গড়ের দোতলায় নিজের ছোট ঘরখানায় আরামকেদারায় শুয়েছিলেন ঠাকুর অর্জুন সিংহ। বয়স ষাটের কোঠায়। এই বয়সেও টানটান ঋজু নির্মেদ শরীর। পাকা মর্তমান কলার মত গাত্রবর্ণ। নিরাভরণ ঊর্ধ্বাঙ্গ জুরে শ্বেতশুভ্র ঘন রোমরাজি। মাথার চুলও সব পেকে ধবধবে সাদা। নাকের নিচে মোটা একজোড়া পাকানো গালপাট্টা মোচ। নিম্নাঙ্গে সরু পাড়ের সাধারণ একটা শান্তিপুরি ধুতি। একটা হাত ভাঁজ করে রাখা মাথার পিছনে। আরামকেদারার পাশে রাখা মোরাদাবাদি রুপোর মিনেকাজ করা সুদৃশ্য একটা গড়গড়া। পাশে ছোট রেকাবিতে রাখা দু’তিনটে মঘাই পান। থেকে থেকে আলবোলায় মৃদু মৃদু টান দিচ্ছেন ঠাকুরসাহেব। জর্দা আর অম্বুরি তামাকের গন্ধে ম ম করছে ছোট ঘরখানা। একটু আগে রাতের খাবার শেষ করেছেন। বরাবরই মিতাহারী তিনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও কমেছে পরিমাণটা। সামান্য খাঁটি ঘি মাখানো পাতলা দু’তিনটে চাপাটি, যে কোনও একটা সবজি আর শেষপাতে একবাটি বাতাসা দেওয়া দুধ। এটা রাতের আহার ঠাকুর সাহেবের।
আরামকেদারার মাথার কাছে একটা ছোট চারপাইয়ে বসে বীণা। একমাত্র কন্যা। বালবিধবা। নীরবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাবার কপালে। প্রতিদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর পান আর তামাকের সঙ্গে এটাও একটা নেশার মত ঠাকুরসাহেবের কাছে। বেটি মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে ঘুম আসতে চায় না কিছুতেই। চোখবুজে একমনে নিজের ভাগ্যের কথাই ভাবছিলেন অর্জুন। কিসমৎ অজব চিজ! পর পর দু’টি মৃত পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ঠাকুরসাহেবের স্ত্রী যশোদা। তৃতীয়বার প্রসব করতে গিয়ে নিজে বাঁচলেন না কিন্তু সদ্যোজাত সন্তান বেঁচে গেল। একলওতি বেটি। সিরফ একহি জ্বলতা হুয়া দিয়া পরিবারকা। স্ত্রী বিয়োগের শোক ভুলে মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরলেন। বারো বছর বয়সে মেরঠের খানদানি গর্গ পরিবারে শাদি দিলেন মেয়ের। লেকিন ওহি শালি ফুটি কিসমৎ! গুটিবসন্তের মড়ক লাগল গাঁয়ে। বেচারা দামাদ সমেত প্রায় পুরো খানদান সাফা হয়ে গেল। লেকিন কিসমতের কপালে কিল ঠুকে ফের একবার বেঁচে গেল বেটি।
ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই নিজে গিয়ে মেরঠ থেকে নিয়ে এসেছিলেন মেয়েকে। আর তারপর থেকেই ফৌজদারির কাজকর্মে ধীরে ধীরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে থাকেন ঠাকুরসাহেব। শেষে একদিন সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন এই পরিহারে। ফৌজদারির কাজে যা টাকাপয়সা রোজগার করেছিলেন, তাই দিয়ে কিছু জমিজমা কিনে বিঘে দশেক জুড়ে এই গড় বানালেন। বাকিটায় চাষ আবাদ হয়। মুনিশ-রায়ত খাটিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খেতিবাড়ি তদারক করেন অর্জুন। গড়ে কাজের লোক বলতে দু’তিনজন নৌকর আর জনাছয়েক রাজপুত দেহরক্ষী। সেই ফৌজদারির সময় থেকেই সঙ্গে রয়েছে ওরা। কাজ ছেড়ে আসার সময় অনেক অনুরোধ করেছিলেন জমিদারবাবুরা। থেকে যেতে বলেছিলেন বারবার করে। অর্জুনের মত ফৌজদার গোঁটা বাংলা ঢুঁড়েও আর দ্বিতীয়টি মিলবে না, এটা ভালো ভাবেই জানতেন তাঁরা। কিন্তু শোনেননি অর্জুন। অর্থ প্রচুর উপার্জন করেছেন জীবনে। কিন্তু যাদের জন্য উপার্জন, তারাই যদি না রইল তাহলে সেই উপার্জনে লাভ কি? হাতে একমাত্র শিউরাত্রি কা দিয়া বীণা। জ্বালিয়ে রাখতে হবে দিয়াটাকে। দেখতে দেখতে পঁচিশে পা দিলো বীণা। নিজের মৃত্যুর পর মেয়ের কি হবে ভাবতে ভাবতে বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে ঠাকুরসাহেবের…
এইসময় দরজায় ঠুকঠুক আওয়াজ। “মালিক!”
