দীর্ঘ টানা বর্ষা কাটিয়ে আশ্বিন এসেছে বাংলায়। কাশ ফুলে ফুলে সাদা হয়ে রয়েছে পরিহার গড়ের সামনে ছোট মাঠটা। ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে গড়ের ভেতর থেকে। গড়ের দালানে কেদারায় বসা অর্জুন সিংহ। সামনে নবনির্মিত নাটমন্দিরে পুজো চলছে। ধুনোর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মণ্ডপ। একচালার প্রতিমা। সামনে দাঁড়িয়ে পুরোহিত মশাই। হাতে পিতলের ঘণ্টাটা নেড়ে নেড়ে মন্ত্রপাঠ করছেন মন্দ্রকণ্ঠে। সামনে যজ্ঞকুণ্ডের চারপাশে কাঠের বারকোশে থরে থরে সাজানো ফলমূল,মন্ডা, বাতাসা, কদমা, মঠ, চিড়ে মুড়কি, ফুল বেলপাতা। ‘ঢ্যাংকুড়কুড়…’ মন্ত্রোচ্চারণের তালে তালে দুলে দুলে বাজাচ্ছে ঢাকিরা। পালকের চামরগুলোও মাথা ঝাঁকাচ্ছে ঢাকের তালে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে সবকিছুর তদারকি করছে ভগবান, বিজয়া আর বীণা। হাঁকডাক করে নির্দেশ দিচ্ছে সবাইকে। আনমনে সেদিকে তাকিয়েছিলেন ঠাকুরসাহেব। এত আয়োজন তবুও যেন কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু।
কিছুদিন আগে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে দুর্গা। ঠাকুরসাহেব শিশুটির নাম রেখেছেন অমরনাথ। ওর জন্মের পর যেন খুশির তুফান বয়ে গেছিল পরিহারের গড়ে। দীর্ঘকাল এ গড়ে কোনও শিশুর জন্ম হয়নি। শিশুর মতো আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে গেছিল বীণা আর বিজয়া। দেখে মনে হচ্ছিল দুর্গার নয়, সন্তানটি বোধহয় ওদেরই। আসলে যে মাতৃত্বের স্বাদ নিজেরা কখনো পায়নি শিশুটিকে ঘিরে সেটাই বোধহয় পূরণ করতে চাইছে ওরা। এমনটাই মনে হয়েছিল ঠাকুরসাহেবের। ঘাড় ফিরিয়ে মণ্ডপের একপাশে তাকালেন ঠাকুরসাহেব। একটা ছোট বেতের মোড়ায় বসা দুর্গা। কোলে শিশুসন্তান। উদাসচোখে তাকিয়ে রয়েছে মাতৃমূর্তির দিকে। পুজোর কদিন আগে ঠাকুরসাহেবের কাছে এসেছিল দুর্গা। বারান্দায় পায়চারি করছিলেন ঠাকুরসাহেব। দেখামাত্র লাঠিতে ভর করে এগিয়ে গিয়েছিলেন সামনে।
— “আমার একটি অনুরোধ রয়েছে বাবা”- মৃদু গলায় বলেছিল দুর্গা।
— “অনুরোধ নয়, হুকুম করও মা” শশব্যস্তে বলে উঠেছিলেন ঠাকুরসাহেব।
— “পুজোয় যেন পশুবলি না হয় এবাড়িতে। জীবনে অনেক রক্তপাত দেখেছি আমি। আমার সন্তানকে যেন এসব দেখে বড় হয়ে না উঠতে হয়। দুটি পায়ে পড়ি আপনার, আমার এই মিনতিটুকু রাখবেন” শুনে শিহরিত হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুরসাহেব।
— “তাই হবে দুর্গামাঈ তাই হবে!” বলে উঠেছিলেন ধরাগলায়।
দুর্গার কথায় মান্যতা দিয়েই পুজোয় পশুর বদলে কূষ্মাণ্ডবলির আয়োজন হয়েছে পরিহারের গড়ে। পুজোর কাজকর্ম সামলে সামনে এসে দাঁড়াল ভগবান। ভারি বিষণ্ণ একটা হাসি ঠোঁটের কোণে।
— “এ তো সেই রামহীন যজ্ঞ, তাই না ঠাকুরসাহেব।” করুণ দৃষ্টিতে ভগবানের দিকে তাকালেন অর্জুন সিংহ।
— “একদম সহি বলেছ বেটা। একাহাতে যে সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখে গেল, এমনদিনে সেই উপস্থিত নেই এখানে। কি জানি এটাই বোধহয় ভগবানের ইচ্ছে।”
ভারি হয়ে আসছিল ঠাকুরসাহেবের গলা। নিচু হয়ে ধুতির খুঁটে চোখ মুছলেন বৃদ্ধ মানুষটি। তারপর ফের মুখ তুলে তাকালেন ভগবানের দিকে।
— “কোথায় যাচ্ছে তোমাকেও কিছু বলে যায়নি, না?”
