পুজো সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলো মনোহর সর্দার। কালীঘাটের কাছে নিজের ডেরা থেকে কিছুটা দূরেই জঙ্গলঘেরা বিশাল এক সরোবর। দৈর্ঘ্যে প্রায় মাইল দেড়েক তো হবেই। সরোবরের গায়েই খানিকটা জমি সাফসুতরো করে ছোট এই কালী মন্দিরটি বানিয়েছে মনোহর। ইতিমধ্যেই মন্দিরের নাম ছড়িয়েছে আশপাশে। কালীঘাট দর্শনে এলে এই মন্দিরটিও দর্শন করে যায় অনেকে। লোকে বলে মনোহর ডাকাতের কালীমন্দির বা ডাকাতে কালী। প্রতিবার কাজে বেরনোর আগে-পরে এই মন্দিরে পুজো দিয়ে যায় ও। কাজের আগে ছাগবলি আর কাজ উতরে গেলে লুট করা সম্পদের মধ্যে বাছাই করে সেরা স্বর্ণালঙ্কারটি প্রণামী চড়ানো হয় দেবীমূর্তির পায়ে। কাঁকুলের ভট্টাচার্য পরিবারের এক সদব্রাহ্মণকে দক্ষিণা আর মাসোহারার ব্যবস্থা করে পুরোহিত হিসেবে বহাল করা হয়েছে। দু’বেলা নিয়মিত এসে পুজো সেরে যান পুরুতমশাই।
***
ধীরপায়ে মন্দিরের চাতালে এসে বসল মনোহর সর্দার। এ বছর জাঁকিয়ে পড়েছে ঠান্ডাটা। ঘন ধোঁয়াটে কুয়াশা চাদরের মত লেপটে রয়েছে চারপাশে। তুষের আলোয়ানটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল মনোহর। সন্ধে নেমেছে অনেকক্ষণ। পুজো সেরে বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধ ভটচায মশাই। হাসলেন মনোহরের দিকে তাকিয়ে।
— কী বাবা, ফিরবে না?
উদাস চোখে পুরুতমশাইয়ের দিকে তাকাল মনোহর।
— এই যাব, আপনি এগোন। বলে ঘুরে তাকাল সামনে।
দেউলের নিচে দাঁড়ানো দুই বিশ্বস্ত সাগরেদ। বলরাম আর সৃষ্টিধর। দু’জনের হাতেই দশ ইঞ্চি ফলার পাটা বল্লম। ঠিকঠাক তাক করে মারতে পারলে বাঘের চোয়াল এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া যায়।
— পুরুতমশাইকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয় তোরা। কদিন হল বড়শেয়ালের (বাঘ) অত্যেচার খুব বেড়েছে কাঁকুলের দিকটায়। সৃষ্টিধরকে বলল মনোহর।
— ঠিক আছে সর্দার।
ঠাকুরমশাইকে নিয়ে চলে গেল দু’জন। একা একা চাতালে বসে রইল মনোহর। এটা সেটা ভাবনার আনাগোনা মনের মধ্যে। দু’দিন আগে বোড়ালের কুঠেল বড়লোক এক বেনের বাড়িতে গিয়েছিল ডাকাতি করতে। সিন্দুকভর্তি টাকা আর সোনাদানা। আয়পয় ভালোই হয়েছে। গয়নাগাঁটির মধ্যে থেকে বেছে বেছে ভরি দশেকের একটা বিছেহার মায়ের পায়ে প্রণামী চড়ানো হয়েছে আজ। শুদ্ধিস্বস্তয়ন করে দেবীমূর্তির গলায় পরিয়ে দিলেন পুরুতমশাই। এটাই রীতি এই পেশায়।
আচ্ছা, এ জীবনে কত নম্বর ডাকাতি হল এটা? ভাবতেই নিজের মনে ফিক করে হেসে ফেলল মনোহর। সেই বারো বছর বয়সে বাপ কালী সর্দারের কাছে ডাকাতির হাতেখড়ি। লোটো আর নিজের জেব ভর। এটাই ছিল জীবনের সারকথা। তারপর একদিন জীবনে বিশে এল। মনোহরের চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু কী তেজ আর দাপট! ওরকম একটা লোকের বশ স্বীকার করেও আনন্দ। মনোহরের জীবনটাই পাল্টে দিয়েছিল বিশে। বলেছিল, ডাকাতির অর্থ শুধু একা একা স্বার্থপরের মত ভোগ করতে নেই সর্দার। যা লুটছ তার অনেকটা নির্ধন, অসহায়, আতুরের মধ্যে বাঁটো। এ মহাপুণ্যির কাজ। দরিদ্রনারায়ণের সেবা করলে মহামায়া তুষ্ট হয়ে আশীর্বাদ করবেন তোমাকে। যে গরিবদের দান করবে, তারাই বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে তোমার সামনে। জমিদার আর কোম্পানির ফৌজ, পাইক বরকন্দাজ…যত ফন্দিফিকির আর দাঁওপ্যাঁচের খবর ওরাই আগাম পৌঁছে দেবে তোমার কাছে। দলের গায়ে আঁচটুকুও লাগবে না।
