বাজপড়া মানুষের মত বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বনাথ! জবাফুলের মতো লাল চোখজোড়া। পাথরচাপা মুখ। ডান চোখের নিচে পেশিগুলো কেঁপেই চলেছে থরথর করে। পৌষ মাস। একটু দূরে খড়ে চূর্ণীর জল বেয়ে উঠে আসা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। আদুল গায়ের ওপর জড়ানো মোটা বালাপোশখানা কখন গা থেকে পড়ে গেছে মাটিতে। হুঁশ নেই সেদিকে। চারপাশে দাঁড়ানো দলের লোকেরা। এগিয়ে এসে তুলে গায়ে জড়িয়ে দেওয়ার সাহস হচ্ছে না কারও। সবরকম ইন্দ্রিয় অনুভূতির যেন উর্ধ্বে চলে গেছে ওর শরীরটা। পায়ের সামনে বসা মানসুরে ডাকাতদলের চারপাঁচজন। ক্লান্ত, আহত, রক্তাক্ত প্রত্যেকে। একদম সামনে শেখ বুনো আর জলিল মোল্লা। করুণ গলায় বলে চলেছে ঘটনাটা।
গত রাতে আটঘড়া গ্রামে এক জমিদার বাড়িতে জনা পঞ্চাশ মিলে ডাকাতি করতে গিয়েছিল ওরা। তার আগে বিশ্বনাথের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী ওখানকার বাবুদের হুমকির চিঠিও পাঠিয়েছিল। পাল্টা চিঠিতে জবাব এসছিল। একটি লাল পয়সাও দেওয়া হবে না। যা পার করে নাও। এত্ত বড় আস্পর্ধা! রাগে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল মানসুরেরা কিন্তু ফাঁদটা বুঝতে পারেনি। দরজা ভেঙে জমিদারবাড়িতে ঢুকতেই বাইরে থেকে ওদের ঘিরে ফেলে শ’দুয়েক লেঠেলের দল। সঙ্গে বন্দুক হাতে কোম্পানির জনাদশেক তেলেগু ফৌজ। লাঠিয়ালদের দলটার একদম সামনে ছিল পাঁচকড়ি সর্দার, বোদে, মেগাই আর ওপরগস্তিরা। ওরাই চালাচ্ছিল দলটাকে। অন্যদিকে তেলেগু ফৌজদের গুলিতে একের পর এক মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল মানসুরেরা। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফৌত হয়ে গিয়েছিল দলের পঁচিশ তিরিশজন।
বিপদ বুঝে সবার আগে বাঘের মতো ছুটে গিয়েছিল ইস্কান্দার মোল্লা। মানসুরেদের সর্দার। জলিলের বড় ভাই। দু’শো জনের দলের সামনে বুক চিতিয়ে অনেকক্ষণ লড়ে গিয়েছিল একা। ঝড়ের মত বন বন করে একা লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করছিল বারবার
— তোরা পালা! আমি রুখছি ওদের।
— বিশু ভাই! হাউমাউ করে কেঁদে উঠল জলিল।
— পালিয়ে আসতে আসতে দেখেছিলাম টাঙ্গি দিয়ে টুকরো টুকরো করে ভাইজানকে কাটছে মেগাই। পাশে দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসছে বোদে। সারারাত আটঘড়ার গায়ে ব্যাঙ্গালচির জঙ্গলে লুকিয়েছিলাম আমরা। ভোর রাতে নদীর ধারে লাশগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল ওরা। সেখান থেকে যত জনকে পারি টেনে হিঁচড়ে এনে জঙ্গলের গভীরে গোর দিই আমরা। ভাইয়ার লাশখানাও ছিল তার মধ্যে। দাদার মুখখানা যদি একবার দেখতে বিশুভাই। গোটা শরীর ফালাফালা মুখখানা তখনও হাসছে।”
পাশে এসে দাঁড়াল মেঘা।
— আমি তোকে তখনই বলেছিলাম বিশে, বোদেকে ছেড়ে দিসনি। সাপ ঘুরে ঠিক ছোবলাবে। সেদিন আমার কথা শুনলে এতো বড় সব্বোনাশ ঘটত না।
বিশ্বনাথের গায়ে বালাপোশটা ভালো করে জড়িয়ে দিল মেঘা। মেঘার কথা কানেই ঢুকছিল না বিশের। ইস্কান্দারের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। ইস্কান্দার! বুনো ঘোড়ার মত লাগামছাড়া, অবাধ্য। ‘সারা বাংলায় এক দল এক সর্দার’- বিশ্বনাথের এই প্রস্তাবের জবাবে বলেছিল,
— যদি সাচ্চা মরদ হও তো দিগনগরের মেলায় লাঠিবাজিতে হারিয়ে দেখাও।
দিগনগরে মহরমের মেলায় লাঠিবাজির খেলায় মুসলমানরা ছাড়াও হাড়ি-বাগদি, নমঃশূদ্র আর কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষেরা যোগ দিত। দিগনগরের মাঠে এক ঘণ্টা লড়াই চলেছিল ইস্কান্দার আর বিশের। শেষমেশ পাল্লা বিশ্বনাথের দিকে ঝুঁকলেও ইস্কান্দারের হাত থেকে লাঠি ফেলতে পারেনি ও। তবুও বশ্যতা স্বীকার করেছিল ইস্কান্দার।
— নাঃ তোমার মত মরদের তাঁবে কাজ করেও ইজ্জত আছে।
তারপর থেকে দলের নিয়মকানুন প্রতিমুহূর্তে মেনে চলেছে অক্ষরে অক্ষরে। সেই ইস্কান্দার। মৃগি রুগির মতো একবার হ্যাঁচকা খেয়ে পরমুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল বিশ্বনাথের শরীরটা। মাথা নিচু করে তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল জলিল। কালো মজবুত শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নার তোড়ে। এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধ ধরে মাটি থেকে টেনে তুলল বিশ্বনাথ। প্রেতে খাওয়া মানুষের মতো চোখের দৃষ্টি।
আজকে ভয়ের কথা বলছিস তুই? সেই সেদিন যখন রণপা থেকে নেমে তোর বাপের দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার সঙ্গে যাবি কিনা, সেদিন কেন না করিসনি? আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে দুর্গা। এবার শেষ একটা লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতে হবে আমাকে।
— কাঁদিসনে জলিল। ইস্কান্দারের গোরের মাটি শুকোবে না, হাড়িকাঠে চড়িয়ে দেব মেগাইকে। মা কালীর কসম। তারপর আটঘড়ার জমিদার বাড়ি জ্বালিয়ে ছাই করে সেই ভস্ম ছড়িয়ে দেব ইস্কান্দারের কবরে। ওর আত্মা শান্তি পাবে। জবান দিলাম তোকে।
জলিলকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মেঘার সামনে নিয়ে গেল বিশ্বনাথ।
— যতদিন না ইস্কান্দার আর ওর দলের লোকেদের খুনের বদলা নেওয়া হচ্ছে, ততদিন ওদের ভার আমাদের। তারপর নতুন করে যদি দল খুলতে চায় তো খুলবে। নয়তো আমাদের সঙ্গেই থাকবে ওরা। পুরো সম্মানের সঙ্গে। বুঝেছিস?
জবাবে ঘাড় নাড়ল মেঘা। জলিলকে মেঘার কাছে রেখে পীতাম্বর আর প্রেমচাঁদের দিকে এগিয়ে গেল বিশ্বনাথ।
— তুই ভগবানকে খবর পাঠা। চারদিকে মাছি লাগাতে বল। যত জলদি সম্ভব মেগাইকে হাতে চাই আমি। যত লোক লাগুক, যত টাকা খরচা হোক পরোয়া নেই। মোট কথা ওদের খবর আমার চাই।
— চিন্তা করিসনে বিশে, মেগাই আমাদের জালে উঠবেই। তুই শুধু একটু শান্ত হ!
পিতাম্বরের কথায় অনেকক্ষণ ধরে দম চেপে থাকা ফুটন্ত একটা আগ্নেয়গিরিতে বিস্ফোরণ ঘটল যেন।
— ইস্কান্দার ভাই আমার!