— “না” হতাশ গলায় বলল ভগবান।
— “বিশে জানত ঠিকানা দিয়ে গেলে যেভাবেই হোক সেখানে গিয়ে পৌঁছব আমি। ইচ্ছে করেই একেবারে পিছুটানের সবকটা সুতো কেটে দিয়ে গেছে ও।”
জবাবে নীরব রইলেন ঠাকুরসাহেব।
— “অঞ্জলি শুরু হবে” নাটমন্দির থেকে হাঁক দিলেন পুরোহিত।
— “চলুন” হাত ধরে ঠাকুরসাহেবকে কেদারা থেকে তুলল ভগবান। লাঠি ঠুকঠুকিয়ে ভগবানের পিছু পিছু মণ্ডপের দিকে এগিয়ে গেলেন অর্জুন সিংহ।
ফেডি আর নৃপতি রায়ের খাজনা লুঠের পর আর কোনও কাজ হয়নি। এদিকে রসদও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বসে খেলে কুবেরের ভাঁড়ারও খালি হয়ে যায়। কালীপুজোর পরেই ফের বেরতে হবে কাজে। দুশমন ঘুরে হামলা করার আগেই পাল্টা মারতে হবে ওদের। ফের একবার বুঝিয়ে দিতে হবে বিশে বাগদী মরে যায়নি এখনও।
ভাঙাচোরা বল্লালঢিবির একদম মাথার ওপর দৈর্ঘ্য প্রস্থে বিশাল একটা সুড়ঙ্গমত। তার মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে গড়ের বাইরে তাকিয়ে ছিল বিশ্বনাথ। হাতদুটো জড়ো করে রাখা থুতনির নিচে। পূবের রোদ্দুর ত্যারচা হয়ে পড়ছে মুখের ওপর। গড়ের সামনে খোলা মাঠ, কাশের ঝোপ, তারপর গহীন জঙ্গল… এসব পেরিয়ে ঝড়ো বাতাসের মত ছুটে যাচ্ছিল মনটা। অনেকদূরে সেই পরিহারের গড়ে। নিশ্চয়ই পুজো শুরু হয়ে গেছে এতক্ষণে। ভগবান সবকিছু ঠিকঠাক সামাল দিতে পারছে তো? যদিও বীণা, বিজয়ারা রয়েছে আর সবার ওপর ঠাকুরসাহেব তো আছেনই। তবুও… ‘ট্রুইইই’ শব্দ তুলে অনেক উঁচুতে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা চিল। ওর মত একজোড়া ডানা যদি থাকত। এখনই উড়ে গিয়ে একপাক ঘুরে আসা যেত ওখানে। অনেকদুর থেকে সবার অলক্ষ্যে একবার দেখে আসা যেত সবকিছু। কেমন আছে সবাই। কেমন আছে দুর্গা। এইমাসেই তো দিন বলেছিল দাই। নাকি গতমাসে? ঠিক মনে পড়ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক হল তো? ছটফট করে উঠে বসল বিশ্বনাথ। তীব্র একটা উদ্বেগ কুরে কুরে খাচ্ছে ভিতরে। একবার মনে হয়েছিল কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নেয়। পরমুহূর্তেই বাতিল করেছে ভাবনাটা। চারদিকে দুশমনের মাছিরা ভনভন করছে। একবার খবর পেলে ওদের বিপদ হবে। এইসব সাতসতেরো চিন্তার মাঝখানে সামনে এসে দাঁড়াল নলে।
— “চল, পুজো শুরু হয়ে গেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।”
নলের কথায় মনে পড়ল এখানেও খুব ছোট করে পুজো হচ্ছে বটে একটা। আসলে এ ব্যাপারে সমস্ত উৎসাহই হারিয়ে ফেলেছিল বিশ্বনাথ। যে বিষমকুলে এত জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো হত রাতারাতি চলে আসতে হল সেই এতদিনকার পুরনো আস্তানা ছেড়ে। ওখানে আর পুজো হবে না এবার। ভাবলেই হু হু করে ওঠে মনটা। নিজের এই যন্ত্রণার কথাটা বন্ধুদের কাছে বলেওছে কয়েকবার। তাই মাসদুয়েক আগে যখন পেমা, নলেরা কথাটা তোলে, তেমন গা করেনি বিশ্বনাথ বন্ধুদের কথায়। শোনেনি ওরা। শিমুলের কুমোরপাড়ার থেকে ছোট একটা প্রতিমা নিয়ে আসা হয়েছে খুব গোপনে। একজনমাত্র ঢাকি আর পুরুতমশাইকে চোখ বেঁধে নিয়ে এসছে জলিল, নলেরা মিলে। পুজো শেষে আবার চোখ বেঁধে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে যার যার ঘরে। ওদের দানদাক্ষিণ্যে যেন কোনও রকমের কার্পণ্য না হয়, নির্দেশ দিয়েছে বিশ্বনাথ। গড়ের মধ্যে ছোট একফালি জায়গাকে সাফসুতরো করে পুজোর আয়োজন হয়েছে কোনওমতে।
— “চল চল, আর দেরি করিসনে।” বিশ্বনাথকে অন্যমনস্ক দেখে ফের তাড়া লাগাল নলে।
— “তুই এগো, আমি আসছি” বলল বিশ্বনাথ।
— “জলদি আয়।” তাড়া দিয়ে চলে গেল নলে।
অন্যমনস্কভাবে নলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো বিশ্বনাথ। এরমধ্যেই অন্যরকম কিছু চিন্তা এসে জড়ো হতে শুরু করেছে মাথার মধ্যে। ফেডি আর নৃপতি রায়ের খাজনা লুঠের পর আর কোনও কাজ হয়নি। এদিকে রসদও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বসে খেলে কুবেরের ভাঁড়ারও খালি হয়ে যায়। কালীপুজোর পরেই ফের বেরতে হবে কাজে। দুশমন ঘুরে হামলা করার আগেই পাল্টা মারতে হবে ওদের। ফের একবার বুঝিয়ে দিতে হবে বিশে বাগদী মরে যায়নি এখনও। এই মুহূর্তে বেশ কয়েকটা নীলকুঠি, জমিদার আর বেনিয়া বাড়ির কথা মাথায় ঘুরছে। সেসব নিয়ে দলের সবার সঙ্গে বসতে হবে একবার… শরীরটাকে ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল বিশ্বনাথ।
দু-তিনমাসে পরপর বেশ কিছু দুঃসাহসিক ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেল বড় বড় কয়েকটা জমিদারবাড়ি আর নীলকুঠিতে। চারদিকে এরকম একটা দিশেহারা অবস্থার মধ্যেও ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসিটা একটুও টস্কায়নি ব্লাকুয়ার সাহেবের। কারণ হামলার সবকটাই ঘটেছে নদীয়ার সীমানার মধ্যে। এর অর্থ জেলা ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারেনি বিশে বাগদী।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
নতুন পর্ব পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা তৈরি করে। এই স্বাদ ভারি সুন্দর।
এবার এডিটিং মন্দ নয়, চলছে চলুক। পুজো যে বাঙালীর মনে একটা সার্বজনীন বিষয় , সেটা নামগুলো থেকেই পরিষ্কার। প্রথাও যে পাল্টে যায় ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সেটার কি অপূর্ব প্রকাশভঙ্গি।