ঠাকুরমশাইকে নিয়ে চলে গেল দু’জন। একা একা চাতালে বসে রইল মনোহর। এটা সেটা ভাবনার আনাগোনা মনের মধ্যে। দু’দিন আগে বোড়ালের কুঠেল বড়লোক এক বেনের বাড়িতে গিয়েছিল ডাকাতি করতে। সিন্দুকভর্তি টাকা আর সোনাদানা। আয়পয় ভালোই হয়েছে। গয়নাগাঁটির মধ্যে থেকে বেছে বেছে ভরি দশেকের একটা বিছেহার মায়ের পায়ে প্রণামী চড়ানো হয়েছে আজ। শুদ্ধিস্বস্তয়ন করে দেবীমূর্তির গলায় পরিয়ে দিলেন পুরুতমশাই। এটাই রীতি এই পেশায়।
কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। কালেদিনে সেটা মিলিয়ে দেখেছে মনোহর। সম্ভাব্য বিপদের কত খবর যে আগেভাগেই গরিব মানুষের কাছ থেকে জেনে গিয়েছে মনোহর, তার আর লেখাজোখা নেই। ওকে বিপদতারণ বলে মানে ওরা। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও ডাকাতি, খুনখারাপি… এসব আর ভালো লাগছে না মনোহরের। এরকমটা হওয়ার শুরু আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে।
বারুইপুরের এক জমিদার বাড়িতে ডাকাতি সেরে ফিরছিল মনোহর। ফেরার পথে ডেরার কাছে ঝোপের ধারে কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দ কানে এল। কাছে যেতে চোখে পড়ল এক যুবতীর মৃতদেহ। পা থেকে অর্ধেকটার বেশি বাঘে খেয়ে ফেলেছে। মৃতদেহের বুকের কাছে হাত পা নেড়ে খেলা করছে মাস ছয়েকের একটি শিশু। গভীর জঙ্গলে হঠাৎ এই যুবতীটি একা এসেছিলই বা কেন! এই শিশুটি নিশ্চয়ই এই যুবতীর সন্তান। মাকে বাঘে খেলেও শিশুটিকে খায়নি কেন? ভেবে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল মনোহর। তারপর কী ভেবে কোলে তুলে নিয়েছিল বাচ্চাটাকে।
বিয়ে থা করেনি মনোহর। ঘরে দূরসম্পর্কের এক থুরথুরে বুড়ি পিসি ছাড়া তিনকুলে কেউ নেই ওর। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল মনোহর। পায়ের আওয়াজে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল পিসি। অবাক হয়ে গেছিল মনোহরের কোলে বাচ্চাটাকে দেখে।
— হ্যাঁ রে মনা, এটাকে আবার আনলি কোত্থেকে? কোথাও থেকে ডাকাতি করিসনি তো? কালীর দিব্যি গেলে বল বাপ। চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করেছিল পিসি।
— আরে না না, পথে কুড়িয়ে পেয়েছি। একগাল হেসে জবাব দিল মনোহর।
— আচ্ছা পিসি, এটাকে পাললে কেমন হয়? প্রশ্ন করেছিল পরমুহূর্তেই একটু দ্বিধাগ্রস্থ গলায়।
— বলিস কী রে! চোখ কপালে উঠেছিল পিসির।
— জেবনে তো বে শাদি করলি নে। রাঁড়ও পুষলিনে এক আধটা। এখন বলছিস বাচ্চা পালবি? আর পাললেই তো শুধু হল না। একে নাওয়ানো খাওয়ানো দেখভাল… সেসব করবে কে শুনি? তোর মরা মা এসে? আমার বলে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেচে… এসব হ্যাপা কে সামলাবে? আমার হয়েছে যত জ্বালা।
মুখে এসব বললেও মনে মনে কিন্তু খুশিই হয়েছিল বুড়ি। মনোহর বেশ বুঝতে পারছিল সেটা।
— দে দে। আর সোহাগ দেখাতে হবে না।
ঝটকা মেরে মনোহরের কোল থেকে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল পিসি।
***
পরদিন রাতে বাচ্চা কোলে পিসিকে পালকিতে চড়িয়ে কালীঘাট নিয়ে গিয়েছিল মনোহর। শিশুর মঙ্গল কামনায় কালীঘাটে পুজো দিয়েছিল পিসি। একশো আটটা জবাফুলের মালা পরিয়েছিল মা কালীর গলায়। বুক চিরে রক্ত দিয়েছিল মনোহর। করজোড়ে প্রার্থনা জানিয়েছিল মুণ্ডমালিনীর সামনে। তারপর সদলবলে রণপা দাপিয়ে রওনা দিয়েছিল চৌরঙ্গীর জঙ্গলের দিকে। পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে বসেছিলেন চৌরঙ্গিবাবা। পায়ের সামনে নামিয়ে রেখেছিল বাচ্চাটাকে।
