অনেকটা দূরে বিশাল উঁচু একটা গাছের ওপর বসে ঘটনার দিকে নজর রাখছিল শম্ভু আর কাশেম। পালানোর কথা বলেও পালায়নি দুজন। মশালের আলো আর পায়ের শব্দ জঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়ার পর নিঃশব্দে নেমে এল গাছ থেকেতারপর নেউলের মত পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল ঘাটের দিকে। ঘাটে পড়ে থাকা বোদে হাতে ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করছে। ছুটে গিয়ে বোদেকে তুলে ধরল শম্ভু।

“ছিপটা কাছে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি! ধরাধরি করে বোদেকে ছিপে তুলে ফেলল দুজন। পাশে সার দিয়ে বিশ্বনাথের দলের নৌকোগুলো বাঁধা রয়েছে ঘাটলা আর পাড়ের খোঁটায়। “যাবার আগে শালাদের নৌকোগুলো সব ফুটো করে দিয়ে যাই।” শম্ভুকে বলল কাশেম। “খেপেছিস শালা আহাম্মক। “ঐ দ্যাখ” আঙুল তুলে নদীর জলে দেখাল শম্ভুচাঁদের আলোয় এদিক ওদিক বুড়বুড়ি কাটছে জলে। “বেঁশেলরা ঘুরছে চারদিকে। রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে শালারা। নাও ফাঁসাতে গেলে জলে নামতে হবে। নৌকো ফাঁসানোর আগেই পুরে ফেলবে পেটে। ওসবে কাজ নেই। বিশের দল ফিরে এসে ধরার আগেই সটকে পড়তে হবে এখান থেকে। কেষ্টনগর নিয়ে গিয়ে কোবরেজ বদ্যি দেখিয়ে আগে চাঙ্গা করে তুলি সর্দারকে। বেঁচেবত্তে থাকলে শালা বিশে বাগদীর মহড়া নেবার অনেক মওকা পাওয়া যাবে। শুধু একটা মওকা…যাত্রাপালার দুঃশাসনের মত বুক চিরে রক্তপান করব হারামির…” দাঁতে দাঁত ঘষল শম্ভু। সরসরে স্রোতে দুজোড়া হাতের দাঁড়টানে মুহূর্তের মধ্যে মাঝনদীতে গিয়ে পড়ল ছিপ নৌকো।

বেশ রাত। দেয়ালে টাঙ্গানো সুদৃশ্য মোমদান আর বিশাল ঝাড়বাতির আলোয় দিন হয়ে রয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট সাহেবের দপ্তরের বিশাল কামরাটা। একটা লম্বা টেবিলের দুপাশে বসে থাকা জেলার নীলকর সাহেব আর জমিদারবাবুর দল। আয়তক্ষেত্রের মত টেবিলটার একদম শেষপ্রান্তে মাঝখানে বসে রয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট সাহেব। পাশে বসা জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্লাকুয়ার। কোম্পানির তরফে জেলাশাসক নিয়োগের পদ্ধতি শুরু হলে এই ব্লাকুয়ার সাহেবই প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছিলেন বাংলায়।

দীর্ঘদিন বিভিন্ন জেলায় কাজ করার ফলে বাংলা বলতে পারেন গড়গড় করে। বড়লাটের কাছে বিশেষ আবেদন পাঠিয়ে ব্লাকুয়ারকে নদীয়ায় নিয়ে এসেছেন স্বয়ং এলিয়ট সাহেব। প্রবাদ আছে ব্লাকুয়ার সাহেব যে জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যান চুরি ডাকাতি রাহাজানি নাকি সেখান থেকে কর্পূরের মত উবে যায়। তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ। বাজপাখির ঠোঁটের মত খাড়া নাক। মুখে সর্বদা লেগে থাকা ভারী শান্ত আর মিষ্টি একটা হাসি। এইমুহূর্তে চোখ ঘুরিয়ে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে চলেছেন চারপাশটেবিলের একদম উল্টোদিকে হাতদুটোকে সামনে রেখে বসে রয়েছেন খোদাবক্স খান। পিছনে হাতজোড় করে জড়সড় হয়ে দাঁড়ানো ওপরগস্তিদের দুই দলপতি হীরা আর মোতিপাশে মামা ভাগ্নে, পাঁচকড়ি সর্দার আর মেগাই। হেসে ওদের দিকে তাকালেন ব্লাকুয়ার সাহেব “টোমরা বসো।”

গ্রামের রাস্তাঘাট, মানুষজন, বিশের আড্ডা, ওর দলবলের শক্তি… সবকিছু ওদের জানা তাই ওরাই লিড করবে ফোর্সটাকে কোম্পানি আপনারা, আমরা প্রত্যেকে ফৌজ পাইক বরকন্দাজ আর অর্থ দিয়ে ওদের সাহায্য করব পিছন থেকে আর এই কাজটা যদি আমরা ঠিকঠাক করতে পারি দেন আই প্রমিস ইউ, উইদিন আ ইয়ার উই উইল গেট রিড ফ্রম দ্য মেনেস কলড বিশে ডেকয়েট

