নীল ষষ্ঠিতে বেলের পানা বা বেলের শরবত—এ বাদে তো শরবত মানে নুন-চিনি আর লেবু দেওয়া মিঠে তরল। সেই শরবত প্রাণের শান্তি, মনের আরাম। ঠাঠা রোদে জ্বলেপুড়ে কেউ বাড়ি ঢুকলে কুঁজো বা মাটির কলসির জলে তৈরি এই শরবত কত জনের যে প্রাণ বাঁচিয়েছে সে কথা ইতিহাস মনে রাখবে না। তবে হ্যাঁ, ফ্রিজবিহীন বাড়িতে চৈত্র মাসের নীল ষষ্ঠিতে বেলের শরবতে তরিবত করে বরফ মেশানোর কথা যুগ যুগ মনে থাকবে অনেক বাঙালি বাড়ির। অন্তত আমরা যারা টেলিফোন-টেলিভিশন ও ফ্রিজ ছাড়া জীবনের বেশ কিছু বছর কাটিয়েছি। সে কী জমজমাট ব্যাপার। বেলের শরবতে দই দিয়ে, চিনি দিয়ে, জল দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে শরবত রেডি হয়ে থাকত দুপুর থেকেই। কিন্তু অপেক্ষা বরফের জন্য। বাড়ির অল্প দূরেই ছিল বরফ কল। দাদা যেত বরফ কল থেকে বরফ আনতে। আর হতভাগারা দুপুর বেলাতেই কারখানা বন্ধ করে রাখত! সুতরাং চারটে অবধি বেলের শরতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেটে যেত। যেই বরফ আসত, তাকে ধুয়ে নেওয়া হত আগে। কারণ সে বরফে চটের থলের রোঁয়া, এ দিক ও দিক অল্প বিস্তর নোংরা যে লেগে থাকত না, তা নয়। মায়ের কড়া হুকুম মেনে ভাল করে বরফ ধুয়ে সেই বরফের চাঁই ভেঙে টুকরো টুকরো করে বেলের শরবতে দেওয়া হত। দেওয়ার পর আর তর সইত না। মায়ের কাছে বায়না, এখনই দাও।
কিন্তু তখনও বরফ গলে শরবতে মিশে কিঞ্চিত ঠান্ডাও হয়নি, তো কী? আমরা ছোটরা ওই শরবতই গ্লাসে গ্লাসে তুলে নিতাম। তার পর অমৃতমাফিক অল্প অল্প চুমুক দিয়ে পান করতাম। সেই শরবত হালকা ঠান্ডা তো পরের চুমুকে হালকা গরম, ফের ঠান্ডা—এই ভাবে শরবত শেষ করে গ্লাসের নীচে পড়ে থাকত কুচো বরফ টুকরো। সেগুলো মুখে পুড়ে বিজয়ীর হাসি হেসে, কড়াম কড়াম খেতাম বিস্বাদ বরফ । এবং মনে রাখতে হবে এই প্রতিটি ধাপই কিন্তু শরবত খাওয়ার অঙ্গ। একটাও বাদ গেলে শরবত-পুরাণ অসম্পূর্ণ।
বাবা মাঝে মাঝে রু-আফজা বলে একটা শরবত নিয়ে আসত। এমনি বাজে খেতে লাগত আমার যে কী বলব! আমাদের কারওরই ওই শরবতের প্রতি নজর ছিল না। লেমন স্কোয়াসও আসত মাঝে মাঝে। সেটি থাকত বাবার জিম্মায়। রোববার রোববার শিকে ছিড়লে পাওয়া যেত। কিন্তু সে বড়ই কম। কারণ, তা বেশির ভাগ সময়ই অতিথি আপ্যায়নের কাজে লেগে যেত। আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে চাইলে ভাগ্যে জুটত নুন-চিনি-লেবুর দ্রবণ। আরও একটা জিনিসের