সন্ধেবেলা একতলার বৈঠকখানা ঘরে একাই বসেছিলেন নৃপতি রায়। অন্যদিন এইসময় ইয়ার-পারিষদ-চাটুকারের ভিরে গমগম করে ঘরটা। আজ বিলকুল ফাঁকা। খাস চাকর নেতাইকে বলে দিয়েছেন কেউ এলে যেন বলে দেয় বাবুর শরীর খারাপ। দেখা হবেনা। নৃপতির ডানপাশে রাখা রুপোর গড়গড়া। বাঁদিকে কারুকাজ করা ছোট গোলাকৃতি কাঠের টেবিলে বেলজিয়ান কাচের পানপাত্রে ব্র্যান্ডি। থেকে থেকে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন নৃপতি। ভুরুক ভুরুক টান পড়ছে গড়গড়ায়। এই মুহূর্তে দৃশ্যতই ভীষণ উত্তেজিত নৃপতি। আর সেই উত্তেজনার পারদটা চড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মাথার উপর টানা পাখা দুলছে। এদিক থেকে ওদিক। তবু গরম বোধটা কমছেনা নৃপতির। “ এই হারামজাদা!” দরজার দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন নৃপতি। “কী মড়াখেকোর মত ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে পাখা টানছিস। খেতে পাসনা নাকি? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দোবো বেয়াদপ!” দরজার বাইরে খাঁদু মণ্ডল। পাঙ্খাবরদার। পরিশ্রমে ঘেমে নেয়ে একাকার। ধমক খেয়ে দড়ি টানার গতি বাড়িয়ে দিলো সঙ্গে সঙ্গে। কেদারা ছেড়ে উঠে অস্থিরভাবে ঘরজুড়ে পায়চারি করতে শুরু করলেন নৃপতি। ঠিক তখনই দরজায় ঠুক ঠুক। “ভিতরে আয়।” গম্ভীর গলায় বললেন নৃপতি। ঘরে ঢুকলো রাসু। বাবুর আরেক খাস চাকর। অনেকদিন রয়েছে এবাড়িতে। খুব বিস্বস্ত। “হারু এসেছে।” বলল নিচু গলায়। “ভেতরে নিয়ে আয়।” হুকুম করলেন নৃপতি। পরমুহূর্তেই ঘরে ঢুকলো হারু। “পেন্নাম ছোটকত্তা।” “কোনও খবর পেলি?” উত্তেজনা ফেটে বেরচ্ছিল নৃপতির চোখেমুখে। “খবর না পেলে কি আর এমনি এমনি হুজুরের কাছে এয়চি।” বলতে বলতে নৃপতির দিকে এগিয়ে গেলো হারু। তারপর চাপা গলায় কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। “হুম।” সিল্কের ফতুয়ার ট্যাঁক থেকে তিনটে রুপোর মোহর বের করে হারুর হাতে দিলেন নৃপতি। “খবর যদি খাঁটি হয় তাহলে এরকম আরও তিনটে মোহর পাবি আর মিথ্যে হলে তুলে নিয়ে এসে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াবো। কথাটা মনে থাকে যেন।” শোনামাত্র দুকান ধরে আধহাত জিভ কাটলো হারু। “কি যে বলেন ছোটকত্তা। আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে আপনাকে মিথ্যে খবর দেবো। এ খবর ষোল আনার ওপর এক পাই খাঁটি। নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি”। “ওকে বাইরে পৌঁছে দিয়ে আয়।” রাসুর দিকে তাকালেন নৃপতি। হারুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো রাসু। ফিরে এলো কিছুক্ষণ বাদেই। রাসুকে কাছে ডাকলেন নৃপতি। “শোন, পরশু