— আশীর্বাদ কর ভৈরব বাবা। এর একটা নাম ঠিক করে দাও দয়া করে।
হেসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন জঙ্গলগিরি। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছিলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর বেদিতে নামিয়ে রেখে হা হা করে হেসে উঠেছিলেন জঙ্গল কাঁপিয়ে।
— আপনা মা কো খোকে তেরে পাস আয়া হ্যায় ইয়ে বাচ্চা। তু এর নাম রখ হারাধন। খুব খেয়াল রাখবি ওর। পড়ালিখা শিখাবি। একদিন তেরা নাম রওশান করেগা তেরা বেটা।
শিহরিত হয়েছিল মনোহর। বাবা বলছেন এ বাচ্চাটা তারই ছেলে।
— তুমি বলছ যখন, তাই হবে বাবা।
কোলে তুলে নিয়ে হারাধনকে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল মনোহর। সেই থেকে মনোহরের ডেরায় রয়ে গেছে হারাধন। আদরের ডাকনাম হারু। পিসির চোখের মণি সে। ঠাম্মা বলে ডাকে বুড়িকে। একটু একটু করে মনোহরকে কেমন যাদু করে ফেলেছে ছেলেটা এই চার পাঁচ বছরে। সাতজায়গা খুঁজে নতুন জামাকাপড়, খেলনাপাতি নিয়ে আসে ছেলের জন্য। ‘বাবা বাবা’ বলে যখন দু’হাত মেলে ছুটে আসে, তখন ভেতরে ভেতরে একটা অজানা ত্রাসে কেঁপে ওঠে মনোহর।
— ওরে আমার আর ক’দিন! কোম্পানির পেয়াদাদের হাতে গুলি খেয়ে মরব নয় তো কেল্লার মাঠে নিয়ে ফাঁসিতে লটকে দেবে।
পিসির কথাগুলো বুড়িগঙ্গার চোরাদহের মত ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে মনের মধ্যে।
পরদিন রাতে বাচ্চা কোলে পিসিকে পালকিতে চড়িয়ে কালীঘাট নিয়ে গিয়েছিল মনোহর। শিশুর মঙ্গল কামনায় কালীঘাটে পুজো দিয়েছিল পিসি। একশো আটটা জবাফুলের মালা পরিয়েছিল মা কালীর গলায়। বুক চিরে রক্ত দিয়েছিল মনোহর। করজোড়ে প্রার্থনা জানিয়েছিল মুণ্ডমালিনীর সামনে। তারপর সদলবলে রণপা দাপিয়ে রওনা দিয়েছিল চৌরঙ্গীর জঙ্গলের দিকে। পঞ্চমুন্ডির আসনের সামনে বসেছিলেন চৌরঙ্গিবাবা। পায়ের সামনে নামিয়ে রেখেছিল বাচ্চাটাকে।
— নাঃ। মন্দিরের চাতাল ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল মনোহর।
অনেক হয়েছে। পদে পদে বিপদের এই পেশা ছেড়ে দেবে ও। হারুটাকে মানুষ করতে হবে। দশজনের একজন বানাতে হবে ওকে। যাতে কেউ না বলতে পারে- “ওই দ্যাখ শালা ডাকাতের ব্যাটা হারু ডাকাত।”
তবে এসব করার আগে একবার কথা বলা দরকার বিশের সঙ্গে। আচ্ছা, এসব শুনে কি খুব রেগে যাবে বিশে? নাকি হাসবে?
— ব্যাটা মনা সর্দার পেশা ছেড়ে শেষমেশ গেরস্ত হতে চাইছ?
সে রেগেই যাক, আর হাসুক। তবু সত্যি কথাটা যে বলতেই হবে ওকে। বিশেকে না জানিয়ে পেশা ছেড়ে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। অধর্ম হবে সেটা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবর পাঠাতে হবে বিশের কাছে। মন্দিরের চাতালে শুইয়ে রাখা লাঠিটা হাতে তুলে নিল মনোহর। তারপর একরাশ ভাবনা মাথায় নিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে রওয়ানা দিল ডেরার দিকে।
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র ১৮
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এই মমত্ববোধ বাংলা সাহিত্যে অন্তজ এবং ব্রাত্য মানুষগুলোকে মেইনস্ট্রিম এর মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করানো তোমায় ওমর করে রাখবে বেরাদর। বাংলায় উঠে আসুক ব্রাত্যজনের রুদ্ধ গর্জন। কুর্নিশ তোমাকে আর সালাম বাংলা লাইভ কে এই ধারাবাহিক টিকে আমাদের উপহার দেবার জন্যে।