ঘরে ঢুকল দুই দেহরক্ষী কানহাইয়া আর শিউলাল।
— জঙ্গলের দিক থেকে রণপার শব্দ শোনা যাচ্ছে অনেকগুলো… মশালের আলোও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা।
শোনামাত্র এক ঝটকায় আরামকেদারায় উঠে বসলেন অর্জুন সিংহ।
— চার জনকে এখনই বল দরজায় সামনে গিয়ে তৈয়ার থাকতে। মেরা হুকুম বিনা কোই দরওয়াজা নেহি খুলেগা। আর তোরা দু’জন থাকবি আমার সঙ্গে। সমঝা?
আরামকেদারা ছেড়ে উঠে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো দোনলা বন্দুকটা নামিয়ে নিলেন ঠাকুরসাহেব। তারপর ঘুরে তাকালেন বীণার দিকে।
— তুই শান্তি নৌকরানিকে নিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাক। আর আমি না বলা পর্যন্ত দরজা খুলবি না। সমঝি?
মুচকি হাসল বীণা। তলোয়ারের মত ঝকঝক করছে চোখ দু’টো।
— বাবুজি, আমি রাজপুতের বেটি। বাপ বিপদে পড়বেন আর বেটি দরোয়াজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকবে এ কখনও হয় নাকি? আমার জন্য চিন্তা করবেন না একদম। আমি আসছি এখনই।
বলেই ঠাকুরসাহেবের সামনে থেকে সরে এলো বীণা। ঠাকুরসাহেবের পাশের ঘরটাই ওর। পালঙ্কের গদির তলায় রাখা দোফলা বাঁকানো খঞ্জর। খাপ থেকে খুলে আঙুলের ডগায় ধারটা পরখ করে নিলো একবার। তারপর দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
গড়ের অলিন্দে দাঁড়ানো ঠাকুর অর্জুন সিংহ। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন সামনে। উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের নিশানা দূরে জঙ্গলের দিকে। খট খট অনেকগুলো রণপার শব্দ, এগিয়ে আসছে এদিকেই। মশালের আলোগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে। পাশে দাঁড়ানো কানহাইয়া আর শিউলাল। দু’জনের হাতে উদ্যত শুলুপি (বর্শা)। ঠাকুর সাহেবের ঠিক পিছনেই বীণা। গাছকোমর দিয়ে পেঁচিয়ে পড়া শাড়ি। হাত কোমরে গোঁজা খঞ্জরের বাঁটে। গড় ঘিরে রাখা সুউচ্চ প্রাচীরের গায়ে বিশাল সিংদরজা। দরজার দু’পাশে দেয়ালে পিঠ মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভোলা আর তানিকলাল। বুকে বাঁধা বর্ম। বাঁ হাতে ঢাল আর ডানহাতে খোলা তলোয়ার।
— ছাদে ওরা তৈরি আছে তো? চাপাগলায় কানহাইয়াকে জিজ্ঞেস করলেন অর্জুন।
— আপ সোচিয়ে মৎ মালিক। একশো গজ পাল্লার তীরধনুক নিয়ে একদম তৈয়ার আছে দু’জন। দরজায় আঙুল ঠেকানোর আগে ফুঁড়ে ফেলবে। দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিলো কানহাইয়া।
— আমি হুকুম না দেয়ার আগে কেউ যেন হাতিয়ার না চালায়! কাঁধে বন্দুকের বাঁটটাকে সজোরে ঠেসে ধরলেন অর্জুন সিংহ।
এগিয়ে আসছে দলটা। সংখ্যায় অন্তত বিশ পঁচিশজন। সশস্ত্র প্রায় প্রত্যেকে। মশালের আলো পিছলে যাচ্ছে তেলমাখানো শরীরগুলোয়। দলের মাঝখানে একটা ছোট পালকি। বয়ে নিয়ে আসছে দু’জন বেহারা। দেখতে দেখতে গড়ের প্রাচীরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দলটা। দলের একদম সামনে দাঁড়ানো দলপতি। সুঠাম পেটা চেহারা। মুখটা ঠিকমত ঠাহর হচ্ছে না আলো আঁধারিতে। রণপায় দাঁড়িয়েই নমস্কার করল মাথা নিচু করে- “প্রণাম ঠাকুরসাহেব। অধমের নাম বিশ্বনাথ!” নামটা শোনামাত্র তীব্র খুশি আর বিস্ময়ের যুগপৎ একটা হিল্লোল খেলে গেল ঠাকুরসাহেবের সারা শরীরে।