বুকফাটা কান্নায় পিতাম্বরের কাঁধে ভেঙে পড়ল বিশ্বনাথ। ছাদের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল দুর্গা। এবার এগিয়ে এসে আলতো করে হাত রাখল বিশ্বনাথের পিঠে।
— নিচে চলো, একটু বিশ্রাম দরকার তোমার।
— তাই চল।
দুর্গার কাঁধে ভর দিয়ে স্খলিতপায়ে নেমে গেল বিশ্বনাথ।
— চারদিকের অবস্থা আমার মোটে ভালো ঠেকছে না বিশুবাবু। মনে হচ্ছে ওরা তোমার বিরুদ্ধে আটঘাট বেঁধে নেমেছে এবার সবাই মিলে। সত্যি বলতে কি, বড় ভয় করছে আমার। দু’টি পায়ে পড়ি তোমার, এ ছাইয়ের পেশা ছেড়ে দাও তুমি। যা করে হোক দু’টো ফ্যানভাত ঠিক জুটে যাবে আমাদের দু’জনের।
পালঙ্কে টান টান হয়ে শোওয়া বিশ্বনাথ। বুক অবধি টানা একটা লেপ। চোখমুখের চেহারা অনেকটাই শান্ত এখন। উত্তরে চোখ ঘুরিয়ে মৃদু হাসল পাশে বসা দুর্গার দিকে তাকিয়ে।
–ছেড়ে দিতে বললেই কি ছেড়ে দেওয়া যায় রে দুর্গা। আর শুধু কি তুই আর আমি? আমার দলের লোকেরা, গাঁয়ে গাঁয়ে গরিব মানুষরা সবাই আমার মুখ চেয়ে রয়েছে। এদের সবাইকে ফেলে কোথায় পালাব আমি? আর আজকে ভয়ের কথা বলছিস তুই? সেই সেদিন যখন রণপা থেকে নেমে তোর বাপের দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম… জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার সঙ্গে যাবি কিনা, সেদিন কেন না করিসনি? আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে দুর্গা। এবার শেষ একটা লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতে হবে আমাকে। সে যুদ্ধের শেষে হয় ওরা থাকবে নয় আমি। এর মাঝামাঝি আর কোনও রাস্তা খোলা নেই আমার।
গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিশ্বনাথ। তারপর হাত বাড়িয়ে দুর্গাকে টেনে নিলো বুকে। হাতের মোটা মোটা আঙুল গুলো বিলি কেটে যাচ্ছে দুর্গার চুলে।
— তবে চিন্তা করিস না। সে যুদ্ধে নামার আগে তোদের সবার জন্য বিলি বন্দোবস্ত করে দিয়ে যাব আমি। আর কিছু না হোক দু’টো পেটের ভাতের অভাব হবে না জীবনে। সাধারণ গেরস্থ যে ভাবে বাঁচে সে ভাবে বাঁচবি সবাই। প্রত্যেকদিন বুকে ভয় পুষে পুষে বাঁচতে হবে না কাউকে। আর সেজন্যই শেষ লড়াইটা চাই।
কথা শেষ হবার আগেই বিশ্বনাথের বুকে মাথা ঠুকে ডুকরে কেঁদে উঠল দুর্গা।
— তোমার টাকাপয়সা, সোনাদানা, কিছু চাই না আমার! শুধু তোমাকে চাই। আমার পেটে তোমার বাচ্চা এসেছে। তোমার সন্তান, শুনতে পাচ্ছ তুমি?
কাঁদতে কাঁদতে বিশ্বনাথের বুকে মাথা কুটছিল দুর্গা। বিস্ময়স্তব্ধ চোখে দুর্গার দিকে তাকিয়ে ছিল বিশ্বনাথ।
— আগে বলিসনি কেন?!
— তুমি শুনতে চেয়েছ কোনওদিন? দলবল, ডাকাতি, খুনজখম এসব নিয়ে ব্যস্ত থাক রাতদিন। তার ফাঁকে আমি কেমন আছি, ঘুরে তাকিয়ে দেখার সময় পেয়েছ কখনও?
কান্নার দমক থামছিল না দুর্গার। দু’হাতে দুর্গাকে বুকে জড়িয়ে ধরল বিশ্বনাথ।
— আজ যখন বললিই, তাহলে তুইও একটা কথা শোন। আমি চাই না আমার সন্তান বেজন্মা হয়ে বাঁচুক। কদিন আগে মনোহর সর্দার লোক পাঠিয়েছিল আমার কাছে। বারবার করে আমাকে একবার ওর ওখানে যেতে বলেছে। খুব জরুরি কিছু কথা নাকি আমাকে বলার আছে ওর। জবাবে ওর লোককে হ্যাঁ বলে দিয়েছি আমি। আগামী অমাবস্যায় আমি ওখানে যাব। এখন ভাবছি তোকেও নিয়ে যাব সঙ্গে। কালীঘাটে মাকে সাক্ষী রেখে শুভ কাজ সেরে ফেলা যাবে।
জলভরা চোখ তুলে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল দুর্গা।
তারপর হাত দিয়ে বিশ্বনাথের মুখটা সামনে টেনে এনে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল ঠোঁটে।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এই লেখাটার জন্যে বলা যায় , “जिओ जनाब हज़ारों साल , साल में हो लाखों दिन ” এতো ভালোবাসা নিয়ে কোথায় কলম তাকে বন্ধক দিয়ে রেখেছিলে?