কাকভোরে বড়কত্তা খাজনার টাকা নিয়ে যাচ্ছে কেষ্টনগর ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের কুঠিতে। আজ ঠিক রাত আটটার সময় লাটুগঞ্জে বিশালাক্ষী মন্দিরের পিছনে যাবি। বিশে ডাকাতের লোক ছিপ নিয়ে হাজির থাকবে নদীর ঘাটে। ওকে খবরটা পৌঁছে দিবি। সময় তারিখ বলতে যেন ভুল না হয় কোনও।” “ ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা কত্তা, আসি।” নৃপতিকে আস্বস্ত করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল রাসু। ফিরে এসে আরামকেদারায় আধশোয়া হলেন নৃপতি। তারপর গড়গড়ায় টান দিতে দিতে ডুবে গেলেন গভীর চিন্তায়।
গড়ের পেছনে একফালি বাধানো ফাঁকা জমি। গতকালই অমানিশা গেছে। তাই ঘোর অন্ধকার চারপাশে। জমির মাঝখানে ছোট কালীমন্দির। জমিটাকে ঘিরে বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ। প্রত্যেকটা গাছের কোটরে গোঁজা রয়েছে জ্বলন্ত মশাল। থেকে থেকে কুনো ব্যাঙের কটকট আর ‘কি র র র’- একটানা ঝিঁ ঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চারপাশে। মন্দিরের মধ্যেও মশালদানিতে গোঁজা একটা মশাল। বেদীতে ঘোর কৃষ্ণকায়া কালিকা মূর্তি। গলায় আকন্দ আর একশো আটটা রক্তজবার মালা। একহাত রক্তজিহ্বা আর ভয়াল দৃষ্টি ত্রিনয়নে। পায়ের কাছে হাড়িকাঠ। রক্ত লেগে রয়েছে গায়ে। দেবীমূর্তির পায়ের কাছে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন একটা পাঁঠার মাথা। বলি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। পাশে বিশাল পেতলের পঞ্চপিদিম জ্বলছে। ধুনোর গন্ধে ম ম করছে ভিতরটা। দেবীমূর্তির সামনে করজোড়ে দাঁড়ানো বিশ্বনাথ। আদুর গা। মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি। সর্বাঙ্গে তেল মাখা। সাপখেলানো পেশিগুলো পিছলে বেড়াচ্ছে সারা শরীরে। লাল ফেট্টিতে বাঁধা ঘন কোঁকড়া বাবরি চুল ফুলেফেঁপে দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে। মশাল আর পিদিমের আলোয় আধভৌতিক কোনও মূর্তির মত দেখাচ্ছে বিশ্বনাথকে। দুচোখ বন্ধ। পাথরের মত স্থির, নিস্পন্দ। শুধু ঠোঁটদুটো নড়ছে অল্প অল্প। অস্ফুটে বিড়বিড় করে বলছে কিছু। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে চোখদুটো খুললো বিশ্বনাথ। তারপর হেঁকে উঠলো মেঘমন্দ্র গলায়- “জয় মা কালী! সন্তানের মনোস্কামনা পূর্ণ করিস মা, মাগো।” হাড়িকাঠের নীচে চাপ বেঁধে জমে থাকা রক্ত। একটা ছোট বাটিতে করে কাঁচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো বাইরে। মন্দিরে নীচে দাঁড়ানো দলের লোকেরা। সংখ্যায় একশোর কাছাকাছি। আদুর গাঁ আর পাকসাট মেরে পরা ধুতি এখানেও সবার। হাতে লাঠি, সড়কি, ল্যাজা, কোঁচ, তলোয়ার, বর্শা, মোষের