ঘরে মুখোমুখি বসা অর্জুন সিংহ আর বিশ্বনাথএকমনে বিশ্বনাথের কথা শুনছিলেন ঠাকুরসাহেব। বলা শেষ হলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন আরামকেদারায়। রেকাবি থেকে একটা পান তুলে মুখে পুরলেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ।
— তোমার সাকরেদরা ঠিক বলেছে বিশ্বনাথ। বোদেকে ছেড়ে দিয়ে তুমি ঠিক কাজ করনি। পাক্কা সাপ কা বাচ্চা হ্যায় উয়ো। থোড়া সা মওকা মিলনে সে হি ফির ঘুমকে ডাঁসেগা হারামি। আমিও বেশ কিছুদিন ধরে ওর নামে এদিক ওদিক থেকে দু’চারটে কথা শুনতে পাচ্ছি। তোমাকে না জানিয়ে আরও অনেক জায়গায় এই একই ধরনের জুলুম করেছে ও। ওকে ওখানেই খতম করে আসা উচিত ছিল তোমার। শালা না রহতা বাঁশ আর না বাজতি বাঁশুরি।
ঠাকুরসাহেবের কথার জবাবে ম্লান হাসল বিশ্বনাথ।

একটা কথা কী জানেন ঠাকুরসাহেব, যে না-মরদ লড়াইয়ের আগেই লড়াই ছেড়ে দেয়, হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায়, কান্নাকাটি করে, মারের পর মার খেয়েও ফুঁসে ওঠে না, রুখে দাঁড়ায় না, তেমন কারওকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে না। আমার সাকরেদরা বলছে আমি ভুল করেছি। আপনিও তাই বলছেন। হয়তো আমারই ভুল। আবার বলতে পারেন এটাই আমার নিয়তি। আর সেটাকে মেনেই চলতে হবে আমার। তাতে যদি বোদের মত ছিঁচকে ছ্যাঁচড়ার ছোবলে মরতে হয় তাই সই। তবে আমাকে জমি ধরানোর কাজটা যে অত সহজ হবে না সেটা আমার মতো আপনিও ভাল করে জানেন। এরপর সবই মা কালীর ইচ্ছে!

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিশ্বনাথকিছুক্ষণ বাদে মুখ খুললেন ঠাকুরসাহেব।
— মথুরাপুর গ্রামের ওই বিনোদ মুখার্জ্জী, লোকটাকে চিনি আমি। ঘরে দুই স্ত্রী, এছাড়াও অসংখ্যবার বিবাহ করেছে। টাকার পিশাচ। ওর মতো নির্লজ্জ চশমখোর শয়তান আশেপাশে বিশ তিরিশ ক্রোশের মধ্যেও আর দু’টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ওরকম একটা জানোয়ারের হাতে পড়ে তোমার মা জননীর কী অবস্থা হবে সেটা ভেবে ভারি দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল ঠাকুর সাহেবকে। সেদিকে তাকিয়ে ফের একবার মৃদু হাসল বিশ্বনাথ।
— ঠাকুরসাহেব ও নিয়ে চিন্তা করবেন না আপনি। আমি নিজে সবকিছু ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলব মুখুজ্জে মশাইকে। আমার কথা শোনার পর তিনি আর কোনওরকম ঝামেলা অশান্তি করার কথা চিন্তাতেও আনবেন বলে আমার মনে হয় না। এছাড়া আপনিও তো কাছেপিঠে রইলেন। মাঝে মাঝে ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে একটু আধটু দর্শন দিয়ে আসবেন, তাতেই কাজ হয়ে যাবে।
বিশ্বনাথের বলার ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন ঠাকুরসাহেব। সে হাসিতে যোগ দিল বিশ্বনাথও। এরই মধ্যে ঘরে ঢুকল বীণা