শোনামাত্র যেন বজ্রপাত হল ঘরের মধ্যে। কতকগুলো খুনে ডাকাতকে এক টেবিলে বসতে বলছেন ব্লাকুয়ার সাহেব। জমিদারবাবুরা তো বটেই। স্বয়ং এলিয়ট আর নীলকর সাহেবরাও বেবাক হয়ে গেছেন সকলে। বিস্ময়ে ঝুলে পড়া চোয়াল আর বিস্ফারিত কয়েক জোড়া চোখ। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই। টেবিল ছেড়ে উঠে এলেন ব্লাকুয়ারপ্রত্যেকের কাঁধে হাত রেখে নিজে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। তারপর ঘুরে তাকালেন ঘরে উপস্থিত সকলের দিকে। “কাহারও কিছু বলার আছে এ ব্যাপারে?” জবাবে থমথমে নীরবতা ঘরজুড়ে।

কয়েক মুহূর্ত এই হতবাক স্তব্ধতাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন ব্লাকুয়ার। তারপর বলা শুরু করলেন শান্ত গলায়।–

“জেন্টলমেন, আমরা আজ এখানে এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য একত্রিত হয়েছি যাকে সমস্যা না বলে ঘোর বিপদ বলাই ভালো। এখনি কড়া হাতে এর মোকাবিলা না করা গেলে জমিনডার আর ইন্ডিগো প্ল্যান্টারসরা তো বটেই, খোদ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও ছাড় পাবে না এর হাত থেকে। সে বিপদের নাম বিশে বাগদী। দ্য লিডার অফ আ লং চেইন অফ ব্যান্ডিটস ইন বেঙ্গল। বিশের মোকাবিলা করতে গেলে সবার আগে এই চেইনটাকে কাটতে হবে আমাদের। আর সেটা কাটার কারিগররা এই মুহূর্তে বসে আছে আমাদের সামনে।” পাঁচকড়ি সর্দারদের দিকে তাকালেন ব্লাকুয়ার।

“আর সেজন্যই তাদের ডিউ অনার দিতে হবে আমাদের সবাইকে সো দে ক্যান ফিল আস অ্যাজ দেয়ার ওন পিপল শুনতে খারাপ লাগলেও একথাটা সত্যি যে গ্রামের সাধারণ মানুষ আমাদের মানে কোম্পানি, জমিনডার আর ইন্ডিগো প্ল্যান্টারসদের হেট করে আর বিশেকে বন্ধুর মত, ভাইয়ের মত ভালোবাসে আমরা ওর কোনও খবর পাওয়ার অনেক আগেই গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের খবর পেয়ে যায় বিশে ফলে শুধু কোম্পানির ফৌজ, ইন্ডিগো প্ল্যান্টারসদের আর জমিনডারবাবুদের পাইক-লাঠিয়াল দিয়ে কাজ হবে না বিশের সঙ্গে লড়তে গেলে কমপ্লিট একটা ফোর্স হিসাবে কাজ করতে হবে আমাদের যে ফোর্সকে লিড করবে এই এরা” টেবিলের এককোণে বসে থাকা চারজনের দিকে আঙুল দেখালেন ব্লাকুয়ার

“কারণ গ্রামের রাস্তাঘাট, মানুষজন, বিশের আড্ডা, ওর দলবলের শক্তি… সবকিছু ওদের জানা তাই ওরাই লিড করবে ফোর্সটাকে কোম্পানি আপনারা, আমরা প্রত্যেকে ফৌজ পাইক বরকন্দাজ আর অর্থ দিয়ে ওদের সাহায্য করব পিছন থেকে আর এই কাজটা যদি আমরা ঠিকঠাক করতে পারি দেন আই প্রমিস ইউ, উইদিন আ ইয়ার উই উইল গেট রিড ফ্রম দ্য মেনেস কলড বিশে ডেকয়েটটেবিলের ডানদিকে বসা স্যামুয়েল ফেডি, অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। একটা হাত তুললেন মাথার ওপর। “আই হ্যাভ আ কোয়েশ্চেন মিঃ ব্লাকুয়ার। আফটার অল দিজ পিপল আর হার্ডকোর ক্রিমিনালস। ক্যান উই রিয়েলি ট্রাস্ট অন দেম? স্পেশালি এত বড় একটা কাজে যেখানে অল অফ আওয়ারস ইন্টারেস্ট ইজ রিলেটেড” প্রশ্নটা শেষ হবার আগেই ফেডির দিকে ঘুরে তাকালেন ব্লাকুয়ার। “ইন্টারেস্ট ইজ রিলেটেড।” ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি। “ উইথ ক্রিমিন্যালস? রিয়ালি? বাট আই থিংক দে আর নট বেটার দ্যান আস। চুরি ডাকাতি করার জন্য এরা মানুষের ঘরে হামলা করে, খুনখারাপি করে। কিন্তু খাজনার টাকা আদায়ের জন্য প্রজার গলায় পা দেয় না। ঘরের মেয়ে বউ তুলে নিয়ে যায় না, ইন্ডিগো প্লান্টেশনের নামে একর একর ফারটাইল প্যাডিফিল্ড জ্বালিয়ে দেয় নাসো প্লিজ স্টপ টকিং ক্র্যাপ