— এই, দরোয়াজা খোল! মেরা ছোটাভাই আয়া হ্যায়।
দরজার পাশে দাঁড়ানো প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে হেঁকে উঠলেন অর্জুন সিংহ।
হুকুম পাওয়ামাত্র ছুটে গিয়ে দরজার খিল নামিয়ে দিল ভোলা আর তানিকলাল। ঘড়ঘড় শব্দ তুলে খুলে গেল সিংদরজা। দলবল নিয়ে দেউড়ির মধ্যে এসে দাঁড়াল বিশ্বনাথ। ততক্ষণে ছুটে নিচে নেমে এসেছেন ঠাকুরসাহেব। পাশে বীণা। সামনে এগিয়ে এলো বিশ্বনাথ।
— আরে বাপরে। কী সৌভাগ্য আমার! রাজা বিশ্বনাথ স্বয়ং আমার দরজায়! বল কী সেবা করতে পারি তোমার জন্য।
— বড় আতান্তরে পরে এত রাতে আপনার কাছে ছুটে এসেছি ঠাকুরসাহেব। এক মা জননী রয়েছেন আমার সঙ্গে। ব্রাহ্মণকন্যা। মথুরাপুর গাঁয়ে শ্বশুরবাড়ি। পথে একটু বিপদ হয়েছিল ওঁর। আমি গিয়ে উদ্ধার করি। আমার সাকরেদরা বলছে এত রাতে ভদ্রঘরের মেয়েকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক উচিত কাজ হবে না। তাই…।
বিশ্বনাথের কথা শেষ হবার আগেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন অর্জুন সিংহ।
— আরে, এত ছোটামোটা তুচ্ছ একটা ব্যাপারে তুমি আমার সামনে হাত জোড় করে অনুমতি চাইছ। ইয়ে তুমহারা ভি ঘর হ্যায়। আজ রাত কেন, পুরি জিন্দেগি এখানে থেকে যেতে পারও তুমি। বলতে বলতে বীণার দিকে ঘুরে তাকালেন ঠাকুরসাহেব।
— বেটি তুই তোর ঘরে মা-জননীর থাকার বন্দবস্ত কর আর নৌকরচাকরদের বল খানা বানাতে… মেহমানলোগোকা খাতিরদারি কম নেহি হোনা চাহিয়ে।
— ও নিয়ে আপনি বিলকুল চিন্তা করবেন না বাবুজি। বলে পালকি দিকে এগিয়ে গেল বীণা। নিজে হাত ধরে পালকি থেকে নামিয়ে আনল বিজয়াকে।
— এস বহিন, কোনও ডর নেই। এখন থেকে এটা তোমার নিজের ঘর মনে করবে। বলে বিজয়ার কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে গেল উপরে।
— যাক! সব বন্দোবস্ত একদম পাক্কা! একটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন ঠাকুরসাহেব।
— এবার তোমার হালচাল শোনাও। বলতে বলতে বিশ্বনাথের হাত ধরে উঠতে শুরু করলেন দোতলার সিঁড়ি ভেঙে।
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ১৪)
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
উফফ! এ কি ডাইমেনশন আনলে কমরেড! তুমি তো ছিলে দলিত সাহিত্যকার , এখন তো শ্রেণীর সাহিত্য বানাচ্ছ – বাগি দের শ্রেণী !!!!!! সাবভার্সন থেকে মানুষের নিজস্ব assertion . এবার তোমায় আজানুলম্বিত কুর্নিশ করতে আমি বাধ্য !
Ei rokom amrito eto Kom kore dile chele bolun..aro khide varea dichchen..ektu beshi kore likhun na baba..saradin dhore porbo..amar Pronam o valobasa neben..valo thakben sabsomay 🙏🙏🙏🙏🙏😁😁