মেহমানদের খানাপিনার ব্যবস্থা হয়ে গেছে বাবুজি। আপনি ওঁকে নিয়ে নিচে আসুন।
— তুই যা। আমরা আসছি এখুনি। বলে বিশ্বনাথের দিকে ঘুরে তাকালেন অর্জুন সিংহ।
— হঠাৎই মনে পড়ে গেল কথাটা। আজ থেকে মাস ছয়েক আগে কলকত্তা গিয়েছিলাম আমি। কলকত্তাওয়ালীর পূজা চড়াতে। সেখানেই তোমার চেলা মনোহর সর্দারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। চৌরঙ্গীর জঙ্গলে এক সাধুবাবা এসে রয়েছেন। জঙ্গলগিরি মহারাজ। লোকে চৌরঙ্গীবাবা নামে ডাকে ওনাকে। ত্রিকালজ্ঞ সিদ্ধপুরুষ। মনোহরের কাছে শুনলাম উনি নাকি দেখা করতে চেয়েছেন তোমার সঙ্গে। একটিবার যাঁর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য ভক্তরা হা পিত্যেশ করে বসে থাকে, এরকম একজন মহাপুরুষ নিজে ডাকছেন তোমাকে। আমার মন বলছে তোমার ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছেন উনি। তোমার একবার অবশ্যই যাওয়া দরকার কলকাত্তায়।
— আমি জানি ব্যাপারটা।
অর্জুন সিংহের কথার জবাবে মাথা নাড়ল বিশ্বনাথ।

আমি যে জন্মাব সেটা নাকি আমার জন্মের অনেক আগেই জেনে গিয়েছিলেন উনি। মনোহর আমাকে বলেছে সে কথা। আগেও বেশ কয়েকবার কলকত্তা গিয়েছি। কিন্তু নানা কারণে বাবার সঙ্গে আর দেখা করাটা হয়ে ওঠেনি। এবার আপনি যখন বলছেন তখন খুব তাড়াতাড়ি একবার যাব ওঁর দর্শন করতে। সঙ্গে কলকাত্তাওয়ালীর পুজোটাও দেওয়া হয়ে যাবে।

— খুব ভালো কথা। উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ঠাকুরসাহেবের মুখখানা।
— এবার চল গিয়ে দেখি আমার বেটি তার মেহমানদের জন্য খানাপিনার কী বন্দোবস্ত করেছে।
“চলুন” বলে কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিশ্বনাথ।

***

‘কঁক কোঁকর কোঁ ওওও’– দূরে মোরগ ডেকে উঠলো শেখপাড়ার দিকে। রাত্রির শেষ প্রহর। ঊষার আলো ফোটেনি এখনও। হাল্কা ফিকে রং ধরতে শুরু করেছে পুব আকাশে সবে।
বিছানায় শোওয়া অচৈতন্য রোগীর নাড়ি ধরে বসে রয়েছেন নিশিকান্ত চক্রবর্তী। বিখ্যাত কবিরাজ। গোটা নদে জেলার মানুষ ধন্বন্তরি নামে ডাকে চক্রবর্তী মশাইকে। গাঁয়ে গাঁয়ে প্রবাদ আছে, দোরে যমদূত এসে দাঁড়ালে তাকে দু’টি মুড়ি বাতাসা দিয়ে বসিয়ে রেখে শান্তিপুরের নিশি কবরেজকে ডেকে নিয়ে এস। যমদূত উঠে পালাতে পথ পাবে না।
চোখ কুঁচকে রোগীকে ফের একবার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন কবরেজমশাই। ক্ষীণ নাড়ির গতি একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রোগীর সারা শরীরে চটচটে ধরনের ভেষজ গুল্মর প্রলেপ। এখনও সম্পূর্ণ অচৈতন্য। হাতটা ছেড়ে দিয়ে রোগীর পাশ থেকে উঠে এলেন নিশিকান্ত। পাশে লম্বা তাকে রাখা সার সার মুখবন্ধ মাটির পাত্র। তার মধ্যে একটার ঢাকনা খুলে কালচে তেল জাতীয় একটা কিছু ঢেলে নিলেন হাতে। বীভৎস দুর্গন্ধ। ফিরে এসে সেই তেল ভাল করে ডলে ডলে মাখিয়ে দিলেন রোগীর হাতের তালু আর দু’পায়ের পাতায়। তারপরে ধবধবে সাদা কাপড়ে হাতটা ভাল করে মুছে নিলেন। সামনে তেপায়ার ওপর রাখা খলনুড়ি। পাশে শালপাতার মোড়কে মোড়া কিছু শেকড়বাকড় আর মধুর পাত্র। সবকিছু ভাল করে খল নুড়িতে মেড়ে ঠোঁট ফাঁক করে ঢেলে দিলেন রোগীর মুখে।
ঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত একাধিক দেবদেবীর ছবি। সেদিকে তাকিয়ে করজোড়ে প্রণাম করে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। দরজার পাশে বসা শম্ভু আর কাশেম। কোবরেজমশাইকে দেখে উঠে দাঁড়ালো শশব্যস্তে।
— কী খবর কবরেজ মশাই! সর্দার আমাদের বাঁচবে তো?
— বাঁচা মরা কি আমার হাতে আছে রে হারামজাদা? দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভেংচে উঠলেন নিশিকান্ত।
— রুগিকে প্রায় মেরে এনে এখন আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, বাঁচবে তো?
কবরেজমশাইয়ের ধমক খেয়ে একদম থেপসে গেল দু’জন। সেদিকে তাকিয়ে একটু নরম হল নিশিকান্তর চোখমুখের চেহারা।