চামড়া নয়তো পেটা লোহার ঢাল সবার হাতে। “ জয় মা কালী।” রক্তচোখে স্যাঙ্গাতদের দিকে তাকিয়ে ফের একবার হুঙ্কার ছাড়লো বিশ্বনাথ। “ফেরাসনে মা হাতখালি/একশো পাঁঠা দেবো বলি।” প্রত্যুত্তরে সমবেত গলায় বজ্রগর্জন উঠলো রাতের নিস্তব্ধতা চিরে। এক এক করে সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো দলের লোকেরা। বাটিতে তর্জনী চুবিয়ে সবার কপালে রক্ততিলক এঁকে দিলো বিশ্বনাথ। একটু দূরে ছোট মাদুরে হাঁটু মুড়ে বসা মেঘা। মাথায় সাদা টুপি। বন্ধ চোখজোড়া। বুকের সামনে প্রার্থনার ভঙ্গিতে পেতে রাখা দুটো হাত। প্রার্থনা শেষ করে হাতদুটো আলতো করে বুলিয়ে নিলো চোখেমুখে। তারপর আসনটা মুড়ে উঠে এসে দাঁড়ালো বিশ্বনাথের সামনে। “তারপর হামলার জায়গা কোথায় ঠিক করলি।” “নীলের জঙ্গল।” শান্ত গলায় জবাব দিলো বিশ্বনাথ। শোনামাত্র ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল মেঘার। “নীলের জঙ্গল? সেতো একেবারে কেষ্টনগরের গায়ে। একটু টের পেলে কোম্পানির ফৌজ এসে পড়তে বেশি সময় লাগবেনা। তার চেয়ে বাঙ্গালচি বা ঠেঙ্গামারির জঙ্গলে ফাঁদ পাতলে ভালো হত না?” মেঘার প্রশ্নের জবাবে হেসে ওর কাঁধে হাত রাখলো বিশ্বনাথ। “দ্যাখ মেঘা অন্য আর দশপাঁচটা এতিফেতি ছ্যাঁচড়া ডাকাতদলের মত আমরা ডাকাতিটা শুধু টাকাপয়সা রোজগারের জন্য করিনা। করি কোম্পানি আর জমিদাররা যাদের পায়ের তলায় পিষছে সেই গরীব মানুষদের জন্যও। আসলে আজকের এই কাজটা আমার কাছে কোম্পানির দরজায় পৌঁছে দেওয়া একটা শমন। এটা বুঝিয়ে দেয়া যে শুধুমাত্র দুচারটে ফোতো জমিদার নয়, দুর থেকে ঢিল ছুঁড়ে মেরে পালিয়ে যাওয়া নয়, দরকারে কোম্পানির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ওদের গালে থাপ্পড় কষাতে পারি আমরা। আর তা ছাড়া ভয় কি রে? তোর খোদাতালা আর আমার মহামায়া, দু দুটো আশীর্বাদী হাত রয়েছে আমাদের মাথার ওপর। কয়েকটা ভেরুয়া জমিদার আর ফিরিঙ্গির সাধ্য কি আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করে?” বলতে বলতে হা হা করে হেসে উঠলো বিশ্বনাথ। “নে নে, আর দেয়ালা করিসনে। রণপা ওঠা। ছ সাত ক্রোশ পথ। অনেকটা দূর। দুপুর দুপুর পৌঁছে যেতে হবে নীলের জঙ্গলে।” আবেগপ্লুত চোখে বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে ছিল মেঘা। এই হচ্ছে বিশে। ছেলেবেলার বন্ধু। মানিকজোড়। সব লড়াইয়ে সবসময় সামনে। সব ভয় আর দ্বিধাকে সাহস আর কথার তেজে উড়িয়ে দিতে পারে এক ফুঁয়ে, মুহূর্তের মধ্যে। বিদ্যুতের মত ঝলসে উঠলো মেঘার চোখজোড়া। “জয় রাজা বিশ্বনাথ! রণপা তোল সবাই।” গাছের তলায় শুইয়ে রাখা সার সার রণপা। মেঘার হুঙ্কার শোনামাত্র ছুটে গিয়ে রণপা তুলে দিয়ে পাটাতনে পা রাখলো সবাই। তারপর বিদ্যুৎগতিতে মিলিয়ে গেল ঘন অন্ধকারে।
“ছয় বেহারা হুম হুঁ না…জোয়ানপারা হুম হুঁ না…পা চালিয়ে হুম হুঁ না…কাঁধ মিলিয়ে হুম হুঁ না…জোর সে চলো হুম হুঁ না…বাহারে বেটা হুম হুঁ না।” সামনে তিন। পিছনে তিন। সুদৃশ্য কারুকাজ করা ভারী সেগুন কাঠের পাল্কিটাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ছজন পাল্কিবাহক। কাঁধের গামছার ওপর চাপানো পাল্কির হাতল। শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে অবিশ্রান্ত। ক্লান্তি কাটাতে একটানা হুম হুঁ না, হুম হুঁ না…তাল তুলে যাচ্ছে মুখে। নিজেরাই উৎসাহ যোগাচ্ছে নিজেদের। পাল্কির পিছনে আরও দুটো চার বেহারার পাল্কি। নজরানার কলসি, টুকরি আর বাক্সপ্যাঁটরায় বোঝাই। এককোণে গুড়িসুঁড়ি মেরে বসে রয়েছেন নায়েব কেদার চক্কোত্তি আর খাজাঞ্চি মশাই। তিনটে পাল্কির আগেপিছে কুড়িজন করে পাইক লেঠেল। হাতে লাঠি সড়কি বল্লম। ছুটছে পাল্কির তালে তাল মিলিয়ে। সামনের পাল্কিতে মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন ভূপতি রায়। মৃদু একটা উদ্বেগের চাপ মুখে। সেই কাকভোরে ছেড়েছে পাল্কি। মাঝপথে দুপুরে একবার পায়রাডাঙ্গার হাট, এছাড়া থামেনি কোথাও। বাঙ্গালচি আর ঠ্যাঙ্গামারির জঙ্গল পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। সামনে নীলের বন। তারপরই কেষ্টনগর। এটুকু পথ পেরোতে পারলে নিশ্চিন্তি। চিন্তার ছাপটা কেটে যাচ্ছে ভূপতির মুখ থেকে। ঝুটমুট ভয় দেখাচ্ছিল নায়েবের পো। নীলের জঙ্গল মানে তো কেষ্টনগরের একদম দোরগোড়ায়। ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবের খাসতালুক। কোন ব্যাটা খালিফার এতো বড় বুকের পাটা হবে এখানে হামলা করে। আর যদি করেই, বেঁচে ফিরবে না এক শালাও। চল্লিশ জনের লেঠেল ফৌজ। তারওপর ওই ভোজপুরি যমদূত দুটো। শালা বিশে বাগদীর বাপেরও ক্ষমতা নেই এখানে দাঁত ফোটায়। হাত দিয়ে পাল্কির পাল্লাটা সরিয়ে গায়ে গায়ে ছুটতে থাকা ভোজপুরি সেপাইদের মধ্যে একজনকে ডাকলেন ভূপতি। “সামনে নীলের বন। বন্দুকে টোটা গেদে একদম তৈরি থাকবি। বুঝেছিস?” “জী হৌজুর। হামলোগ একদাম তৈয়ার আছে।” ছুটতে ছুটতেই উত্তর দিলো বন্দুকধারী। নিশ্চিন্ত হয়ে তাকিয়ার আরামে শরীরটাকে ছেড়ে দিলেন জমিদারবাবু।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এবারের টা বড্ডো ছোট হয়ে গেলো , একেকটা পর্যায় অন্ততঃ একেকটা লজিকাল break এর মাথায় হলে টানটান হতো. একটা জিনিস শিখলাম , টানটান হওয়া মানে ছোট বা দ্রুত হওয়া ই শুধু নয়, পর্যায়ের যতি টা ঠিকমতো ধরা। তবেই attention ঠিক মতো ধরা থাকবে
দারুন সুন্দর । পরবর্তী পর্ব জলদি আসুক।