প্রতি মহাআকর্ষণ ছিল আমার। সে হল নিউ মার্কেটের একটি দোকানে থরেবিথরে সাজানো লাল-সবুজ-কমলা-হলুদ রঙের শরবতের বোতলের প্রতি। বিখ্যাত শরবত আর কুলফির জাদুকর। তার দোকানের শরবত বিশ্ববিখ্যাত। লোকে নাকি বিদেশেও নিয়ে যায়। কিন্তু বাইরের জলে তৈরি কোনও পানীয় খাওয়া আমাদের নিষিদ্ধ ছিল। কারণ জল খারাপ। পেট বিদ্রোহ করতে পারে। আমার দোকানের শরবত খাওয়ারই অনুমতি ছিল না কিন্তু শখ ছিল ষোলো আনা। আমি চাইতাম রাস্তায় ছোট্ট গাড়িতে একটা চোঙা মতো জিনিস থেকে শরবতওয়ালার কাচের গ্লাসে জল ঢেলে দিত, কিছু বরফ কুচি আর কিছুটা পুদিনা পাতা ছড়িয়ে দিত তাতে। দশ পয়সা প্রতি গ্লাসের দাম ছিল। কত জন তো দাঁড়িয়ে খেত। কিন্তু আমার একেবারেই অনুমতি ছিল না। সেই জলের পাত্রের চারধারে একটা লাল শালু জড়ানো থাকত। খাঁখাঁ দুপুরে কত সেলসম্যান, কত ট্যাক্সি ড্রাইভার, কত ঝাঁকামুটে, কত রিক্সাওয়ালা, কত ঠিকে কাজের মাসিকে দেখেছি এই শরবত কী আরাম করে খাচ্ছে। সেই দশ পয়সার গ্লাস তখন কালবোশেখির চেয়ে কম কিছু ছিল না। আর এর পর তো রসনা-জীবন। সে কথা বাড়ি বাড়ি সবাই জানে।
তবে হ্যাঁ, শরবতকে জাতে তুলে দিয়েছিলেন মগনলাল মেঘরাজ আর জটায়ু। অমন ঘনঘটাময় শরবতের সিন না থাকলে ফেলুদা খানিক ম্যাড়মেড়ে হয়ে যেত। শরবতও যে একটা দুর্দান্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে এই সিনটিতে, তা বোধগম্য হয় একটু বড় বয়সে। শরবতের প্রতি লালমোহন বাবুর অবিশ্বাস, তাঁর ভয়, তাঁর আতঙ্ক আমাদেরও শঙ্কিত করে তোলে নির্দিষ্ট গ্লাসের শরবতের প্রতি। এবং মগনলালের সেই আতঙ্ককে পরিহাস করার মধ্যে দিয়ে ঘোর অপমান ফুটে ওঠে ফেলুদা ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের প্রতি। এক সময় অতন্ত তাচ্ছিল্য করে মগনলাল বলে, “হালুয়ামোহন বাবু শরবত পসন্দ হল না? ও শরবতে ভিষ নাই! ভিষ খুব বাজে জিনিস বলে আমি মনে করি। ভিষের চেয়ে অন্য জিনিসে কাম দেয় বেশি”। এর পর যখন চাকুর খেলা শুরু হব হব করছে, তখন লালমোহন বাবু, এত ক্ষণ যে শরবতের প্রত সন্দিগ্ধ ছিলেন, সেই শরবত খেয়েই তাঁর আন্দাজ অনুযায়ী “নিশ্চিত মৃত্যুর” দিকে এগিয়ে যান।
এই পুরো সময়টায় মগনলালের ক্যারিশ্মা ছাড়া মধ্যমণি হয়ে ওঠে লালমোহন বাবুর এক গ্লাস শরবত। যে শরবতের গ্লাসটি আজীবন বাঙালির তৃষ্ণার্ত আত্মায় পরম শান্তি এনে দেবে।
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।