা ছড়িয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো চৌরঙ্গিবাবার সামনে। আনন্দে মাটিতে ল্যাজটা আছড়াচ্ছে ঘন ঘন। আদর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন জঙ্গলগিরি। ‘কীরে ব্যাটা, তিনচার দিন দেখা নেই। কোথায় ছিলি এত দিন? হরিণটরিন কিছু জুটেছে কপালে?” জবাবে জিভ দিয়ে মুখটা একবার চেটে নিয়ে আদুরে গরগর ডাক ছাড়ল ভীমা। সেদিকে তাকিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন সাধুবাবা।
বিশাল এই চৌরঙ্গির জঙ্গল। মাঝখানে ভবানীপুর, কালীঘাট, ব্যায়লা, বড়ষে আরও অনেক ছোট ছোট গ্রামকে মাঝখানে রেখে দু’পাশ বেড় দিয়ে সোজা চলে গেছে সোঁদরবন, সেই দক্ষিণরায়, বনবিবির থান পর্যন্ত। যুগ যুগ ধরে নির্জন জঙ্গলে একা রয়েছেন তিনি। তবু মাঝে মাঝে গরিব ভক্ত আর ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতদের মুখে অনেক খবরই আসে কানে। চারদিকে ঘোর অরাজকতা চলছে। আংরেজ কোম্পানি দেশটাকে বাবু, জমিনদার আর বানিয়াদের হাতে তুলে দিয়েছে। কোনও দায়দায়িত্ব নেই। বছরের শেষে শুধু কোম্পানির ঘরে খাজনা পৌঁছে গেলেই হল। জমিদাররাও সেই টাকা আদায়ের জন্য লাগামছাড়া অত্যাচার চালাচ্ছে প্রজাদের ওপর। অনাদায়ে গুমখুন, কাছারিবাড়িতে তুলে এনে চাবুকপেটা, ঘরের বউ-ঝিদের তুলে নিয়ে যাওয়া, গ্রাম জ্বালানো সবই চলছে। এতসবের পরেও রক্ষে নেই। আরও, আরও বেশি মুনাফার আশায় নীলকর সায়েবদের জমি দাদন দিচ্ছে জমিদাররা। গরিব চাষির উর্বর ধানিজমি জ্বালিয়ে দিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে নীলচাষ করতে। প্রতিবাদ করলেই পিঠে নেমে আসছে চাবুক। জমিদার আর নীলকর সায়েব, এই দু’য়ের মাঝে জাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে দুনিয়ার যত গরীবগুর্বো, চাষাভুষো। হাড়ি-বাগদি-দুলে-মুচি-মেথর-ডোম, হাড়হাভাতে মানুষের দল। গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে, উপোস দিয়ে মরছে, খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ঠ্যাঙাড়ে, চোর-ডাকাতের দলে নাম লেখাচ্ছে। মেয়েরা গঞ্জের বাজারে গিয়ে কুপি হাতে দরজায় দাঁড়াচ্ছে…।
একটা গভীর দমচাপা দুঃখ দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো সাধুবাবার বুক চিরে। সে দিকে চোখ তুলে তাকাল ভীমা। চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি। যেন সাধুবাবার দুঃখটা বুঝতে পারছে। ভীমার চোখে তাকিয়ে ভারী বিষণ্ণ একটা হাসি হাসলেন জঙ্গলগিরি। “দেশে ঘোর দুর্দিন চলছে রে ভীমা। ব্যাটা মূর্খ জানোয়ার, তুই সেসবের কী বুঝবি। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অ্যায়সা দিন নেহি রহেগা। এখান থেকে শ’ শ’ কোস দূরে গৌড় বাংলা। নদে জিলা। যাঁহাপে বাঙ্গাল কা কানহাই, নিমাই সন্ন্যাসি জনম লিয়া থা, ওহি নদিয়া মে অওর কোই জনম লিয়া। সে বেড়ে উঠছে দিনে দিনে! মহাকালীর সন্তান। প্যায়ারা বাচ্চা কালি মাঈ কা। যো আমিরকো লুটেগা অওর গরিবোঁ মে বাঁটেগা। ওহ দিন বহোত জলদি আ রহা হ্যায়।” বলতে বলতে ভাঁটার মত জ্বলছিল জঙ্গলগিরির রক্তবর্ণ চোখ দুটো।
ঠিক তখনই জঙ্গলের গভীরে একটানা উঁউম উঁউম আওয়াজ একটা। সাধুবাবা জানেন ওটা বাঘিনীর ডাক। প্রেমাস্মদকে মিলনে আহ্বান জানাচ্ছে। শোনামাত্র লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ভীমা। হেসে ভীমার বিশাল গালে একটা সস্নেহ থাবড়া মারলেন জঙ্গলগিরি “ওরে ব্যাটা, কুড়কুড়ুনি জেগেছে বুঝি? সে তো জাগবেই। জঙ্গল থেকে সখি ডাক পাঠাচ্ছে যে। তাহলে তুই যা এখন। আমি বরং বসে বসে একটু ভাবি।” চাতাল থেকে লাফ দিয়ে নেমে কুয়াশা আর জঙ্গলের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ভীমা। চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন জঙ্গলগিরি। অনেকক্ষণ বাদে চোখ খুলে টুং টুং করে হাতের চিমটে বাজিয়ে করুণ সুরে গান ধরলেন গুনগুন করে-‘পাঠান দেখা, মুঘল দেখা, আব আয়া বিরটিশরে/কোম্পানিকা লুঠ মচা হায়, মর গয়া গরীব রে, বেচারা গরীব রে….।’ বিষণ্ণ সেই গানের সুর মৃদু ফিশফিশে হাওয়ার মত সময়কালের সীমা ছাড়িয়ে ছুটে চলে গেলো জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে।
পর্ব ২ https://banglalive.today/shonitmontro-part-two/
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
জমজমাট শুরু
বুর বালা শুরু করিসেন যে দাদা , কার একখান যেন গন্দ পাই , তা হে থাকে! নয়া ইস্টাইল যে দেহি !
Sei Supriyo Chowdhury style, sei gati. Mone hocche sadharan manish er janya r ek ta larai er galpo sunte jacchi.
খুব ভালো লাগল
Khub sundor
Asadharan kintu next part kothay?
Asadharan kintu next part kothay? kabe pabo?
আগামী মঙ্গলবার। প্রতি মঙ্গলবার নতুন পর্ব প্রকাশিত হবে।
গভীর রাতের অন্ধকারে দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে এক ভয়াল দর্শন তান্ত্রিক। পাশে পোষা বাঘ। গুরুগম্ভীর আবহ। ঠিক যেমনটা প্রয়োজন।
কিন্তু সঙ্গিনীর ডাক শুনে বাঘটি চলে যাওয়ার উদ্যোগ করলে সাধু বললেন “কুড়কুড়ুনি জেগেছে বুঝি?….”
ঠিক এই “কুড়কুড়ুনি” শব্দটা এমন একটা আবহে এক ফোঁটা গোচোনা।
কুরকুড়ুনি কি খুব প্রাচীন শব্দ ? এর কাছাকাছি কিছু পাওয়া গেলোনা? হিন্দি ঘেঁষা বাংলা বলা কাউকে এমন একটা শব্দ এখনকার দিনেও বলতে শুনিনা। এটা একান্তই বাংলা এবং আধুনিক স্ল্যাং। অমন লঘু ডায়লগ না দিলেও কি ভীষণ ক্ষতি ছিল এই মুহূর্তে।
ব্যাস এটুকুই। দুটো অধ্যায় পড়েছি। ভালো এবং টানটান লাগছে পড়তে।