আরে বাবা আগে থেকেই অত চিন্তা করে হেদিয়ে মরছিস কেন? মায়ের আশীর্বাদ থাকলে সাতদিনের বাসিপচা মড়াও বাঁচাতে পারে এই নিশি কবরেজ। কম তো দেখলাম না এ জীবনে। শুধু তো গেরস্থ ভদ্রলোকই নয়। তোদের মত চোরডাকাতরাও আসে আমার কাছে। গুলির চোট, তলোয়ারের কোপ, লাঠির ঘা, বল্লমের ফোঁড়, সড়কির পোঁচ…কতরকমের আঘাত ব্যঘাতের চিকিচ্ছে করেছি। কিন্তু বাপু এ চিকিচ্ছেয় খরচা আছে যে!

দু’জনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন নিশি কবরেজ।
— ধর এখন থেকে কম করে দু’হপ্তা রোগীকে আমার এখানে রাখতে হবে। তার ওষুধপথ্যি, দেখভাল, খাইখরচা… তার ওপর যদি কোতোয়ালি একবার খবর পায় তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। সব মিলিয়ে তা প্রায়…
কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজের আঙুল থেকে সোনার আংটিটা খুলে নিয়ে নিশিকান্তর হাতে গুঁজে দিলো শম্ভু।
— টাকাকড়ি নিয়ে চিন্তা করবেন না কবরেজমশাই। সর্দারের চিকিচ্ছের জন্য যা যা দরকার করুন। যা চাইবেন তাই পাবেন।
শোনামাত্র বিদ্যুতের মতো ঝিলিক খেলে গেল কবরেজমশাইয়ের চোখে।
— বাঃ বাঃ, এই তো জ্ঞানীগুণীর মতো কথা। আমি তো এর মধ্যেই আমার কাজ শুরু করে দিয়েছি। চিন্তা করিস না। তোদের সর্দার বেঁচে যাবে।
দু’আঙুলে আংটিটা পরখ করতে করতে ঘরে ঢুকে গেলেন নিশি কবরেজ।

রাস্তায় বেরিয়েই শম্ভুকে চেপে ধরল কাশেম।
— তোর বুদ্ধির বলিহারি যাই মাইরি, কোন আক্কেলে ওই শালা বোদের পেছনে এত খরচাপাতি করলি। তার চেয়ে এ কদিন ওর দলে থেকে যা কামিয়েছি তাতে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে ছোটখাটো কোনও কারবার ফাঁদতে পারতাম আরামসে

ঠোঁটে তীব্র একটা ব্যঙ্গের হাসি নিয়ে কাশেমের দিকে তাকাল শম্ভু।

এতদিন ভাবতাম তোর মাথায় গোবর পোরা। এখন দেখছি গোবর শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে। আরে পেত্নির ব্যাটা কারিয়া পিরেত, ওর নাম বোদে গয়লা। একসময় ডানহাত ছিল বিশের। বিশের চালচলন, দলবল, লুকোনো আড্ডা… সব খবর বোদের ধুতির গেঁজে। এখন দল থেকে হঠাবাহার হয়ে গেলেও অন্য জহুরীদের কাছে ওর দাম লাখ টাকা। আমার মন বলছে ওরা হন্যে হয়ে বোদেকে খুঁজছেআমাদের কাজ হবে শুধু ওদেরকে খুঁজে বের করা। তাহলেই কিস্তিমাত। বোদের পেছনে যা খরচা করছি তার দশগুণ যদি না উশুল করে নিতে পেরেছি তাহলে গাদামারার হাটে আমার নামে ধম্মের ষাঁড় পালিস তুইযাকগে, অনেক এতরব্যতর কথাবাত্তা হল। নে এবার পা চালা তাড়াতাড়ি। পেটে আগুন পাক মারছে। দেখি সামনে কোনও ময়রার দোকান পাওয়া যায় কিনা।

মেঠো রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল দু’জন।

আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ১৫)

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *