সন্ধ্যে সাতটা। কৃষ্ণনগরে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দফতর। অসংখ্য খাসগেলাসের মোমদানের আলোয় আলোময় ঘরটা। বিশাল মেহগনি কাঠের টেবিলটার পিছনে মখমলের গদি আঁটা কেদারায় সোজা হয়ে বসে রয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উইলিয়াম এলিয়ট। রাগে অপমানে ফরসা মুখখানা লাল টকটকে!
টেবিলের উল্টোদিকে বসা ভূপতি রায়। তখনও কাঁপছেন থরথর করে। বিকেলবেলার সেই মারাত্মক ত্রাসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখনও। দেয়ালের একধারে দাঁড়ানো নায়েব কেদার চক্কোত্তি। তাঁর অবস্থাও তথৈবচ। ভূপতি রায়ের পাশে বসা নন্দলাল মল্লিক আর চারুচন্দ্র সরকার। মেহেরপুর আর চাকুলের জমিদার। ওঁদেরও খাজনার তারিখ ছিল আজ। ওঁদের দু’জনকেও এই মিটিং-এ থাকতে অনুরোধ করেছেন এলিয়ট। এলিয়ট সাহেবের পাশে পাশে আরেকটা কেদারায় স্যামুয়েল ফ্রেডি। এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় নীলকর ব্যবসায়ী। ভূপতি রায়, নন্দ মল্লিক আর চারু সরকার এই তিন জমিদারের সঙ্গেই জমি দাদনের কারবার রয়েছে ফ্রেডি সাহেবের। “সরি বাবু, আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর পেইন অ্যান্ড অ্যাগোনি।” সমবেদনার চোখে ভূপতি রায়ের দিকে তাকালেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। এতক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফোঁপাচ্ছিলেন ভূপতি। প্রাণপণে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন নিজেকে। সাহেবের কথা শোনামাত্র সেই বাঁধ ভেঙে গেল এক মুহূর্তে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। “কোম্পানির রাজত্বে হুজুররা থাকতে আমার এতবড় অপমান! আমার চাকরবাকরদের সামনে আমাকে কান ধরে ওঠবোস করালো ওই বিশে বাগদি। তারপর ন্যাংটো করে আধক্রোশ হাঁটিয়ে শহরে পাঠাল। আজ অবধি ঘড়ির কাঁটা ধরে খাজনা পাঠিয়েছি হুজুরের দরবারে। এক পয়সা এদিক ওদিক নেমকহারামি হয়নি কখনও। হুজুরের এত সেবা করে আমার লাভ কী হল। মানসম্মান, অর্থ…এক মুহূর্তে সব ধুলোয় মিশে গেল।” কান্না থামছিল না ভূপতির।
“শান্ত হোন রায়মশাই…” পাশে বসা নন্দ মল্লিক কাঁধে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করলেন ভুপতিকে। তারপর ঘুরে তাকালেন এলিয়ট সাহেবের দিকে। “রায়মশাই কিন্তু ঠিকই বলেছেন হুজুর। যদি নিজের নিরাপত্তাই না থাকল, তাহলে আর জমিদারি চালিয়ে লাভ কী? আমার তো আজকাল সন্দেহ হয় রাজত্বটা কে চালাচ্ছে। কোম্পানি না ওই বিশে ডাকাত?”
“কিছু যদি মনে না করেন। তাহলে আমারও ওই এক মত।” পাশ থেকে বলে উঠলেন চারু সরকার। তারপর পাঞ্জাবির ট্যাঁক থেকে একটা চিঠি বের করে এগিয়ে দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে। “গেল বছর দুগগাপুজোর সময় চিঠিটা এসেছিল আমার কাছে। আপনাকে দেখাব কি দেখাব না, মনস্থির করতে পারছিলাম না। তবু সঙ্গে এনেছিলাম। কিন্তু রায়মশাইয়ের অবস্থা দেখার পর মনে হচ্ছে ব্যাপারটা হুজুরের গোচরে আনা দরকার।” এলিয়ট সায়েবের পিছনে দাঁড়ানো পাঁচকড়ি ব্যাবত্যা। একই সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের সহকারি এবং দোভাষি। “কী এটা?” প্রশ্ন করলেন ভুরু নাচিয়ে। “পড়েই দেখুন না।” বিষণ্ণ হাসলেন চারু সরকার। জমিদারবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিলেন পাঁচকড়ি। প্রথম দু এক লাইন পড়তেই চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠল তাঁর। চিঠির বয়ান এইরকম-
শ্রী শ্রী কালী সহায়
‘মান্যবর জমিদার শ্রী চারুচন্দ্র সরকার বাবুবরেষু,
আমি এ বিষয়ে সবিশেষ জ্ঞাত যে আপনি নদিয়া জিলার দক্ষিণ ভাগে চাকুলে গ্রামের জমিদার। আমি ইহাও অবগত আছি যে তিন পুরুষ ধরিয়া আপনার গরিব রায়ত প্রজাদের রক্ত শুষিয়া বিস্তর ধনসম্পত্তি অর্জন করিয়াছেন, অথচ তাহাদিগের হিতার্থে কিছুই করেন নাই। আপনাদের চোরকুঠুরিতে সিন্দুকে ঘড়া ঘড়া রাশি রাশি মোহর উপচাইয়া পড়িতেছে। গরিবের মঙ্গলার্থেই অবিলম্বে তার কিছুটা সদ্ব্যবহার হওয়া প্রয়োজন। এই হেতু আপনাকে আজ্ঞা করা যাইতেছে যে আগামী মঙ্গলবার একাদশীর রাত্রি দ্বিপ্রহরে পাঁচ ঘড়া মোহর মশানতলার মাঠে রাখিয়া আসিবেন। আমার আদেশের অবাধ্য হইলে ওইদিনই ভোর নিশিতে আপনার গৃহে আমি পদধুলি দিব এবং আপনার সমস্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন করিব। অতঃপর আপনি এবং আপনার পরিবার যথাযুক্ত ফল ভোগ করিবেন।
ইতি,
মা কালীর একান্ত অনুগত সন্তানবিশ্বনাথবাবু|
চিঠি পড়া শেষ করে বিস্মিত চোখে চারু রায়ের দিকে তাকালেন পাঁচকড়ি। প্রশ্ন ছুড়লেন
–আপনি কী করলেন?
— কী আবার, বিশের আদেশ মত পাঁচ ঘড়া মোহর গুনে গুনে নিয়ে গিয়ে রেখে এলাম মশানতলার মাঠে।
নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন চারু রায়। করুণ হাসিটা তখনও লেগে রয়েছে তাঁর চোখের কোণে। তড়িঘড়ি সামনে ঝুঁকে পড়ে জমিদারবাবুর বয়ান সমেত পুরো চিঠিটা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে তর্জমা করে দিলেন পাঁচকড়ি। শোনামাত্র আরও একপোঁচ লাল হয়ে উঠল সাহেবের রক্তবর্ণ মুখখানা।
–হোয়াই ডিডন্ট ইউ ইনফরম মি! বিস্ময় আর ক্রোধে টেবিলে একটা ঘুষি মেরে প্রশ্ন করলেন এলিয়ট।
–কী হবে হুজুর খবর দিয়ে? একইরকম শান্ত এবং নির্লিপ্ত কণ্ঠ চারু সরকারের।
–হুজুরের কুঠির পাঁচ আঙুল দূরে নীলের বন। সেখানেই রায়বাবুর গালে থাপ্পড় মেরে সর্বস্ব লুঠে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল বিশে। আর আমার ঐ ধ্যাধ্ধেড়ে গোবিন্দপুর চাকুলে গাঁয়ে বসে বেচাল কিছু করলে রক্ষা পাব মনে করেছেন? ধনসম্পত্তি তো যাবেই। তার ওপর কচুকাটা হতে হবে সপরিবার। বুদ্ধি থাকলে কেউ ঘরজামাই হয় হুজুর? তাই চুপচাপ গিয়ে পাঁচ পাঁচ ঘড়া মোহর সোনামুখ করে রেখে এসেছিলাম মশানতলার মাঠে। কথায় বলে সুবুদ্ধি, বাঁচলে তবে তো টাকাকড়ি।
চারু সরকারের কথায় অত দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেললেন ভূপতি রায়। সঙ্গে নন্দ মল্লিকও। অতঃপর ফের একবার পাঁচকড়ির ঝুঁকে ফ্রেডি পড়া সাহেবের সামনে। পুরো তর্জমাটা খুব মন দিয়ে শুনলেন স্যামুয়েল ফ্রেডি।
–জমিনদারবাবু ইস রাইট এলিয়ট। বললেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দিকে তাকিয়ে। “দ্যাট বিশে বাগডি। ব্লাডি ব্যান্ডিট। পুরো এলাকা জুড়ে একটা প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রান করে লোকটা। জমিনডারস এন্ড রিচ পিপল…সোবাই যমের মত ভয় পায় ওকে। আমার কাছে খবর আছে, আমার সঙ্গে কারবার না করার জন্য আনেক জমিনডারকে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছে বিশে। আজ যে জমিনডারবাবুর সঙ্গে পাকা কথা বলে এলাম, কাল সে না করে দিচ্ছে। ইফ দিস থিং গোজ অন, দেন আয়্যাম সিওর আমাদের মত ইন্ডিগো প্ল্যান্টারদের খুব জলদি বিজনেস গোটাতে হবে দেশ থেকে। সেই সঙ্গে তোমাদেরও। কারণ কোম্পানিকে ট্যাক্স দেওয়ার বদলে বাবুরা ঐ বিশে ডেকয়েটকেই ট্যাক্স দেবে।”
–উইল ইউ প্লিজ কিপ ইওর মাউথ শাট, ফ্রেডি? রাগে কাঁপতে কাঁপতে টেবিলের ওপর রাখা পেতলের বেলটায় সজোরে একটা চাপড় মারলেন এলিয়ট। মুহূর্তের মধ্যে ঘরে ঢুকল আর্দালি চমনলাল। রক্তচোখে আর্দালির দিকে তাকালেন এলিয়ট। “আভি বুলাও থানেদার সাবকো। জলদি!” আদেশ পাওয়ামাত্র ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল চমনলাল।
পরের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৭)
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৫)
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
আহাহাহা , উলঙ্গ কাঁপুনে জমিদার আর হুঁকো মুখ সাহেব , ব্লাডি bandit কে ডরাচ্ছে , এটাই তো চাই ! এই ভাবেই মিথ গুলো ইতিহাস হয়ে উঠুক ভবিষ্যতের প্রয়োজনে।