হাঁ করে ব্লাকুয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলেন ফেডি। ক্রোধে অপমানে টকটকে লাল ফর্সা মুখখানা। ঘরে উপস্থিত বাকি বাবু আর সাহেবদের অবস্থাও তথৈবচ। হাসি চাপার জন্যে মাথা নিচু করলেন খোদাবক্স। সত্যি, একটা মানুষ বটে ব্লাকুয়ার সায়েব। বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন জনের কাছে শুনেছেন নিজের সহকর্মীরা তো বটেই ঊর্ধ্বতন আধিকারিক এমনকি প্রয়োজনে বড়লাটকেও সত্যি কথাটা স্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না মানুষটা। আজ নিজের চোখে দেখলেন সেটা খোদাবক্স। কিন্তু অসামান্য কর্মদক্ষতার জন্য বড়কর্তারাও চটাতে সাহস করেন না ব্লাকুয়ারকে। ভেবে আশ্চর্য লাগে, যে মানুষটা নিজে মনে করেন এ ধরনের কাজগুলো অন্যায় অথচ তাকেই রক্ষা করতে পদক্ষেপ গ্রহণে দেরি করেন না একমুহূর্ত। মাথা নিচু করে ভাবছিলেন খোদাবক্স।

চুরি ডাকাতি করার জন্য এরা মানুষের ঘরে হামলা করে, খুনখারাপি করে। কিন্তু খাজনার টাকা আদায়ের জন্য প্রজার গলায় পা দেয় না। ঘরের মেয়ে বউ তুলে নিয়ে যায় না, ইন্ডিগো প্লান্টেশনের নামে একর একর ফারটাইল প্যাডিফিল্ড জ্বালিয়ে দেয় না।

 বলা শেষ করে টেবিলে দুহাত রেখে পাঁচকড়িদের দিকে ঝুঁকে পড়লেন ব্লাকুয়ার। “একটা কথা মনে রাখবে, বিশেকে খুঁজে বের করাটাই শুধু তোমাদের কাজ নয়। আগ বাড়িয়ে গিয়ে হামলা চালাতে হবে ওর ওপর। ও তোমাদের খুঁজে বের করার আগেই মারতে হবে ওকে।চর লাগাও চারদিকে, খোঁজ নাও কোথায়, কোন বাবুদের বাড়িতে ডাকাতির ছক আঁটছে ওরা। ভয় নেই, বাবুদের লোকজন তো থাকবেই, তা ছাড়াও হিজ হাইনেস গভর্নর সাহেবকে বলে ক্যালকুটা থেকে তোমাদের জন্য স্পেশাল এক কোম্পানি ফৌজ আনছি আমি। প্রয়োজন মতো তারা গিয়ে দাঁড়াবে তোমাদের পাশে। তোমরা খবর দিলেই।”

“জো হুকুম হুজুর।” হাতজোড় করে সমস্বরে সায় দিল পাঁচকড়ি, হীরা, লাটনারা। “গুড” বলে খোদাবক্সের দিকে এগিয়ে গেলেন ব্লাকুয়ার। “খুডাবক্স” “ইয়েস স্যর”  চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খাড়া স্যালুট ঠুকলেন খোদাবক্স। চোখের ইশারা করলেন ব্লাকুয়ার। সঙ্গে সঙ্গে উর্দির বিশাল চারটে প্যাচপকেটের নীচের একটা খাপ থেকে দড়ি বাঁধা মোটা একটা কাপড়ের বটুয়া বের করে লাটনাদের দিকে এগিয়ে গেলেন খোদাবক্স। “হাজার তনখা রয়েছে এতে। দরকারে আরও পাবে। কিন্তু হুজুরের কথামত কাজ করে দেখাতে হবে। খুব জলদি ভালো কোনও খবর চাই আমরা। ঠিক আছে? যাও এবার।” সেলাম ঠুকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল পাঁচকড়িরা। ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসলেন ব্লাকুয়ার। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কথাবার্তায়।

আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ১৩)

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

  1. প্রস্তুতি শুরু করেছো কমরেড যুদ্ধের , তবে বাস্তব অভিজ্ঞান কে স্বীকৃতি দিয়েছো দেখে আস্বস্ত হলাম “শত্রু কে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ মৃত্যু” – বিশে রাজার ওই একটা চাল ভুল হয়ে গিয়েছিলো , দারুন অবতারণা করেছো রক্তে যে কিছু পরিমান বৈষ্ণব ফোঁটা ছিল যে , ওটা ভয়ঙ্কর , কেজো কে অকেজো বানিয়ে রাজা বা ব্রাহ্মণ অমাত্য দের সব অধিকারের অছিদার করে দেয় , সেই গীতা থেকে অদ্যাবধি। খেটে খাওয়া মাথা উঁচু করা মানুষ কে কিছুতেই সোজা দাঁড়াতে দিলো না ওই দর্শন। বিশে দাম দিয়ে বুঝতে চলেছে ,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *